মণিকন্ঠ

[শুরুর আগেঃ

অভিষেক চুপচাপ একজন মানুষ, ভিড় এড়িয়ে, কিন্তু প্রতিবাদী। ধর্মবিষয়ক লেখা, মূলত হিন্দুধর্মে এলজিবিটি+ -এর উপস্থিতি নিয়ে বহুদিন পত্রপত্রিকায় লিখে চলেছে। যদিও অন্য কোনকিছু সে লেখেনা তা নয় একদমই। সময় করে বোধহয় নিজের থিসিওটাও লেখে। বহুদিনের একসাথে চলা, কখনো গভীর রাজনৈতিক আলোচনা, তো কখনো চটুল ঠাট্টা। বর্তমানে বঙ্কু পত্রিকার সাথে যুক্ত। কাজের ফাঁকে সময় বের করে কিছু লেখা, তার মধ্যে থেকে নিজেই একটা বেঁছে দিলেন এখানে। বাবুর কম্প্যুটার খারাপ, তাই নতুন কিছু একটা লিখছিলেন, সেটাকে আর পাওয়া গেলোনা বলে মনে একটু দুঃখ রয়েই গেলো। চিন্তা নেই। পরে দিও কখনো, তখন প্রকাশ করা যাবে না হয়। আর শুধু ধর্ম নয়, হিন্দু ধর্মের মধ্যে উচ্চনীচ বিভেধের বিরুদ্ধাচরণ, আর হিন্দু-মুসলিম বন্ধুত্বের যুগোপযোগী রেশ রেখে লেখাটি শেষ করার জন্যে রইলো অনেক অনেক ভালোবাসা।]

মণিকণ্ঠ

অভিষেক বব চক্রবর্ত্তী

।। হরি-হর পর্ব ।।

“চলুন মহাদেব, তাণ্ডবের পরে আপনার একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। আমরা এখন অরণ্য থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে স্বর্গের অভিমুখে যাত্রা করি”।

বাস্তবিকই ভিক্ষতন-রূপী মহাদেব একটু পরিশ্রান্তই হয়ে পড়েছিলেন। নৈমিষারণ্যের তীরবর্তী কিছু ঋষির অহংকার দিন দিন বেড়েই চলেছিল। নিজেদের তারা দেবতার সমতুল্য বলে মনে করতে শুরু করেছিল। তাদের এই অহংকার ভাঙ্গার কারনেই তো মহাদেব কে ভিক্ষতন আর বিষ্ণুদেবকে মোহিনী রূপ ধারণ করতে হল! অপরুপ সুঠাম এক যুবাপুরুষের বেশ ধারন করেছিলেন মহাদেব, উন্নত গ্রীবা, প্রশস্ত স্কন্ধ, প্রশস্ত বক্ষে উন্নত কৃষ্ণবর্ণের বৃন্তযুগল, সরু রোমরাজি নেমে গেছে নাভিগহ্বর পর্যন্ত, সুগভীর সেই নাভিগহ্বর, দুই বলিষ্ঠ উরুর মাঝখানে রয়েছে দীর্ঘ, সুদৃঢ় উন্নত পুরুষাঙ্গ- যা মহাদেবের পরিচায়ক। নিরাবরণ নিরাভরণ হয়ে মহাদেব এসেছেন নৈমিষারণ্যে। সঙ্গে মোহিনী-রূপী বিষ্ণু,তিনি অবশ্য আবরণে-আভরণে ভূষিতা, তবুও উত্তরীয় ভেদ করে পীনপয়োধরযুগল দৃশ্যমান,ভারীনিতম্ব যে কারুরই দৃষ্টি আকর্ষন করতে সক্ষম, তাম্বুলচর্চিত ওষ্ঠে মনবিমোহিনী হাস্য,শরীরের তরঙ্গে লাস্য, অনির্বচনীয় এক মাদকতা।

এ হেন এক যুগলকে দেখে কিছুকালের জন্যে যেন সব কিছু বিস্মৃত হয়েছিলেন ঋষি এবং ঋষিপত্নীগণ। ঋষিরা কামার্ত হয়ে অনুসরণ করছিলেন মোহিনীকে, আর ঋষিপত্নীরা ভিক্ষতনকে। উপগতহবার বাসনায়,কামের তাড়নায় তারা জগৎ চরাচরের সকলকিছুই বিস্মৃত হয়েছিলেন। কামনা প্রশমিত হবার পরে তাদের স্মরণে এল কামের বশবর্তী হয়ে তারা সাধনা ত্যাগ করে এই যুগলের পশ্চাতধাবণ করেছেন! ঋষিদের সকল ক্রোধ এসে পড়ল ভিক্ষতন এবং মোহিনীর উপরে। মন্ত্রবলে ঋষিরা এক ব্যাঘ্র নির্মাণ করলেন, এবং আদেশ করলেন সেই ব্যাঘ্র যেন ভিক্ষতন এবং মোহিনীকে ভক্ষণ করে, কিন্তু, ভিক্ষতন ব্যাঘ্রকে বধ করে তার চামড়া নিজের নিম্নাঙ্গে পরিধান করলেন। ক্রুদ্ধ ঋষিগণ তখন মন্ত্রের দ্বারা এক সর্পের সৃষ্টি করলেন,কিন্তু সেই সর্পকে ভিক্ষতন নিজের গলায় ধারন করে ডমরু হস্তে তাণ্ডবনৃত্য করতে শুরু করলেন। এতক্ষণে ঋষিরা উপলব্ধি করলেন যে এই যুবাপুরুষ এবং এই যুবতী সাধারণ কেউ নন, এবং নতজানু হয়ে তারা ক্ষমা চেয়ে নিলেন। মহাদেব এবং বিষ্ণুদেব তখন স্বরূপে প্রকট হয়ে ঋষি এবং ঋষিপত্নীদের আশির্বাদ করলেন এবং অন্তর্হিত হলেন। তাণ্ডবশ্রান্ত মহাদেব বিষ্ণুদেবকে অনুরোধ করলেন, স্বর্গারোহনের পূর্বে কোথাও একটু বিশ্রামের জন্যে। ঔড্রদেশে (বর্তমানে ঊড়িষ্যা) অল্পসময় বিশ্রামের জন্যে থামলেন তাঁরা। অগ্নি ও ঘৃত পরষ্পরের সংস্পর্শে এলে যা হয়, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। ভিক্ষতন-রূপী মহাদেবের উন্নত শিশ্ন তার আশ্রয় খুঁজে নিল মোহিনী-রূপী বিষ্ণুর পায়ুতে। জন্ম নিল অযোনিজ সন্তান, জন্মের সময়েই তার কণ্ঠে ছিল এক মণিখচিত রত্নমালা, তাই তার নাম হল মণিকণ্ঠ।

দুই পিতা, মহাদেব এবং বিষ্ণুদেব পরলেন মহা সমস্যায়। তাঁদের পুত্রটিকে কে লালন-পালন করবে? অবশেষে শবরিমালা পর্বতমালার অধিপতি এক শিবভক্ত নিঃসন্তান রাজাকে লালন পালনের দায়িত্ব অর্পন করা হ’ল।

।। ষড়যন্ত্র পর্ব ।।

নিঃসন্তান রাজা পুত্রস্নেহেই বড় করলেন মণিকণ্ঠকে, মণিকণ্ঠ শিক্ষা করলেন ধনুর্বিদ্যা, শাস্ত্র, রাজদণ্ডনীতি। তার মত প্রাজ্ঞ, ধী-সম্পন্ন, নম্র, ভদ্র, ওজস্বী উদার হৃদয় যুবক সহজেই হয়ে উঠলেন দেশের সকলের চোখের মণি। বাহুবলে, পরাক্রমে শত্রুদের পরাজিত করে মণিকণ্ঠ হয়ে উঠলেন দেশের পরিত্রাতা। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে গেল তাঁর নাম। শুধু শত্রুর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করাই নয়,মণিকণ্ঠ দেশের যে কোনও অভ্যন্তরীন সমস্যার সমাধানও অত্যন্ত সুচারু ভাবেই করতেন। এ দেশেরই এক পরাক্রমী যোদ্ধা বাবর এর সাথে মণিকণ্ঠের যুদ্ধক্ষেত্রেই আলাপ। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করতে করতেই ভালোলাগা এবং পরিশেষে ভালোবাসায় পরিণত হয় তাদের সম্পর্ক। যখন মণিকণ্ঠের আঠারো বছর বয়েস, রাজা অবগত হলেন কনীষ্ঠা রানী সন্তান সম্ভবা।

যথাসময়ে রানী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন। আনন্দে আবেগে ভেসে যাওয়া রাজা রানীকে কথা দিলেন যে রানীর পুত্রই সকল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবে। রাজা তাকেই অভিষিক্ত করবেন রাজসিংহাসনে। রানীকে এই প্রতিশ্রুতি দেবার সময় রাজা বিস্মৃত হয়েছিলেন তিনি মহাদেবকে কথা দিয়েছিলেন মণিকণ্ঠকে তিনি রাজার আসনে স্থাপন করবেন।

রাজা যতই প্রতিশ্রুতি দিন না কেন, রানী মনে মনে সন্দিহান ছিলেন। তিনি কৌশলে মণিকন্ঠকে নিধন করতে চাইলেন। এক দাসী পরামর্শ দিল রানীকে। “ মহারানী, আপনি রাজকুমার মণিকণ্ঠকে অবগত করুন, আপনি অসুস্থ। এই অসুস্থতা সারবে একমাত্র যদি কোনও নিষ্কাম যুবকের হস্তে আপনি ব্যাঘ্রীর দুগ্ধ পান করেন। নচেৎ আপনার মৃত্যু অনিবার্য। এবং আপনার মৃত্যু হলে মাতৃহত্যার দায় আরোপিত হবে রাজকুমার মণিকণ্ঠের উপরেই”।

রানীর মনে ধরল দাসীর পরামর্শ,কিন্তু, ভয়ও হ’ল। রানী দাসীকে শুধোলেন, “শুনেছি কুমার মণিকণ্ঠ না কি দেবাদীদেব মহাদেব এবং জগৎপালক শ্রীবিষ্ণুর পুত্র। এঁদের পুত্রের প্রতি অবিচার করলে যদি এঁনারা কূপিত হন? যদি এঁদের ক্রোধ নেমে আসে আমার ওপর? আমার সন্তানের ওপর? আমার রাজ্যের ওপর?? ক্ষতি হয়ে যায় দেশের??কি হবে তখন”?

দাসী সাহস দিয়ে বললে, “রানীমা, চিন্তার কিছুই নেই। যে পিতারা এই অষ্টাদশ বৎসরে একবারের জন্যেও দেখতে এলেন না, খোঁজ নিলেন না, পুত্র কেমন আছে, তাঁরা বোধকরি বিস্মৃতই হয়েছেন কুমার মণিকণ্ঠের কথা”।

দাসীর পরামর্শে রানী ডেকে পাঠালেন মণিকণ্ঠকে, বললেন, “পুত্র মণিকণ্ঠ, তোমাকে আমি আপনার পুত্র মনে করেই স্নেহে, মায়া, মমতায় বড় করেছি। আজ, সময় এসেছে,তার প্রতিদান স্বরূপ কিছু চাইবার। পুত্র, আমি জানি তুমি নিষ্কাম এক যুবক। তাই তোমাকেই অনুরোধ করছি। রাজবৈদ্যের পথ্য অনুসারে,এক নিষ্কাম যুবকের নিজ হস্তে দোহন করা ব্যঘ্রীর দুগ্ধ পান করলে, তবেই আমি সুস্থ হব। অন্যথায়, আমার মৃত্যু অনিবার্য পুত্র। বল আমায় পুত্রবর, তুমি কি পারবে আমায় জীবনদান করতে? নতুবা, মাতৃহন্তারকরূপে যুগে যুগে সকলের চক্ষে ঘৃণার পাত্র হতে হবে তোমায় পুত্র”।

মাতৃ আদেশ রক্ষার্থে কুমার মণিকণ্ঠ চললেন গভীর অরন্যে, ব্যাঘ্রীর দুগ্ধ আহরণে। সঙ্গে রইলেন মণিকণ্ঠের অভিন্নহৃদয় সখা বাবর। মণিকণ্ঠের বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও বাবর মণিকণ্ঠকে একাকী গহীন অরণ্যে ব্যঘ্রীর দুগ্ধের সন্ধানে যেতে দিতে সম্মত হলেন না।

অরণ্যসঙ্কুল পথ অতিক্রম করে, নানান বিপদ-বাধার সম্মুখিন হতে হতে মণিকণ্ঠ এবং বাবর উপনীত হলেন অরণ্যের মধ্যভাগে, কোথাও আর পথের রেখা দেখা যায়না কোনো,সূর্যালোক প্রবেশ করতে অক্ষম হয় সেই গহীন অরণ্য এতই নিবিড়। শ্রান্ত মণিকণ্ঠ এবং বাবর আশ্রয় নিলেন গাছের কোলে। সহসা অন্ধকার ভেদ করে এক ছায়ামূর্তি এগিয়ে এল তাদের দিকে। কষ্টিপাথরে খোদাই করা, নির্মেদ, সুঠাম, বলিষ্ঠ চেহারার এক যুবক। পরনে বাকল,পত্র দ্বারা নির্মিত পোষাক,হাতে ভল্ল। নিজের পরিচয় দিলেন কদুথা বলে। কদুথা ওই অরণ্যের শবর গোষ্ঠীপতির পুত্র। সরল হৃদয় কদুথা অল্পসময়েই বন্ধু হয়ে উঠেছিল মণিকণ্ঠের। মণিকণ্ঠ কদুথার কাছে খুলে বললেন সব কথা। সব শুনে কদুথা প্রতিশ্রুতি দিল মণিকণ্ঠকে ব্যাঘ্রদলপতির কাছে নিয়ে যাওয়ার। কদুথার সহায়তাতেই মণিকন্ঠ পৌঁছাল অরণ্যের শেষভাগে,ব্যাঘ্রদের গোষ্ঠী বাস করে যেখানে। কদুথা মণিকণ্ঠের পরিচয় দিল ব্যাঘ্র দলপতির কাছে। মণিকণ্ঠ বুঝিয়ে বলল পরিস্থিতি। মণিকণ্ঠের সব কথা শুনে ব্যাঘ্র দলপতি মণিকন্ঠকে ব্যাঘ্রদুগ্ধ দিলেন। শুধু তাইই নয়, ব্যাঘ্রদলপতি মণিকণ্ঠকে রাজপ্রাসাদে পৌঁছে দেবার জন্যে ব্যাঘ্রদের আদেশ করলেন। বীর মণিকণ্ঠ ব্যাঘ্রদুগ্ধ নিয়ে ব্যাঘ্রপৃষ্ঠে আরোহন করে রাজ্যে প্রবেশ করলেন বীরের বেশে। প্রজারা ধন্য ধন্য করতে লাগলো। পুষ্পমাল্যে তারা বরণ করে নিল মণিকন্ঠকে। কূটীলা কনীষ্ঠা রানী অসূয়ায়, ক্রোধে মুখ ফিরিয়ে রইলেন। নিরুপায় রাজা রাজ্যবাসীর সম্মুখে মণিকণ্ঠকে পরবর্তী রাজা বলে ঘোষণা করলেন। কিন্তু, বিধাতার পরিকল্পনা ছিল অন্য কিছু।

।। সন্ন্যাসগ্রহণ পর্ব ।।

“তুমি তো দেবাদিদেব মহাদেব এবং বিষ্ণুদেবের সন্তান, বৎস মণিকণ্ঠ? তাহলে দেবী পার্বতী এবং দেবী লক্ষ্মীর সঙ্গে তোমার সঠিক সম্পর্কটি কি?” প্রশ্ন করলেন নারদ মুনি। “যদি সঠিক ভাবে উত্তর দান করতে পার, তবেই তুমি হবে এই সিংহাসনের অধিকারী, নচেৎ তোমার ভ্রাতা পাবে এই সিংহাসন”।

নারদমুনির আগমন কিন্তু সহসা ছিল না। রাজা দ্বিধায়, অন্তর্দ্বন্দে জর্জরিত হয়ে শরণ নিয়েছিলেন নারদমুনির। রাজা নির্ধারণ করে উঠতে পারছিলেন না,কাকে তিনি সিংহাসন দিয়ে যাবেন,কে হবে তার প্রকৃত উত্তরাধিকারী, নিজের পুত্র না পালিত পুত্র। এই দ্বন্দের নিরসন ঘটাতেই আসরে এসেছিলেন দেবলোকের মুনি নারদ।

নারদমুনির এই প্রশ্নে মণিকণ্ঠ সঠিক কোনোও উত্তর দিয়ে উঠতে পারলেন না। তবে বুঝতে পারলে, তাকে সিংহাসনে বসতে না দেওয়ার এটা একটা পরিকল্পনা। মণিকন্ঠ প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, সন্ন্যাস গ্রহণ করে রাজসুখভোগ, সম্পদ ,রাজ্যের মোহ ত্যাগ করে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাজা অনুরোধ করলেন মণিকন্ঠকে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্যে। মণিকন্ঠ রাজী না হলে, রাজা মণিকন্ঠের ডানপায়ে একটি সাদা বস্ত্র খন্ড বেঁধে দিলেন মণিকণ্ঠের কল্যান চিন্তা করে। রাজা এও প্রতিশ্রুতি দিলেন, শবরীমালাই পর্বতের উপরে একটি আশ্রম বানিয়ে দেবার। যেখানে মণিকণ্ঠ সাধনা করতে পারবেন। মণিকণ্ঠ চলে গেলেন শবরিমালাই পর্বতের এক গহিন অরণ্যে, সঙ্গে রইলেন শুধু বাবর এবং কদুথা। মণিকন্ঠ সিদ্ধান্ত নিলেন সারাজীবন তপস্বীর জীবন কাটাবার। দেশবাসীকে সমস্ত বিপদ থেকে এই অষ্টাদশ বৎসর রক্ষা করবার কারণে দেশের জনগণ মণিকণ্ঠকে আয়াপ্পা নামে সম্বোধন শুরু করেছিলেন। আয়াপ্পা নামের অর্থ পিতা।

।। শাপমোচন পর্ব ।।

“হে উন্নতদর্শন যুবাপুরুষ, আমি লীলা। একজন শাপগ্রস্তা অপ্সরা। নৃত্যবিভঙ্গে ভুল হবার কারণে আভিশাপের ভাগিনী হয়েছিলাম। এই জঙ্গলে রাক্ষসীরূপে ঘুরে বেড়াতাম, আর প্রতি নিয়ত অপেক্ষা করতাম, কবে কোনও নিষ্কাম যুবাপুরুষ এসে আমায় যুদ্ধে পরাস্ত করবেন এবং হত্যা করবেন, যাতে আমার শাপমুক্তি ঘটে। আপনিই সেই নিষ্কাম যুবাপুরুষ, আপনিই এই শাপ থেকে আমায় মুক্ত করেছেন। আপনিই এবারে আমায় গ্রহণ করুন। মনে মনে আমি আপনাকেই স্বামীরূপে গ্রহণ করে ফেলেছি”। প্রার্থণা জানালেন লীলা।

শবরিমালা পর্বতের সেই অরণ্যে মহিষী নাম্নী রাক্ষসী বাস করত। মানুষের গন্ধ পেয়ে সে একদিন আক্রমন করেছিল মণিকন্ঠকে। বীর যোদ্ধা মণিকণ্ঠ সহজেই রাক্ষসীকে বধ করল। আসলে সেই রাক্ষসী ছিল এক অভিশপ্ত অপ্সরা, নাম লীলা। শাপমুক্ত লীলা সুদর্শন যুবাপুরুষ মণিকণ্ঠকে বিবাহ প্রস্তাব দিল। মণিকণ্ঠ সম্মত হলেন না, কিন্তু তারপরেও লীলা বারংবার অনুরোধ করতে থাকলেন। তখন মণিকণ্ঠ লীলাকে শান্ত করে বললেন “হে সুন্দরী অপ্সরা লীলা, যেইদিন থেকে আমার সাধনালয়ে নিষ্কাম কোন যুবক প্রবেশ করবেন না, সেইদিনই আমি সক্ষম হব আপনাকে বিবাহ করতে। তার পূর্বে কোনওভাবেই তা সম্ভব নয়”।

লীলা এই আশ্বাসন শুনে সিদ্ধান্ত নিলেন,মালা হস্তে জীবনের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে যাবেন মণিকণ্ঠের জন্যে।

।। উপসংহার পর্ব ।।

ক্রমে ক্রমে মণিকন্ঠর সাধনালয় মণিকন্ঠর মন্দিরে পরিণত হল। পর্বতমালার পাদদেশ থেকে আঠেরটি ধাপে পৌঁছানো যায় সেই আশ্রমে। আঠেরটি সিঁড়ি প্রকৃতপক্ষে সেই অষ্টাদশ বৎসরকে সূচিত করে,যে সময়কাল মণিকণ্ঠ রাজপ্রাসাদে অতিবাহিত করেছিল। সেই মন্দিরের অদূরেই স্থাপিত হল মণিকন্ঠর পরম মিত্র প্রাণাধিকেষু বাবরের মসজিদ। অপর পার্শ্বে স্থাপিত হল মণিকণ্ঠের আরেক প্রিয়তম সখা কদুথার মন্দির। লীলাও বাদ পরলেন না,শবরিমালাই পর্বতমালার পাদদেশে এক মন্দিরে মালা হাতে পূজিতা হতে থাকলেন তিনি। অদ্ভুত অভূতপূর্ব ভাবে পরষ্পর বিবাদমান ধর্মসম্প্রদায়গুলি এক সাথে অবস্থান করতে থাকল শবরিমালাই পর্বতমালা ও তার পাদদেশ জুড়ে।

মণিকন্ঠ (শৈব এবং বৈষ্ণবের মিলন), লীলা (শক্তির উপাসক,শাক্ত), কদুথা (অন্ত্যজশ্রেণির প্রতিভূ) এবং বাবর (ইসলাম ধর্মের প্রতিনিধিত্ব)এক সাথে। যুগযুগ ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তা দিয়ে যেতে থাকল তারা মানবসমাজকে।


 

1 comment on “মণিকন্ঠ

  1. Pingback: কালিজা ২০১৮- সূচীপত্র - কাঁচালঙ্কা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *