এক বিছানা অন্ধকার
– রানি মজুমদার
মৃত্যুঞ্জয় ট্রাক থেকে লম্বা লাফ মারে। রাস্তাটা ভিজে ভিজে। এরই মধ্যে বৃষ্টিও হয়ে গেলো? গুনে দেখে নেয় পাঁচটা দশ টাকার নোট। পকেটে রেখে দ্রুত পা চালায় । রাত বাড়ছে। এবার বাড়ি ফেরা। পথে মানুষ বলতে কিছু নেই। শুধু ট্রাকগুলো একে একে বিকট আওয়াজ করে পেরিয়ে যাচ্ছে । মৃত্যঞ্জয়ের ওড়নাটা বাতাসের সাথে খেলা করতে থাকে।
মস্ত সেই নীল ওড়না যেন পিচের সমস্ত লম্বা রাস্তা পেরিয়ে শেষ আকাশটা পর্যন্ত পতপত করে উড়তে থাকে, উড়তেই থাকে।আর মৃত্যুঞ্জয় সো সো শব্দে ঝড়ের গতিতে সামনে এগিয়ে চলে। ট্রাক পেরোলেই দুপাশের ঝোঁপ গুলোতে যেন বিদ্যুৎ খেলে যাছে। তারপর আবার সেই ঘুটঘুটে কালো অন্ধকার। এসব ঝোপের আড়ালেই ওর যাতায়াত। এতে দুটো টাকা আসে পকেটে। সংসার চলে। মৃত্যুঞ্জয় ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে নিতে চায় কিন্তু হাওয়াতে পারে না। মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে এক্ষুনি । ঝড় উঠলে কোত্থাও দাঁড়াবার জায়গাটুকু নেই। হয়তো আবার কোনো ট্রাকেই আশ্রয় নিতে হবে। ট্রাকে উঠলেই আরো টাকা। কিন্তু না আজ আর নয়। এখুনি বাড়ি ফিরতেই হবে । ওই তো দূরে ধাবা। ধাবার উঠোনে সবুজ আলোটা। ঝড়ো হওয়ার সাথে মশলাদার তরকার গন্ধ ভেসে আসছে। এসবই মৃত্যুঞ্জয় বহুকালের চেনা। আরো অনেক খানি পথ। প্রথমে ধাবা আসবে। সেখান থেকে ডান দিকে বাঁকলে একটা মোড়। সেই মোড় থেকে আরো আধঘন্টার রাস্তা।ব্যাস তারপরই বাড়ি। মৃত্যুঞ্জয় বিড় বিড় করে। প্রথম ট্রাক থেকে সত্তর, পরেরটা থেকে একশ, শেষের টা দিলো পঞ্চাশ। মোট দুশো কুড়ি। কত ট্রাকওআলাগুলো এখনো হাঁক দিয়েই চলেছে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়ের আর শোনার সময় নেই। ওড়নাটা গুটিয়ে পকেটে ভরে সে। এই ওড়নাটাই ঘোমটা করে সে গাড়িওয়ালা দের জানায় সে ছক্কা। দূরদূরান্ত থেকে আসা ড্রাইভাররা ছক্কাদের কদর করে। সঙ্গে নিয়ে যায়। কেউ নিজের গাড়িতে ওঠায় কেউ ঝোপ জঙ্গলে নিয়ে যায়। প্রথম প্রথম মৃত্যুঞ্জয়ের ব্যাথা লাগতো। এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। অনেক ড্রাইভার তেল সাথে করে আনে। তেল না থাকলে থুথু। আজকাল সবাই বলে কন্ডোম নিতে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জযের তাতে কষ্ট হয়। সে ড্রাইভারদের বুঝিয়ে বলে আমি তো মেয়ে নই। তোমরা কনডোম পড়বে আর আমার ব্যথাতে প্রাণ বেরোবে।
ধাবা এসে গেল। কত ড্রাইভার খালাসি খাটিয়াতে বসে খাচ্ছে, কেউ কেউ পাশের চুবাচ্চার জলে স্নান করছে। কেউ নিজেদের মধ্যে গল্প করছে। চারপাশ গরম রুটির গন্ধ, মদের গন্ধ, গরম তারকার গন্ধ।সাথে পেঁয়াজ টুকরো। ধাবা জুড়ে কত আলো, কত লোকজন, কত ব্যাস্ততা। মৃত্যুঞ্জয় ধাবা পেছনে ফেলে রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। এখন কেউ আর মৃত্যুঞ্জয়কে ডাকছে না। ও যে এখন পুরোপুরি ছেলে। আর কোমর দুলিয়ে চলছে না সে, আর তালি বাজাচ্ছে না, আর ওড়না নেই। ও এখন দুশ কুড়ি টাকা নিয়ে ঘরে ফিরছে।
মৃত্যঞ্জয় ঘরে ফেরে। কৌটোতে চাল বাড়ন্ত। তাই উনানের আঁচ উনানেই মরে চলেছে । ভাত তো হলো তবে বেশ রাতে। এবার বিছানা এবার ঘুম। পাশে বউ শ্যামলী। তবু , খোলা জানলা দিয়ে হু হু বাতাসে ফেলে আসা জি টি রোডের গন্ধ, ঝোপ ঝাড়ের বুনো গন্ধ, খালাসীর সেই গায়ের গন্ধ মৃত্যুঞ্জয় পাগলের মতো হাতড়াতে থাকে সমস্ত অন্ধকার বিছানা জুড়ে। শেষ রাত অবধি।
ছবিঃ ভুটান