ফুল ছড়ানোর পালা
— দেবাদৃতা বোস
[শুরুর আগেঃ আজ আন্তর্জাতিক নারীদিবসে কাঁচালঙ্কার নিবেদন বন্ধু দেবাদৃতার লেখা গল্প “ফুল ছড়ানোর পালা”। অনেক ধন্যবাদ রে লেখাটা আমাদের পাঠানোর জন্যে। আজকের চারপাশের আন্দোলনের স্লোগানগুলির ভিড়ে তোর সমপ্রেমের আবেদনটুকুও মিশে যাক। মিশে থাক নারীদের স্বাধীন জীবনযাপন আর যৌনপছন্দের অধিকারের ভাষারা।]
— ১ —
আঁখি চা ছাঁকছিল। টুং শব্দ। কানে যেতেই খানিকটা চা কাপের বাইরে পরে গেলো হাত কেঁপে। রান্নাঘর থেকে এক দৌড়ে কম্পিউটারের সামনে। জি মেইলটা খোলা ছিল। একটা মেইল টাইপ করতে করতে ও উঠে যায় চা করতে। কেউ একজন পিং করায় ওই শব্দ। পিং টা কে করেছে ভালো করে দেখলও না, লগ আউট করে অফ করে দিল কম্পিউটার।
টুং শব্দে হাতের সমস্ত কাজ ফেলে কম্পিউটারের সামনে ছুটে আসাটা নতুন কিছু না। তখন সারাদিন জি টক খোলা থাকত। বাড়ির বাইরে গেলেও ফোনে। ঠিক এক বছর হল অভ্যাসে ঘাটতি হচ্চে। প্রথম প্রথম কান খাড়া থাকত, কখন ওই শব্দ। এক একটা গোটা সন্ধে, গোটা রাত কেটেছে চিৎ হয়ে শুয়ে ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে। কখন টুং শব্দ? আঁখি ভাবত কানগুলো হয়ত একসময় বিড়ালের মত হয়ে যাবে। ইনহেরিটেন্স অফ অ্যাকয়ার্ড ক্যারেক্টার্স। বন্ধ কম্পিউটারের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে থাকতে এক সময় চোখ বন্ধ করে নিলো ও। আবার খুলে মুখ ফিরিয়ে পাশে কাঠের শো কেসের মাথায় রাখা গাছটার দিকে তাকাল। এক জোড়া কিনেছিল। নিজেরটা প্রায় শুকিয়ে এসেছে। জল দেওয়া হয় না । অন্যটার খবর জানা নেই।
— ২ —
— মেট্রো স্টেশান থেকে বেড়িয়ে সামনেই দেখলাম ফুটপাথের ওপর একটা বুড়ো লোক বসে লাল গোলাপ বিক্রি করছে। ভাবলাম একখান নিয়ে যাই। তারপর মনে হল, থাক বাবা, কী না কী ভাববে। পরে যখন বারে বসে রাম খাচ্ছি, তখন মেয়েটি নিজেও বলল ওরও নাকি আমার জন্য গোলাপ কিনতে ইচ্ছা হয়েছিল, আমি কী ভাবব, তাই কেনে নি।
— চুমু খেলি?
— হুম
— বাব্বা! প্রথম দিনেই এত। কে আগে খেলো?
— নেশার ঘোরে। ট্যাক্সিতে। এক সাথেই খেয়েছিলাম। জানিস, একটা গোটা সন্ধে যেন একটা আস্ত স্বপ্ন। আমরা আর কলকাতা একটা ট্যাক্সিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি হাত ধরে। হাত ধরাটাও এক সাথে। কোনও প্রি প্ল্যান ছাড়াই। বারের ভেতর এত আলো, এত লোক, আর আমি ভাবছি নিজেকে সামলাতে হবে, কিছুতেই চোখ সরাতে পারছিনা ওই চোখদুটো থেকে। I must never fall for those eyes.
— ৩ —
— Don’t fall
— From?
— In
— In?
— Don’t fall in love
আমার পাশে শুয়ে ভুরূতে আঙুল বোলাচ্ছে সে। আর প্রতি মুহূর্তে আরও নিঃস্ব হয়ে উঠছি। এই মুহূর্তগুলো। এভাবে উষ্ণতা, এরকম কথা… এর আগে কি কখনো কেউ। নাহ, শুধু ওই চোখ আর ওই হাসি। যেন একটা গোটা পৃথিবীর ঋতুবদল। আর সেই আলোর বলয়ের ভেতর আমাদের দুজনকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না। বাকি পৃথিবী তার রঙ গন্ধ সব হারিয়েছে। উঠে বসলাম,
— শোনো, তোমাকে কয়েকটা কথা বলার আছে।
— সে তো কবে থেকেই বলবে বলছ।
— বলব।
আবার শুয়ে পরি । ও আগের অবস্থায়, আঙুল ভুরূতে। ওভাবেই কত সময়, কত দুপুর কেটে যায় কেউ বুঝতে পারে না। আমি নিজের বুকের ওপর ওর শরীরটা আঁকড়ে ধরে থাকি, মাথাটা পেছনে এলিয়ে দিয়ে।
— শোনো
— হুম
— তোমার গলার এই জায়গাটা গাছের মত।
— উম
— আমাকে এই গাছটার ছবি তুলতে দেবে?
— ‘আর এই গাছটা? মানুষ কই। গোটাটাই তো গাছ। কতরকমের গাছ।‘ ঘাড়ে নাক ঘষে আবার বলে, ‘ছাতিম গাছের গন্ধ। আমি কি এভাবেই পাগল হয়ে যাব একদিন?’।
সে হাসে
— ‘বেশ। আমি ফুল ছড়াই। তোমার কুড়নোর হলে কুড়িয়ে নিয়ো।
— ৪ —
টুং।
— Hello
— হেলো, হেলো, কী অবস্থা?
— তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে
— ওলা
— মানে?
— ওলা ক্যাব
— এখন? রাত সাড়ে ১২ টা।
— তাতে কী?
— তোমাকে প্রতি দু দিন পর পর দেখতে ইচ্ছা করে কেন বলত?
— দু-দিন! প্রতিদিন? প্রতি ঘণ্টা? প্রতি সেকেন্ড?
— না বাবা। অত ভালো না।
— ক’ পেগ?
— 😊 এই তিন নম্বর নেব। তুমি?
— এই উঠবো। নেব।
— যাও, অপেক্ষা করছি।
— হুম
— ……
— নিলাম।
— চিয়ার্স।
— 😊 চিয়ার্স।
— ৫ —
প্রিয় ছাতিম গাছ
তুমি জানতে চেয়েছিলে একবার, চিঠি লিখি কিনা। লিখছি।
ভুল বলেছিলাম তখন… ঝড় না, অনেকদিন ঝড়ের পর সবকিছু যেমন শান্ত, শান্তি হয়ে ওঠে এখানকার আবহাওয়া তেমন। শুধু যেখানেই জল, সেখানেই অল্প তরঙ্গ, তাই তো জল খুঁজে বেড়াচ্ছি কয়েকদিন ধরে।
আর এ কি ব্যাবহার তরঙ্গগুলোর! ওই সব অল্প অল্প আয়তন এবং গতি নিয়ে সব ভাসাতে চায়।
তবুও তার গতির ভেতর থেকে স্থিতি খোঁজার চেষ্টা করি, আর পাখির ডানার উষ্ণতা। তাতেই হবে আমার। আর কিচ্ছু চাই না।
আর দুদিন পর শীত শেষ হবে, তারপর ঘুমিয়ে থাকব কয়েকদিন, একদম নির্ভেজাল ঘুম। পুরনো হিন্দি গান শুনছি কদিন আর সরে যাচ্ছি সমস্ত সজ্ঞাবহ বস্তুর থেকে।
অনেক বড় করে নিঃশ্বাস নেওয়া অভ্যাস করছি।
তুমি এলে ঢেউ নিয়ে কথা বলব, কেমন?
— ৬ —
গরম পড়ছে। হঠাৎ বলেই ফেললাম
তুমি বারবার বলেছিলে না, don’t fall, আর আমি, জাস্ট গুছিয়ে ছড়িয়েছি।
ও উঠে বসে। আমি এবার হেসে ফেলি, পরিবেশটা সহজ করার জন্যই হয়ত।
— এই, উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই।
— কিন্তু আমি যে আগেই বলেছি, জড়াতে পারবো না।
— জড়াবে কেন?
— একটা কথা বলবে?
— বল
— ৭ —
তুমি বলেছিলে আমরা দুজন লম্বা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাব। কালো কোল্ড ড্রিংকে মিশিয়ে। যাওয়ার পথে একে একে সমস্ত গাছ হয়ে উঠবো আমরা। আমি কিন্তু আকন্দ নই, সে তুমি যাই বল। আমার ওই কাঠ গোলাপ হতে বেশ ইচ্ছা করে। আর তুমি, তুমি হলে জোড় সঙ্খ্যার পাতার গাছ, জাভা অলিভ।
আমার বারান্দায় আজকাল একটা ছোট্ট পাখি বসে থাকে। তোমার জন্যই। যেদিন ও বুঝতে পারবে যে তুমি ওকে আর দেখতে আসবেনা, সেদিন ও উড়ে যাবে ঠিক। আর আমিও হয়েছি তেমন, খালি অপেক্ষা, শুধু অপেক্ষা। এতগুলো মাস যে একরকম ভাবে বেঁচে ফেললাম তার কী হবে? আমাদের ক্যালেন্ডারে যে শুধুই শীত রয়ে গেলো, তার কী হবে? আমি তো ঠিক বুঝতেই পারলাম না, কখন তুমি নাম না জানা গাছ হয়ে গেছো আর গোটা বসন্ত জুড়ে আমি তুমি ভেবে ভেবে কাঁঠাল গাছের পাতায় পাতায় নাচের মুদ্রা খুঁজে বেড়াচ্ছি। ক্লান্ত হচ্ছি। গাছে জল দেওয়া হয় না জানো।
— ৮ —
আবার কম্পিউটার অন করে আঁখি। এ এক অদ্ভুত সমাপতন। কালকেই দেখেছিল তাকে, দূর থেকে, রাস্তার এপার আর ওপার। কিছুই চাহিদা নেই, সেভাবে ছিল না। শুধু একটু পাশেই থাকুক। দূর থেকেও ভালোবাসা যায়। তাও কাছে থাকার বা রাখার ইচ্ছাগুলো জুড়ে জুড়ে আমরা বেঁচে থাকি। কেউ দূরে সরে গেলে তাকে দেখা যায় এদিক ওদিক, কিন্তু কিছু আর বলা হয়ে ওঠেনা। হবে না। সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলো সজাগ হয়ে থাকবে, থেকে যাবে শুধু টের পাওয়াগুলো। আঁখি এটাই বুঝে উঠতে পারলনা এই টের পাওয়াগুলো শুধু একমুখী কিনা।
চেয়ার ছেড়ে সে উঠে দাঁড়ায়। জলের বোতল থেকে সরাসরি কাঠের শো কেসের ওপর রাখা শুকিয়ে যাওয়া গাছটায় অনেকটা জল ঢেলে দেয়।
[ছবিঃ ভুটান]
[** লেখাটি বঙ্কু পত্রিকার উৎসব ২০১৭ সংখ্যায় পূর্বপ্রকাশিত ]