দোস্তি (১৯৬৪) – এটাই কি ভারতের প্রথম “গে” ছবি? (কালবৈশাখী ২য় বর্ষ – পর্ব ২)

দোস্তি (১৯৬৪) – এটাই কি ভারতের প্রথম “গে” ছবি?

অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

স্মৃতির জাল বুনছি, ভারতের সিনেমার পাতা ওলটাতে ওলটাতে। যেই করণ জোহারের উপরে ভারতের পুরো এল- জি-বি-টি গোষ্ঠী খাপ্পা, তার হাত ধরেই বেরোলো “অজিব দাসতাঁ হ্যায় য়ে”, ভারতীয় সিনেমার ১০০ বছর পুর্তি উপলক্ষে “বম্বে টকিজ (২০১৩)” নামক প্যাকেজের অংশ হিসেবে। ওর বানানো এতোটা পরিণত ছবি বোধহয় আমি আর দেখিনি। মূলধারার ছবিতে দেখানো গে রোম্যান্স নজর কাড়লো সবার। যেই কোতি সিনেমাটা দেখতে দেখতে তার পারিকের হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরে, ছলছল চোখে তার কাঁধে মাথা রাখলো তারও। যে ম্যাচো (পড়ুন মেছো) বাঙালী জিমকরা ছেলে তার গার্লফ্রেন্ডের সামনে নিজেকে অতিরিক্ত পুরুষ প্রমাণ করতে হলে বসে আওয়াজ দিলো, টিটকিরি মারলো, তারও । কিন্তু “লগজা গলে” গানটির এই নতুন রেন্ডিশন কানে লেগে থাকলো সবার। এর সাথে ঐ একই প্যাকেজে দেখানো “শিলা কি জওয়ানি”র কথা না বললে আমাকে স্বয়ং ফালকেদাদুর ভুতও ক্ষমা করবে না। যদিও আমার এই লেখার আলোচ্য বিষয় আপাত অর্থে ঠিক লিঙ্গচেতনা বা জেন্ডার নয়। সমকাম বা হোমোসেক্স্যুয়ালিটি, অথবা ভাষান্তরে সমপ্রেম। যদিও কাম এবং প্রেম খুব আলাদা করে দেখা যায় কি না, সে নিয়েও বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু সেসব কথা ছেড়ে আমরা আবার লেখায় ফিরি।
হ্যাঁ! তো আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম ২০১৩এ। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় সময়, পরিবর্তন এর আগে বা পরে কখনোই থেমে থাকেনি। সমকামিতাও এর আগে স্ক্রিনে এসেছে, পরেও। অনেক নাম মনে পড়ছে, এক এক করে। ফায়ার (১৯৯৬), হানিমুন ট্রাভেলস (২০০৭), বম-গে (১৯৯৬), বম্বে বয়েজ (১৯৯৮), স্ট্রেইট (২০০৯), ম্যাঙ্গো সাফেল (২০০২), ইওরস ইমোশনালি (২০০৬), ডিয়ার ড্যাড (২০১৬), আলীগড় (২০১৬), ডোন্নো ওয়াই… না জানে কিউ (২০১০) , কাপুর এন্ড সন্স (২০১৬)। বাংলায়, নীল নির্জনে (২০০৩), আরেকটি প্রেমের গল্প (২০১০), চিত্রাঙ্গদাঃ দি ক্রাউনিং উইশ (২০১২), মেমরিস ইন মার্চ (২০১১)। সব নাম বলা তো দূর, মনে করাও খুব কঠিন। ১৯৮২তে স্মিতা পাটিল অভিনীত মারাঠি ছবি উম্বরঠা। আরও আগে ১৯৭৮ সালে মালায়ালম ভাষায় “রান্ডু পেনকুট্টিকাল”, নারী সমকামিতার উপরে ভিত্তি করে একই নামের এক উপন্যাস থেকে এর জন্ম। লোকে বলে ছবির পরিচালক নাকি এই ছবি বানানোর আগে বা পরে, কখনোই পুরো উপন্যাসটা পড়েই দেখেননি। ভারতের প্রথম সমকামী ছবি হিসেবে বার বার উঠে আসে আরেকটা নাম। ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “বদনাম বস্তি”। ছবিটার কোন রিল এখন আর পাওয়া যায়না। কিন্তু ঘড়ির কাঁটা উলটো দিকে ঘুরাতে থাকলে এখানে এসেই কি সময় গোলাপি ছেড়ে লাল আর নীল হয়ে যাবে পুরো? বা সাদা আর কালো? আর কোন রঙ খেলা করবে না?

সালটা সম্ভবত ১৯৫৮ কি ৫৯, কিরীটীখ্যাত নীহাররঞ্জন গুপ্ত, “বানভট্ট” ছদ্মনামে কোন এক দৈনিক পত্রিকার ছোটদের বিভাগে লিখে ফেললেন উপন্যাস “লালু ভুলু”। আর তার ঠিক কয়েক বছর পরেই মুক্তি পেলো হিন্দি ছবি “দোস্তি”। পরিচালনায় সত্যেন বোস। “লালু ভুলু” থেকে দোস্তিতে খুব বেশী কিছু পাল্টায়নি হয়তো, বা হয়তো পাল্টেছে। তবে পরিচালক ছবিটি বানানোর আগে উপন্যাসটা আগাগোড়া পড়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। চোখে পড়ার মতো অনেককিছুর মধ্যে একটা জিনিষ অবশ্যই পাল্টালো। নাম। উপন্যাসের নাম দুই মূল চরিত্রের নামে। আর ছবির নামে, তাদের নাম গৌণ হয়ে মুখ্য হলো তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক। তাদের “দোস্তি”। তাদের বন্ধুত্ব। খুব সোজাসাপটা গল্প। দুই কিশোর, দুজনেই অনাথ, দুজনেই গরীব। দুজনেই প্রতিবন্ধী। তাদের জীবনযাত্রা, একসাথে লড়াই করা, আর ছিমছাম নিখাদ বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। বোধহয় আমার নাকটাই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত লম্বা, তাই এই সহজ সরল বন্ধুত্বের সর্ষের মধ্যেও অন্য ভুত চোখে পড়ছে। কিন্তু অন্তত যেই যায়গাগুলো চমকে দিয়ে গেছে, তাদেরকে একটু আবার করে এই লেখায় ছুঁয়ে না গেলে পেট ফেটে মারাই যাবো। তাই নিজের আত্মরক্ষার্থেই এই লেখা, এই মনে করেই এই অধমকে ক্ষমা করে দেবেন; আর এই আশাটুকু করেই আপাতত এই গৌরচন্দ্রিকায় ইতি টানলাম। বরং পেটে জমানো কথাগুলোই এক এক করে চট করে সেরে ফেলি।
১৯৬৪ সালে যখন “দোস্তি” মুক্তি পেল তখন সত্যেন বোসের পাশাপাশি অনেক নামিদামি পরিচালকই দাপটের সাথে কাজ করে চলেছেন হিন্দি সিনেমার জগতে। আর বানিয়ে চলেছেন এভারগ্রিন কিছু ছবি। “সঙ্গম”, “কশ্মির কি কলি”, “রাজকুমার”, “এপ্রিল ফুল”, “ও কৌণ থি” প্রমুখ। তার আগের বছর? “মেরে মেহবুব”, “ফির ও দিল লায়া হু”, “দিল এক মন্দির”, “তেরে ঘরকে সামনে”, “বন্দিনী”। তারও আগের বছর? মানে ১৯৬২তে? “বিস সাল বাদ”, “এক মুসাফির এক হাসিনা”, “হরিয়ালি ওউর রাস্তা”, “অসলি নকলি”, “অনপড়”, “আরতি”। আরে!! সব সিনেমাই প্রেমের না হলেও কোথাও না কোথাও তো ছুঁয়ে গেছে প্রেমকেই। আর কোন প্রেম? না, নারী পুরুষের সমাজসিদ্ধ প্রেম। হ্যাঁ! মেন চরিত্রের অভিনেতারা তো একজন ছেলে, একজন মেয়ে। বা দুজন ছেলে, একজন মেয়ে। বা ঐ গোছেরই আর কি। এর মধ্যে বাণিজ্যিক সাফল্যের সূত্র মেনে দুই কিশোরের বন্ধুত্বের গল্প!!?? “বানভট্টের” লালু ভুলু? নাহ! কেমন যেন গোলমেলে ঠেকছে। উঁহু! একদম ফ্লপ। তাহলে উপায়? উপায় একটাই, পাব্লিক যা খায়, তাই তাদের খাওয়াতে হবে। পাব্লিক বন্ধুত্ব খায় না, প্রেম খায়। ধর্মেন্দ্র আর হেমা মালিনীও, এর অনেক বছর পরে, স্রেফ বন্ধুত্ব করে কোন সিনেমায় রেহাই পাননি। কেউ তাদের দিয়ে একটা বন্ধুত্বের ছবি বানাবে, তা ভাবেওনি। পরে বন্ধুত্ব নিয়ে ছবি হলেও তা সংখ্যায়, আর প্রেমের ছবির লটবহরের কাছে, খুবই নগণ্য। তাই ১৯৬৪তে প্রেম চাই সিনেমা হিট করতে গেলে, আর তা নারী পুরুষের প্রেম। কিন্তু দুই কিশোরের মধ্যে প্রেম? সেই সময়? তাথলে উপায়?

তাই “বন্ধুত্ব থাকনা – প্রেমকে বাদ দিতে হবে কে বলেছে” গোছের এক ফান্ডা হয়তো নিজের অগোচরেই, হয়তো বাণিজ্যিক কারণেই, চলে এলো কিছুটা বাধ্য হয়েই। পরিচালক সত্যেন বোস ইচ্ছে করে বা না করে, এই নারী পুরুষের প্রেমকেই কোথাও আবছায়াভাবে তুলে ধরলেন এই লালু আর ভুলুর চরিত্রের মধ্যে। কোলকাতা শহরের শিয়ালদা চত্তরের রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়ানো “লালু” আর “ভুলু” পাল্টে গেলো “দোস্তি” ছবির “রামু” আর “মোহন” চরিত্রে। কেমন যেন প্রেম থেকেও নেই। কিন্তু এই আবেদন না থাকলে আমার বিশ্বাস দোস্তি আর যাই হোক, এতোটা হিট হোতনা। আর আমরা ভারতের প্রথম গে ছবিটা এতো আগে পেতামনা।
দাঁড়ান দাঁড়ান, একটু জল খেয়ে নিন। হ্যাঁ। ঠিকই শুনেছেন, ভারতের গে ছবিগুলির (অন্ততঃ আমার দেখা যেকটি) মধ্যে প্রথম হলো এই দোস্তি। ১৯৬৪ সালের। সমকামী কি না জানিনা। তবে সমপ্রেমি তো বটেই। আরে বাবা! কুছ কুছ হোতা হ্যায় ছবিতে কিং খানের সেই ডায়ালগটা মনে নেই? “পেয়ার দোস্তি হ্যায়”। সেটা যে এরকম আক্ষরিক উদাহরণে আমাদের সবার সামনে “আছে কিন্তু নেই” হয়ে রয়ে গেছে, বিশ্বাস করুন, ব্যাপারটা ধরতে আমারও একটু সময় লেগেছিলো। তবে তা রয়ে যে গেছিলো সে বিষয়ে আমি খানিক হলপ করেই বলতে পারি।

“I was standing
All alone against the world outside
You were searching
For a place to hide
Lost and lonely
Now you’ve given me the will to survive
When we’re hungry, love will keep us alive”

– Eagles (Album: Hell Freezes Over, Year: 1994)

এই গানের প্রত্যেকটা কথা যেন রামু-মোহনের চরিত্রে, তাদের বন্ধুতেও, তাদের ভালোবাসায়, তাদের মিথোজীবীত্বে নতুন করে প্রাণ পায়। কালানৌচিত্য দোষ হোলো কি? হোকগে। সে ব্যাকরণ শিং বুঝে নেবে খন।
রামু-মোহন দুজনেই প্রতিবন্ধী, দুজনেই সহায়-সম্বলহীন। দুজনের হঠাৎ দেখা রাস্তায়, আর এখান থেকেই ছবির আসল গল্প শুরু হয়।
কৈশোর, আমাদের মধ্যে অনেকেরই প্রথম প্রেমের আস্বাদ। যারা ভালোবাসার কাঙ্গাল, তারা যেন আরও একটু বেশী তাড়াতাড়ি প্রেমে পড়ে। আমাদের এই দুই চরিত্র “রামু” আর “মোহন”, তারাও তো কিশোর। তারাও তো ভালোবাসার কাঙ্গাল। খুব কষ্ট করে এদের বেঁচে থাকা। উপন্যাসে “লালু”র মধ্যে খানিকটা ভিলেন ভিলেন ছাপ থাকলেও, সিনেমাতে অন্তত দুজনেই ভালো। “রামু”, এক পা খোয়া যাওয়া এক কিশোর, একসময় ভালো ফুটবল খেলতো। পড়াশোনা করে নিজের মাকে খুশী রাখার চেষ্টা করতো। নীতিবান রিজিড ছেলে। প্রচণ্ড আত্মাভিমানী। অন্যায় দেখলে এখনও নিজেকে আটকে রাখতে পারেনা। নিজের প্রতিবন্ধকতা ভুলেই হয়তো ঝাঁপিয়ে পড়ে একদল ধনী স্কুলপড়ুয়াদের উপরে। বাজায় মাউথ-অর্গ্যান। শক্ত চোয়ালে, আটোসাটো চুলে তার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব কৈশোরেও নজর কাড়ার মতো।

অন্যদিকে “মোহন” একটু অন্যরকম। গলায় মিষ্টি সুর। টানা টানা চোখ। চুল ছোট হলেও তা ঢেউ খেলানো, খানিক আলুথালু। মনটা তার বড্ড নরম। লড়াই করে নয়, অন্যকে ক্ষমা করেই সে উত্তর দেয় তার উপরে হয়ে যাওয়া অবিচারের। সেও আত্মাভিমানী। কিন্তু সেই আত্মাভিমানে “আত্ম”র চেয়ে “অভিমান”টাই যেন একটু বেশী। তাই শুধু ক্ষমা না, অভিমানও সে করে। কিন্তু শুধু নিজের লোকেদের উপর। “মোহন” গ্রামের ছেলে। হাসিখুশি। “রামু”র চেয়ে বেশী সংসারী সে। হাতে যে অল্প স্বল্প পয়সা আসে, তাকে গুছিয়ে রাখা থেকে শুরু করে, সেই টাকাই যখন চুরি যাওয়ার উপক্রম হয়, রামুকে একটা প্লেস দেখার কথা বলা পর্যন্ত, সবদিকেই। প্লেস? হ্যাঁ! থাকার জন্য। আর রাতটুকু শোয়ার জন্যও বটে। খিক খিক। তবে তারা রাতে ফুটবলও খেলতো না, লুডোও না। আর রামুর মতো মোহনের আদৌ ফুটবল খেলার আগ্রহ আছে কি না, সে বিষয়ে আদৌ ইচ্ছাকৃতভাবেই কি না কে জানে, তবে সিনেমার পরিচালক একদমই স্পিকটি নট। উপন্যাসের থেকে কিন্তু আবারও এখানে চরিত্ররা আলাদা হয়ে পড়লো। লালুর আগে ফুটবল খেলতো কি না খেলতো, আর তার পা কীভাবে কাটা পড়লো সে বিষয়ে উপন্যাসে যেমন কিছুই বলা নেই, তেমনি এই ভিসুয়াল ডিফারেন্সটাও দেখতে পাওয়া উপন্যাস পড়তে পড়তে আদৌ সম্ভব ছিলোনা। তখনো ছবির নায়িকারা রান্নাঘরে হাতাখুন্তি খুব একটা নাড়তোনা, খুব বেশী হলে ঠাকুরঘরে ভজন টজন গাইতো, নইলে আমার বিশ্বাস, সত্যেন বোস নিশ্চয়ই মোহনের হাতে অন্তত একটা চালুনি হলেও ধরাতেন। যাই হোক, তো সিনেমায় এই ডিফারেন্সটা এলো।
কিন্তু একি!! এটা কি বিষম ডিফারেন্স। দুজন ছেলে। দুজন কিশোর। তাদের মধ্যেও এই হেটেরো-নরম্যাটিভিটি? আর এই হেটেরো-নরম্যাটিভিটি যে ছড়িয়ে পরলো সিনেমার সর্বাঙ্গে। সংলাপ থেকে গান হয়ে গল্পের বহমানতা জুড়ে। আর সেকাল হোক বা একাল, আমরা যে বাঁচিই এই হেটেরো-নরম্যাটিভিটি নিয়ে। আপনি গে হলে সবার আগে প্রশ্ন আসে “তুমি টপ না বটম ডিয়ার?”। মেয়ে হলে বুচ না ফেম। ট্রান্স হলে তো কথাই নেই। রুপান্তরকামী ছেলে মানেই সে ডমিনেটিং রোল প্লে করবে, আর রুপান্তরকামী মেয়ে হলে প্যাসিভ। ট্রান্স-গে, ট্রান্স-লেসবিয়ান? সেসব মঙ্গলের জলের মতো, নাসা খুঁজে বেড়াচ্ছে। এই আধা-হোমো, আধা-হেটেরো স্ট্রাকচারে খুব দুঃখজনক হলেও, সমকামীরা অভ্যস্ত। যুগ যুগ ধরেই ছিলো। কিন্তু তাই বলে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আ“গে” ছবির পর্দায় ফুটে উঠছে এই একই স্ট্রাকচার দুই সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে? ব্যাপারটা আরেকটু খতিয়ে দেখতে হলে কিন্তু আবারো চরিত্রদের নামে একবার ফিরে আসতেই হবে।
“রামু”- “মোহন”, একই আত্মা, দুই শরীর। আর বিষ্ণুর এই দুই রূপের মধ্যেও যে অন্তত রোলপ্লেয়িং-এর একটা পার্থক্য স্পষ্ট সে ব্যাপারেও কি আরেকবার আমরা ভেবে নেবোনা? রাম দৃঢ়, কৃষ্ণ কিন্তু অতোটাও নন। চরিত্র থেকে মানসিকতা, সর্বত্র এই পার্থক্য স্পষ্ট। রাম নীতিজ্ঞ। যা ঠিক তাই করেন। তিনি পুরুষোত্তম শ্রী রাম। কৃষ্ণ কিন্তু সত্যের জয়ের জন্যে মিথ্যের আশ্রয় নিতেও প্রস্তুত। তার কূটনৈতিক মানসিকতা কিন্তু রামের সারল্যের সাথে একটা বৈপরীত্য ঠিকই তৈরি করে। কৃষ্ণ মোহিনী রূপে আরাভানের সাথে ফুলশয্যা করলেও, রামায়নে কিন্তু রামের মধ্যে সেরম কোন পটপরিবর্তন দেখা যায়না। চরিত্রদের এতো সাদামাটা কিন্তু তীক্ষ্ণ নামকরণের জন্যে কিন্তু পরিচালককে সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর এই দুই নামের মধ্যেও পৌরুষ আর অধিকতর পৌরুষের একটা উষ্মা ছুঁয়ে যায় আমাদের সবাইকে।
আর কি পাল্টালো তাহলে উপন্যাসের এই সিনেমায়নে? তৃতীয় আরেকটা চরিত্র। মঞ্জু। ছোট্ট একটি মেয়ে। অনাথ। তার দাদার সাথে অট্টালিকাপ্রমান এক বাড়িতে থাকে। রামু আর মোহনের মাউথ অর্গ্যান আর গান শুনতে বড়ো ভালোবাসে মেয়েটা। এক সেকেন্ড! মেয়েটা!!?? উপন্যাসে কিন্তু এই চরিত্রে কোন বালিকা নেই। এক বালক আছে। নাম সুরজিৎ। আবারো খটকা। সত্যেন বোস হঠাৎ সুরজিৎকে মঞ্জু বানাতে গেলেন কেন? উনি কি চাইছিলেননা যে দুই বালকের বন্ধুত্বের মধ্যে তৃতীয় কোন বালক আসুক? তাতে কি তার ভিশ্যুয়ালাইসেশানটা ঘেটে যাচ্ছিলো? যাই হোক। খুব ভালোভাবে দেখলে এই মঞ্জুর সাথে দুই চরিত্রের কেমিস্ট্রি বা রসায়নেও কিন্তু একটা বিভেদ আছে। মোহন আর মঞ্জুর মধ্যে যে “বোন-বোন” ভাবটা ফুটে ওঠে, রামুর সাথে কিন্তু সেটা অনেকটাই কম।
আপনি যদি এখনও ভুরু কুঁচকে ভাবছেন যে আমার মাথা খারাপ, আর সিমপ্লি ভাট বকছি, তাহলে কয়েকটা প্রশ্ন করি, উত্তরগুলো না হয় নিজেই খুঁজে নিন।

১) রামুর কি দরকার পরেছিলো মোহনের রূপের প্রশংসা করার যখন সে বলে “সচ!! কিতনি সুন্দর আঁখে হ্যায় তুমহারি…”??

২) ঐ সময় বাচ্চারাও পটাপট সিনেমায় অপোসিট সেক্সের মানুষদের সাথে প্রেমে পড়ে যেতো। পরে সেই “বচপনকা প্যার” ইন্টারভেলের পর এসে বাকি সিনেমা টানতো। কৈ, রামু বা মোহন তো মঞ্জুর প্রেমে পড়লোনা। কেন?

৩) মোহন অন্ধ, বুঝলাম। তা হাঁটার সময় তো রামুর হাতে হাত রেখে, বা কাঁধে হাত রেখে হাটতে পারতো। কিন্তু না, সে তো রামুর সুদৃঢ় বাইসেপ/ট্রাইসেপ ধরেই হাটতে অভ্যস্ত। এমনকি ঘুমানোর সময়ও সে রামুর অ্যাব্সে হাত রেখে ঘুমাতো। কেন? … বিশ্বাস না হয় ছবিটা ভালো করে দেখে নিন, দেখে থাকলে আবারো, আরেকবার।

৪) রামুর চোখের জল মোছার সময়ও মোহন কেন রামুর ঠোঁট ছুঁয়ে যায় বারবার?

কি? বিশ্বাস হচ্ছেনা? কিন্তু সত্যিই এই সব সেন্স্যুয়ালিটিগুলো সিনেমাটাতে আছে। যেমন এক্ষুনি মনে পড়ছে একটা দৃশ্য। মোহন রামুর জন্যে বুকের মলম নিয়ে এসে বলছে “ইয়ে দওয়া তো ম্যায় লে আয়া। মগর ম্যায় অপনে হাথোসে ইনে নহি লগা সকতা। আজ মেরি আঁখে হোতি তো ম্যায় অচ্ছি তরহাসে ইনে লগা দেতা।” এর উত্তরে রামু বলে “তু সির্ফ হাথ ফিরাদে”, আর মোহনের হাতটা টেনে নিয়ে বলে চলে “সব ঠিক হো জায়েগা”। মোহন রামুর গালে হাত বোলাতে থাকে। আর রামু রোম্যান্টিক চোখে মোহনের দিকে তাকায়। পরে আবার যখন মোহনের আনা লন্ঠন পেয়ে রামু মোহনের বুকে মাথা রাখে, সেই দৃশ্যটা? মনে পড়ছে, যখন মোহন খবরের কাগজে বেড়োনো রামুর ছবিটাকে হাতের আঙুল দিয়ে চেপে আদর করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে, সেই দৃশ্যটাও। আরও একটা দৃশ্য, যখন মোহন অসুস্থ অবস্থায় পাশের বালিশে হাত বুলিয়ে রামুর উপস্থিতি অনুভব করার চেষ্টা করে। এসব কোন মেল-টু-মেল বন্ধুত্বের অনুভূতি কাকা?
না না।। এতোটা পানু পানু ভাবারও দরকার নেই। আসলে মোহনের চরিত্রটা অনেকটা পতিব্রতা নারীর মতো করে ফুটে উঠেছে যেন এই পুরো সিনেমাটায়। সে রামুর উপর কায়মনোবাক্যে ভরসা করে, যেন সে তার স্বামী। আগেই তো বলেছি, গেয়িসমের সমকামের চেয়ে সমপ্রেম মোডটাই বেশী ফুটে উঠেছে এই সিনেমায়। আর মোহনের নিজের গাওয়া গানেই তো এ কথা খুব স্পষ্টই বলা আছে। “খরা হ্যায় দর্দকা রিশ্তা, তো ফির জুদায়ি ক্যা? জুদা তো হোতে হ্যায় উও হোঁঠ জিনকি চাহমে হ্যায়।” হ্যাঁ, এদের দুজনের চরিত্রটা খানিক পবিত্র প্রেমিকদের মতো। হয়তো কিছুটা প্লেটোনিক। কিন্তু কিছু দৃশ্যে যে গৌণ শরীরী আদানপ্রদানগুলোর কথা আগে বললাম, সেগুলোও কিন্তু চোখে পড়ার মতো।
কথা বলতে বলতে উঠে এলো গানের প্রসঙ্গ। “দোস্তি” ছবিটা যে গে ছবি, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ এই ছবির গান। যেকোন মানুষকে, যে সিনেমাটার সম্পর্কে জানেনা তাকে “চাহুংগা ম্যায় তুঝে সাঁঝ সওয়েরে” বা “মেরা তো যো ভি কদম হ্যায়” গানগুলি শুনিয়ে জিজ্ঞেস করুন দেখি যে তার কি মনে হয়। গানগুলোতে “দোস্ত” কথাটার উল্লেখ থাকলেও, যে কেউ বলে দেবে এটা বিরহের গান। আর এ বিরহ প্রেমেরই। আর কিছুর হতেই পারেনা। এমনই সেই গানের আর্তি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মজরুহ সুলতানপুরীর লেখায় এই ছবিতেই খাতা খোলেন ভারতীয় সিনেমার অন্যতম সুরকার জুটি “লকষমীকান্ত-পিয়ারেলাল”। মোহনের গলায় যেমন গান গেয়েছেন ভীষ্মলোচন শর্মা থুকু মহম্মদ রফি, ঠিক তেমনি রামুর মাউথ-অর্গ্যানগুলো কিন্তু স্বয়ং আর-ডি-বর্মনের বাজানো। ব্যাকগ্রাউন্ডের হার্মোনিকা(মাউথ-অর্গ্যানের আরেক নাম) বাজিয়েছেন আবার ডাকসাইটে হার্মোনিকাবাজ মিলন গুপ্ত।
যাক“গে”। আবার “দোস্তি”র গানে ফিরে আসি। এই গানগুলোয় কয়েকটা জিনিষ খুব ভালোভাবে দেখা যেতে পারে।

১) মোহন গান করে। রামু “হার্মোনিকা” বাজায়। হার্মোনিকা কিন্তু অনেকদিনই ভারতীয় সংগীতে বেশ মেল ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবেই পরিচিত। তবে এই ভাগটা উপন্যাসেও ছিলো। যেটা ছিলোনা সেটা বলি। এখানে খুব আবছাভাবে গানকে মোহন আর হার্মোনিকাকে রামু হিসেবে দেখানো হয়েছে। খুব ভালো করে খেয়াল করলে চোখে পরে, থুকু, আই মিন কানে ধরা পরে। “চাহুংগা ম্যায় তুঝে” গানটা মোহন গাইছে রামুর বিরহে। এই গানে কিন্তু ব্যাকগ্রাউন্ডেও কোথাও হার্মোনিকার ব্যাবহার নেই। “লকষমীকান্ত-পিয়ারেলাল” যে কীভাবে এই ছোট জায়গাগুলোকেও ধরে রেখেছিলেন ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। কিন্তু এভাবেও কিন্তু সেই হেটেরো-নরম্যাটিভ ডিভিশনটা আবারো উঠে আসে।

২) দ্বিতীয় মোহনের এক্সপ্রেশান। তার নরম ঠোঁটগুলোয় আর তার নড়াচড়ায় কেন জানিনা ক্যামেরাটা খুব বিশেষভাবে ফোকাস করা হয়েছে। তার ঠোঁট ছুয়ে যখন শব্দগুলো বেরিয়ে আসে, আমার মাথায় ঘোরে নজরুলগীতির কয়েকটা লাইন। “গানগুলি মোর আহত পাখীর সম / লুটাইয়া পড়ে তব পায়ে প্রিয়তম”। এই প্রিয়তম যে কে, এতো গুচ্ছ মাথাখাওয়ার পর আশা করি আর বলতে হবেনা। খিক খিক। বিশেষত “মেরি দোস্তি, মেরা প্যার” (লিরিক্সপে থৌরা গৌর কিজিয়েগা হুজুর) বলার সময় মোহনের ঠোঁটের অভিব্যাক্তি, যেকোন ফিমেল অ্যাক্ট্রেসের পক্ষেও দেওয়াটা হেব্বি চাপের।

৩) ২য়ে যে জিনিসটাকে ছুঁয়েই হালকা করে কাটিয়ে এসছি, এক্স্যাক্টলি সেটা। লিরিক্স। বলছি। স্রেফ শুনে যান, থুকু, পড়ে যান।
“দোনো কে হ্যায় রূপ হযার / পর মেরি সুনে যো সনসার / দোস্তি হ্যায় ভায়ি তো বহনা হ্যায় প্যার ….
পেয়ারকা হ্যায় এক হি নাম / কভি মীরা কভি ঘনশাম”
ভাবুন, মীরার সাথে রাধার নয়, কৃষ্ণের তুলনা টানা হলো। প্রেম কিন্তু এই দ্বিতীয় তুলনাতে জেন্ডার ফেন্ডার ছাড়িয়ে আরও অনেক উপরে উঠে গেলো, তাই নয় কি? আরেকটা …
“দর্দ ভি তু / চ্যায়েন ভি তু / দরস ভি তু / ন্যায়েন ভি তু” – কাউকে ঠিক কতোটা ভালোবাসলে এতোটা আত্মসমর্পণ করা যায়, ভাবতে পারছেন?

এবার আপনি গিয়ে ঐ সিনেমাটার সাথে জড়িত যেকোন কাউকে এই লেখাটা নিয়ে গিয়ে দেখান। হয়তো আমার নামে মানহানির মামলাই ঠুকে দেবে। কিন্তু একটা বন্ধুত্বর ছিমছাম সিনেমা বানাতে গিয়ে, তার মধ্যে এই এক্সট্রা জিনিশগুলো মাখিয়ে যেটা হয়েছে, তার দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে। এক, এটা বন্ধুত্বের একটা অসফল প্রকাশ। আর দুই, এটা প্রেমের এক স্তিমিত মার্জিত চিত্রায়ন। আমার কাছে কিন্তু দ্বিতীয়টার সপক্ষেই যুক্তি বেশী। আমার কাছে এটা সিক্সটি এইট পেজেসের গে কাপলের থেকেও বেশী রোম্যান্টিক, কাপুর এন্ড সন্সের ফাওয়াদ খানের চরিত্রের চেয়েও বেশী অ্যাপিলিং। আর হ্যাঁ, বন্ধুত্ব জিনিশটা নিজেই এত ভার্সেটাইল, যে এটা প্রেম কিন্তু বন্ধুত্ব না, এই কথা আমি কেন, স্বয়ং প্রেমের দেবতা এরোস এসেও বলতে পারবেননা। আর তাছাড়া গে ছবি আর অ-গে ছবির পার্থক্যটাও এবার আসতে আসতে মুছে ফেলা দরকার। আমরা মানুষরা সবাই মানুষ, আর সিনেমারা সবাই সিনেমা, এভাবে ভাবলেও কি বিশেষ কোন ক্ষতি হবে? যদি জিজ্ঞেস করেন এক্সে তাহলে আমি কেন এটা ফালতু ফালতু লিখতে বসলাম, তাহলে বলবো যে একটা ট্রান্সিশন পিরিয়ডেরও দরকার আছে, তাই।
তাই, যারা ছবিটা দেখেননি, জাস্ট শুধু সিনেমা হিসেবে দেখতে চাইলেও, দেখে ফেলুন। ক্যামেরা দুর্দান্ত। অভিনয় ফাটাফাটি। গান নিয়ে তো কোন কথাই হবেনা। গল্প অসাধারণ। যার প্রায় কিছুই আমি বলিনি। অনেক অনেক শেডস আছে ছবিটাতে। তবে, ছবিটা দেখতে দেখতে খালি এই অধমের পয়েন্টগুলো একটু মাথায় রাখবেন। দেখবেন সিনেমার জনৈকা চরিত্র, নন্দুর মায়ের মতো, কখনো না কখনো আপনিও রামু-মোহনের প্রতি বলতে বাধ্য হবেন, “ভগওয়ান করে, তুমহারি জোড়ি, ইসি তরহা বনি রহে।”

আমার জানা কিছু রিমেকঃ লালু-ভুলু (কোলকাতা), লালু-ভুলু (বাংলাদেশ) এবং হমরাহি(পাকিস্তান)

তথ্যসুত্রঃ লালু ভুলু ও বাদশা (মিত্র ও ঘোষ), এতোদিন ধরে দেখা কিছু সিনেমা যাদের কথা উল্লেখ করেছি, অন্তর্জাল, এবং আমার প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত ফাজিল মস্তিষ্ক।

ছবিস্বত্বঃ রাজশ্রী প্রোডাকশন প্রাইভেট লিমিটেড, মিত্র ও ঘোষ পাবলিকেশন

** বঙ্কু পত্রিকায় পূর্বে প্রকাশিত


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *