কাঁচালঙ্কা

সরল গল্প 

— সরল গল্প —

— সুমন সাহা

 

— (ক) —

কিসব যেন ঘটে চলেছে রত্নাবলীর বাড়ি ঘিরে! ভৌতিক ছ্যাবলামো, আরও অনেক কিছু। সকালে আজ আমি যখন ঐরিকের আঙুলগুলোয় মুখ বোলাচ্ছি, পুরুষ-পুরুষ গন্ধটায় মাতোয়ারা মন, ঐরিক অন্য হাত দিয়ে আমার কোমরের চর্বিগুলো চটকাচ্ছে, ফোনটা ভ’ ভ’ করে উঠল আচমকা ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে। ভাইব্রেশন মোড মাঝে মাঝে চমকে দেয়, বিরক্ত করে। আলুথালু ভাবে উঠতে হল। ওঠার সময় ভারী শরীর কবজা করে ফেলছে আজকাল, মাঝে মাঝে। ঐরিক বলে, দিন কে দিন বঙ্গীয় ষাঁড়ে পরিণত হচ্ছি। শরীর ভরে যাচ্ছে। তা বাবা, শরীরে মাংস জমা ভাল নয়? আগে আগে তো তোর বক্তব্য ছিল রোগা পটকা দেহ অপছন্দের। এখন এই থলথলে শরীর নিয়ে যত ইচ্ছে দুষ্টুমি কর! চিজ-আইসক্রিম-বিরিয়ানি-ফুচকা’দের আজকাল ধন্যবাদ জানাচ্ছি হটাৎ হটাৎ। মোবাইলে রত্নাবলীর নাম আর নাম্বার। রিসিভ করার আগে ফ্ল্যাশব্যাক এল। আসতে হয় বলেই এল। কলেজ জীবনের বন্ধু, থিয়েটার করত, কথাবার্তায় চকচকে ছিল, আমার এখন যেমন ফিগার, ওর তখন ঠিক সেই ধরনের ছিল। কলেজ শেষের পর মালটা যোগাযোগ কেটেই দিয়েছিল প্রায়। ওর যে নাম্বারটা ছিল আমার কাছে, ফোন করলেই জানান দিত রং নাম্বার। থার্ড ইয়ারে প্রেম-ফ্রেম করে একসা! বছর দুয়েক ঘাপটি মেরে ছিল। থার্ড ইয়ারে মাইয়ার ক্যান্টিনরুমে যাতায়াত শুরু যেই, অমনি খটকা জন্মাল গোটা ডিপার্টমেন্টে। এমনি আমাদের ডিপার্টমেন্টটাতে একতা বলে কিছু ছিল না, সেটা অবশ্য ফার্স্ট ইয়ারের শেষাশেষিই বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কেউ ক্লাসে আসছে, আসছে নাও আবার, কেউ কথা বলছে, বলছে নাও আবার! কেমন একটা ছাড়া ছাড়া ভাব, আর সব কেমন যেন জোড়ায় জোড়ায়। যেখানেই যাচ্ছি একটা রাজা, একটা রাণী। রাজাটা হয়ত সেলফি স্টার, তার রাণীটা বোধকরি অতটা কায়দা রপ্ত করেনি তখনও অবধি। কোথাও কোথাও রাজা রাণী দুজনেই সুপার ডুপার হিট, মধ্যমণি। ইউনিয়ন রুমে, ক্যান্টিনে, লাইব্রেরিতে, ফাঁকা ক্লাসরুমে। সব জায়গায় আগে থেকেই গল্প তৈরি হয়ে আছে। আর সমস্যা হয়ছে যত আমার। প্রেম চেনার আগেই শরীর চিনে বসে আছি এবং শরীর নিঃসৃত অলৌকিক মায়ায় জড়িয়ে গেছি। তাও সমশরীর! তখন ভাবছি কেবল, আমায় একটা না একটা রোম্যান্টিক গল্পের অংশীদার হতে হবে। তখন যে কোনো ছেলে দেখলেই গলে তরল হয়ে যেতাম। কলেজ পত্রিকায় যৌনতার ‘য’ উচ্চারিত হত না, কারণ কলেজটা আমার ততোধিক লিবারাল ছিল না। সেইখানে এলজিবিটি নিয়ে লিখে আমি বলতে গেলে প্রায় একখান মিনি বিপ্লব করেছিলাম। ওসব থাক। রত্নার কথায় ফিরি। এটা আমার গল্প নয়, এটা রত্নাবলীর গল্প, রত্নার জীবনে কিসব ভুলভাল ঘটছে, এটা সেসবের গল্প।

— (খ) —

শাক্যজ্যোতি নামে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একখান রোমহর্ষক তরুনকে মাঝে মাঝেই ক্যান্টিনরুমে গিয়ে গান শোনাতে হত। বলিউডের চলতি গান অথবা যে গানে প্রেম আছে বা যে গান মনের ভিতরে স্ফূর্তি জোগায় এরকম গান শোনানোর আবদার করত ইউনিয়নের রাজারা রাণীরা। সেই টানে আমাদের রত্নাবলীও যেত। এর অনেককাল আগে থেকেই ওর আর গায়কের মধ্যে কিছু একটা চালু হয়ে গেছে। গোটা ডিপার্টমেন্ট জানত আমি আর রত্না ফর এভারের জন্য সিঙ্গল, আমি একটি বৌদ্ধিক মানুষ, ঠিকঠাক কাটকাট ছেলে নই এরকম কেউ, আর রত্নার ওই ভারিক্কি চেহারা নিয়ে ভালবাসা-টাসা পোষায় না। ওকে ফুটপাথের গোলাবরফ দাও, উত্তেজিত হবে অথচ দোকানদারের ফুলে থাকা প্যান্টের ডগা দেখিয়ে দাও, ও এনজয় করবে না। রত্নাবলী সেন্টিমেন্টাল ছিল না, অথচ মার্কস-ফার্কস ও কোনদিন ছোঁয় নি। মানে যা যা পড়লে কিংবা করলে কোনো উনিশ কুড়ির মেয়ের মধ্যে থেকে ন্যাকামো সুলভ ভাব উবে যাবে কি বিরুদ্ধ মনোভাব জন্ম নেবে তা তা ও কখনোই পড়েনি কিংবা করেনি। ‘তিমিরযোজনা’ শো’টা দেখার সুযোগ হয়েছিল, রত্নার দলের , রত্নার অভিনয়। লাল রণচন্ডী-রূপী রত্নার ডাগর ডাগর চোখদুটো এখনও মাঝে মাঝে ভয় ধরায়। অতীত এসে মনের মধ্যে ছলাৎ করে ওঠে। ভয় লাগে আবার ওর আর শাক্যজ্যোতির মাখন মাখন গল্পের কথা ভাবলে মজাও লাগে।

ফোন কানে নিতেই রত্নার মিউমিউ গলা: ‘হ্যালো বিট্টু!’
‘বল।’
‘ডিসটার্ব করলাম? জরুরী কথা বলার আছে।’
‘না রে। বল না কি কথা!’
‘বাড়িতে এখন কেউ নেই বুঝলি ! সায়ন্তন বেরল সাড়ে আটটা নাগাদ, পিংকির স্কুল তো জানিসই ছ’টা থেকে প্রতিদিন।’
‘হ্যাঁ। তো কি হয়েছে তাতে? কি জরুরী কথা বলবি?’
‘শোন না! পিংকির জন্য টিফিনে আজ পাস্তা করেছিলাম, জানিসই তো মেয়েটা কত ভালবাসে। গাজর, বিনস, পেঁয়াজ, দু’রকম সস দিয়ে। .. ওমা মেয়েকে জামা পরিয়ে কিচেনে ঢুকে দেখি, টিফিন বাক্স নেই! উধাও!’
যেন কত্ত উৎসাহ পেয়েছি ওর কথায় এরকম ভঙ্গিতে বললাম : ‘তারপর তারপর!’
‘আমি তো অবাক বুঝলি! কে নিতে পারে? বাড়িতে চতুর্থ প্রাণী নেই আর। সায়ন্তন লুকিয়ে চুরিয়ে এসব খাওয়ার বান্দা নয়। তাছাড়া ও বাথরুমে তখন! মেয়েকে তো আমিই জামা পরিয়ে এলাম। তাহলে? তখনই ভয়টা জাপটে ধরল। তোকে বলেছিলাম না ..’

মাসখানেক ধরে এমন অনেক কথা রত্না ঘ্যানর ঘ্যানর করছে যেগুলোর বাস্তব ভিত্তি নিই। যেমন ওর কুর্তিতে কেউ মাঝে মাঝে বমি করে দেয়। কখনও কখনও ওর ব্যাগ থেকে ফিমেল কন্ডোমের প্যাকেট পাওয়া যায়। একদিন বাথরুমে কাউকে স্নান করতে শুনেছিল। ও বারান্দায় জামা মিলছে, গোটা বাড়ি ফাঁকা, বাথরুমে জলের আওয়াজ। একবার দুপুরে শুয়ে আছে, শুয়ে শুয়ে সানন্দা পড়ছে, আচমকা ফ্যান থেমে গেল। ফের চালু হল। আবার থেমে গেল। অথচ ঘরে লাইট জ্বলছে (তখন হালকা শীতকাল, জানলা দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া আসে, সদ্য মনে ভয়ের প্রবেশ। তাই দিনের বেলা আলো জ্বেলে রাখা)। একবার এক বিকেলবেলায় বারান্দার ওদিক দিয়ে কাউকে ছুটে যেতে দেখা গেল। আর কি কি যেন। মনেও নেই ঠিক। যখন বছর কয়েক আগে পুনরায় আমাদের দেখা হল অ্যাক্রোপলিস মলের ফুডকোর্ডে, তখন কিন্তু ও এই রকম ছিল না। সায়ন্তনকে পাশে নিয়ে কিরকম যেন খুশিটি জমাটি। অথচ আজকাল রত্নাকে অজানা এক ভয় তাড়া করছে। এই যেমন আজ। রত্নার বাড়ি যেতে হবে, জলদি। ফোনে ওসব বলার পর ও জানাল, বেডরুমে ও নাকি ওর মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছে, টাটকা দেহ।

— (গ) —

সাড়ে দশ। ঐরিক রেডি হয়ে কাজে চলে গেল। গতকাল রাতে এসেছিল, অফিসের জামাকাপড় সঙ্গে করেই এনেছিল। রাতের দিকে আজ আসবে আবার। আমরা একটু বেরব ওদিক এদিক। এই একটু বিগবাজার। রাতের খাওয়া একসাথে। ভালবাসা, রাতভোর। তারপর ফের একখানা গতানুগতিক সকাল।

আজকের সকালখানা সেরকম নয়। রত্নার বাড়ি ছুটতে হচ্ছে, বেচারি ভয় পাচ্ছে খুব। একটা ডাক্তার দেখাতে হবে সায়ন্তনকে বলে। মালটা বৌয়ের প্রতি নজর দেয় না মোটেই। দিনরাত ফেসবুকে ব্যাস্ত থাকে; ফ্রেন্ডলিস্ট নেড়ে ঘেটে দেখেছি বড় বড় বুবস্-ওয়ালা মেয়েদের ছবি সাটানো প্রোফাইল ওর লিস্টে। ফেক অ্যাকাউন্ট বেশির ভাগ। দিনরাত আন্তর্জালিক যৌন সুড়সুড়ি গায়ে লাগিয়ে লাভটা কি বুঝি না। ও কি কারোর সঙ্গে দেখা টেখা করে গোপনে? হয়ত রত্না জানে না, চুপি চুপি চোরি চোরি হোটেলে কাউকে নিয়ে যায়, আদর টাদর দেয়, পায়। আমি না বেশি বেশি! কল্পনা বাঁধ মানে না। রত্না একটা ভাল মেয়ে, ওর বর একটা ভাল বাবু বাবু দেখতে ছেলে। সুখী সংসার। ডলপুতুলের মত দেখতে একটা মেয়ে ওদের। চুমু , চুমু এমন জীবনকে। কোত্থেকে এমনতর জীবনে উৎপাত এসে হাজির হল? রত্নাবলীর ঘুম টুম ঠিকঠাক হচ্ছে না আজকাল। বরকে সকাল সকাল জলখাবারটা দিতে পারছে না। মেয়েকে খাওয়াতে খাওয়াতে ঘরের দেওয়ালে কীসের ছায়া দেখছে। নিজের ডেডবডি দেখতে পাওয়াটা পুরো ফলস্ বোঝাই যাচ্ছে। বেশি উৎকন্ঠায় মানুষ ভুলভাল অ্যাজিউম করে নেয়। ও-ও নিচ্ছে। অথচ এমন সুখী মেয়েটার উৎকন্ঠা জন্ম নিচ্ছেই বা কেমন করে?

প্রতাপগড়ের এদিকটা থেকে একটু কম-কম মেট্রোপলিটন গন্ধ ছাড়ে। রত্নাবলীর বাড়িটা একটা গলি পেরিয়ে ঝিলের ধারে। এখন বেলা, রোদ আছে, ঝিলের ধার ঘেষে বাজার বসেছে। এপাশে সারি সারি বিল্ডিং অ্যাপার্টমেন্ট, তার একটার পাঁচ তলায় রত্নারা থাকে। গেটে নাম লিখিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একটু ইউক্যালিপটাস, একটু শহুরে গাছ এদিক ওদিক। আরেকটু এগোলে লিফট।

এর আগে আমি আর মোটে একবার এসেছিলাম। তখন ফের নতুন করে রত্নাবলীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, আমার চালু প্রেমটা ভেঙে গিয়েছে, মনটা খারাপ, ফেসবুকের ছেলেগুলো ‘ছায়া’তে যাওয়ার কথা বলছে, আমি একটা শর্টফিল্ম বানানোর চেষ্টা চালাচ্ছি, টাকা জুটছে না, এরকম একটা সময়ে এক বর্ষণসিক্ত বিকেলে রত্নাকে ফোন করে বসলাম। কত দিনের বন্ধুতা! মাঝে কিছু কালের ব্রেক সত্বেও কেটে যায়নি সব মায়া স্নেহ। ওকে শাক্যজ্যোতির কথা জিগেস করেছিলাম। তাতে ও গুটিয়ে গিয়েছিল, বলেছিল : ‘এই এখন ওর কথা তুলিস না। সায়ন্তন শুনলে খারাপ ভাববে। তোকে পরে বলব সব।’ পরে বলেছিল : ‘ও বেশিদিন টেকেনি। বলল আমার মতন ধুমসিকে নিয়ে ও চলতে পারবে না। কিন্ত আমার তাতে কি? দ্যাখ্ সায়ন্তনকে পেয়ে আমি কত হ্যাপি। আমায় কত ভালবাসে, মাসে একবার করে ঘুরতে নিয়ে যায়। হাতখরচ না চাইতেই দিয়ে দেয়। রোজ সন্ধ্যেবেলা নিয়ম করে বাড়ি ফেরে। আমায় একটা পিংকি দিয়েছে, কেবল বলেছে এখন আর নাটক-ফাটক করার দরকার নেই। এত ভাল আমার সংসার যে তুই লোভে পড়ে যাবি। তাই আমিও স্যাক্রিফাইস করলাম না হয় খানিক।’ কথা শেষ হলেই আমি অতি উৎসাহ নিয়ে রত্নাকে প্রশ্ন করেছিলাম : ‘হ্যাঁ রে তুই কি খুব রিসেন্ট ‘প্রাক্তন’ দেখেছিস?’ ও গদগদ হয়ে বলেছিল : ‘ঐটা দেখতে আমরা তিনজনে আইনক্সে গেছিলাম জানিস। সেদিন ফেরার পথে ট্যাক্সিতে মেয়ের অজান্তে ও আমায় টুক করে একটা চুমুও খেয়েছিল। আমার খুব ভাল লেগেছিল জানিস! পিংকি হওয়র পর তেমন কিছু তো হয়না আর। ভাল লেগেছিল।’ বুঝেছিলাম এরপর আমার কিছু বলার নেই। ঝলমলে থিয়েটার করা মানুষটা মানুষ থেকে মেয়েতে বদলে গিয়েছে।

রত্নার বাড়িতে প্রথম যেদিন এলাম সেদিন আকাশে ঘনঘোর মেঘ। এই সব দিনে খুব রোম্যান্টিক হতে ইচ্ছে করে। অথচ মন তখন দু’টুকরো। তখনও ঐরিক আসেনি জীবনে। রত্নার ঘরদোরের বৈভব আছে বেশ। অনেকটাই লোক দেখানো লাগল। যেমন, দেওয়ালগুলো তকতকে রং করা অথচ চেয়ারের পিঠে ক্র্যাক ধরেছে ভালমত। মিক্সার মেশিনে ক্ষতর দাগ। সাজগোজের টেবিলে চারখানা পারফিউম, সব শেষ শুধু একটায় তলানিতে খানিক তরল। মেয়ের বইখাতা বড্ড অগোছালো। মলাট নেই। ওয়াটার বটলের কাঞ্চিতে ময়লা। মাসের ছয় তারিখ অথচ রত্না চা করতে গিয়ে বলল : ‘ইস দেখেছিস সব আনা হল গ্রসারি থেকে অথচ চা-পাতা টাই আনা হয়নি। তুই দাঁড়া অমলেট খা।’ অমলেটে তেল ঢালল আধ-খালি বোতল থেকে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখা গেল রত্নার গলার কাছটায় লালচে কালচে দাগ। বলেই বসলাম : ‘এই তোর সুখী সংসারের নমুনা!’ ও কেমন বিহ্বল হয়ে তাকাল। ‘হ্যাঁ রে, আমায় খুব ভাল রেখেছে ও । দ্যাখ না গতকাল গিয়ে পিংকির স্কুলের প্রোজেক্টের সব কিছু কিনে আনল। কত্ত ভাল!’

ধুস গল্পে কোনও সাসপেন্স আসছে না। গ্যাদগ্যাদে সিরিয়াল হয়ে যাচ্ছে। একটু টুইস্ট যোগ করা যাক। রত্নার ফ্ল্যাটে গিয়ে আমিও চমকে উঠলাম। রত্নাবলী দরজা খুলে দিল। এত অন্ধকার কেন? ঘরে ঢুকে বুঝলাম জানলাগুলো আটকানো। রত্না চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। উদ্বিগ্ন চোখ। আমার একটু শিরশিরানি এল শরীরে। বললাম : ‘কি রে জানলা খোল! কি হয়েছে ..’ কথা শেষ হল না। নীচে ডানদিকে চোখ গেল। এটা ড্রয়িংরুম। সোজাসুজি পিংকির রুম, লাগোয়া বাথরুম। ভিতর থেকে জল পড়ার শব্দ আসছে। ডানদিকে এই অন্ধকারেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সোফার সামনের মেঝেতে একটা দেহ এঁকেবেঁকে শুয়ে আছে , নিথর।

— (ঘ) —

এইসব সময়ে ভয়ের থেকেও বেশি আসে আতঙ্ক। ঠিক-ভুলের মাপকাঠি ওলট পালট হয়ে যায়। বছর সাতেক আগেকার এক অদ্ভুতুড়ে দুপুর, শেয়ালদা ফ্লাইওভারের কাছাকাছি গলির মধ্যে ঘুপচি হোটেল ঝাপটা মারল চোখে মুখে। রত্নাবলীদের পাঁচতলা উচ্চতা থেকে মন মুহূর্তে পৌঁছে গেল সেখানে। অন্ধকার, স্যাতস্যাতে পরিবেশ, হোটেলের সিঁড়ি, পথ দেখিয়ে নিয়ে চলা ছেলেটির চোখে মুখে কেমন পাগলাটে আবহাওয়া। কালশিটে জিন্স, ময়লা কলারওয়ালা সবুজ শার্টের কাঞ্চিতে যৌন আহ্বান। খিদে মেটানোর জন্য এই সস্তা হোটেলে আগমন। খিদে বেশি ওর ছিল। আমার নয়। অথচ কেমন এক অসমানুপাতিক টানে সেদিন বৃষ্টির মধ্যেও চলে গিয়েছিলাম। এরকমটা হয়। ফেসবুক উপমহাদেশে ছড়িয়ে যাওয়ার পর থেকে জীবন বড় শ্লীলতাহীন হয়ে গিয়েছে। নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, শিখতে হচ্ছে নৈতিকতার পাঠ। টাইমলাইন ছাপিয়ে যাচ্ছে যৌন সন্ধানীদের আবেদনে, ইশারায়। বিনামূল্যে যৌন সঙ্গী মিলে যাচ্ছে, পুরুষ সঙ্গী। আমি সাড়া দিতাম না কারোর ডাকেই অথচ এই ছেলেটা আমায় ভুলিয়েছিল। ছবি দেখায় নি প্রথমে। কথা হল কিছুদিন, পছন্দ-অপছন্দ বিষয়ে ওয়াকিবহাল হওয়া গেল দু’দিক থেকে। এরপর দেখা একদিন। ঘড়ি ধরে, সময় মেনে, ঢাকুরিয়া লেকে। আরে! ঐ যে দূরে দাঁড়িয়ে, আমার কল রিসিভ করে ‘কোথায় তুমি?’ করছে যে, সে কে! সে তো শাক্য! কলেজের গিটার বাজিয়ে ভাল গাইয়ে শাক্যজ্যোতি! রত্নাকে পছন্দ করত। তাহলে এই যে ফেসবুকের ভিড়ে নকল প্রোফাইল নকল নামে বিচরণ করছে, এর হেতু একটাই হতে পারে – শরীরের খিদে মেটানোটাই প্রধান কারণ। ও আমাকে দেখে চমকাল না। আমি তো নিজের ছবি অনেক আগেই দেখিয়েছি, অথচ ও যে আমার পরিচিত তা তো এতদিন বলেনি! ঢের রাগ হল। চোরা একটা খুশী-আনন্দ-গর্বের শিরশিরানি খেলেও গেল শরীরে। এই শাক্যজ্যোতির হ্যান্ডসাম শরীর, এই শাক্যজ্যোতির জন্য তিরিশ চল্লিশটা মেয়ে ফিদা ছিল এককালে। এই শাক্যজ্যোতি এখন ছেলে থেকে পুরুষ হয়েছে। এই শাক্যজ্যোতি রত্নাকে ছেড়ে পুরুষ শরীরের মোহে পড়েছে । তার মানে এই স্বভাব, এই স্বাদ গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চয়ই আগে থেকেই ছিল তোমার? কলেজ করিডরে তুমি প্রেম করতে রত্নার সঙ্গে, আমার হয়ত খানিক কথা ওকে বলার ছিল, বলা-কালীন আড়চোখে তোমায় দেখতাম আর দেখতাম তুমি তাকিয়ে আছো, দেখছ আমায়। ভাল লাগত, তবে তখন ভাবতাম ঐ তাকানো নির্ভেজাল। ও আচ্ছা, তাহলে আজ বুঝলাম সব। কিন্তু রত্না? ওর সাথে তখন আর যোগাযোগ নেই। শাক্যই জানাল তোমাদের সব চুকেবুকে গিয়েছে। কুলকুল নদীর সর্পিনী ছন্দ খেলা করে উঠেছিল ভিতরে। তুমি আমায় বাসবে ভাল, খেলবে আলো এই জানলায়। তারপরেই বললে প্লেসের কথা। আছে কিনা। মানে তোমার অভিসন্ধি কেবল শরীর! তখন এক জটিল মোহমায়া বিস্তার করেছে লেকের পরিবেশে। এত কিছু ভাবার সময় ছিল না । বললাম, নেই। তুমি বললে তাহলে ব্যাবস্থা করতে হবে। চিপ হোটেলের কথা তুললে। আমার একটু ঢিলেঢালা শরীর নিয়ে অশ্লীল ইশারা করলে, হাসলে। আমার ভাল লাগছিল। পরশু দিন দেখা হবে, কথা দেওয়া-নেওয়া হল। তুমি হোটেলের সামনে ওয়েট করবে, আমি যাব। সেদিন বৃষ্টি। অনন্ত মেঘলা। মন বিহ্বল। আগে শরীর নিয়ে যে কটা এক্সপিরিয়েন্স হয়েছে সব বাজে। শাক্য যেন স্বপ্ন থেকে লাফ দিয়ে ধরায় নামল। গেলাম। ময়লাটে চেহারা আজ। চুল উস্কোখুস্কো। চোখে লালচে ভাব। রুমে নিয়ে বসাল। দেওয়ালের রংচটা জ্যামিতিক প্যাটার্ন আমাদের দেখছে। তুমি বড্ড উশৃঙ্খল হয়ে গেলে। যৌনতায় চড় থাপ্পড় মারধর গালাগালি এসবের সঙ্গে মোলাকাত তখনও অব্দি হয়নি, ভয় পেয়ে গেলাম। স্যাডিজম কি জিনিস সেটা নিয়ে আমার কোনও ধারণা ছিল না তখন, আজ বুঝি সেটা ছিল একপ্রকার পুরুষতান্ত্রিক ধর্ষণ। যে কোনও প্রকার বারণে তুমি অমনোযোগী হলে। আমার কোমরে আচড়ের দাগ, ঠোঁটের কোণে কষাটে স্বাদ। হয়ত ঐ রকমটাই তোমার যৌনতার প্রকাশ। আমি এক ধাক্কা দিয়ে তোমায় ফেলে দিলাম। বাইরের বৃষ্টি প্রত্যক্ষ করছে একজন মানুষের অসহায়তা। চটপট জামা পরতে হবে। তুমি ফের আমায় আছড়ে ফেললে বিছানায়। প্রচন্ড রাগ জন্ম নিচ্ছে, শরীরে বয়ে যাচ্ছে ব্যাথার স্রোত। আমার কিছু করার ছিল না শাক্য, কেবল বার তিনেক প্রচন্ড শক্তিতে জানলার রডে তোমার মাথা ঠোকা ছাড়া। অতঃপর সিনেমাটিক মুক্তি এই বন্ধ ঘর থেকে। অথচ তোমার দেহ আর কোনো শ্বাস কার্য চালাচ্ছে না যে!

মিনিট দুয়েক লাগল সব ঠিক করে নিতে। কল্পনাশক্তি খুব বেশি বলেই সম্ভব হল। কাঁচা রক্তে তোমার মুখের একপাশ ডুবে যাচ্ছে ক্রমশ। তোমার ফোন কই! চটপট আমার নাম্বার ডিলিট করলাম। কললিস্ট থেকে সমস্ত কল মুছে গেল এক তীক্ষ্ণ ঠোক্করে। অথচ ফেসবুকে তুমি আছ, আমি আছি, আমাদের কথা-চালাচালি গুলো রয়ে আছে! এই ফোনে রিস্টার্ট অপশন নেই। ফেসবুকের পাসওয়ার্ড জানা নেই। সময় এগোচ্ছে টিকটিক। না, এত ভাবার প্রয়োজন নেই। কাঁধের ব্যাগে ফোনটা ঢুকিয়ে নিলাম। জামাকাপড় পরে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। সিঁড়ির ধারে ঘর, এপাশ ওপাশ আরও অনেক ঘর। দরজা আটকানো। পানের পিক মাখানো সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে এলাম। রিসেপশন বলে কিছু নেই। থাকলেও ওদিকটাতে। এইদিক দিয়ে কে ঢুকছে, বেরচ্ছে দেখা যায় না। দিনের নরম আলোয় বেরিয়ে এসে ফেলে আসা মুহূর্তটাকে অলৌকিক মনে হল।

আজ রত্নাবলীর ফ্ল্যাটে ঢুকে অতীত চলকে উঠল আচমকা। রত্নার শরীরে গোলাপী রঙের ঘরোয়া ম্যাক্সি। চোখের তলায় কালশিটে। মেঝেতে পড়ে থাকা দেহটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হটাৎ ও আমার বাঁ-কাধ শুদ্ধ শরীর জড়িয়ে ধরল। দুজনেই চেয়ে আছি নীচের দিকে। একটু দূরে, পিংকির ঘরের দরজার কাছাকাছি ঢাকনা ছাড়া প্রেশার কুকার উপুড় হয়ে পরে আছে। পিছন দিকটায় রক্তের অসম দাগ। দেহটা সায়ন্তনের।

— (ঙ) —

রত্নাকে নিয়ে পিংকির ঘরে গেলাম। জানালা বন্ধ, খুলে দিলাম। একঝাঁক আলো আসবে ভাবলাম, এল না। ওপাশে ফ্ল্যাটের সারি। এখান থেকে সূর্য দেখা যায় না। হাওয়াও আসে না তেমন। ফ্যান চালু করলাম। রত্না আমায় দেখছে। অর্থহীন, দিশাহীন মুখচোখ। গল্পটা ধরে ফেলেছি অনেকটাই। আধুনিক দাম্পত্য ঝঞ্ঝাট ও তার ফলে বেরিয়ে আসা গরল। রত্নার পাশে বসলাম। বললাম : ‘বল, শুনব।’

রত্নার বলা কথাগুলোর সঙ্গে আমার ধারণা প্রায় মিলে গেল। মারত , খুব মারত , মেয়ের সামনেও রেহাই দিত না। কথায় কথায় সন্দেহ, প্রতি মিনিটে ভুল ধরা, হেয় করা। সায়ন্তন বাড়ি ফিরে ওকে না দেখলেই হল, একচোট কাল্পনিক গল্প তৈরি করে নেবে ও মনে মনে ফুঁসবে, সেই ফোঁস ফোঁস ক্রমশ ক্রোধে পরিণত হবে। হয়ত রান্নায় ভুলচুক হল খানিক, গালাগালি দিয়ে চড় থাপ্পড় মেরে রত্নাকে বিপর্যস্ত করবে। এইরকম। অথচ বিয়ের আগে বা পরপর সায়ন্তন এইরকম ছিল না মোটেই। ওর মধ্যে ভালবাসা ছিল, স্নেহ ছিল, হিউম্যানিটি ছিল। অনেস্টি ছিল। পিংকি হল, তারপর থেকেই এইসব। পিংকি সঠিক উপায়ে আসেনি। সায়ন্তন দিতে পারে নি, ক্ষমতা ছিল না । অন্যের স্পার্মের সাহায্যে জন্ম নেওয়া শিশুকে মন থেকে নিজের বলে মেনে নেওয়ার মত উন্নত মন সায়ন্তনের ছিল না। কোনও দিন যত্ন করত না মেয়েটার। মেয়ের জন্য হরলিক্সটা, দুধটা, আইসক্রিমটা, টফিটা আনত না কখনও। রত্নাকে টাকা দিতে কার্পণ্য করত। স্নেহের তার কেটে গিয়েছিল। ছোট শরীরকে তো আর কষ্ট দেওয়া যায় না, চড় থাপ্পড় মারা যায় না, চুলের মুঠি ধরে বাথটবে মুখ গুঁজে দেওয়া যায় না। কারণ ওতে মজা খুব কম। তাই এইসবের প্রয়োগ ঘটত রত্নার উপর। রত্নার বিপর্যস্ত করুণ অসহায় পরিস্থিতি সায়ন্তনকে আরও উৎসাহ যোগাত। কখনও কোথাও ঘুরতে নিয়ে যেত না, দুধওয়ালা বা পেপারওয়ালার সঙ্গে কথা বলতে দেখলে খুব মারধর করত। নিজেই প্ল্যান করে কন্ডোম কিনে রত্নার হ্যান্ডব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছিল রত্নার অজান্তে আর কিছু একটা খোঁজার নাম করে ব্যাগ খুলে জিনিসটা বের করে এনেছিল; চোখে মুখে জন্ম নিয়েছিল কপট রাগ। বেদম প্রহার, সেই সঙ্গে মা-বাপ তুলে গালাগালি। সেদিনের পর টানা দুইদিন রত্নার ডান পা মেঝেতে ফেলতে কষ্ট হয়েছিল, হাতদুটো তেমন কাজ করতে পারছিল না। রত্নার মনে ধীরে ধীরে একপ্রকার ভয় ঢুকে অতলে থিতিয়ে বসছিল, ভায়োলেন্সের ভয়। সব সময় কুকড়ে থাকত, ভুলভাল চিন্তা করত, ভুল দেখত, ভুল শুনত। ভৌতিক কিছু অনুভব করা ওর কাল্পনিক মন তৈরি করে নিয়েছিল। এর কারণটা লুকিয়ে সায়ন্তনের অহেতুক দোষারোপে। একটা মানুষকে ক্রমশ যদি বলা হয় তুমি ভুল করছ, ভুল বুঝছ, ভুল শুনছ, তবে সে ভুল জিনিসগুলোকেই আয়ত্ত করে নেয়। রত্নাও নিয়েছিল। ওর মা আছেন কেবল, কলেজ শেষের বছরেই বাবা মারা গিয়েছিলেন। সায়ন্তন ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল, কাউকে কিছু জানালে মেয়েকে গলা টিপে মেরে ফেলবে। এইভাবে দিন যাচ্ছিল। মানসিকভাবে বড্ড দুর্বল হয় গিয়েছিল রত্না, অদ্ভুত কথা বলা শুরু করেছিল। গতকাল বিকেল বিকেল বাড়ি ফিরেছিল সায়ন্তন, মদ নিয়ে বসে গিয়েছিল। রাত দশটা অব্দি নিজের ঘরে কাটিয়ে মেয়ের ঘরে যায়। মেয়ের ক্লাস টু, অঙ্ক করছিল। খুব বাজে ভাবে মেয়ের শরীরটাকে ধরে, লালসা মাখানো হাত পিংকির গলায়, ঠোঁটে, বুকে চলেফিরে বেড়ায়। এসব দেখে আর কেউ কি স্বাভাবিক থাকতে পারে? অথচ রত্না তখন-তখন প্রতিবাদটুকুও করতে পারেনি। সেই সামর্থটাই ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত কিছু বছরে। অথচ ক্ষতভরা ডানাওয়ালা সামান্য প্রজাপতিও উড়তে চায় মরিয়া হয়ে, আত্মহননের আগে ফের ফুলে ফলে ভরা দুনিয়াতে বেঁচে থাকার বাসনা জন্মায়। আজ সকালে পিংকি স্কুল চলে গেল, রত্নার সঙ্গে সায়ন্তনের একচোট হল। রত্না গতরাতের বিষয়ে কথা বলতে গিয়েছিল অথচ আজকের সুস্থ সায়ন্তন গতকালের থেকেও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। শেষে অন্তিম মানবিক অনুভূতিটুকু সঙ্গ করে রত্না গর্জে উঠল। কিচেনের প্রেসার কুকার হয় উঠল বিধ্বংসী মারণাস্ত্র, মুক্তিদাতাও।

রত্না কাঁদছে। এখন চোখে জল নেই, ফোঁপানি থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। এখন পরবর্তী চিন্তা। ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে, প্ল্যান করতে হবে। জল খাব। উঠলাম। রত্নার বিধ্বস্ত ভাবটা অনেক কেটেছে। চোখে কেমন যেন পাগলাটে ভাব। বিগত অত্যাচার আতঙ্কের ফল। বলল : ‘বস। আনছি। আমায় ওষুধ খেতে হবে।’

মানসিক রোগী হিসেবে চিকিৎসা চলছিল রত্নার, বিডন স্ট্রিটের এক ডাক্তার বাড়ি এসে দেখে যেত মাঝে মাঝে। না, ওকে বসিয়ে রাখাটা ঠিক হবে না। কাজ করুক। ওষুধ টষুধ খাক। খুন করে ফেলার পর একটা ট্রমা কাজ করে। যদিও রত্নার মনে এক শিরশিরে মুক্তির স্রোত বয়ে যাচ্ছে, অবচেতনে, বুঝতে পারছি।

ড্রয়িংরুমে গেলাম। সায়ন্তন মরে পরে আছে। বেচারা ছেলে একটা! চুক চুক! কিচেন থেকে খুটখাট আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বেসিনের কল খোলার শব্দ হল। কিছু একটা ধুচ্ছে রত্না। গ্লাস হয়ত। কয়েকটা মাছি ভনভন করছে সায়ন্তনের মাথার কাছে। ওখানে রক্ত , তাই মাছি। অফিসের পোশাক গায়ে, এলোমেলো, রক্তের ছোপ গলার কাছটায়। ওর মোবাইলটা কই? প্এন্টের পকেটটা উঁচু হয়ে রয়েছে। রুমালে হাত জড়িয়ে ফোনটা বের করে আনলাম। পাসওয়ার্ড জানা। বহুদিন থেকেই জানা। আমি অনেক কিছুই জানি সায়ন্তনের। ও-ও জানে, সরি জানত। এখন তো নেই আর! এতদিন জেনেছিল। আমায় কাছে পেলে আদর করত, যা চাইতাম দিত। এই যে রত্নাকে কব্জা করার, খাদে ফেলার সুন্দর সুন্দর প্ল্যান – এগুলো কি আর ঐ মোটা মাথা থেকে বেরিয়েছে? না মোটেই। কন্ডোম কেনানোর প্ল্যান আমার ছিল। বউকে আতঙ্কিত করে রাখা সর্বক্ষণ, ভয় পাওয়ানো, ভুল বোঝানো, ভুল বিশ্বাস করানোর সাইকোলজিকাল এবিসিডি সব এই শর্মার দিমাগ কা খেল। ও কেন সুখে থাকবে? সুখী সংসার! ফোট সালা! আমার কোনোদিন বাচ্চা-কাচ্চা হবে না, সেই সুযোগই নেই এই শরীরে আর তুই বুঝি বাচ্চা-কাচ্চা বর-ফর নিয়ে আদরে থাকবি ভেবেছিস ! সায়ন্তনের একপ্রকার ঘৃণা-ক্রোধ-অমানবিকতা তো ছিলই রত্নার প্রতি, তার সাথে যুক্ত হয়ছিল আমার অভিসন্ধি। আর কিছুদিন গেলে সম্পূর্ণতই পাগল হয়ে যেত রত্নাবলী। বাধ্য হত। যাক, সায়ন্তনকে খুন করে এইবার ওকে জেলের জীবন কাটাতে হবে। আহা, তাও ভাল!

মেসেঞ্জারের কথোপকথন সব ডিলিট করে দিলাম। হোয়াটসঅ্যাপেরও। কললিস্ট থেকে আমার নাম্বারটাও। সায়ন্তনের প্রতি আমার কোনও প্রকার কামনা কোনওদিন ছিল না। ওকে জাস্ট এই কিছু কাল প্লাস্টিকের পুতুলের মতন ব্যবহার করেছি। পুলিশ এনকোয়ারি তেমন খুব একটা জবরদস্ত হবে না, কারণ এখানে খুনী নিজেই দোষ কবুল করবে। তবুও নিজেকে সুরক্ষিত করতে দোষ নেই কোনও।

রত্না আসছে বোধহয়। ফোনটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিলাম। পিংকির ঘরে আসলাম। ঐরিক ফোন করছে। এই ছেলেটাও না! দুটো মিনিট আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারে না। ভালবাসে খুব। বাসে?

জলের গ্লাস নিয়ে এ ঘরে এল রত্না। কপালের চুলে জলজ ফোঁটা। মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিয়ে এসেছে বোধহয়। একটা হাসিখুশি সংসার আজ এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে দেখে মন বড় আনন্দিত আমার। জলের গ্লাসে সাদা সাদা তরল। কি এটা? ‘গ্লুকোনডি।’ রত্না বলল। ওর হাতেও গ্লাস। গ্লুকোজ জল। এই সময় রত্নার উদভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার কথা, কেঁদে ককিয়ে আমার কাছ থেকে সাহায্য চাইবার কথা, কিন্তু ও কিছুই এসবের করছে না দেখে খানিক অবাক হলাম। অবশ্য ও সুস্থ মস্তিষ্কের নয়। স্বাভাবিক হলে না হয় ওর এখনকার আচরণ অস্বাভাবিক মনে হত। খেয়ে নিলাম।

দুজনেই কিছু সময় চুপচাপ। নীরবতা ভাঙলাম : ‘কি করবি এখন? পুলিশে তো জানাতেই হবে।’ রত্না কিছু বলল না। আমায় দেখছে। কি দেখছে, কেন দেখছে? এই চার দেওয়ালের মধ্যিখানে হটাৎ কেমন যেন করতে লাগল শরীরর ভেতরটায়। গলা জ্বালা করছে। গা গুলোচ্ছে। বুকের মধ্যে প্রবল যন্ত্রণা। রত্নার হেলদোল নেই। জলের বদলে গ্লুকোনডি অন্য অর্থ নিয়ে আসেনি তো? আ! কষ্ট , কী কষ্ট! চেয়ারে বসে থাকা সম্ভব হল না, পড়ে গেলাম। মাথার মধ্যে চরকিপাক কাটছে, সব এলোমেলো লাগছে, এত সাফোকেশন কেন? রত্না এখনও এক মনে আমাকেই দেখছে।

— শেষ —

ছবিঃ ভূটান

Exit mobile version