অ আ ক খ
– সুমন
(১)
বেল্টের রং লাল। ঠিকঠাক লাল নয়, চামড়ার রঙও নয়। হুকের অংশগুলোতে জং ছোবল বসিয়েছে। আমার কোমরে বেল্ট বাঁধা নেই। চারপকেটের ঢোলা প্যান্ট। কুঁচকিতে ঘা, তাই জাঙ্গিয়া পরছিনা ইদানীং। এই তো মুখ ফস্কে জাঙ্গিয়া বেরিয়ে গেল! আমার এই ব্যাক্তিগত পরিসরেও তো উচিত সুশীল সামাজিক সভ্য হওয়া! তেমনটাই দস্তুর। আন্ডারগার্মেন্ট শব্দটা অত কুৎসিত গন্ধ ছাড়ে না। জাঙ্গিয়া মিলারের শব্দ। আন্ডারগার্মেন্ট ট্রাম্পের আত্মজীবনীর অংশ। আমি মিলার পড়েছি খানিক। আমি আজকাল জাঙ্গিয়া পরছিনা।
লাল বেল্ট একটু আগে হেঁটে পেচ্ছাপ করতে গেল। আধা-হেঁটে, আধা-বেঁকেবুকে। পাছায় লেগেছে। ঐ গর্ত যেটা আছে ওখানে, রহস্য আনে। শতবছরের কর্দমাক্ত ইতিহাস জানে ঐ অন্ধকার। ওখানে জমাট বাঁধে ধূসর বীর্যেরা। লাল বেল্ট যখন আধা-হেঁটে আধা-বেঁকেবুকে কোনও জামা গায়ে না চড়িয়ে পেচ্ছাপ করতে গেল – ধরে নিচ্ছি পেচ্ছাপ করতে, আদতে তা নয়, গর্ত ধোবে, শরীরটাও ধোবে; চারপকেটের মালিক আর লাল বেল্টের কোনও মায়ার যোগাযোগ নেই, ঐ একটু ফেসবুক, ঐ একটু কথাবার্তা, ঐ একটু ছবি দেওয়া-নেওয়া, ঐ একটু দেখে-টেখে ইচ্ছে হল, চল দীঘা। এই যে দিন-ছয়েকের পরিচয়ে বেমক্কা দীঘা এল, খরচা সব আমার, কেননা আমার একটা লাল-বেল্টের সঙ্গ আবশ্যক হয়ে পড়েছে যাপনে। আমি লাল বেল্টের ইতিহাস-ভূগোল জানিনা, জানার তেমন আগ্রহ নেই, নামটাও মনে পড়ছেনা, জেনে তেমন লাভ নেই বিশেষ – এরা সিউডো-মানুষ। বিছানায় জটলা পাকিয়ে থাকা জিন্সের প্যান্ট, তাতে লালবেল্ট জড়ানো। আর একটা ফুরফুরে নেভি-ব্লু গেঞ্জি এলিয়ে। কন্ডোমের সুবেশী খাপ সোফার পাশে, মেঝেয়। কুঁচকির ঘায়ে একটু আগে ঘষা লেগেছে নির্ঘাত, চুলকোচ্ছে।
অথচ এইসব শরীর খাওয়া-খায়ি কলকাতাতেও করা যেত। আমরা যারা একটু বেশি ভদ্রতা, উচ্চবিত্ততার মুখোশ লটকাই মুখে, তাদের জন্য কলকাতার দু’খানা হাত খোলা সবসময়। পয়সা ঝড়ছে, সুযোগ ঝড়ছে। অশোক রোডের তিনকামরার বাক্সবন্দী ফ্ল্যাটে মা কোথায় পড়ে থাকে টের তেমন পাইনা। অফিস থেকে খুব সহজে বাড়ি আসা হয়না, ব্যস্ততা থাকে কখনও, কখনও অলীক-ব্যাস্ততা বানিয়ে নিই। স্কুল-কলেজের শিল্পীসুলভ বন্ধুদের জগতটা অনেক চওড়া। আমি একটু সাহিত্য-সিনেমা কপচাই বলে ওরা আর ওদের চওড়া জগৎ আমায় খুব প্রাধান্য দেয়। প্রাধান্য পেতে মন্দ লাগেনা। একটু মাতিসের ধোয়া ছাড়লেই অরিন্দম-বিপাশার মত ইলাস্ট্রেটর-কভার আর্টিস্ট ছোকরা-ছুকরিরা আমায় স্রোতে টেনে নেয়। একটু ঋত্বিক আর পাসোলিনি গুলে কোনও লেখা ফেসবুকে নিজস্ব ওয়ালে ছাড়লে ফ্রেন্ডলিস্টের ভার বৃদ্ধি পায় অনায়াসে। বিকেলগুলো আমার অর্থহীন কাটেনা কোনওদিন। কলেজস্ট্রীটের নান্দনিক এলাকাগুলোতে গেলে-টেলে কোনও-না-কোনও দলের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যায়ই। অথচ, প্রায় সকলের সামনেই আমায় মিলারের পাশাপাশি ট্রাম্পের আত্মজীবনীকেও রাশভারী মার্কস দিতে হয়। তাই ওদের কাছাকাছি থাকলে আমায় আন্ডারগার্মেন্ট-সুলভ গ্লোরিয়াস শব্দ ওগড়াতে হয়ই। তিনকামরার ফ্ল্যাটের কোন কোনায় মা লুকিয়ে থাকে, বুঝতে পারিনা। রাতের খাবারটা টেবিলে দিতে আসে যখন, তখন হয়ত আমি মোবাইলে, নয়ত ল্যাপটপে। ওপাশে কোনও লাল-নীল বেল্ট, আর নয়ত এলিট-চর্চাকারী মানুষেরা। লাল-নীল বেল্টদের খবর এলিট-চর্চাকারীরা রাখেনা। সামগ্রিক মানুষ হিসেবে আমি এলজিবিটিআইকিউ মুভমেন্টের সাপোর্টার। নান্দনিক বান্ধবেরাও তাদের কাগজে, ওয়ালে লেখালেখি করে এ নিয়ে, কিন্তু এই খোদ আমি ব্যক্তিত্বটি ক্লাস হারাতে চায়না। সামগ্রিক মানুষের জয়জয়কার – সামগ্রিক সমকামীদের উত্তরাধুনিক এই শহরও রেয়াত করেনা।
ল্যাপটপ খুলি। স্ক্রিন জুড়ে ‘অটোম্যাট’। এডোয়ার্ড হপারের আঁকা, সাতাশের। একাকীত্ব পর্যবেক্ষণ করি অপলক। কুঁচকির চুলকানি ভুলে যাই।
(২)
রাত নামলে শোর বাড়ে। চত্বর জুড়ে বিকিকিনি, তটে খুশিয়ালি ছোপ। লাল বেল্ট সঙ্গে সঙ্গে হাঁটে। কখনও হাত ধরে, ছাড়িয়ে নিই। ঝিনুকের ব্রেসলেট কেনে, চিনির সিরায় জড়ানো নারকেল কেনে। প্যাকেট ছিঁড়ে খেতে থাকে। বলে কিছু। কানে আসেনা। বাঙালী হোটেলগুলোতে হাঁকডাক শোনা যায়। একটা ভ্রান্ত গোরু নির্বাক চোখে রুমালী রুটির হাওয়ায় ভাসা দ্যাখে, শিক কাবাবের কালশিটে রং প্রত্যক্ষ করে। খাট্টামিঠা বিক্রি করা লোকটাকে এই সন্ধ্যেবেলায় মোমোর দোকানে দেখা যায়। অগোছালো মোমোর দোকান, লাল বেল্টের মোমো দেখে খিদে পেয়ে যায়। চল্লিশ খরচা করে মোমো গেলে। একপাল ফ্যামিলি যায়, খিলখিল হোহো। এক দঙ্গল ছেলে যায় স্যান্ডো গায়ে। বুকের অন্ধকারে রহস্য লুকিয়ে। হাফপ্যান্টের আধাফোলা ভাব অবচেতনে ছাপ ফেলে। সাদের কথা মনে পড়ে।
আন্তর্জালে বছর দেড়েকের যোগাযোগ। ডুবসাঁতার দিয়েই যেন বা কাছাকাছি এসেছিল। বা ছিলাম। তাগিদটা শুরুতে আমার ছিলনা ততোটা। আনকোরা ছেলে শহরের, ছবি দেখিনি; ফেক অ্যাকাউন্ট থেকে কথা চালায়। একে বিশ্বাস করা যায়? না বোধহয়। কি জানি, সম্পর্ক তৈরিতে মোহ আছে হয়ত বা। ভালবাসার কথা আসে শরীরের কথা এলে তারপর। বলেছিল শুরুতে, থাকে শেয়ালদায়। কোথায়? -না, শেয়ালদায়। -আরে বাবা শেয়ালদার কোথায়? -না, টেমার লেনের গলিতে। -কি বলো, ওখানে যাওয়া হয় মাঝেসাঝে, বাণীশিল্প আছে তো ঐ পথে! -না, বাণীশিল্প চিনি না। -চেনো না? তোমার এলাকা, চেনোনা? আজন্ম এখানে নয়? -আজন্মই তো। -তাহলে? বাড়ি কিরকম তোমার? -শরিকি বাড়ি, ভঙ্গপ্রায়। সাদ বলেছিল, শহরের ঐ প্রাচীনত্ব ছেড়ে ও দূরে যেতে চায়। ভরসা যোগাত, খুব কথা হত। তখন অফিসে সাদ, কফিহাউসে সাদ, প্রিয়া সিনেমা হলে সাদ। টেক্সটিং। গভীরতা বাড়ল। ছবি চাইলাম। দেখাল না। -তোমার ঐ গলিতে যাব। দেখা তো করো। বলল, সেক্স, সেক্স, অনলি সেক্স। চোখ মারছে রসিক ইমোজি। বললাম, না, ওসব না। এর আগে যে’কটা এক্সপিরিয়েন্স সব বাজে, অরাজক। লাভ চাই লাভ! সাপোর্ট। উষ্ণতা। বললে, ধুর, কাটি! আর দেখা নেই দিন ছয়েক। ইমোশনাল অত্যাচার। অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে, সাড়া দিচ্ছে না। নাক উঁচু। ভাল। এতরফ থেকে মেসেজ পাঠানো বন্ধ করা হল। দিন কাটছে। ফেক প্রোফাইল অবলোকন করি। নতুন পোস্ট এল কিনা, ইত্যাদি। টেমার লেনের গলিতে ঢুকি একদিন। হাঁটতে থাকি। মেডিক্যাল বইপত্রের দোকান অব্দি যাওয়ার পর বিষন্নতা হানা দেয়। বাণীশিল্পতে উঠি সিঁড়ি ভেঙে। ক্যাটালগ নেড়ে চেড়ে ‘চার্লি দ্য কিড’ নিয়ে নিই। আইজেনস্টাইন। বিকেলের মরা আলো ভাঙা সিঁড়িতে খেলা করেনা। চারদিন পরে টুং করে মেসেজবাক্স সচল হয় হটাৎ। কেমন আছ, কোথায় আছ? রিপ্লাই পাঠাই সঙ্গে সঙ্গে। ফের সাইকেল গতিশীল হয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে এইনাউদি পিয়ানোতে সাইরেন বাজাতে থাকে। তাও সতর্কতা জারি হয়না শব্দে-অক্ষরে।
সেক্স-ম্যানিয়াক ছেলে প্রতিবেশের ভূগোল ভুলিয়ে দেয়। গোটা দিন সাদ। অথচ আমাদের দেখা হয়না। নীচের ওটার ছবি চায়। রাত বাড়লে পাগলামি বাড়ে। এটা দেখাও, ওটা দেখাও! ইমাজিনেশন বাড়ে। দেখাই। ওপাশ থেকে টেক্সট আসে। চুকচুক করে। জিভ দিয়ে জল ঝরে। বুঝতে পারি। ইমোজি ভাষা যোগায়। এলাকার ছবি পাঠায়। ঐ তো মোহিনীমোহনের স্থাপত্য! ঐ তো মহাবোধির ফুটপাথ! বাণীশিল্পের গলি! আকুলতা বাড়ে। দেখা তো করো! প্রেম করতে হবে না যাও। ওপাশ থেকে ‘হাহা’ টেক্সট এদিকে আসে। বলি, ভালোবাসো? বলে, হ্যাঁ, খুব। বলি, এটা তো অল্প করে বাসা। সাথে থাকব। কাছাকাছি থাকব। কেউ আর কথা বলেনা এরপর। ওপাশ থেকে খুটুরখুটুর অনুভব করিনা। সাদের কিছু সমস্যা আছে। যৌনজীবন
ভাল লাগে, হয়ত আছে বেশ কিছু ইয়ারদোস্ত। আমার সঙ্গে লটকে কেন তাহলে? আমি তো ব্যাকুল নই, খাব-খাব করছিনা। কেবল একঘেয়ে প্রেমের কথা বলি, ভরসা বিশ্বাস শব্দগুলো টেনে এনে মুডের ভারসাম্য খইয়ে দিই। দরজায় মা টোকা দেয়। ফোন ঘাটতে ঘাটতে একহাতে দরজা খুলি, ডিনারের থালাসুদ্ধ দুটো বৃদ্ধ হাত এগিয়ে আসে, থালা হাতে নিই। তাকানোটা আর হয়না, ছোট্ট একটা কি দুটো কথা আর হয়না। শূন্য দুটো হাত দরজার ওদিকের আবছায়াতে মিশে যায়। শরীর জাগতে চায়। হ্যান্ডেল মারি। বুকে হাত বোলাই। নিজের বাসী শার্টের গন্ধ শুঁকি। মাল ছিটকে কোথায় কোথায় যায়, খেয়াল করিনা। রাতের খাবার সুপ্ত হতে থাকে।
(৩)
লাল বেল্টকে সঙ্গে নিয়ে হোটেলে ফিরতে ফিরতে সোয়া এগারো বেজে যায়। গ্লোরিয়াস রিশেপসনে ম্যানেজার বসে, কর্মচারীগুলো বসে। টিভি দ্যাখে। মানুষ দ্যাখে। গুলতানি মারে। অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছগুলো এত আলো পেয়ে বিব্রত, ক্রুদ্ধ ভাবে ঘোরাফেরা করে। লাল বেল্ট আমার হাত ধরতে চায়, কাছে ঘেসতে চায়, ছাড়িয়ে নিই। ও কি ভেবে আমার দিকে না তাকিয়ে ধপধপ করে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে যায়। যারা বসে আছে সোফায়, তারা লক্ষ্য করে সব। আমিও উঠি, ধপধপ করে নয়, ধীরে সুস্থে, মেলানকলিক ভাবে। রুমে ঢোকার মুখে টুক করে সমুদ্রের গর্জন কানে আসে। লাল বেল্ট বিছানায় শুয়ে, এলোমেলো। ক্লান্ত বোধহয়। আমি সোফায় হেলান দিই, ল্যাপটপ কাছে টানি। ওয়ালপেপার থেকে নব্বই বছর আগেকার নিঃসঙ্গতা এই চারদেওয়ালে আছড়ে পড়ে। হপারের ছবিতে ঐ যে মেয়ে কাপডিশ সামনে নিয়ে বসে আছে আর একমনে কি একটা দেখে চলেছে, আর তার পেছনের ঐ যে কাচের দেওয়াল আর তা থেকে দেখা যাচ্ছে বাইরের স্ট্রিট লাইটের আলো যা ক্রমশ শূন্যে মিলিয়ে গেছে, এই মেয়ে এই শূন্যতা ঐ খালি কাপডিশই জীবনের সত্য বলে মনে হতে থাকে। ল্যাপটপ খুললেই দার্শনিকতা আক্রমণ করে। ওয়ালপেপার বদলাতে হবে।
ঘরের লাইটগুলো নিভিয়ে দিই। ব্যালকনি থেকে বাইরের হাওয়া ভেসে আসে। কোলাহল, হুল্লোড়। লাল বেল্ট মুখ লুকিয়ে শুয়ে। শুকনো চেহারা, খেতে ভাল লাগে। মুখের আদলটা কেমন যেন? মনে পড়ছে। আবার ভুলেও যাচ্ছি। সাদ একটা ছবি পাঠিয়েছিল। সেই ভারী গালে টোল পড়া ফর্সা মুখটা কেবল চোখে ভাসছে। সাদ একদিন ছবি পাঠিয়ে বলল এই দ্যাখো আমার ছবি। আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকি, গোটা দিনভর দেখতে থাকি। ঐ চোখদুটোতেই সমস্ত উচ্ছাস লুকিয়ে। ও সাদ, তুমি এমন কেন? আমার যে কিছুতেই ঘুম আসেনা তুমি কি তা জানো? তোমায় কাঁদতে দেখলে আমার চোখে জল আসে, তুমি সমস্যায় ডড়ালে আমিও নিজেকে জড়িয়ে ফেলি কিছু না কিছুতে- ও সাদ দ্যাখো আমি বাংলা সিরিয়ালসুলভ কথা বলছি, সাদ দ্যাখো!
জীবনটা সিরিয়ালের এপিসোড নয়। সাদ ধর্মের কথা বলে। পিছন মারাকে ইসলাম নারী স্বাধীনতার মতোই ভয় পায়। সাদ ধর্ম মানে, সাদ ভয় মানে। পাপ জমছে মনের খাদে। সাদ শিগগির স্ব-লিঙ্গের মায়া ত্যাগ করতে চায়। ওর চিপটিওয়ালি দরকার। তা বিয়ে করো! বলি। বলে, তাতে কি তুমি সুখী হবে? বলি, হব। কষ্ট হয়, তাও বলি, সুখী হব। চুমু বিলোনো ইমোজি ঠিকরে আসে ওদিক থেকে। প্লেট সুদ্ধ দুটো বয়স-মাখা হাত দরজার ফাঁক গলে এদিকে আসে। মনোযোগ দিতে প্রতিবারের মতোই ভুলে যাই।
সোফায় হেলান দিয়ে শূন্যে চেয়ে থাকি। সাগর এত রাতে কথা বলছে। কিছু কুকুর এখন জেগে উঠেছে। ব্যালকনির নীচে কিছু মানুষ হয়ত জড় হয়েছে, কথা বলছে উঁচু স্বরে। লাল বেল্টের অমন দম্ভসহ শুয়ে থাকা সহ্য হয়না। ড্রেসিং টেবিলে দামী নাইটক্রিম চুপচাপ বসে ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। ও ব্যবহার করে। কিনে দিতে হয়েছে। বাইরে ঘুরতে এসে পয়সাওয়ালা বাবু পেয়ে ভালোই সাধ মেটাচ্ছিস নিজের! সালা! নিজেকে বাবু ভাবতে থাকি। লাল বেল্ট নোখ চেটে দিচ্ছে, জুতোয় নাক ঘষছে, ওর পেছনে গরম শিক ঢুকিয়ে দিচ্ছি আর ও চীৎকার করছে – ইমেজগুলো এই আধো-অন্ধকারে খেলে বেড়াচ্ছে চোখের সামনে, দ্রুত। থলে সংলগ্ন লম্বা লাঠি জমাট বাঁধতে শুরু করে। সোফা থেকে উঠে খাটের কাছাকাছি যাই। চুলের গোছা ধরে টেনে তুলি কাঠির মত চেহারাটাকে। অস্বস্তি প্রকাশ করে। কিছু হয়ত বলে। কান অব্দি আসেনা। প্যান্টের জিপ খুলে লাঠি বের করে মুখে গুঁজে দিই। চোষ! অনিচ্ছা দেখাচ্ছে। মার গালে জোরসে থাপ্পড়! কান গরম হয়ে ওঠে। ঠোট চটচট করে। এলোপাথাড়ি ওর মুখের ভেতর ধাক্কা দিতে থাকি লম্বা কুঁজো লাঠি দিয়ে। কুঁচকিতে চুলকানির প্রভাব বাড়বে রাত ঠিকঠাক শামিয়ানা খাটালে, ঠিক।
(৪)
পরের দিন, ব্রেকফাস্ট গিলব বলে হোটেল থেকে বের হই। বাইরে স্ফূর্তির হাওয়া, মিষ্টি মধুর সূর্য। অন্নপূর্ণা হোটেলে যেখানে তৈরি হতে থাকা রুমালী রুটিগুলোর দিকে ঢিমে মনোযোগ দিয়ে গতরাতে তাকিয়ে ছিল গোধুলি গোরু, সেই হোটেলে ঢুকি। খুব সুস্বাদু আলুর পরোটা বানায়। একটা টেবিলে মুখোমুখি দু’জন বসি। কাচের দরজার ওপাশে জীবন বয়ে যাচ্ছে। সারি সারি টেবিল চেয়ারের কিছুগুলোতে মানুষ বসে। ওপাশে পরদা ঝুলছে, রান্না যা যা সব ওদিক থেকেই আসছে। অর্ডার দিয়ে দিই। শূন্য টেবিলে নুনের কণা ছড়িয়ে খানিক। লাল বেল্ট একমনে সেগুলোকে একজায়গায় জড়ো করছে। চোখদুটো বেশ অন্যরকম লাগছে এখন। পবিত্র ফ্লেভার। নুনের কণা জড়ো করতে করতে একবার আমার দিকে তাকাল। পাত্তা দিলাম না। একটু বিব্রত বোধ জাগছে মস্তিস্কে। এইরকম সময় একটা হেরে যাচ্ছি-হেরে যাচ্ছি গন্ধ নাকে আসে। আগেও এসেছিল বারকয়েক। সাদ একদিন জানাল, ফটোর ছবিখানা ওর নয়। ওর এক বন্ধুর। সেদিন ঘরে কোনো আলো জ্বালানো যায়নি। ফ্যান চলছিল না। সুইচগুলো বিকলাঙ্গ হয়ে ছিল। সেই বন্ধুর প্রোফাইলের লিঙ্ক পাঠিয়েছিল। আর বলেছিল, ‘এই মুখটাই তো তোমার কাছে সাদ। প্রোফাইল ঘাটো, অনেক ছবি পাবে। মনে পড়বে। মনে রেখো, প্রোফাইলের এই মানুষটা কিন্তু আমি নই।’ সাথে খচ্চর ইমোজি। আঁতিপাতি দেখলাম। নাম নুরুল ইসলাম, থাকে ভবানীপুরে। এমবিএ পড়ছে। সাদের কিরকম বন্ধু? মিউচুয়াল ফ্রেন্ডলিস্টে সাদ নেই। নুরুল ইসলামের ছবিগুলো দেখতে থাকি। এই কদিন একেই সাদ ভেবে সকাল বিকেল ভাবনায় ডুবতাম। নুরুলের খোঁজ দিয়েই ডুব দিল সাদ। আর সন্ধান নেই দিন তিনেক। নুরুল ইসলামকে মেসেজ পাঠাই কি ভেবে। বলি যা যা। নুরুল নামের যে মানুষটি ওপাশ থেকে টাইপ করছে সে লেখে, সে সাদ নামের কাউকে চেনে না, এবং সে বা তার কোনো পরিচিতই টেমার লেনে থাকেনা। সন্দেহ কাটে না তবুও। ভয়েস কল করি। ওপাশ থেকে কেউ রিসিভ করে। নুরুল কথা বলে, বলে সে স্ট্রেট। তার সমকামী কোনো বন্ধুও নেই। কোথাও একটা ভুল হচ্ছে আমার। নুরুল কল কেটে দেয়। সন্দেহ জমাট বাঁধে খুব করে। সাদের সাথে এর আগে বার কয়েক কথা হয়েছে, ওর কন্ঠস্বর চিনি। নুরুলের কন্ঠস্বর এখনো কানে গমগম করছে। কি করে দুজনের স্বর চমৎকার ভাবে মিলে যেতে পারে? প্লেটের ঠোকাঠুকিতে চমক ভাঙে। লাল বেল্ট কিছু বলছে। কি বলছে, কেন বলছে ধরতে পারিনা। বাইরের এই মিঠেকড়া পরিবেশে গতরাতের গোরু নির্বাক দাঁড়িয়ে। আশপাশ দিয়ে জীবনস্রোত বয়ে চলেছে, গোরু তাও নিশ্চল। প্রশ্নহীন। পাশের চায়ের গুমটি থেকে কেউ কফ ঠুকরে ফ্যালে। গোরুর পিঠে পড়ে। গোরু বিচলিত হয়না। ল্যাজও নাড়ায়না। কেবল তাকিয়ে থাকে এদিকে, অপলক। আর পেচ্ছাপ করে। নীচের ধুলো বালির চত্বর ভিজে যাচ্ছে জলের স্রোতে। নির্বাক প্রাণী পেচ্ছাপ ছিটিয়ে কিছু বলতে চায়। আমরা আধুনিক মানুষেরা বিশেষ কিছু ধরতে পারিনা।
(৫)
বিচের ফিচেল পথে হাঁটা কিছুক্ষণ। ঢেউরা আসছে, ফের মিলিয়ে যাচ্ছে। এই আসা যাওয়ার মাঝে অসংলগ্ন রিদম রয়েছে। বাচ্চা বুড়ো মদ্দা ছুড়ি সব জলে জলে থৈথৈ। লাল বেল্ট জলে নামবে বলেছিল কাল, আমাকেও টানাটানি করছিল, আগ্রহ দেখাইনি। আজ খেয়ালের বসে ছয়-সাত পা এগিয়ে গেলাম। গোড়ালিতে এসে জল মিশে যাচ্ছে যেন। লাল বেল্ট কোথায়? আশেপাশে ভীড় আর কোলাহলের মাঝে খুঁজে পাচ্ছিনা। সাথে সাথেই তো ছিল এতক্ষণ! নাকি মাল বেরবে বলে সিগন্যাল পেয়েছে আর তাই হোটেল অভিমুখে হাঁটা লাগিয়েছে? মাল মানে পেছনের মাল, হাগা। লাল বেল্টের সময়-মাফিক ওটা হয়না, গত কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করলাম। খুব এমার্জেন্সির প্রয়োজন বোধ করলে তবে যায়। আজিব চীজ মাইরি!
হোটেলে ফিরলাম খানিক বাদে। রুমের চাবি আমার কাছে। গেল কোথায় মালটা? সঙ্গ ছাড়ে না কখনো। সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। দেওয়াল জুড়ে অপেক্ষারা এঁকেবেঁকে চলেফিরে বেড়াতে লাগল। মোবাইল ঘাটা শুরু করি। মেসেজ আসে টুং করে। দেখি না। ফেসবুক খুলি। সাদের পোস্ট। ‘এনিবডি অ্যাভেলেবেল টুডে?’ কষ্টেরা বুকের ভেতর থেকে বাইরে ছিটকে পড়ে। কষ্টের সঙ্গে মিশে থাকা ঘৃণাগুলো আজ খাঁচার বাইরে আসতে চায়। ঘৃণা কার প্রতি? সাদ? চিনিই তো না! শহরের ভেতরকার লক্ষ লক্ষ মানুষের ভিড়ে মিশে আছে। নিজের ছায়াকে চেনেনা, চেনাতে চায়না। নুরুল সাদ সব তালগোল পাকিয়ে এপাং ওপাং করে চলেছে। কে সত্যি কে মিথ্যে চেনার উপায় নেই। সাদকে ব্লক করা যাক। তারপর সবকিছু মুছে ফেলা যাক। গোবেচারা স্মৃতিদের দোষ নেই। তাও ওদের নলি কাটতে হবে।
ঘন্টাখনেক চোখ বুজে শুয়ে থাকলাম। দরজাটা সেই থেকে খোলাই ছিল। বারান্দা থেকে হাওয়া হেসেখেলে ঘরে ঢুকছে। অশোক রোডের তিনকামরার ফ্ল্যাটে বন্দী বুড়ি হাতদুটোকে জাপটে ধরতে ইচ্ছে করছে। ল্যাপটপ খুলি। ওয়ালপেপার থেকে হপারের বিষন্নতা কোন খেয়ালে উড়ে পালিয়েছে। শাগালের প্রমিনেদ জায়গা করে নিয়েছে। পেছনের ঐ গোলাপী বাড়ি, নীলচে গাছের পাতারা উত্তাপ ছড়াচ্ছে। জীবনের।
দরজা খোলা রইল। বিকেল নামছে। অপেক্ষায় থাকলাম। না চেনা আধো চেনা অবয়বেরাই থেকে যায়, থাকে পাশে। অপেক্ষার রঙও গোলাপী।
( শেষ )
মূল ছবিঃ ভুটান
ছবি – ‘অটোম্যাট’
শিল্পী – এডোয়ার্ড হপার
ছবি সূত্র – উইকিপিডিয়া
ছবি – প্রমিনেদ
শিল্পী – শাগাল
ছবি সূত্র –উইকিআর্ট