কাঁচালঙ্কা

স্বাধীন বাংলায় পরাধীন সমকামীরা

[শুরুর আগেঃ

লেখক ফেসবুকে বাংলাদেশের এলজিবিটি+ মানুষদের নিয়ে লেখালেখি করেন ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। নতুন কিছু উদ্যোগ অনেকেরই নজর কেড়েছে ইতিমধ্যে। সুরক্ষার খাতিরে পেজের নাম বলবো কি বলবো না, এই ভেবে নাম আর বলছিইনা আপাতত। তবে জুলহাজ হত্যার পরে পরে, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলজিবিটি মানুষ যখন আন্ডারগ্রাউন্ড, তখনো দেশে থেকে সামিউল কিন্তু চালিয়ে গেছে তার অকুতোভয় সংগ্রাম, তার কলমের মাধ্যমে। কাঁচালঙ্কার জন্মলগ্ন থেকেই বন্ধু ও সহযোদ্ধা সামিউলকে আমার বিশেষ আর কিছুই বলার নেই। আশা করি চিরটাকাল আমরা সবাই নিজেদের মতো করে, কখনো ছোট। কখনো বা বড়ো উদ্যোগগুলির মাধ্যমে, বাংলাভাষাভাষী মানুষদের সমাজ-অস্বীকৃত যৌনতা আর লিঙ্গচেতনার অধিকারকে ভাষা দিয়ে যেতে পারবো। সমতার পথ এখনও এনেকটা দূর। বিঃদ্রঃ লেখকের নাম, ছদ্মনামে।]

 

স্বাধীন বাংলায় পরাধীন সমকামীরা

সামীউল হাসান সামী 

 

১৯৭২ সালের সংবিধানে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সকল নাগরিকের জন্য আইন, মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা, ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার যে বৈষম্যহীন ও ন্যয়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল তা এখনো অর্জিত হয়নি। স্বাধীন বাংলায় ক্রমাগত যুদ্ধ করে চলেছে ভালোবাসার স্বাধীনতার জন্য সমকামীরা। ভোটের রাজনীতিতে মানুষের মৌলিক অধিকার, স্বাধীনতা মূল্যহীন। তাইতো কোন সরকারই সমকামীদের মানবিকতা নিয়ে মাথা ঘামায় না। সমকামীদের নিয়ে কথা বলতেও এরা বিব্রত হয়। কিন্তু, সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে অনুযায়ী রাষ্ট্র সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে বাধ্য এবং ২৬(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে অসমঞ্জস সকল প্রচলিত আইন আপনা আপনি বাতিল বলে গন্য হবে। একই সাথে,২৬(২)অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্র সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সাথে অসমঞ্জস কোন আইন প্রণয়ন করবে না এবং অনুরূপ কোন আইন প্রণীত হলে তা বাতিল হয়ে যাবে। তাছাড়া,২৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী বলে ঘোষনা করেছে। সংখ্যা গরিষ্ঠরা কখনোই আইন কানুনের তোয়াক্কা করেনা। বিপরীতকামীরা সংখ্যায় বেশি হওয়ায় সমকামীরা স্বাধীন বাংলায় পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী। স্বাধীন বাংলায় সমকামীরা অস্তিত্ব সংকটে। বাংলাদেশে সমকামীদের মৌলিক অধিকার মানে, নিজেকে লুকিয়ে রেখে বেচেঁ থাকা। এদেশের রক্ষনশীল সমাজব্যবস্থায় কোন ছেলে বা মেয়ের ভিন্ন যৌনতার কথা প্রকাশ হওয়া মানে, সকল প্রকার মৌলিক অধিকার হতে বঞ্চিত হওয়া। নিজে মৃত্যুর পথ বেছে নেয়া, নয়তো অন্যের হাতে মৃত্যু বরন করা। বাংলাদেশে সমকামীদের হত্যা করা হলে, সরকার বিচারে বিভিন্ন তদন্তের অযুহাতে ধীরগতি নিয়ে আশে, যা হত্যাকারীদের উৎসাহিত করে। বাংলাদেশের শিক্ষিত সুশিল সমাজ নামে পরিচিত বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের বুদ্ধি বিক্রি করেছেন বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে, তাই এরা এমন কোন মৌলিক অধিকার, নাগরিক অধিকার অথবা মানবাধিকার নিয়ে মুখ খুলে না, যাতে সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো বিব্রত হয়। এরা কখনোই সমকামীদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি সামাজিকতার রক্ত চক্ষুর ভয়ে। যারাও কথা বলতে চেয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদিরা তাদের চুপ করিয়েছে বিভিন্ন হুমকিতে। বাংলাদেশে সমকামীদের একমাত্র পত্রিকা রূপবানের সম্পাদক ছিলেন জুলহাস মান্নান। ২৫শে এপ্রিল-২০১৫ তাকে ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয় কে কলাবাগানের বাসায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। কিন্তু আজও পর্যন্ত তাদের সেই নির্মম হত্যা মামলার তদন্ত রিপোর্ট সরকার উপস্থাপন করতে পারেনি। ১৯ মে ২০১৭ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে রাতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে ২৮ জন সমকামীকে আটক করা হয়েছিল। এবং তাদের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা আনা হয়েছিল। যদিও আমাদের দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চাহিদা মতো ঘুষ আদায় করতে না পারলে হয়রানির জন্য যে কাউকেই মাদকের মামলায় জরিয়ে দেন। বাংলাদেশে সমকামীদের আটকের ঘটনা এই প্রথম নয়৷ ২০১৬’র পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের দিন ‘রংধনু’ র‌্যালী বের করার চেষ্টাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা এলাকা থেকে ৪ জন সমকামীকে আটক করে পুলিশ৷ তারা তখন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলকে এলজিবিটি আন্দোলনের পক্ষে তাদের মতামত দিচ্ছিলেন৷ এমনই পরিস্থিতিতে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বেচে আছে স্বাধীন বাংলার পরাধীন সমকামীরা। এতো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কিছু NGO কিছু আইনি সংস্থা সমকামীদের সাস্থ্য ও আইনি সহায়তা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাক্তি পর্যায়ে কিছু ব্যাক্তির চেষ্টায় সচেতনতা সৃষ্টিতে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমত সৃষ্টির কাজ চলছে। যা প্রয়োজনে তুলনায় খুবই কম। তবে বাংলাদেশের সমকামী জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার আদায়ে আশাবাদী। জুলহাজ, তনয়ের মৃত্যুতে তারা মৃত্যু ভয় কাটিয়েছে। তারা বুঝতে শিখেছে কোন স্বাধীনতাই বিনা রক্তপাতে অর্জিত হয়নি। তাই বাংলাদেশের সমকামীরা আমৃত্যু লড়ে যাবে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।

[ছবিঃ ভুটান]


 

Exit mobile version