৭নং মিত্তির লেন
– ভুটান
রুপেশ অফিস থেকে ফেরার পথেই ভাবতে থাকে, বাড়িতে গিয়ে কথাটা কিভাবে পাড়বে বৌয়ের সামনে? ও কি ঠিক দেখলো আজ সকালে? বার বার তো ভুল হতে পারেনা। এই নিয়ে দুবার দেখেছে তার নিজের ছেলেকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে সাজতে। প্রথমবার অতটা পাত্তা না দিলেও, দ্বিতীয়বার কিন্তু, নাহ! বেশ ভালো করেই দেখেছে। এই একরত্তি ছেলেটার মাথাও খেলো, ঐ পাশের বাড়ির ছক্কাটা? নাহ। আজ তাকে বাড়িতে সাবধান করতেই হবে। আর বৌটাও তেমনি। সারাদিন খালি এর-ওর বাড়ি গপ্পের আসর। নিজের ঘরের দিকে একটুও যদি নজর থাকে। ছেলেটাও কিভাবে যেন তাকিয়ে থাকে ছক্কাটার সাজগোজের দিকে, এমন মেয়েলি নজর দেখলে গা-হাত-পা রিরি করে ওঠে।
——
ঘরে ঢুকেই ব্যাগটা ড্রয়িং-কাম-ডাইনিং রুমের ছেঁড়া সোফাটার উপর ছুঁড়ে ফেলে নিজের রাগ দেখায় রুপেশ। যদিও তাতে মিলির যেন কিছুই আসে যায়না। যত্ন করে নিজের হাতে নেল্পলিশ পরতে পরতে মুখ না তুলেই বলে “কিছু খাবে?”। কোন উত্তর না দিয়ে বেডরুমে চলে আসে রুপেশ। ধুর বাল। ওকেই বা বলে কি হবে? সারাদিন তো ছেলেকে নিয়ে ঐ লেডিস টার বাড়িতেই পরে থাকে। এই কারনেই তো ছেলেটাও…
“এ ঘরে একবার এসো তো”। তবুও মিলিকে ডাকে।
মিলি নেল্পলিশ পরা আঙুলে ফুঁ দিতে দিতে ঘরে ঢোকে। আর তার সাথে ঝাঁঝালো স্পিরিটের গন্ধ।
রুপেশ নাক সিটকোয়, “সাজটা একটু বেশি হচ্ছেনা দিনে দিনে?”
মিলি একটু রুপেশের চোখের দিকে তাকায় এবার। গলায় আদর আনে। “ধ্যাত। যত্তো বাজে কথা। বুবুদা এনে দিলো এটা। এই দেখো। রঙটা কি মিষ্টি না?”
মিলির গলায় আহ্লাদী সুর শুনে মাথার রাগ আরো চড়ে বসে রুপেশের। “তোমায় বলেছিনা কতবার, ওর সাথে কথা বলবেনা, মিশবেনা। নিজে তো উচ্ছন্নে যাচ্ছই, ছেলেটার মাথাটাও খাচ্ছো তার সাথে”
“আমার সাজগোজের সাথে ছেলের মাথা বিগড়োবে কেন? আর তাছাড়া পাশের বাড়িতেই থাকে। না কথা বলাটা… “। অভিযোগ আর আত্মপক্ষ সমর্থনের যুগলবন্দী মিলির কণ্ঠে।
রুপেশ সেই লয় কেটে, দাঁতে দাঁত চেপে, কাটা কাটা ভাবে, কথা কটা উচ্চারণ করে। “জানো কি, বাবান আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ে সাজে, পাছা দুলিয়ে নাচে?”
মিলি শুনে হেসে গড়িয়ে পরে। হাসির দমকে বিষম লাগে তার। রুপেশের রাগ মিলির এই হাসিতে কমেনা একটুও।
হাসি কমিয়ে মিলি বলে “ওম্মা। এটা একটা কথা হলো নাকি? বাচ্চা ছেলে। তার আবার এসবের বোধ আছে কোনো?”
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মিলি হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগোয়। রুপেশ খেয়াল করেনা। মনে মনে ভাবতে থাকে, বাবান এবার ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবে, তাও নাকি বাচ্চা। হুহ! সাধে বলে মেয়েছেলে।
——
রাতে, খাবার টেবিলে ছেলের দিকে ভালোভাবে তাকায় রুপেশ। অনেকদিন পর। এতোটা ভালোভাবে বোধ হয় যখন একেবারে ছোট্ট, তখন দেখেছে। ছেলেকে তখন দুহাতে তুলে বুকের কাছে নিয়ে আসতো। এখন হয়তো। নাহ। আর পারবেনা। বাবানের ছোট্ট মুখে পুরো মিলির মুখ কেটে বসানো। মায়ের মতো মুখ কি ছেলেদের মানায়? খটকা লাগে রুপেশের।
——
সকাল সকাল নানান হাসির শব্দে ঘুম ভাঙ্গে রুপেশের। আজ অফিস দেরি করে গেলেও হবে।
তাদের ৭ নং মিত্তির লেনের এই সরকারি কোয়ার্টার গুলো ইদানীং পুরো ক্লাবঘর হয়ে উঠেছে। ধুর দু-কামরার কোয়ার্টারে থাকার এই এক চাপ। যে যখন খুশি আসবে, যখন খুশি যাবে, কোন সময় অসময় নেই। হাসির সাথে একটা দুটো কথাও ভাসছে সকালের হাওয়ায়। রুপেশের ঘুমজড়ানো বিছানা থেকে পাশের ঘরের তাড়াতাড়ি উঠে পরা সোফার আওয়াজ খানিকটা অস্পষ্টই শোনায়। তবুও সবচেয়ে তীক্ষ্ণ, চড়া, কানে তালি বাজার মতো হাসিটা যে ঐ বুবুর, এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয়না রুপেশের। সেই, যবে থেকে মা বাবা পটল তুলেছিলো, আর দাদা বিয়ে করে তার হাইফাই বৌকে নিয়ে আলাদা হয়েছিলো, তবে থেকে, তবে থেকে মালটা আর এ বাড়ির চৌকাঠ মাড়াতে সাহস পেতনা। কিন্তু এখন? মিলি তাকে পাত পেড়ে ঘরে এনে তুলেছে।
——
সবাই চলে গেলে স্নান সেরে খেতে বসে রুপেশ। কোন কথা বলেনা আজ। মিলির হাতের চুড়িগাছার অহেতুক আওয়াজে আরো বিরক্ত লাগে। যদিও এই আওয়াজ নতুন নয়। রোজই তো শোনে রুপেশ! কাল রাতেও তো ঘেমো দুই শরীর ঘুমানোর আগে…। কিন্তু আজ? ঠিক এই মুহূর্তটায়? নাহ! কান পাতা যাচ্ছেনা।
মিলি হাতের কাজ সেরে রুপেশের পাশের চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে, হাসিমুখে। এই হাসিমুখে অস্বস্তি আরও বাড়ে রুপেশের। এমনিতে তার বৌ যে অল্টাইম মুখ ভার করে রাখে তা না, তবে কিছু কিছু সময় মিলি হাসলে রুপেশের খরচ বাড়ে।
——
কথায় ভুল ভাঙলো।
“এই জানো? আজ আমায় বুবুদা কি বলেছে?”
আবার সক্কাল সক্কাল সেই নাম, দিনটাই খারাপ যাবে। মুখে বিরক্তি নিয়ে চোখ কুঁচকে তাকায় সে। মিলি কিন্তু বলে চলে।
“বলেছে বুবুদার নাকি আবার একটা লাভারও আছে। ছেলে লাভার।” কথাটা বলেই হেসে গড়িয়ে পড়ে মিলি। রুপেশের মনের আগুনে ছ্যাঁক ওঠে।
দপ করে চোখে আগুণ এসে আবার মিলিয়ে যায়। এই গাম্বাট মেয়েছেলেটা তার বৌ। অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে এবার। তর্ক করার সময় এটা নয়। এক ঝটকায় উঠে পড়ে টেবিল ছেড়ে। হাত ধুয়ে, ঘরে ঢোকে ব্যাগটা নিতে। মিলি একটু অবাক হয় এই আকস্মিক ব্যবহারে।
“কি হয়েছে বলোতো? মুখের ভাতটাও প্রায় ফেলে আসলে।”
“তোমার খুব মজা লাগে, না? এসব শুনতে? খুব? খুব মজা পাও, তাই না?”
“ও মা, এতে আর খারাপ কি? এখন তো শুনছি কতকিছুই হয়।” ফিক করে হেসে মিলি বলেই চলে।
——
দড়াম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আগে কিছুটা ধাতস্থ হয় রুপেশ। রাস্তার একটা নোংরা চায়ের ভাঁড়কে পায়ের চাপে কুচিকুচি করে।গোটা দুনিয়ার সমস্ত হোমোচোদানে গল্পও নিশ্চয়ই করেছে মিলির কাছে। যেখানে গিয়ে যা খুশি চোদা হারামি। কিন্তু এই মিত্তির পাড়ায় এসব হোমো নোংরামো কিছুতেই মেনে নেওয়া যাবেনা।
নাহ ছেলেটাকে বাঁচাতেই হবে। নইলে…
আর তাছাড়া ব্যাপারটা হয়তো অনেকটাই সহজই হবে। সব্বাই জানে বুবু একটা হোমো মাল। ছোটবেলা থেকে রুপেশ, ওর বন্ধুরা, ওকে কম টিজ করেছে? একবার তো দোলের দিন, শাল্লাহ, ওর পোঁদে…।
বাল! তবুও মালটা একিরকম লেডিসমার্কা হয়ে রইলো। বড়ো বয়সে এসেও এসব মাগিপনা? উফ! চোখে দেখা যায়না। আর সেবার কালীপূজার রাতে, ক্লাবের ছাদে, মদের নেশায়। রুপেশের ক্রুর চোখদুটোর জ্বলজ্বলে জোনাকিতে কিরকম একটা নৃশংসতা দেখা দিলো। চিন্তাগুলোকে আপাতত সঙ্গে নিয়েই বাসের পাদানিতে উঠে পড়লো।
——
মিলির আর কোন কাজ হয়না। তার বরের এই ব্যবহার, এই রাগে, ছোট্ট একটা কারণে। কিন্তু সত্যিই কি… না না এগুলো নিশ্চয়ই ওর বাড়াবাড়ি চিন্তা।
রুপেশ বরাবরই খুব একগুঁয়ে। আর, আর অদ্ভুত। কিন্তু এই রহস্যের আকর্ষণেই এক কাপড়ে তার সাথে ঘর ছেড়েছিল মিলি। তারপর থেকে মানুষটা অফিসে খাটে। অনেকদিন বেশ রাত করেও ফেরে। মিলিও চেয়েছে কতবার ওকে আর্থিকভাবে কিছু সাহায্য করতে। কিন্তু মিলির চাকরি করায় রুপেশের আপত্তি ছিলো। মিলি নিজেও আর কখনো জোর করেনি এসব নিয়ে। রুপেশের নামটা প্রথম তার কানে আসে কলেজে পড়ার সময়ে, ওদের কলেজের সামনের মাঠে যখন ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো রুপেশকে বহুবার দেখেছে মিলি খেলতে। গোলকিপার। জীবনেও সে বরাবরই তাই। কেমন যেন সবদিক সামলে চলার চেষ্টা। হা করে তাকিয়ে থাকতো মিলি। শুধু মিলি কেন? পিয়া, ঋতা, আয়েশা, সব্বাই। তাকিয়ে থাকতো ধুলোমাখা কাদামাখা পেশিবহুল ঐ শরীরটার দিকে। আর মুখের মিষ্টি দৃঢ়তার দিকে। বিভিন্ন সময় আলাদা আলাদা রঙের গেঞ্জি পরে খেলতে নামতো রুপেশ। পড়ে ওর কাছে শুনেছে ওটা নাকি “খেপ খেলা”।
রুপেশ কিন্তু কোন মেয়ের দিকে তাকাতোনা। খুব ভালো করে লক্ষ্য করেছিলো মিলি। কেমন যেন বেপরোয়া। কেমন যেন রহস্যময়। বিয়ের পর থেকে মিলিও কখনো কোন ছেলের দিকে তাকায়নি। এখন রাস্তায় ছেলেরা ফুটবল খেল্লেও মিলির ইচ্ছেও হয়না তাদেরকে একবার আড়চোখে দেখার। হাসি পায়। ছেলেমানুষি মনে হয়।
রুপেশ এখনো আকর্ষণীও, একিরকম রহস্যময়। অধিকাংশ সময়ই অনেক রাতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফেরে তার বর। মাঝে মাঝে, কিছু কিছু রাতে, তার শরীরে যখন ঘষা খায় ফুটবলারের পেশীতে লেগে থাকা রাশরাশ ধুলো, রক্তে মেশে একতাল কাদা, হয়তো যান্ত্রিক নিয়মেই, মিলি তবু জোর পায়। সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেওয়ার জোর। আলগোছে আদরে খুঁজে নেয় জোরালো ভালোবাসা।
বুবুদা কিন্তু এখনো তাকিয়ে থাকে রাস্তায় ফুটবল খেলা ছেলেগুলোর দিকে। মিলি জিজ্ঞেস করেছিলো একবার। হাসতে হাসতে বলেছিলো “কি করবো বলো? আমার তো আর তোমার মতো হ্যান্ডসাম বিয়ে করা বর নেই। হি হি হি হি…”। হাসিটা ভালো লাগেনি মিলির।
তবু বন্ধু বলতেও তো আর কারোর সাথে সেরম যোগাযোগ নেই মিলির। সবাই তো নিজের নিজের জীবনে ব্যাস্ত। একমাত্র বুবুদার সাথেই সময় কাটে তার। আর সঙ্গে থাকে রুপেশের জন্য অপেক্ষা।
“বাবান, শোন তো একটু।”
“কি মা?” মর্নিং স্কুল থেকে ফিরে, রঙের খাতাটায় নিজের মনে আঁকিবুঁকি কাটছিলো বাবান। মায়ের ডাকে খাতা হাতেই এসে হাজির। অন্য হাতে লাল, গোলাপি, আর আকাশী স্কেচপেন।
“কি আঁকছিলি রে?” হাতের খাতাটা বেশ জোরেই টেনে নিয়ে মিলি দেখতে থাকে। প্যাস্টেলের পুতুল। জলরঙের পুতুল। স্কেচপেনের পুতুল। লাল, নীল, কমলা, মেরুন, সবুজ, হলুদ বিভিন্ন সাজ পোষাকে, পাতার পর পাতায়, খালি সেই পুতুল।
“এই তুই খালি পুতুলের ছবি আঁকিস কেন রে? আর কিছু আঁকতে পারিসনা? স্কুলে কি শুধু পুতুল আঁকা শেখায়?”
বাবান কিছু বলেনা। চুপ করে থাকে। তার সাধের খাতা হঠাত কেড়ে নেওয়ায় সে অনেকটাই অবাক। তার পর মাকে খুব একটা এরকম রাগি গলায় কথা বলতেও শোনেনা সে। শেষ শুনেছিলো অঙ্ক পরীক্ষায় একটা সোজা অঙ্ক ভুল করার জন্য। কিন্তু আজ তো সে কোন পরীক্ষা দিয়ে ফেরেনি।
ছেলের হতভম্ব মুখ দেখে সুর কিছুটা নরম করে মিলি। বুবুদা বাবানের সাথে কি গল্প করে, তা তাকে জানতেই হবে। বেশি বকাঝকা করলে এ ছেলে কিচ্ছু বলবেনা। ভীষণ গোঁয়ার তৈরি হয়েছে। বাবার মতো।
——
“এই বাবান, দেখ। তোর সেই ম্যাগনেটটা খুঁজে পেয়েছি।” মিলি শোকেসের তাকে পাতা খবরের কাগজের নিচ থেকে ম্যাগনেট এনে দেখায় ছেলেকে।
“মা! এটা তুমি কোথায় পেলে?” বাবানের মুখে বিস্ময় আর আনন্দের ছাপ স্পষ্ট।
হাতের কাছে নিয়ে এসে ভালো করে দেখে বলে “হ্যাঁ। এটাই তো সেটা। উপর দিকটা একটু চাঁদের মতো করে ভাঙা। বলো না মা, কোথায় পেলে।”
“ঐ বুবুকাকুর মা আমায় দিলো। দেখিস না ঠাম্মাটা কেমন আঁচলে বেঁধে রাখে সবকিছু? এটাও রেখেছিলো। তুই তো সবসময় ওখানেই থাকিস।”
বাবান শুধু ম্যাগনেটের মসৃণ ত্বকে হাত বোলায়।
“তুই বুবুদার সাথে এতো কি গল্প করিস রে?”
“উহু! কই? বুবুকাকুই তো কতো গল্প করে। মজার মজার। বলে পুজোয় নাকি একটা ম্যাক্সি কিনবে, ঐ তুমি যেমন পরো, তেমন। আর মেয়েদের জুতো। আচ্ছা মা, তুমিই বলো, ছেলেরা কেউ অমন কিছু পরে কখনো?”
বাবানের সরল কৌতূহলে মিমির আশঙ্কা আরো জেঁকে বসে। রুপেশের কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
“ধুস ও তো এমনি বলে, মজা করে। পাগল একটা। তুই কিন্তু ওর সব কথা সত্যি ভাব্বিনা। তুই ওখানে না গিয়ে তো ধীমানের ভাইদের সাথে খেলতে পারিস রে।”
বাবান মুখ বেঁকায় “ধ্যাত! ওরা কেউ খেলায় নেয় না আমায়। আমার ভালো লাগেনা ওদের।”
বুবু ঘরে ঢোকে একটা ফেয়ার অ্যান্ড লাভ্লির টিউব হাতে করে।
“এই নাও গো ক্রিমটা। অনেএএকটা আছে এখনো। একটু টিপে টিপেএএএ, বের করতে হবে।”
মিলি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি ফেরায় বুবুদার দিকে। “আমি তো ক্রিম চাইনি, বুবুদা।”
“ও মা, বাবান তো চাইলো আমার কাছ থেকে, মাখবে বলে। আমায় মাখতে দেখে তো প্রায়ই। বলে, ও মাখবে। তোমার ছেলের কিন্তু খুব সাজগোজের শখ আছে মিলি, আমার মতো।” ক্রিমটা টুলের উপর রেখে, লালচে ঠোঁট এলিয়ে বুবু হেসে চলে গেলো।
এই দ্বিতীয়বারও, মিলির বুবুদার হাসিটা ভালো লাগলোনা। ওটা কি সৌহার্দ্যের হাসি? না করুণার? উফ! মিলি ছুড়ে ফেলে দেয় টিউবটা। ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। বোঝার চেষ্টা করে। বুবুদার মতো সাজগোজ করা মানে কি বুবুদা হয়ে যাওয়া?
বাবান কিছু হয়তো বোঝে, কিছু হয়তো বোঝেনা। তবে মাথা নিচু করে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তাকিয়ে থাকে প্রায় মড়ে যাওয়া টিউবটার দিকে।
——
রুপেশ একতলার সিঁড়ি থেকে দেখতে পায় তিনতলার টিউবটা দপদপ করছে। হয় টিউব গেছে নয় স্টার্টার।হয় কম খরচ নয় বেশি খরচ। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে অন্ধকারে ধাক্কা লাগে, উগ্র মেয়েলি পারফিউম এর সাথে ছেলেলি ঘামের গন্ধের বিশ্রী মিক্সচারটা নাকে আস্তেই বুঝতে পারে, কার সাথে ধাক্কা লাগলো। চওড়া অথচ কোমল শরীরটার ধাক্কায় হাল্কা টাল খেলেও নিমেষে অনায়াসে নিজেকে সামলে নেয় সে।
“এমাআআআ! রুপুউউউ! লাগেনি তো?” বুবু হাত দিয়ে রুপেশকে ধরতে যায়। রুপেশ এক ঝটকায় নিজেকে ছিটকে দুরে সরিয়ে আনে।
“এই খানকি। সর। ধরবিনা আমায়। দেখলেই পোঁদে চুলকুনি হয় না? গায়ে হাত দেওয়ার খুব শখ?”
বুবু দু পা পিছিয়ে যায়। খুব খারাপ লাগলেও অসম্মানটা গিলে নিয়ে বলে “কেন মুখ খারাপ করছিস রুপু? আমি তো শুধু…”
“কেন করবোনা বে? তুমি আমার বৌ ছেলের মাথা খাচ্ছো, আমি কি তোমায় পূজো করবো উদ্গান্ডু? আমার ছেলের সাথে তোর এতো কি রে? ওকে কি লাইনে টানবি ভেবেছিস?”
“আমার কোন লাইন নেই বুবু। আমি তোদের মতো এক লাইনেই আছি। নিজের গলা আর বুকের মাঝে মাঝে হাত ছুঁইয়ে কোমলভাবে ধুলো ঝাড়ার চেষ্টা করে বুবু।
রুপেশ ঘৃণায় ওর বুকের দিকে একবার দেখে নিয়ে চারদিক আবার ভালো করে দেখার চেষ্টা করে, অন্ধকারে। তারপর দাঁতে দাঁতে বলে “আর আমার বৌ? ওর সাথেই বা তোর এতো নকড়াছকড়া কিসের? কি কথা হয় তোদের?”
বুবু হঠাত নিমেষেই অনেক কিছু বুঝে ফেলে।
“ভাবিসনা। আমি মিলিকে কিছু বলিনি আগের কথা; তোর আর আমার, আগের কথা।” শেষের কথাগুলো একটু থেমে। রুপেশের দিকে সরাসরি তাকিয়ে।
রুপেশ বুবুর চোখের দিকে আর তাকায়না। তাকাতে চায়ওনা। বুবু পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেবে যায় নিচে। সঙ্গে সেই বিশ্রী মিক্সচার গন্ধটা।
রুপেশ কিছুক্ষণ ঐ দপদপ করা আলোটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথায় সকালের রাগটা যেন আরো রেগে যায়। “মালটার কত সাহস!! কি বলবে ঐ গান্ডুটা? কি এমন রাসলীলা করেছি আমি তোমার সাথে? আর আমি বাল একা নাকি? পাড়ার অনেক পুরুষমানুষই তো… আমারটাই খাসখবর, না কি? সিঁড়ি উঠতে উঠতে বিড়বিড় করতে থাকে। সিঁড়ির এক কোনায় লেপটে থাকা পানের পিকটাকে মাঝ বরাবর কেটে এক দলা থুতু ফেলে সে।
সেই কালীপূজোর রাতে যখন গোটা পাড়া বুবুকে নিয়ে খিল্লি করা শুরু করে, রুপেশের কিন্তু মজাই লাগছিলো। ঐ বুবুর নাম রেখেছিলো। ভেসলিন। ও যদিও সেভাবে ডাকতোনা, দাদার ভয়ে। তবে বাকিরা ডাকতো। তাছাড়া বৌদি, ছক্কা, দিদি, লেডিস, এগুলো তো ছিলোই। বুবুর সাথে তখন থেকেই একটা দূরত্ব এসেছিলো রুপেশের। কথা বলতোনা ঐ হোমোর সাথে। বুবুও লজ্জায়, ভয়ে, রুপেশকে দেখলে দুরে দুরে থাকতো। একবার নাকি সুইসাইডও করতে গেছিলো। পারেনি। রুপেশ সেদিন মামাবাড়িতে। বুবুর লজ্জা লাল থেকে বোধ হয় সেদিনি আরো বেড়ে বেগুনি হয়ে গেছিলো। আর আজ কি দেমাক। ছক্কাদের এতো দেমাক কিসের? এখনো যদি ওকে সবাই মিলে একইভাবে হিউমিলিয়েট করা যেতো, তাহলে এসব দেমাক নিয়ে মওগাবাজি পেছন দিয়ে বেড়তো।
——
সকালে ধীমানের ভাইদের সাথে খেলবে বলে ব্যাট হাতে বেরিয়েছে বাবান। তার মায়ের পরামর্শে। কিছুটা আশ্বস্ত হয়েই অফিসে এসেছিলো রুপেশ। যাক মিলির তাহলে মগজে ব্যাপারটা ঢুকেছে। খুব খারাপ বৌও পায়নি সে। এটা রুপেশ বোঝে। আর কেউ কি সত্যি কখনো এতোটা তাকে ভালোবেসে সবকিছু ছেড়ে আসতে পারতো? কতটুকুই বা দিতে পারে সে? একটা মেয়ে সারাদিন সংসারের নানা কাজের মধ্যে থাকে। বাইরেও খুব একটা বেড়োয়না। দুজনকে নিয়েই আঁকড়ে বেঁচে আছে। বাবান আর সে নিজে। খুব ভালো ছবি আঁকতো মিলি। কোথায় কোন বুটিকে একটা কাজও পেয়েছিলো। রুপেশই রাজি হয়নি। সুন্দরী বৌ বাড়ির বাইরে না যাওয়াই উচিৎ, দিনকাল মোটেই ভালো না।
——
এই পুরোনো নোংরা ফাইলের স্তূপ ধাপার মাঠের থেকেও কুচ্ছিত। এসব এক হাতে ম্যানেজ করা…, আর ফ্যানটাও কিভাবে চলছে, তিনটে ব্লেডই দেখা যাচ্ছে। একরাশ ঘামে রুপেশ যেন আবার স্নান সেরে নেয়।
“আরে ও গাঙ্গুলিদা, আসুন না একবার। এই জঞ্জাল কি একা সাফ করা যায় নাকি?”
পাশের কেবিন থেকে গাঙ্গুলিদা কোন উত্তর দেননা। রুপেশ জানে কথাগুলো ঠিকই কানে ঢুকেছে। সিনিয়ারকে চট করে কিছু বলার সাহসও তার নেই। মেজাজটা যদিও যা তেতো হওয়ার হয়ে গেছে। মনে মনে প্রনম্য সিনিয়ারকে বাছাই করা চারটে কাঁচা খিস্তি দিয়ে সে লাল ফিতেয় বাঁধা ফাইলগুলোয় মন দেয়।
পকেটের ফোনটা বাগরা দেয়, বেজে ওঠে। আওয়াজটা ধীরে ধীরে আস্তে থেকে জোরে হওয়া শুরু করে।বাঁহাতে ফাইলগুলো কোনোমতে ঠেকিয়ে ডানহাত দিয়ে ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে আসে সে। মিলি। ধুর বাল। এখন আবার কি? চাল? না নুন? না তেল? ফোন কেটে দিলো সে। এই এক অভ্যেস তার লাডলি বৌয়ের। কাজের সময় যে কেন বিরক্ত করে বুঝিনা। কতবার বারণ করেছি। সেই এক জিনিস। আজ কি আবার বাইরে থেকে খাবার আনতে হবে নাকি? হার হাভাতে ফ্যামিলিতে থেকেও যত্তো ফ্যাকনা আবদার। পটের বিবি। রূপ তো কম ছিলোনা মামনি, কোন বড়োলোককে ফাঁসালেই তো পারতে। এই খেপখেলা মালকেই মনে ধরলো?
হ্যাঁ। খেপ খেলা দেখেই তার বৌয়ের তাকে নাকি পছন্দ হয়েছিলো। মিলি রুপেশকে বলেছে সে কথা। যদিও সে কি এখনো খেপ খেলেনা? শালা জীবনটাই তো বড়ো খেপ একটা।
ফোনটা আবার বাজলো। আবার কেটে দেয়। তিনবারের বার অগত্যা একরাশ বিরক্তি নিয়ে রুপেশ ফোনটা তোলে।
“কি হয়েছে কি? কতোবার বলেছি তোমায়, যে আমি যখন কাজের জায়গায় থাকবো…”
ফোনের ওপাশ থেকে ডুকরে কেঁদে ওঠে মিলি।
“আরে কি হলো কি?এমন কি বললাম বাওয়া?”
“ওগো! বুবুদা!”
“উফ আবার বুবুদা?” ঝাঁঝিয়ে ওঠে রুপেশ। শেষে বুবুদার গপ্প শোনার জন্য তার বৌ এই ভরদুপুরে অফিসে তাকে ফোন করেছে?
“বুবুদা আর নেই।”
“নেই মানে!! ঠিক করে বলো নেই মানে কি?”
“সুইসাইড করেছে। পুলিশ এসেছে। বাবানকেও কিসব জিজ্ঞেস করছিলো। বডিটা নিয়ে…” ফোনটা কেটে যায়। বোধ হয় ব্যালেন্স শেষ। মিলি ভরাতে বলেছিলো। ইচ্ছে করেই রুপেশ আর ভরায়নি।
কথাটা শুনে প্রথমে একটু থম মেরে যায় রুপেশ, তবে মনে মনে সেই আবার বিড়বিড়িয়ে ওঠে “এত্দিনে আপদ বিদেয় হলো।“ তার ছেলেকে নিয়ে পুলিশের টানাটানি শুনে দুশ্চিন্তা হলেও; খুব হাল্কাও লাগে তার, এক মুহূর্তের জন্য চোখদুটো চকচক করে ওঠে রুপেশের। ঠোঁটে খেলে যায় নির্মম হাসি। এটাই তো চেয়েছিল সে। না মরলে হয়তো সেই খুন করে আসতো কোন একদিন। বুবু শেষ। অতীত শেষ। আহ! কি শান্তি। কিন্তু তবুও, মনটা কেন জানি খারাপ লাগতে শুরু করে। বাড়ির দিকে টানে। এরকম এক জটিল মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় তার নিজের অবাক লাগে। কাল রাতেই ওরম একটা ঘটনা, বুবুকে অন্ধকারে ভালো করে দেখতেও পারেনি সে। তার চোখে কি কোন জল ছিলো? জানা নেই।এটা কি অপরাধ বোধ। ধুর এতো ভাবছে কেন সে? তবে তার ছেলেটা তো বাঁচলো। বাড়ির আশেপাশের পরিবেশটা ভালোও লাগবে। বাবানকে নিয়ে আর চাপ খেতে হবেনা। তবে তা কতোদিন? এই ঘটনার পরেও, বাবান কি বাঁচলো? বুবু কে সে তার অতীত চাপা দিতে মনে মনে খুন করেছে অনেকবার । তাই কি বুবু মরলো শেষে। মিলিকে কলব্যাক করতে গিয়ে এইসব চিন্তাগুলো তালগোল পাকায়। বাবানের জন্য কে বেশি ক্ষতিকর তাহলে? কথাটা ভাবতেই বলিষ্ঠ রুপেশের সমস্ত মাংসপেশী এক অচেনা অনুভূতিতে কেঁপে উঠলো।
ছবিঃ লেখক
( বঙ্কু ম্যাগাজিনে পূর্বে প্রকাশিত )