বাতায়ন ও মুক্তির উচ্ছ্বাস
– অরুন্ধতী সরকার
অনুভূতি ১
——-
কবিতা লিখে পাঠালাম ক্লাসের সেরা সুন্দরীকে। কিরকম যেন হাসাহাসি চলছে ওইদিকটায়। উঠে গিয়ে দেখি তো। ক্লাস সিক্স।
অনুভূতি ২
——-
“তুই জামাকাপড় মাপার ফিতে নিয়ে কি করছিস ক্লাসে?”
বাড়ি থেকে জামাকাপড় মাপার ফিতে নিয়ে যেতে হয়েছিলো সেলাই ক্লাসের জন্যে। কিন্ত ওইদিন তো ক্লাস ছিলোনা।
“আরে এটা একটা খেলা। দর্জি-দর্জি খেলবো। তোর জন্যে জামা সেলাই করে দেবো, দেখবি?”
কিছু উৎসাহী ‘ক্রেতা’ পাওয়া গেলো ক্লাসে। দর্জির মুখে চওড়া হাসি। ‘ক্রেতা’-দেরও। ক্লাস সিক্স।
অনুভূতি ৩
——-
“চল! উপরের ক্লাসরুমে অমুক তমুককে চুম্বন করছে। দেখে আসিগা।”
গার্লস স্কুলে দুই প্রিয় বান্ধবী চুমু খাবে, এতে দোষের কি আছে? দেখারই বা কি আছে? কি জানি বাবা। ক্লাস নাইন।
অনুভূতি ৪
——-
“জানিস! আজকে ‘চ’ মেয়েটি অন্য কলেজের বড়ো, মানে বয়সে বড়ো একটি মেয়েকে কফিশপে নিয়ে গেছে। যাবি দেখতে?”
মনের মধ্যে একটা জোয়ার আসছে না? … শুনতে পাচ্ছি কেমন জানি। ক্লাস নাইন।
অনুভূতি ৫
——-
পত্রিকায় কিসব নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, সংবাদপত্রেও, ‘মাই ব্রাদার… নিখিল’, ‘ফায়ার’, আরও কিসব। ‘ফায়ার’ মানে তো আগুণ। মনের মধ্যে আজ কোন দাবানল এ? ‘লেসবিয়ান’ মানে শুধুই মেয়েতে মেয়েতে ভালোবাসা? নাকি আরও কিছু? ধুস! বুঝতে পারছিনা। ক্লাস টেন।
অনুভূতি ৬
——-
হুমম! বহুবছর আগে বাড়িতে কিসব আলোচনা হয়েছিলো। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বাবা কর্মরত তখন। অন্য আত্মীয়দের মাঝে বসে ক্লাস সিক্সের আমি শুনলাম কোন কর্মী নারী থেকে পুরুষ ‘হয়েছেন’। খুব বেশী কিছু না বুঝলেও এইটা বুঝেছিলাম যে যা হয়েছে খুব ভালোই হয়েছে। আত্মসমীক্ষা।
অনুভূতি ৭
——-
‘কুচ কুচ হোতা হ্যায়’-তে শাহরুখকে রাখার দরকার কি? যত্তোসব। আর ‘কভি সৌতন কভি সহেলী’-তে দুইজনে ঝগড়া করে কেন ওই বেআক্কেলেটার জন্যে? দুজনে তো দুজনকে ভালোইবাসে।
“‘ক্যাপ্টেন ব্যোম’ দেখিস? মিলিন্দ সোমান কি ভালো না? উফফ!!”
কে সে? মনে পড়ছে না তো। দুর! আত্মসমীক্ষা।
অনুভূতি ৮
——-
“জানিস তো, আমার না মেয়েদের খুব ভালো লাগে।”
“ছেলেদের?”
“উমম, নাহ, ঠিক বুঝিনা।”
ক্লাস টেন।
অনুভূতি ৯
——-
স্কুল পাল্টে।
“স্কুলে আর টিউশনে কতো ছেলে দ্যাখ। এই মেয়েটা, তোর কাকে পছন্দ?”
ওই তো, একটা ছেলে কবিতা লিখছে। এর কথাই বলে দিই। আমিও তো লিখি। মেয়েদের ভালো লাগে ওটা তো আমি জানি। হুঁ হুঁ বাওয়া!! ক্লাস এলেভেন।
অনুভূতি ১০
——-
আরে! ওই ডাগর ডাগর আঁখির মেয়েটা কে? বন্ধুত্ব করতে হবে।
“ওরে! তোর প্রেমিক তো ‘ক’-কে সাইকেলে নিয়ে ঘুরছে।”
“‘ক’-কে?”
‘ক’-কে তো ক্লাস নাইনে বেশ পছন্দ হয়েছিলো। আমার মতোই চুপচাপ। যাক ভালোই হলো। ছেলেটা ভালো সঙ্গী পেলো একটা। কিন্তু এই ডাগর আঁখিকে দেখলে নিঃশ্বাস কেন বন্ধ হয়ে আসে? ক্লাস ইলেভেন।
অনুভূতি ১১
——-
বেশ বুঝেছি মেয়েদের দিকেই পাল্লা ভারী। আরে! এ তো ছোটবেলা থেকেই জানি। ডাগর আঁখি আর আলগা হাসি দুজনকেই একদিন চুমু খেয়েচি। না একইদিনে নয়। ক্লাসে পড়াতে আসা ম্যাম, কমার্সের তন্বী, ডাগর আঁখির স্পর্শ, পাল্লা ভারী হতে হতে কবিতা লেখা ছেলে এখন শূন্যে ভাসছে। ক্লাস টুয়েলভ।
অনুভূতি ১২
——-
তাও কি কবিতা লেখা ছেলের কথা ভাবিনি? কলেজে ঢুকে ভাবলাম, এই তো সব্বাই জিজ্ঞেস করলেই বলবো, ওই আমার প্রথম প্রেম। ও মা! হোস্টেলের রুমে একটা মেয়ে ঢুকলো না? কলেজ, ফার্স্ট ইয়ার।
অনুভূতি ১৩
——-
বেশ বুঝে গেছি, রুমের ভিতরে, শরীরে শরীরের আবেশে, মনের উচ্ছাসে, জানলা দিয়ে হাওয়া এসে আমায় ছুঁয়ে দিচ্ছে। একটা ছেলে প্রস্তাব দিয়েছে। ফোনে কথাও বলেছে। বন্ধুরা বলছে আমি নাকি এদিকেও আছি, ওদিকেও। ‘বাই’ নাকি আমি। কিন্তু ছেলের সাথে কথায় সেই ঢেউ, কই লাগছে না তো মনে। পূর্ণতা পাচ্ছি কই? কলেজ, সেকেন্ড ইয়ার।
অনুভূতি ১৪
——-
কলেজের অভিজ্ঞতা আজ আমায় সে পূর্ণতা দিয়েছে, ছোট্টবেলায় যা মনের গভীরে থাকতো। তা মুখে আনতে একটু সময় লাগে, কিন্তু লজ্জা বাঁ ভয় করেনা। আমি এক সমকামী নারী। কলেজ, ফোর্থ ইয়ার।
অনুভূতি ১৫
——-
“মা, আমি পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হইনি কোনওদিনও।”
“তাই? তাহলে তো…”
ঘুুুমটা ভেঙে গেলো… এরপর কি ঘটলো?
বন্ধুরা… নিঃশর্ত ভালোবাসায় ভরিয়ে তোলে। কখনো ধাক্কা খাই, গুঁটিয়েও যাই গুঁটির মধ্যে, কিছু পরিস্থিতিতে। বন্ধুত্বের আড়ালে স্বরূপগুলো আঘাত দেয়। কিন্তু শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতি হওয়ার উত্তরণ তো জারিই আছে।
[‘আত্মপ্রকাশ’ একটি অবস্থান মাত্র, কিন্ত সেটি ঘটে পর্যায়ে এবং আত্মপ্রয়োজনেই।]
ছবিঃ ভুটান