সাধারণ প্রেম

      1 Comment on সাধারণ প্রেম

[শুরুর আগেঃ

নাহ! লেখক সোহিনীর সাথে সরাসরি যোগাযোগ হয়নি কখনো। তবে এই লেখাই প্রথমেসেছিলো আমাদের কাছে। আর পাঠিয়েছিলেন চিত্রাঙ্গদা পত্রিকার কুশীলবেরা। আবারো ধন্যবাদ লেখককে এবং চিত্রাঙ্গদাকে আমাদের উপরে আস্থা রেখে এই লেখাটি আমাদেরকে প্রকাশের অনুমতি দেওয়ার জন্যে। এ বছরে কালিজার সমাপ্তি ঘটছে দুখানি “মধুরেণ সমাপয়েৎ” গল্প দিয়ে। এটি প্রথম। ]

সাধারণ প্রেম

সোহিনী

।। ১ ।।

কলেজের প্রথম দিনেই একী হল আমাদের গল্পের নায়িকার? নায়িকার নাম নাহয় নাই জানলাম আমরা! সে ভিড়ের মধ্যে খুঁজে-পাওয়া- যাবে-না ধরনের একটা খুউব সাধারণ মেয়ে। তাহলে প্রশ্ন তোমরা করতেই পারো যে এত সাধারণই যদি হবে, তবে সে নায়িকা হল কীভাবে? হুঁ হুঁ! অত সহজ নয়।

গল্প আছে। তবে যা বলছিলাম তা হল আমাদের নায়িকা দেখতে খুবই সাধারণ। রঙ ফর্সার দিকেই, তবে আহামরি কিছু নয়। নাকটা বোঁচার দিকে, চোখ দুটো টানা টানা, তবে বড্ড ছোট। হাসলে ওকে চীনে মনে হয় বলে ওর ধারণা। ওহো! হাসির থেকে মনে পড়ল, খুব ছড়িয়ে হাসলে ওর বাঁদিকের একটা গজদাঁত চোখে পড়ে। উচ্চতা? এই, পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি মতো ধরা যাক।

হুম! বর্ণনা বেশী হয়ে যাচ্ছে। এবার গল্পে না ঢুকলে তোমরা হাই তুলতে শুরু করবে। হ্যাঁ, তো, শুরুটা খুব সাধারণ (থুড়ি! হিন্দিতে যাকে বলে ‘ঘিসাপিটা’)। ইংলিশ অনার্সের ছাত্রী আমাদের সাধারণ মেয়ে প্রথমদিন কলেজে গিয়ে মেয়েদের সাথে ভালোই আলাপ জমিয়ে ফেলল। কিছু কিছু ছেলের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হল। কিন্তু নায়িকা আর তার ক্লাসের বেশীরভাগ মেয়েরই চোখ আটকে গেল ক্লাসের পেছনের একটা কোণে। একটা ছেলে চুপটি করে বসে আছে ওখানে। কাউকেই পাত্তা দিচ্ছে না। কী অ্যাটিটুড!

আর…

“কী হ্যাণ্ডসাম! উফফ!” একটি মেয়ে ফিসফিস করে মন্তব্য করল৷

বেশীরভাগ মেয়েই তাতে মনে মনে সায় দিল৷ আমাদের নায়িকাও।

“বড্ড ‘মেয়েলি’। আলুভাতে টাইপের চেহারা”, ক্লাসের মধ্যে একটা বয়কাট চুল মেয়ে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল। এই মেয়েটা নাকি স্পোর্টস কোটায় ভর্তি হয়েছে। স্টেট লেভেল কবাডি খেলে। দুর্দান্ত চেহারা। আমাদের নায়িকাও অবশ্য স্কুলে একটু আধটু কবাডি খেলত, কিন্তু এত সিরিয়াস সে কোনওদিনই ছিল না।

“উফফফ! এটাই হল চকোলেট বয়! কী ফর্সা! আর ঠঁটগুলো দেখ। একদম পিঙ্ক। হাতগুলো যেন তুলি দিয়ে আঁকা! আর চোখদুটো, হাল্কা ব্রাউন।

উফফফ! আমি পাগল হয়ে যাব! কী দারুন!” আগের মেয়েটা কমেন্ট করল।

আমাদের নায়িকা শুধু দু’চোখ ভরে দেখল। কলেজের প্রথম দিনই বোধহয় প্রেমের ফাঁদে পড়ল মেয়ে। নায়িকার কিন্তু কোনও দোষ নেই। নায়ক যদি এত সুন্দর হয়, ও কী করবে!

।। ২ ।।

কলেজে প্রায় মাস দুয়েক কেটে গেল। সেই সুন্দর ছেলেটা কিন্তু এখনও সবার কাছে একটি ‘মিস্টিরিয়াস এলিমেন্ট’ হয়ে আছে। কারুর সঙ্গেই ঠিক করে কথা বলে না। তবে মাঝে মধ্যে যখন বলে, নায়িকা খেয়াল করেছে, ওকে বড্ড সুন্দর লাগে দেখতে। ওর গলার আওয়াজটাও খুব সুন্দর। প্রায় সব মেয়েগুলোই উপযাচক হয়ে ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করেছে।

কিন্তু প্রায় সবাই ব্যার্থ। ছেলেটা নাকি খুব ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাকে।

রূপালী বলছিল যে ওর তাকানোটা নাকি খুব অস্বস্তিকর। সেই তাকানোর সামনে নাকি বেশীক্ষণ থাকা যায় না।

আমাদের নায়িকা তো কোনওদিন চেষ্টাই করল না ওর সঙ্গে কথা বলতে।

তবে তারও অবশ্য একটা যুক্তি আছে। একেবারে অকাট্য একখানা যুক্তি।

এত এত সুন্দরীরা যদি ফেল মেরে যায়, তবে অনেক প্রবাবিলিটির আঁক কষেও আমাদের নায়িকার সুযোগ খুব কম। আর সত্যি কথা বলতে, এই ছেলেটার কাছে গেলেই আমাদের নায়িকা বড্ড নার্ভাস হয়ে পড়ে। এই যেমন, ও কখনও অন্যমনস্ক হয়ে যায়, কখনও আবার ওর গলা শুকিয়ে, হাত পা ঘেমে এক কান্ড হয় (‘ম্যায় হু না’র মতো ব্যাকগ্রাউন্ডে ভায়োলিন, গান, ইত্যাদিও বাজে বই কি!)।

“ছেলেটা কিন্তু খুব ভদ্র”, নম্রতা, সেই বয়কাট চুল মেয়েটা, এই কথাটা মাঝে মধ্যেই বলে। কোনও এক অজ্ঞাত কারণে, এই একটিমাত্র মেয়ের সাথেই আমাদের নায়ক তবু যা দু চারটে কথা বলে। হয়তো ও বোঝে বাকিরা ওর সাথে ফ্লার্ট করে, শুধু নম্রতাই ওসবের ধার ও মাড়ায় না! হয়তো নম্রতার সাথেই ও কম্ফোর্টেবল।

নায়িকা লক্ষ করেছে নায়ক দু চারবার তার দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু তা মাত্রই কয়েক মুহুর্তের জন্য। আর নায়িকার বুকের রক্ত চলকে উঠেছে।

এরকম অনুভূতি আগে কনওদিন নায়িকার হয় নি। সত্যি বলতে এই ছেলেটার মিস্ট্রি কেমন করে যেন নায়িকার মাথার মধ্যে অদ্ভূত এক বিক্রিয়া করে। বড্ড ভালো লাগে। কিন্তু নায়িকা আবার এটাও লক্ষ করেছে, ছেলেটা বাকি ছেলেদের সঙ্গেও অন্তরঙ্গভাবে মেশে না। সুমিত বলছিল যে ও নাকি কোনও ননভেজ জোক শুনতে চায় না।

সেদিন পাপিয়া বলছিল, “এই, ও আবার ‘গে’ নয়তো?”

হতেই পারে। এই কথাটা হয়তো সবার মনেই উঁকিঝুকি মেরেছে কখনও না কখনও, কেউ এর আগে প্রকাশ করেনি আর কি!

এখন অফ চলছে। আকাশে চাপ চাপ মেঘ জমাট বেঁধে আছে। চারদিকে কালচে জোলো আলোর ছড়াছড়ি। আমাদের নায়িকা একা একা কলেজের লনে হাঁটছে।

“এই শোন!” নায়িকাকে কেউ ডাকল পেছন থেকে। পেছনে ঘুরেই অবাক কান্ড! নায়ক দাঁড়িয়ে! এত কাছে! হাত ঘামছে নায়িকার, গলা বুজে আসছে।

ছেলেটা খুব একটা লম্বা নয়। পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি মতো হবে। কিন্তু তাতে ওর রূপ এতটুকু কমে না! আর পার্সোন্যালিটিও পাগল করে দেওয়া।

“তোর সঙ্গে কথা আছে”, ওর গলাটা নায়িকার কানের ভেতর দিয়ে যখন ওর মাথায় প্রবেশ করল, তখন সেটা শুধু একটা মধুর সুরেলা শব্দ।

নায়িকার গলায় আওয়াজই ফুটল না।

নায়ক এবার বুঝি একটু লজ্জা পেল। ফর্সা টুকটুকে গাল দুটো সামান্য লাল। মাথা নীচু করে আবার বলল, “শুনছিস?”

“হুঁ”, নায়িকা মূগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে।

“তুই কি কলেজের সোশালে আমার সঙ্গে গান করবি?”

“তুই কী করে জানলি যে আমি গান করি?”

“সেটা বড় কথা নয়। গাইবি কিনা বল।”

বাব্বা! ভালো গান করে বলে কি অহংকার! নায়িকাও চটপট বলল, “গাইব।”

এবার নায়কের ঠঁটের কোণে হাসির ঝিলিক খেলে গেল। আর কোথা থেকে যেন নায়িকাও মনে মনে দুঃসাহসী হয়ে উঠল। অথবা কে বলতে পারে, হয়তো মরিয়া হয়ে উঠল। প্রেমে পড়লে কতকিছুই তো হয়!

“থ্যাঙ্কস” বলে নায়ক যখন চলে যাচ্ছে, নায়িকা বলল, “শোন।”

“আমাকে বললি?” নায়ক অবাক!

“হ্যাঁ। (আর কে আছে এই মুহুর্তে এই লনে? ক্যাবলারাম!)”

“ও। বল।”

হঠাৎ নায়িকার বুকের ভেতরটা যেন হিম হয়ে গেল। মনে হল নায়ক বুঝি

ওর ভেতরটা পড়েই ফেলছে।

“তুই কি বরাবর এরকম চুপচাপ?” মেঘ ডাকছে। আরো কালো হয়ে আসছে সব। এক্ষুনি বৃষ্টি শুরু হবে।

নায়ক উত্তর দিল না। শুধু একটা ভুরু তুলে তাকাল।

“না, মানে, তুই নিশ্চয়ই জানিস এখানে অনেক মেয়েই তোর ফ্যান? (ফ্যান নয়, তোর জন্য পাগল। এই যে! এই আমি রে, আমি!)”

“কীসব বলছিস!” বিরক্তি ফুটল নায়কের মুখে।

আর তখনই চারদিক অন্ধকার করে নেমে এল বৃষ্টি।

“ভেতরে যা! তোর ঠান্ডা লেগে আছে। পরশু থেকে দেখছি কাশছিস”, নায়িকা

আদেশের সুরে বলল।

বিনাবাক্যব্যায়ে নায়ক বিল্ডিং-এ ঢুকে গেল। শুধু ঢোকার আগে পেছনে

ফিরে একবার তাকাল ‘দ্য মিস্টিরিয়াস বয়”। ওর চোখে কী ছিল? মিস্ট্রি?

।। ৩ ।।

এখন সন্ধ্যে সাতটা। কলেজ সোশাল চলছে। আমাদের নায়ক-নায়িকার গান শেষ। ওরা দুজনে প্রচুর হাততালি পেয়েছে। এর মধ্যেই নায়ক নায়িকা খুব ‘ভাল বন্ধু’ হয়ে গেছে। যদিও মিস্টিরিয়াস বয়-এর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানে না নায়িকা। খুব ইচ্ছে করে জানতে ও কোন স্কুলে পড়েছে। সেটাও বলে না ও। শুধু বলে, “ওগুলো শুনতে ভাল লাগবে না তোদের।”

গান শেষ করেই কোথায় যেন উধাও হয়ে গিয়েছে নায়ক। নায়িকা তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাড়ি চলে গেল নাকি? এত করে যে নায়িকা যেতে বারণ করল?

শুনল না?

এখন অল্প অল্প শীত পড়তে শুরু করেছে। নায়িকা নিজের শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে নিল। খুঁজতে খুঁজতে বিল্ডিং এর একেবারে অন্ধকার কোণেয় এসে পড়ল সে। দেখে, সেখানে বসে বসে নায়ক একা একা সিগারেট খাচ্ছে।

“তোর কী ব্যাপার, আমি বুঝছি না। কেন এরকম একা একা থাকিস?”

নায়িকা নায়কের পাশে বসে বলল।

“বুঝবি না তোরা এসব। সো জাস্ট স্টে আওয়ে”, নায়কের গলা কর্কশ।

“তুই বলেই দেখ বুঝি কিনা। (আমি তো বুঝতেই চাই)”

“আমি- আমি রিলেট করতে পারি না। আগে খুব কষ্ট হত, কেউ বুঝত না।

ইট বিকেম আ বার্ডেন। এখন অন্য রকম কষ্ট হয়। মনে হয় এটা আমার

মেন্টাল ডিসর্ডার। শুধু শুধু আমি…” এই প্রথম একসঙ্গে এতগুলো কথা বলল নায়ক।

নায়িকা থাকতে না পেরে নায়কের হাতে হাত রেখে নরম গলায় বলল, “কী কষ্ট হয় তোর আমাকে বল, আমি তোকে হেল্প করবো।”

“একটা হেল্প কর। দূরে থাক”, ঠান্ডা গলায় বলল ছেলেটা।

ধক করে বুকে লাগল। কী? কী বলল? না। ও এরকম বলতেই পারে না।

“আমার অপরাধটা কী? এটা, যে আমি তোকে ভালোবাসি?” নায়িকা ফুঁপিয়ে উঠল।

“হ্যাঁ। কারণ একদিন এই সব ভালোবাসা উবে যাবে। আমি জানি’, উঠে দাঁড়াল নায়ক। আর একটাও কথা না বলে চলে গেল নায়িকাকে পেছনে একা ফেলে। নায়ক কি দেখল না নায়িকা খুব কাঁদছে?

নায়িকাই কি দেখতে পেল যে নায়কের চোখে এক কুচি জল টলটল করছিল?

।। ৪ ।।

এরপর সেমেস্টারের ফর্ম ফিলাপের দিন চলে এল। সবাই ব্যস্ত। মিস্ট্রিবয় সাধারণ মেয়ে নায়িকাকে এড়িয়ে চলে, নায়িকার মন খারাপ। কেন যে ছেলেটা এমন অদ্ভূত! নায়িকা এখনও বোঝে না ছেলেটা সেদিন কেন অমন ব্যবহার করল।

“আজ ওর ফর্মটা কেড়ে নেব দেখিস”, দুষ্টু হাসি হেসে নায়কের দিকে দেখিয়ে বলল নম্রতা।

“কেন?” নায়িকা অবাক।

“এমনি। খুব অ্যাটিটুড দেখায় তাই জ্বালাব।”

“ও। (যা খতরনাক জিনিস জানিস না তো! যা গিয়ে মজা দেখ।)”

এরপর নম্রতা হঠাৎ গিয়ে ফর্মটা কেড়ে নিল নায়কের হাত থেকে। নায়ক

কিছু বোঝার আগেই সবাই সেই ফর্ম ঘিরে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।

নায়িকা প্রমাদ গুণল। বাঁধল বুঝি একখানা কুরুক্ষেত্র! কিন্তু অবাক কান্ড! নায়কের মুখ লাল হয়ে গেল, তার চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে।

নম্রতা ফর্মটা পড়েই স্থির হয়ে গেল। নম্রতার হাত থেকে ফর্মটা পড়ে যেতেই সবাই দেখতে পেল। নামের নীচে সেক্সঃ ট্রান্সজেন্ডার।

বাজ পড়ল ঘরে? সবাই চুপ। পরক্ষণেই শুরু হল ফিসফিস। নায়ক হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। কান্নার মাঝে বলল, “আমি গার্লস স্কুলে পড়তাম, গার্লস স্কুলে।”

সব মেয়েগুলোর চোখে কি ঘৃণা ছিল? নায়িকা জানে না। সে শুধু জানে যে সে ঘরভর্তি ক্লাসমেটদের মাঝে মেঝেতে বসে ফোঁপানো নায়ককে নিজের বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে পরম স্নেহে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “তাতে কী?

তুই এখন যা, সেটাই আমার কাছে সত্যি। তোকেই ভালোবাসি আমি।”

নায়ক তাকে আরও জোরে জড়িয়ে ধরে কান্না ভেজা গলায় শুধু বলল “আই লাভ ইউ টু।”

[ছবিঃ ভুটান]


1 comment on “সাধারণ প্রেম

  1. Pingback: কালিজা ২০১৮- সূচীপত্র - কাঁচালঙ্কা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *