কাঁচালঙ্কা

নবজন্ম

নবজন্ম

– অঙ্কিতা রায়

 

– আজ নতুন করে সব শুরু করার আগেই যদি সব শেষ করে দিতে চাই তার জন্য আমায় ক্ষমা করে দিতে পারবে মৈনাক?
– কি বলছো সেঁজুতি? প্রথমবারে সবার অভিজ্ঞতা ভালো নাই হতে পারে ! তোমার আমার কাছে আসতে অস্বস্তি কেন হচ্ছে সেটা আমরা নিজেদের মধ্যে তো কথা বলে মিটিয়ে নিতে পারি বলো ! তুমি তো আমার স্ত্রী !
– না মৈনাক সেটা নয় ! আমি যে..মানে কোনো ছেলের ঘনিষ্ঠ হতে আমার ঘেন্না হয় ! খুব বাজে লাগে|
– কিন্তু আমি তো যেকোনো ছেলে নই সেঁজুতি আমি তো তোমার স্বামী ! তোমার কি আমার কাছে আসতেও ঘেন্না করে?
– তুমি আমায় ভুল বুঝো না মৈনাক! মা বাবা, পরিবারের কাউকে বোঝাতে পারলাম না আমার কথা ! সবাই ভাবলো আমার কোনো রোগ আছে !আমি স্বাভাবিক নই ! আজ তোমায় সব সত্যি টা বলতে চাই তুমি শুনবে?
-ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না | আমি সব কিছু মিটিয়ে নিতে চাই | তুমি বলো আমার মধ্যে কিছু ত্রুটি আছে?
-না না মৈনাক ! কোনো ত্রুটি নেই তোমার| তুমি ভীষণ ভালো মানুষ | কিন্তু আমার কথা টা একবার শোনো|
-আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! কি বলতে চাও বলো !
-যখন একটু বড়ো হয়েছি ! টিউশন, স্কুলে সব মেয়েরা ছেলেদের নিয়ে আলোচনা করলে জানি না কেন খুব বিরক্ত হতাম| কোয়েড স্কুল ছিল, ছেলে বন্ধুও ছিল কিন্তু কখনো তাদের মধ্যে কারো প্রতি আকর্ষিত বোধ করিনি |
-এ তো হতেই পারে তখন বয়স কম ছিল ! হয়তো তুমি কোনো কারণে ভয় পেতে !
– আমিও প্রথমে তাই ভেবেছিলাম মৈনাক বিস্বাস করো ! কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো ততই যেন এসবে অস্বস্তি বাড়তে লাগলো| স্কুল শেষ করে সব গার্লস কলেজ গুলোতে এপলাই করেছিলাম ছেলেদের সংস্পর্শ এড়াতে|
– কেউ কি কখনো তোমার সাথে কোনো বাজে ব্যবহার করেছিল সেঁজুতি? সেক্ষেত্রে অনেক সময় এরকম হয়|
– আমার পুরো কথা টা শোনো তুমি তেমন কিছুই ঘটেনি আমার সাথে | গার্লস কলেজ এ গ্রাজুয়েশন করার সময় দেখা হয় মীনাক্ষীর সাথে| ওর সাথে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগতো আমরা সব সময় একসাথে ঘোরা ফেরা করতাম সব কথা শেয়ার করতাম|
– তারমানে ও তোমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল তাই তো?
– তার থেকে অনেক বেশি ছিল ! কলেজ ফেয়ারওয়েল এর দিন ওর হাত ধরে বলেছিলাম “আমি বিয়ে করতে চাই না মীনাক্ষী, আমি শুধু তোর সাথে থাকতে চাই | আমি তোকে খুব ভালোবাসি রে !” এ কথা শুনে ও আমায় বলে “আমিও তোকে ভালোবাসি সেঁজুতি”, বলেই আমার ঠোঁটে একটি চুম্বন করে | ওই চুম্বন টি আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমি কে ! এত দিনের সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়ে যায় সেদিন|
– তার মানে.. মানে তুমি সমকামী?
– হ্যাঁ মৈনাক এটাই সত্যি !
– তাহলে তুমি আমায় বিয়ে করলে কেন?
– সবই বলছি ! কলেজ শেষ হলে মা-বাবাকে সব খুলে বললাম ! মা তো মীনাক্ষীর ওপর রেগে খাপ্পা হয়ে গেলো ! মা এর ধারণা ও আমায় বিগড়ে দিয়েছে | তারপর ওর সাথে আমার মেশা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলো | ওর সাথে মিশে আমার কোনো মানসিক রোগ হয়েছে ভেবে আমাকে ডাক্তার এর কাছে নিয়ে যাওয়া হয় | ডাক্তার আমার সব কথা শোনেন, বেশ কিছু দিন ট্রিটমেন্ট করানোর পর উনি মা-বাবাকে বলেন আমি সত্যি লেসবিয়ান অর্থাৎ মহিলা-সমকামী|
– তোমার মা, বাবা তার মানে সব জানতেন ! ওনারা জেনে শুনে এমন করলেন !
– আমি জানি তোমার রাগ হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু ওরা এই জিনিস টা কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না| তাদের মেয়ের মানসিকতা অন্যরকম সেটা বুঝতেই চাইলো না | এবার এক মাসির কথায় তান্ত্রিক ডেকে ঝাড় ফুঁক করা শুরু হলো | একের পর এক যন্ত্রনা দিয়েছে ! যে দিন আমার হাতে জ্বলন্ত কয়লা রেখে খুব ঝাঁটা দিয়ে মারছিলো সেদিন বাবা প্রতিবাদ করলো| বাবা বললো “তোর বিয়ে দিচ্ছি তুই এখান থেকে চলে যা মা নাহলে এরা প্রাণে মেরে ফেলবে !”
আমি বাবাকে বললাম বিয়ে করে আমি ভালো থাকতে পারবো না কিন্তু সবার ধারণা হলো ভালো বাড়ির ভালো ছেলের সাথে বিয়ে হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে|
– তাহলে বিয়ের আগে যখন দেখা করেছিলাম তখন তো এসব বলতে পারতে!
– মা দিব্যি করিয়ে ছিল যেন বিয়ের আগে এসব নিয়ে কোনো কথা না বলি কারো সাথে| মা বললো বিয়ে করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে তাই এসব কথা পাঁচ কান না করতে | তারপর তোমার সাথে দেখা হয় | তুমি সত্যি খুব ভালো মানুষ মৈনাক, তোমার বন্ধুত্ব পূর্ণ ব্যবহারে আমারও মনে হতে লাগলো যে সব আমার মনের ভুল| হয়তো মা এর কথায় ঠিক| কিন্তু গত একমাস ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করছি সব ঠিক করার কিন্তু পারলাম না ! আমায় ক্ষমা করো মৈনাক !
আর কোনো কথা বলেনি মৈনাক, সেঁজুতির মাথায় হাত বুলিয়ে তার চোখের জল মুছে দিলো|
কেটে গেছে তিনটে বছর | মৈনাক, সেঁজুতির মা বাবাকে বুঝিয়ে বলেছে সবটা ! এত সব করার পরেও কিছু পরিবর্তন হলো না দেখে তারাও একটু একটু করে মেনে নিয়েছেন | সেঁজুতি,মৈনাক মিউচুয়ালি ডিভোর্স করার পর এখন সেঁজুতি মীনাক্ষীর সাথে থাকে| মীনাক্ষী ছিল মায়ের একমাত্র সন্তান | বাবা মারা গেলেও তার মা খুব খোলা মনের মানুষ তিনি এই ব্যাপার গুলি বুঝতেন| তিনি কোনো আপত্তি করেননি|
সেঁজুতির মতো মানুষেরা দুর্বল নন, সমাজের চেনা রাস্তা দিয়ে চলেন না বলে সমাজ তাদের আলাদা চোখে দেখে ! তারা যে অসুস্থ, অস্বাভাবিক নয় সেটা বোঝার জন্য অনেক সময় তাদের নিজের সাথেও লড়াই করতে হয়, সেই লড়াই এ তাদের পাশের দাঁড়ানোর চেষ্টা করুন !দয়া করে সেই লড়াই টিকে কঠিন করে তুলবেন না |
মানসিকতা তো প্রত্যেক মানুষেরই ভিন্ন ভিন্ন তাতে সে সমকামী হোক বা না হোক | আমরা যে যেমনই হই পাশে দাঁড়ানোর একজনকে পেলে মনের বল অনেক বেড়ে যায় | তাই সেঁজুতির মতো সবার পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন|

[প্রতিটি চরিত্র এবং গল্পের প্লট সম্পূর্ণ কাল্পনিক | বাস্তবের সাথে কোনো মিল থাকলে তা কাকতালীয় ]

 

ছবিঃ ভুটান

কালিজা-২০১৯-২য়-বর্ষ-সূচীপত্র

 

Exit mobile version