সায়ন – সন্ধ্যে? নাকি এক নতুন ভোরের সূচনা

সায়ন – সন্ধ্যে? নাকি এক নতুন ভোরের সূচনা

অনিরুদ্ধ (নিজস্ব সংবাদদাতা)

(ছবিঃ কোলকাতার বিভিন্ন তরুণ আন্দোলনকারীদের পাশে নিয়ে আমেরিকান দূতাবাসে বক্তব্য রাখছেন বাপ্পাদিত্য মুখার্জী)

২০১৭ এর জুন মাসে যখন চন্দ্রা (নাম পরিবর্তিত) আমায় “এশিয়ান ক্যুয়ের নেটওয়ার্ক” নামক ওয়্যাটসাপ গ্রুপে যুক্ত করলো তখনো বুঝতে পারিনি এর পরবর্তীতে ঠিক কি আসতে চলেছে। “আমরা একটা গে সার্ক বানানোর চেষ্টায় আছি”, শুনে মনে হয়েছিলো এও কি সম্ভব? কিন্তু উদ্যোগ থাকলে যে যেকোন কাজই সম্ভব তার প্রমাণ মিললো ১লা মার্চ, জন্ম নিলো “সায়ন”/”সায়ান” যার পুরো নাম “সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ ক্যুয়ার অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্ক”।

(ছবিঃ পর্দার ওপারে দিল্লীর হয়ে বক্তব্য রাখছেন কৌশিক হোড়)

সতরঙ্গির কৌশিক হোড়, আর আমেরিকান দূতাবাসের ক্রেগ হল -এর বিশেষ সহযোগিতায় প্রান্তকথার বাপ্পাদিত্য মুখার্জীর চেষ্টায় ভারতের বিভিন্ন শহর (কোলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই) এর পাশাপাশি আলোচনায় বসলো ঢাকা। বিষয় সমান্তরাল লিঙ্গ-যৌন পরিচয়ের মানুষের অবস্থা, তাদের অসুবিধে, যা দেশ সীমানার গণ্ডি পেড়িয়ে কোথাও গিয়ে একইরকম। পাকিস্তানের করাচীর বন্ধুদেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিলো, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পরেই সেখানকার আমেরিকান দূতাবাসের পক্ষে জানানো হলো সেই বন্ধুরা উপস্থিত নেই। কারন এখনও অজানা।

(ছবিঃ কোলকাতার মার্কিন দূতাবাসের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সাথে আলাপচারিতায় বাপ্পাদিত্য মুখার্জী)

হ্যাঁ, সমস্ত দূতাবাসের পারস্পরিক মেলবন্ধন, সেখান থেকেই সবাই একসাথে যুক্ত হয়ে আলোচনা, আর অবশেষে আবারও দেখা হওয়ার প্রতিস্তুতি। “এটাই আমাদের সরকারের নীতি, বিশ্বের যেকোন জায়গায় সমান্তরাল লিঙ্গ-যৌন পরিচয়ের মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় আমরা বদ্ধপরিকর। আজ আমাদের প্রথম দেখা। এর পরবর্তীতে আমরা আরো বিভিন্ন নির্দিষ্ট বিষয় নিয়েও আলোচনায় বসতে পারি।” জানালেন আমেরিকান দূতাবাসের কনসাল জেনারেল ক্রেগ হল। “কবে থেকে ভেবেছিলাম বল? এই এতোদিনে হলো তাহলে” বাপ্পাদিত্য মুখার্জীর গলাতেও এক অনাবিল আনন্দ আর ফেটে পড়া উৎসাহ।

(ছবিঃ পর্দার ওপাড়ে অভিনা নিজের ভাষায় তুলে ধরছেন দিল্লীর ট্রান্সজেন্ডারদের কথা)

সত্যিই এই উদ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই। “আর কয়েকবছরের মধ্যে ভারতবর্ষের নাগরিকদের মধ্যে সংখ্যাগুরু হতে চলেছে তরুণ প্রজন্ম। ভারতের নাগরিকদের গড় বয়স হবে ৩০এরও নিচে। সেদিক দিয়ে এরকম একটা উদ্যোগ কিন্তু খুবই প্রাসঙ্গিক” জানালেন মুম্বাইয়ের অশোক রো কবি। সাংস্কৃতিক স্তরে একে অন্যের সাথে যুক্ত বিভিন্ন মানুষের মধ্যে দেশের ভিন্নতার চেয়েও বড়ো হয়তো তাদের আন্দোলনের রাস্তা, তাদের মানবাধিকার স্খলনের গাঁথা।

(ছবিঃ মুম্বাইয়ে আমেরিকান দূতাবাস থেকে সায়নের আলোচনায় বিশিষ্ট আন্দোলনকারীরা)

“আমরা ভিন্ন ভিন্ন দেশের মাটিতে বড়ো হয়ে উঠেছি, কিন্তু যুঝে চলেছি একই অসুবিধেগুলো নিয়ে। ভারত হোক, পাকিস্তান, অথবা বাংলাদেশ, আমরা সবাই বয়ে চলেছি সাহেবদের ফেলে যাওয়া ৩৭৭ ধারা।” বাংলাদেশ থেকে জানালো চন্দ্রা। জুলহাজ পরবর্তী বাংলাদেশের গল্প, দুই সমকামী মেয়ের একসাথে কাছেও নতুন থাকতে পারা যেন দিল্লীর কাছেও নতুন না। সেখানেও যে দুজন ছেলের একসাথে থাকা সহজ নয় যখন কেউ বাড়িই ভাড়া দিতে চায়না। কোলকাতার তিস্তা দাসের প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের জয়স্মিতা (নাম পরিবর্তিত) জানালেন তাদের লিঙ্গ পরিচয় প্রমাণ করতে হয় ডাক্তারি পরিক্ষার মাধ্যমে, তাই অনেকেই সরকারের দেওয়া তৃতীয় লিঙ্গের সুযোগ সুবিধা পায়না। ঠিক একই গল্প কোলকাতার রঞ্জিতা সিনহার। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের ট্রান্সজেন্ডার বোর্ড মাসোহারা দেওয়ার জন্যেও যখন দাবী করে এস-আর-এস সার্টিফিকেটের।

(ছবিঃ করাচীর মার্কিন দুতাবাসে অনুপস্থিত বন্ধুরা)

কোলকাতার অভিজিৎ কুণ্ডু নিজের ডায়েরী বই আকারে ছাপার পরের দিন ছাটাই হন কোলকাতার নামী স্কুলের শিক্ষকতা থেকে। অন্যদিকে অঙ্কন বিস্বাস নিজে আইনজ্ঞ হয়েও কীভাবে ওকালতি করার সময় নিজের উর্দ্ধতন সহকর্মীদের থেকে শুনেছেন আপত্তিকর মন্তব্য তারও গল্প উঠে আসে আলোচনায়। সব গল্প ছাপিয়ে উঠে আসে কিছু প্রশ্ন, একে অন্যকে বোঝার চেষ্টা, নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে খুঁজে নেওয়া শিক্ষাকে ছড়িয়ে দেওয়ার তাগিদ।

(ছবিঃ শুরুর আগে বাপ্পাদিত্য মুখার্জী আর ক্রেগ হল কথা বলছেন সায়নের আলোচ্য বিষয় নিয়ে)

দিল্লী থেকে কৌশিক হোড় প্রস্তাব রাখলেন এই আলোচনা সভার বাইরে গিয়ে এক বৃহত্তর ফোরাম তৈরি করার, বিনীত আবেদন রাখলেন মার্কিন দূতাবাসের কাছে এ বিষয়ে সমস্তরকম সহযোগিতার। কথাটা নিশ্চয়ই চন্দ্রার অন্তত খুব মনে ধরেছিলো। বাড়ি এসে পরেরদিনই দেখি নতুন এক ওয়্যাটসাপ গ্রুপে আমায় অ্যাড করেছে সে। আর এবার শুধু ভারত পাকিস্তান আর বাংলাদেশ নয়, তাতে রয়েছেন শ্রীলঙ্কা আর নেপালেরও বেশ কিছু বন্ধু। অতএব… পরবর্তী আলোচনার পথ আরো প্রশস্ত হলো, তৈরি হলো আরো অনেক নতুন বন্ধুদের পাশে নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলন।

(ছবিঃ অনুষ্ঠানের শেষে করতালিমুখর কোলকাতার বিশিষ্ট আন্দোলনকর্মীরা)

নাহ! এই সায়ন হয়তো রাত কাটিয়ে সত্যিই নিয়ে আসবে নতুন ভোরের সূচনা। এই সায়ন মনখারাপের নয়। হাতে মশাল নিয়ে নিজেদের অধিকারে নিজেদের বাড়ি ফেরার। এই সায়ন, ধ্রুবতারার অপেক্ষায়, তারাভরা আকাশের নিচে এবার পথ চলা শুরু, কিন্তু একা নয়, একসাথে।

“এর মাঝেই

বহুজনেরা সাঁতরে এপার ওপার ।

ওপারে

নাকি পোনা মাছের চাষ আছে

আছে মৎস্যকুমারীরাও

দাবী দু’একজনের “

—— জুলহাজ মান্নান

[ছবিসূত্রঃ বাপ্পাদিত্য মুখার্জী]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *