সেবারের পহেলাবৈশাখ! (কালবৈশাখী ২য় বর্ষ – পর্ব ১)

সেবারের পহেলাবৈশাখ!

সামীউল হাসান সামী

১৪২৩ বঙ্গাব্দ পহেলাবৈশাখের দিনে আমরাও এসেছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এরিয়া মধুর ক্যান্টিনের সামনে। এসে দেখি আরও অনেকেই এসেছে আমাদের মতো মঙ্গল শুভাযাত্রায় অংশ নিতে। গত কয়েক বছর যাবত দেশের একমাত্র ভিন্ন যৌনতার মানুষদের অধিকার নিয়ে কথা বলা রূপবাণ, বন্ধুত্ব ও বৈচিত্রার মাধ্যমে একটি শুভাযাত্রা আয়োজন করে আছে। বিভিন্ন রঙে সেজে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত নরনারী সতস্ফুর্ত ভাবে এই আয়োজনে শামিল হতে আসতো। জুলহাজ ভাইয়ের আমন্ত্রণে আমিও আসি নিয়মিত। তবে ২০১৬ ঈসায়ী বা ১৪২৩ বঙ্গাব্দের পহেলাবৈশাখটা ছিলো আমাদের জন্য একটু অন্যরকম। প্রথমে রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞা এলো সুকৌশলে আমাদের সরিয়ে দিতে। জঙ্গি আতঙ্কে মুখোশ নিষিদ্ধ করা হলো আমরা মুখোশ ছাড়াই অংশগ্রহণ করবার সিদ্ধান্ত পেলাম। কিন্তু রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পর কট্টরপন্থী ধর্মবিশ্বাসীরা আমাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আমাদের শুভাযাত্রার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রচার শুরু করেছিলো। তাদের প্রচার এমন ছিলো যে, শেষ পযর্ন্ত তারা আমাদের হামলার হুমকি ও সাধারণ জনগণকে আমাদের উপর হামলার আহবান করতে থাকে আমাদের ছবি দিয়ে দিয়ে। এটা ছিলো পহেলাবৈশাখের আগের কথা।

এতো কিছু উপেক্ষা করেই আমরা একত্রিত হয়েছিলাম সেবার পহেলাবৈশাখে। আমি একটু দেরি করে এলেও সবাইকে দেখতে পাচ্ছিলাম, এবং আমি আরও সাহস পাচ্ছিলাম। আমাদের সকলের প্রস্তুতি শেষে হঠাৎ জুলহাজ ভাই এসে আমাকে জানালো, আমরা এবার শুভাযাত্রা করতে পারছিনা। শেষ পযর্ন্ত আমাদের অনুমতি মেলেনি। পহেলাবৈশাখ উৎযাপন কমিটির আপত্তি না থাকলেও আপত্তি ছিলো প্রশাসনের। তবুও আমরা পিছপা হইনি। আলাদা শুভাযাত্রা না করে আমরা মঙ্গল শুভাযাত্রায় ঢুকে পরেছিলাম। পরামর্শটা জুলহাজ ভাই দিয়েছিলো। সেদিন তনয় ভাইকে একটু চুপচাপই মনে হচ্ছিল। আমরা আমাদের তৈরি বিভিন্ন রঙবেরঙের ঝাজরা গুলো রেখে মঙ্গল শুভাযাত্রায় ঢুকে পরি যাতে উগ্রপন্হীরা আমাদের আলাদা করতে না পারে। মঙ্গল শুভাযাত্রা শেষ হলো, জুলহাজ ভাই দ্রুত প্রস্থান করতে বললো সে এলাকা থেকে। দ্রুত চলেও এলাম। বাসায় এসে শুনলাম বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলকে সমকামীদের অধিকার বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে উগ্রপন্হীদের সহায়তায় পুলিশ আমাদের ৪ জন সহযোদ্ধাদের আটক করেছে।
সঙ্গে সঙ্গে জুলহাজ ভাইকে ফোন দিলে সে আমাকে বলল, চিন্তার কিছু নেই, তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চাকরির সুবাদে আমি ঢাকার বাইরে চলে গিয়েছিলাম। তাই জুলহাজ ভাইয়ের সঙ্গে ওটাই শেষ কথা ছিলো। ফেসবুকে টুকটাক কথা হলেও আর কথা হয়নি ফোনে।

২৫ এপ্রিল ২০১৬ ঈসায়ী, রাত ৯ টার দিকে ঢাকার এক বন্ধুর ফোন কলে জানতে পারলাম উগ্রপন্হী জঙ্গিদের হামলায় নিজ বাসায় জুলহাজ- তনয় ভাই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছেন। সেই রাতেই ছুটে এসেছিল ধানমন্ডির সেই চেনা লেকসার্কাসের বাসায়। প্রতিবারের মতো সেবার শান্ত বাসা মনে হয়নি। জুলহাজ ভাইয়ের প্রিয় সেই বিড়ালটির মিউ মিউ ডাকও শুনতে পাইনি। অনেক গুলো অচেনা আতঙ্কিত মুখ দেখেছিলাম। আমি ফিরে এলাম। সেদিন আর কথা হয়নি জুলহাজ তনয় ভাইদের সঙ্গে। আর কখনো কথা হবেনা সেই বিশ্বাস নিয়েই সেদিন আমাকে ফিরতে হয়েছিলো।
সেই বেদনাদায়ক দিনগুলো ছিলো আতঙ্কেরও, বিভিন্ন হুমকি, ধামকি। তবুও কথা বলে গিয়েছি যতোটা সম্ভব। ভয় ছিলো এই বুঝি চাপাতির এক কোপে আলাদা হয়ে যাবে মাথা। অফিসের গেইটে, বাসার গেইটে দারোয়ান সাহেবদের বলে রাখতে হয়েছে, অপরিচিত কেউ দেখা করতে এলে বলবেন আমি বাসায় নিই।

আজও পহেলাবৈশাখ আসে, তবে আমি আসিনা ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের চারুকলায়, আসিনা মঙ্গল শুভাযাত্রায়। কারণ এখন আর ফোন করে জুলহাজ ভাই জিজ্ঞেস করেনা কি রঙের পাঞ্জাবি / শার্ট পরবো।

ভালো থেকো জুলহাজ ভাই, ভালো থেকো তনয় ভাই। পহেলাবৈশাখ নিয়ে আসুক প্রতিটি মানুষের অনাবিল সুখ শান্তি ও ভালোবাসার অধিকার।

জয় হোক বন্ধুত্ব ও বৈচিত্রতার।

[ছবিস্বত্বঃ রূপবান]


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *