কাঁচালঙ্কা

 চিঠি

 চিঠি

– সায়ক সেনগুপ্ত

 

আজ একটা ছেলের গল্প শোনাবো আপনাদের। তবে এটা ঠিক গল্প হয়ত না আবার সত্যি বলে মানতেও অনেকের খটকা লাগবে, বলতেই পারে কেউ এসব আজগুবি,ঘটনার অতিরঞ্জন।
ছেলেটিকে চিনি অনেকদিন থেকে এক পাড়াতেই তো বাস,খুব প্রানোচ্ছল আর মজার মানুষ। আমার সাথে রাস্তায় দেখা হলেই কথা বলতো, আমার লেখার ফ্যান ছিল একরকম। এমন কাঁচা লেখকের একমাত্র পাঠক বলে কথা তাই আমিও ওকে বেশী সমীহ করতাম, এখন তো সব বিজ্ঞাপনের যুগ, ওই লেখার বিজ্ঞাপন করত। নানান বিষয় নিয়ে আলোচনা হত আমাদের মধ্যে। একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করল
– বিয়ে কি করতেই হয়? সংসার করাই কি মানুষের একনিষ্ট লক্ষ্য?
– না তা কেন হবে। তবে একটা সঙ্গীর দরকার হয় একটা সময়, যে তোর একাকীত্বগুলো ভুলিয়ে দেবে।
-হম । বুঝলাম।
– কি বুঝলি? তা আজ হঠাৎ এসব কথা?
– না তেমন কিছু নয়, মনে হল তাই জিজ্ঞাসা করলাম।
– খুব বেশী বৈষয়িক কিছু ভাবছিস আজকাল, তা পড়া হচ্ছে তো? ফাইনাল ইয়ার কিন্তু।
– সে তুমি ভেবো না। সেসব হচ্ছে। অবশ্য চপের দোকান খুলতে বা ফ্ল্যাগ হাতে নিতে কোনোটাতেই গ্রাজুয়েট হতে লাগে না। হা হা হা
– তবে আর কি ওই কর। সবাই মিলে শিকেয় তোল দেশকে। যা দূর হ, পড়তে বস বাড়ি গিয়ে।
ও চলে যেতেই আমিও বসলাম একটু লেখালিখি নিয়ে।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে, তবে ওর সাথে দেখা হয়নি , হয়তো ব্যস্ত পড়া নিয়ে। ভাবছি দেখা করতে যাব কিনা ,হঠাৎ এক বিকালে একটা অচেনা ছেলে এল আমার কাছে।
– তোমাকে ঠিক চিনতে পারলাম না।
– হ্যাঁ, আপনি আমাকে চিনবেন না। কিন্তু আমি আপনার কথা শুনেছি রূপের কাছে।
– ওহ তাই বল তুমি রূপের বন্ধু। তা বল কি সাহায্য করতে পারি। রূপকেও নিয়ে আসতে পারতে, অনেকদিন দেখা হয়নি।
– ও আসবে না। আমাকে পাঠিয়েছে এই চিঠি খানা দিয়ে। বলেছে আপনি তো লেখেন তাই ওর এই কথাগুলো একটু সাজিয়ে লিখবেন।
– ও আসবেনা কেন? কি হয়েছে?
– চিঠিটা পড়লেই আপনি সব উত্তর পেয়ে যাবেন। আমি চলি।
চিঠিটা আমার হাতেই রয়ে গেল আমাকে বলার কোনো সুযোগ না দিয়েই ও চলে গেল।
অগত্যা আমি আর কি করি চেয়ারে বসে পড়ে ফেললাম চিঠি।
আশ্চর্য এ লেখা আমি শোধরাবো কি, এমন লেখা আমি কোনোদিন লিখতে পারব কিনা সন্দেহ। ও লিখছে
প্রিয় মা,
তোমাকেই লিখলাম। বাবাকে লিখলে হয়তো পড়বেই না,আমি তো জানি বাবা ভাঙবে তবু মচকাবে না, আমি তো ওই বাবারই ছেলে তাই জেদ আমারো কম ভেবো না তোমরা। তোমরা তো আমাকে কখনো বোঝোনি , বোঝার চেষ্টাও করনি।বাবার কথা বাদ দিলাম, বাবা তো আমার বেড়ে ওঠার সাথে থাকতেই পারেনি, আমাদের অবস্থা ফেরাতে দিনরাত পরিশ্রম করে গেছে, তাই বাবাকে দোষ দিনা। কিন্তু তুমি তো আমার বেড়ে ওঠার সাথে ছিলে তুমিও চেষ্টা করলে না, অবশ্য করবেই বা কি, স্বামীর মতামতই তো তোমাদের মতামত তাই দোষারোপ তোমাকেও করছি না। আসলে এ চিঠি কেবল আমার একান্ত ব্যক্তিগত কিছু অনুভূতি আর স্বীকারোক্তির চিঠি।
তোমরা বেশ কয়েকমাস ধরেই আমার বিয়ের জন্য তোড়জোড় শুরু করেছ। হয়তো অন্য কেউ হলে সে তাদের মা বাবার এহেন প্রচেষ্টায় উৎসাহ দিত, কিন্তু আমি নিরুপায়। তোমাদের এ সিদ্ধান্ত আমি মানতে পারলাম না কারন আমি সমকামী। তোমাকে আমি বললাম মা এসব বন্ধ করো কিন্তু তুমি এটা একটা শারীরিক সমস্যা মনে করলে, বাবা ও তাই বলল এসব কিছু না বিয়ে করে মেয়ের সংস্পর্শে এলেই ঠিক হয়ে যাবে।
তোমাদের আমি বোঝাতে পারি নি। অবশ্য তোমরা বুঝবেই বা কি করে, আমার মধ্যে তো কোনো মেয়েলি সত্ত্বা নেই, তবু আমার কামনা পুরুষকে ঘিরে। আসলে আমারো নিজেকে বুঝতে সময় লেগেছে। অনেক ভাবে আমি নিজেকে পরীক্ষা করে বুঝেছি যে যতোই নারীসঙ্গ থাকুক পুরুষের প্রতি টান খানিক বেশী।তাই বেকার এক নারীকে বিয়ের মধ্যে আবদ্ধ রেখে বাইরে অন্য পুরুষের সাথে দৈহিক সম্পর্ক রাখতে পারব না। আসলে আমি ভালোবাসা নিয়ে প্রতারণা করতে পারব না।কারন আমি এক পুরুষকে ভালোবেসে ভোগ করতে চাই, জীবন কাটাতে চাই, যেমন একটা নারী পুরুষের সংসার হয়। আমি সমকামী নয় সমপ্রেমী হতে চাই।জানি এ প্রেমে শিশুর কান্নার আওয়াজ থাকবে না কিন্তু সব বিয়ের মূলকথাই কি ওই এক জায়গাতেই শেষ? তাহলে যারা নিঃসন্তান তারা তাই এখনো ব্রাত্য সমাজে। আর এমন অনেক ঘর আছে যেখানে শিশুর কান্নার আওয়াজ ও সংসারের ভাঙন রুখতে পারে না।
আসলে আমি সত্যিই বুঝতে পারি না আমি কাকে খুশি করব, নিজেকে না তোমাদের ।নিজেকে খুশি করতে গেলে তোমাদের আঘাত দিয়ে ফেলি আর তোমাদের খুশি করতে গেলে নিজের মৃত্যু পরোয়ানা লিখতে হয়। তাই আমি চললাম এক অচেনার উদ্দেশ্যে, যেখানে তোমাদের থেকে দূরে নিজের একটা ঘর গড়ব যে ঘরে তোমাদের আশীর্বাদ পাব কিনা জানা নেই তবে তোমরা আমার মনের কাছে সসম্মানেই থাকবে।
পারলে আমাকে মনের মধ্যে রেখো যেমন এতদিন রেখে ছিলে। ভালোথেকো।

ইতি-
তোমাদের রূপ

না এরপর মনে হয় আমার কিছু লেখা সমীচীন নয়, আর আমার লেখার ভাষাও নেই।

 

ছবিঃ ভুটান

 

কালিজা-২০১৯-২য়-বর্ষ-সূচীপত্র

 

Exit mobile version