ঐতিহাসিক জয় — ৩৭৭ পালটে দিলো সুপ্রিমকোর্ট — স্বেচ্ছায় দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যৌনতা অপরাধ নয়

ঐতিহাসিক জয় — ৩৭৭ পালটে দিলো সুপ্রিমকোর্ট — স্বেচ্ছায় দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যৌনতা অপরাধ নয়

— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন / নিজস্ব সংবাদদাতা

“এই মানুষগুলির কাছে ইতিহাসের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।” — সুপ্রিমকোর্ট

এইতো সেদিন, ২০১৩ সালের ৩০শে ডিসেম্বর, প্রায় ১৫০ বছরেরও পুরনো ধারা ৩৭৭ কে বহাল তবীয়তে ফিরিয়ে আনলো সুপ্রিমকোর্ট, দু’জন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষ সমলিঙ্গে স্বেচ্ছায় যৌনাচারে লিপ্ত হলে তাদেরকে অপরাধী বলা হবে, জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করা যাবে, আর সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

তারপর ৪ বছর ৮ মাস ৭ দিন, সেই আগের রায় ভুল ছিলো তাই কার্যত মেনে নিলো তারা। ২০১৩ সালের সেই বিচারকে কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না, স্পষ্টত জানিয়ে দিলো সেই সুপ্রিমকোর্ট নিজেই। পাঁচজন বিচারক জুলাই মাসে শুনেছিলেন ৩৭৭ এর কিউরেটিভ পিটিশন, আর তারা এক বাক্যে স্বীকার করলেন, সমকামিতা মানুষের স্বাভাবিক আর প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি। আর লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক (এলজিবিটি+) মানুষদেরও, বাকি সমস্ত নাগরিকদের মতো মৌলিক অধিকার রয়েছে।

রায় ঘোষনা করলো তারা, আজ থেকে, ভারতীয় আইনে, ৩৭৭ ধারায় দুজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের মধ্যেকার পরস্পর সম্মতিক্রমে শারীরিক যৌনতা আর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবেনা।

ঐতিহাসিক এক আনন্দের মুহূর্তে ফেটে পড়লেন ভারতের আপামর এল-জি-বি-টি+ জনগণ। আনন্দেরই তো মুহূর্ত। কতো লাঞ্ছনা, কতো টানাপোড়েন, অনেকটা রাস্তা হাঁটা — এর পড়ে এই প্রাপ্তির মুহূর্তটুকু উপভোগ তো করতেই হয়। সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় আরো জানিয়ে দিলেন সরকারের তরফে বিশেষ নজর দিতে হবে যাতে লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের প্রতি কোন অনাচার না হয়। একধাপ এগিয়ে কোর্ট আরো বলে, যে এই মানুষগুলির কাছে ইতিহাসের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ।

আজ ভারতের আইনে এই রদবদল কিন্তু রাস্তা খুলে দিলো পাকিস্তান, বাংলাদেশ ইত্যাদি রাষ্ট্রের বন্ধুদের কাছেও।

প্রাক-ব্রিটিশ এই উপনিবেশগুলির আইনি খাতায় ৩৭৭ এখনও বহাল, তাদের উপরে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি এখন আরো অনেকটা সহজ হবে বলেই মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল।

শুরুতে যখন সুপ্রিমকোর্ট বলেছিলো যে তারা কিউরেটিভ পিটিশন শুনবে, অথচ ব্যক্তিগত পছন্দে সঙ্গী খুঁজে নেওয়া, বা ব্যক্তিগত পরিসরের অধিকার নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলি আশা বাকি ছিলো, তখনো এটুকুই ভেবেছিলাম যে শুধুমাত্র “মায়ের কাছে মাসির গপ্পো” ছাড়া আর কিছু হবে কি? কিন্তু এই রায়দুটি সত্যিই আশার আলো দেখিয়েছিলো। আর সাথে নালসাও ছিলো। জুলাই মাসে শুনানির পুংখানুপুংখ খবর রাখতে রাখতে আকাশ আরো পরিষ্কার। আর আজ তো সত্যিই একটা বিশেষ প্রাপ্তির দিন। এই নিয়ে কথা বলতে গেলে অনেক কিছু বলা যায়, অনেক পুরনো কথা, নিজের, বন্ধুদের, আজকের কিছু হাসিকান্না। এটুকুই বলবো, আমার দেশের আইনের চোখে আমি অপরাধী নই, এই ভাবনাটা একটা প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে। খুব বড়ো মাপের। কিন্তু সমানাধিকারের লক্ষে এই রায় কিন্তু একটি ধাপ। একদিকে আজকের এই রায়, আর নালসা, এই দুইকে হাতিয়ার করে আরো অনেকটা লড়াই বাকি।

ভবিষ্যৎ কতোটা এই ইতিহাসকে মনে রাখবে জানিনা, কিন্তু এই ইতিহাসকে আজ আমরা যে কতোটা উপভোগ করলাম, তা বলার নয়।

আমার চেয়ে প্রবীণ যারা, তাদের টানাপোড়েন অনেক বেশী, তারা হয়তো আরো বেশী উচ্ছসিত। গোটা দেশে “সুপ্রিমকোর্ট” বলে একটা জায়গা আছে, যেখানে এখনো নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার নিয়ে কথা বলা যায়, সঠিক সমাধান পাওয়া যায়, কিছুটা দেরী করে হলেও, এই বিশ্বাসটুকু আরো দৃঢ় হলো৷

প্রসঙ্গত ৩৭৭ ধারাকে সম্পূর্ণ বাতিল করা হয়নি, পশুকামিতা, অথবা সমলিঙ্গে শিশুকামিতার মতো বৈজ্ঞানিক অজাচারগুলি কিন্তু এর পরেও ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী একইরকম শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বহাল রইলো। এবং একসাথে সহবাস, বিয়ে, সন্তান-দত্তক ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ মন্তব্য কোর্টের তরফে পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখনই সবাই কোমর বেঁধে রয়েছে আরো বাকি অধিকারগুলিও আদায় করার জন্যে, এবং অবশ্যই আইনি পদ্ধতিতে। সমাজ, সেও কি এতো সহজে মেনে নেবে?

সময়টা আনন্দের, কিন্তু পথ চলা বাকি। আজ আর লিখবোনা বেশী, আমার নিজেকেও তো কিছুটা নিজের সাথে আনন্দ করতে হবে তো, না কি?

ছবি-সূত্রঃ উইকিপিডিয়া (ক্রিয়েটিভ কমন লাইসেন্স)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *