কাঁচালঙ্কা

পুরুষ, পৌরুষ, পুরুষতন্ত্র আর …

পুরুষ, পৌরুষ, পুরুষতন্ত্র আর …

— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

 

“অনহোনি-কো হোনি করদে / হোনি-কো অনহোনি / এক জগা যব জমা হো তিনো…”

হঠাৎ করেই লেখাটা শুরু করে দিলাম। আসলে লিখবো বললেই লেখা হয়না। পাতি কথায়, আমার লেখা পাচ্ছেনা। পাওয়াতে হচ্ছে। ভাবনারা বড়োই বেয়াড়া। খুঁজছিলাম এমন একটা কিছু, অন্যরকম কিছু, যেটা নিয়ে লেখা যাবে। কিস্যু মাথায় আর আসেনা। তাকালাম চারদিকে একবার। আরে!! সাধারণ কিছুকেই তো একটু অন্যরকমভাবে ভাবলে অন্যকিছু হয়ে যায়। এর জন্যে নাকি চুলকে চুলকে মাথার উকুনগুলোর উপরে এতো অবিচার। একটু সাধারণ জায়গাগুলোই ঝালিয়ে নিই না একবার। সবসময় কঠিন-কঠিন শক্ত-শক্ত কথাই লিখতে হবে, তা কেন? কঠিন/শক্ত হওয়াটাও তো একটা খোপে ঢোকার চেষ্টা।

কিন্তু বহেনো অউর মেরে বহনকে ভাইয়ো (নাহ! মিঁত্রো আজকাল আর বলা যায়না, বললেই লোকে ভয়ে কাঁপে), লিখতে যখন বসেছি লিঙ্গ যৌনতার লীলেখেলা নে, তখন তো জলকেও আর H2O কইতে ভরসা পাইনে। অতএব লিখতে লিখতে ইচ্ছে না হলেও, এই ছোট্ট কুট্টি লেখার মধ্যে, একটু এদিক ওদিক, পসেটিভ আর নেগেটিভ জটিলতার খাদে/গুহায় সেঁধিয়ে যাবো। চেষ্টা করবো তবু যতোটা পারা যায়, সোজা সমান রাস্তায় লেখাটাকে নাকে দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যেতে।

“পুরুষ বনাম পৌরুষ বনাম পুরুশতন্ত্র” এই খটমট থ্রিসাম বোধহয় বেঞ্চের উপরে টপিয়ে বা নিচে বটমিয়েও “নরঃ-নরৌ-নরাঃ” -এর মতো সহজ সমীকরণে আসেনা। ব্যাপারটা বেশ আরও খানিকটা পুরুষ্টু। প্রথম জিনিশটা নিজেই একটা ফোলানো ফাঁপানো “ফুশশশ…”, দ্বিতীয়টা ফুশ-গিড়ির আদপ-কায়দা (বা বলা চলে বেয়াদপ-কায়দা), আর তৃতীয়টা এই কায়দাবাজি টিকিয়ে রাখার ব্যাদ-কোরান-বাইবেল-ত্রিপিটক ইত্যাদি ইত্যাদি, সংক্ষেপে নিয়মাবলী। জিনিষটা কি’রম অদ্ভুত, না? প্রথমে একটা ভাগ তৈরি করো। অ্যাঁই এদিকে আয়, দেখি দু’পায়ের মাঝখানটা, ডানদিকে দাঁড়া, তুই ব্যাটাছেলে। অ্যাঁই তুই আয় এবার, নে দেখি তোরটাও, বাঁদিকে দাঁড়া, তুই মেয়েছেলে। “তুমি নারী, রক্ষা করবে শান্তি; আমরা পুরুষ রক্ষা করব কৃষ্টি।” বাকিরা বাতিল? শরীরের নিরিখেই? মন তো আরও কঠিন দার্শনিক তত্ত্ব। নিরেট জনগণের মাথায় ঢুকবেনা।

একটা মতলব এসেছে। এক কাজ করি। চাই, না চাই, আমরা তো সবাই পুরুষতন্ত্রের বশে, কোথাও-না-কোথাও, কখনো-না-কখনো। তাই তার ভাষাতেই কথা বলিনা, তার মতো করে, নিজের ভাষা ছেড়ে। পুরোটা ছাড়ছিনা অবশ্যই। তাই এটা একটা খেলা, কোথায় আমি কথা বলছি, আর কোথায় পুরুষতন্ত্র, বুঝে নাও দেখি বাওয়া।

“ম্যায় পুরুষতন্ত্র হু; টিং”। আমি মন বুঝিনা। কারন পুরুষতন্ত্র নিজের সংজ্ঞায় নিজেই একটা পুরুষ। পুরুষ কঠিন। পুরুষ পেশিবহুল। পুরুষ নির্দয়। পুরুষ কর্মঠ। পুরুষ শক্তিশালী। চামড়া গণ্ডারের মতো খসখসে। পুরুষ এই সবকিছু। বোধহয় পুরুষ খানিক অতিপুরুষই বটে। “আপ তো পুরুষ হি নহি হো। আপ মহাপুরুষ হো, মহাপুরুষ।”

হেসোনা হে, হেসোনা। পুরুষতন্ত্রের কাছে পুরুষ খানিকটা এরকমই। আর নারী তার দাসী-বাঁদি-আশ্রয়ভিক্ষাপ্রার্থিনী। পুরুষের যা যা নেই, নারীর তাই তাই আছে। কোমল, পেলব, “পুরো মাখন”, করুণ (জোকসের ভাষায় ঝগড়ুটে, ছিঁচকাঁদুনে এবং ঘ্যানঘ্যানে), রান্না-বান্না আর সাংসারিক-বাচ্চা-নাচানো যার কাজ। এই অবধি ঠিকই ছিলো, মাঝে লেজুর জুড়লো এসে পুঁজিবাদ। এরা বেশ মুখোশ পড়ালো পুরুষতন্ত্রের গায়ে। গণ্ডারের চামড়ার জন্যে তৈরি হলো বিশেষ “মেয়েদেরটা-না-মেখে-পুরুষের-জন্যে-বিশেষ” সাবান/শ্যাম্পু/লোশন/পাউডার/ক্রিম ইত্যাদি। কিন্তু তাতে এই পুরুষদের মনের চামড়া রইলো গণ্ডারের মতোই লৌহ-কঠিন।

এতে করে আর দুনিয়ায় পুরুষ রইলো কৈ? এতো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা মেনে কি মানুষ থাকা যায়? যায় না। তাই আরও সঠিক পুরুষ হওয়ার প্রতিযোগিতায় নামলো প্রায় সমস্ত পুরুশমানষের দল। জিমে ছোট রে, চার পাঁচটা বৌ পটাও রে, নাচ-গান কোরনা হে, বেশী টাকা কামাও রে। আর শুধু এই? মায় লিঙ্গ লম্বা আর মোটা বানাও রে পর্যন্ত। বেচারা পুরুষ। তার দুখখু নিয়ে কেউ আর কথা বলেনা। বেচারাকে বাপ-মা মড়লে ছাদে গিয়ে একা একা ফুঁপিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে হয়, বৌয়ের মাইনে বেড়ে গেলে বেশী করে বসের পা চাটতে হয়, বন্ধুর সাথে কোলাকুলি করার আগে হিসেব কসতে হয়, গুণে গুণে মদ খেতে হয়, এমনকি বড়লোক মেয়ে দেখে যে ঘরজামাই হবে, তাতেও সমাজের চোখরাঙানি? নাচ শিখোনা, ফুটবল খেলো। গান গেওনা, খিস্তি মারো। ভদ্র হয়োনা, মেয়েদের টিটকিরি দাও। বৌ পেটাও। রোজ রাতে বিছানায় রাষ্ট্রকে শিখণ্ডী বানিয়ে তাকে ধর্ষন অবধি করো। কত্তো কাজ! বাপরে বাপ!! কত্তো দায়িত্ব তোমার পুরুষ, তোমাদের ছাড়া আমরা বাঁচতাম কি’করে তাই ভাবি মাঝে মাঝে। মড়েই যেতাম হয়তো।

আর উল্টোদিকে অধিকাংশ নারীরা? দিব্যি আছে। খাচ্ছে, দাচ্ছে, আসল “মরদ”-দের দ্বারা ধর্ষীতা হচ্ছে, আওয়াজ খাচ্ছে, অথচ সকাল বিকেল এই পুরুষতন্ত্রেরই গুণগান গাইছে। নিজেরাই চলে যাচ্ছে পেটের বাচ্চা ছেলে হবে না মেয়ে সেটা জানার জন্যে। দারুণ সাম্যাবস্থা। পুরো ঝিঙ্কু।

এই “প্রায়” আর “অধিকাংশ” বাদ দিলে বাকি বাতিলদের ভেল আবার অন্যরকম। ট্রান্স? ম্যাগা! কি ঢং, কি ঢং। কেউ বলে আমি ছেলে থেকে মেয়ে, কেউ বলে আমি মেয়ে থেকে ছেলে। কেউ বলে আমি কখনো ছেলে কখনো মেয়ে, আরও গোলমেলে মানুষ আছে যারা নিজেদের ছেলেও বলেনা, মেয়েও বলেনা। এ আবার কিরকম জাত গা?

হোমোগুলোও যেন কিরকম? চোখের চামড়া নেই লা তোদের? তাও তোরা নিজেদের মধ্যে বেশ টপ-বট, বুচ-ফেম নাম দিয়ে পুরুষ/নারী এই বিভাজনকে অন্তত সন্মানটুকু তো দিলি। হুঁহুঁ বাওয়া, দেখ দেখি, কেমন কঠিন এই পুরুষতন্ত্র। ছেলে থেকে মেয়ে হবি? সেখানেও তো মেনে নিলি মেয়েদের কর্তব্য। সেই বিয়ে করে সংসার, সেই “ছেলে-কোলে-করা” মমতা(ব্যানার্জী না)ময়ী। আর মেয়ে থেকে ছেলে হতে গেলে? হ সেই, কঠিন, দৃঢ়, নাচ-গান-না-করা, ফুটবলানো, বৌ এনে ঘরে তোলা পুরুষ। এবং আরও আরও, এবং ইত্যাদি ইত্যাদি… কত্তোরকম এলো, কত্তোরকম গেলো। তবে নাচনকোঁদন যাই কর বাপ। আমরা তোদের পাত্তা দিচ্ছিনা খুব একটা। আর কে দেয় বলতো? ঐ যে তোদের হোমরাচোমরা নারীবাদি মালগুলো, ওদের লেখায় কতোবার পাস নিজেদের কথা? চারটে ছক্কা মেয়েদের টয়লেটে ঢুকলে ওরা তোদের ছেড়ে দেবে ভেবেছিস?

তাই মানে মানে কাট তো বাপ। আমার নিজেরই অনেক যন্ত্রনা। সেগুলোকে একটু গুছোতে দে। আজকাল হেব্বি চাপ যাচ্ছে। এই নতুন মানবিক ফানবিক (এবং আনবিক) আন্দোলনের জেরে, পুরুষতন্ত্রের মোড়কে উওমেনস ডে, মুখে ঝামা ঘষে মেয়েদের এয়ার হোস্টেস বানানো, হিজড়েদের দিয়ে সিঁদুর খেলানো — কত্তো যে নতুন নতুন ধান্দা করতে হচ্ছে সে কথা আর কি বলি। যায্যা! ভাগ! ফোট তো! আমায় একটু শান্তিতে ফুশশশগিড়ি করতে দে এবার।

আমার কথাটি ফুরলো

নটে গাছটি মুড়লো

কেন রে নটে মুড়লি?

কিউ বে ব্যাইঞ্চোঁ? হম কা পুরুষতন্ত্রকা পুরুষ-নুঙ্কু আছি নাকি বে? যো হরবখৎ চোদার জন্যে টনটনিয়ে খড়া রহেনা পড়েগা?

 

ছবিঃ ভুটান

 

কালিজা-২০১৯-২য়-বর্ষ-সূচীপত্র

 

Exit mobile version