স্টোনওয়াল, এক বৈপ্লবিক রামধনুর স্বর্ণজয়ন্তী
(প্রথম পর্ব)
— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন
“জানো, ওখানের মানুষগুলোকে কি সুন্দর দেখাচ্ছিলো। দশ বছরের আগের সেই আহত চেহারাগুলো আজ কোথায় যেন মিলিয়ে গিয়েছে।”
— অ্যালেন গিন্সবার্গ, কবি, দার্শনিক, সমকামী, নগ্নতাবাদী (স্টোনওয়াল অভ্যুত্থানের পরের দিনে)
দিনরাতের হিসেব পেরিয়ে পঞ্চাশটা বছর। এক ইতিহাসের পঞ্চাশ বছর। গৌরব, আর শুধু গৌরব নয়, নানান রঙে, নানান রঙ্গে, সময়ের গায়ে লেগে থাকা, এঁটে থাকা, সারি সারি মুহূর্ত।
একটি সরাইখানা দিয়ে শুরু, সেখান থেকে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়া। কখনো রাজপথে রামধনু মিছিলের শ্লোগান হয়ে, কখনো লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষের পক্ষে আদালতে সওয়ালরত উকিলের চতুর বাগ্মিতায়, আবার কখনো বা এলজিবিটি চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমার পর্দায় ফুটে ওঠা একমুঠো স্ফুলিঙ্গ, যার আগুণ জ্বলেছিলো আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে। ইতিহাসের পাতায় সেই ঘটনার নাম স্টোনওয়াল দাঙ্গা। যদিও ঘটনাটিকে দাঙ্গা না বলে অভ্যুত্থান বললে হয়তো আরো সঠিক বলা হয়। কিন্তু কি এমন ঘটেছিলো সেদিন যা আগে কখনো ঘটেনি? কেনই বা ঘটেছিলো? আর কি ছিলো এই স্টোনওয়াল সরাইখানার বিশেষত্ব? আজ ফিরে দেখা সেই ইতিহাসের ফেলে আসা হলুদ পাতা। খুঁজে ফেরা আজকের সময়ের নিরিখে তার প্রাসঙ্গিকতা, মিলিয়ে নেওয়া, মিলিয়ে দেওয়া নতুন আর পুরনোকে, সময়ের সুতো জড়িয়ে জড়িয়ে।
সামাজিকভাবে দেখা যাক, অথবা বৈজ্ঞানিক, একটি তন্ত্র যখন আরেকটি তন্ত্রের উপর নিজের শক্তিবিস্তার করে, অবদমিত তন্ত্রের ভিতরে জমা হতে থাকে পুঞ্জীভূত চাপ। এই চাপ, একটা সময় অবধি জমতে পারে, আর একটি চ্যুতিবিন্দুতে আগ্নেয়গিরিরির লাভা আর ছাইয়ের মতো ফেটে বেরিয়ে আসে প্রাকৃতিক নিয়মেই।
১৯৬০-৭০ সালের যুক্তরাষ্ট্র। তারই শহর নিউইয়র্কের পশ্চিমপ্রান্তের একটি পাড়া, নাম গ্রিনউইচ ভিলেজ। সেইসময়ে এতে বসবাসরত বেশ কিছু সমকামী পুরুষ মহিলা, এবং আরো কিছু ভিন্ন লিঙ্গসত্বার মানুষ। এই অঞ্চলেই পুড়ে যাওয়া একটা বাড়িকে বেছে নিয়ে আমেরিকার মাফিয়ারা খুলে ফেললো সমকামীদের জন্যে পানশালা এবং রেস্তোরা। পুড়ে যাওয়া বাড়িটার আগের নামই বহাল রেখে নাম দেওয়া হলো “স্টোনওয়াল ইন”। পানশালার লাইসেন্স ছিলোনা, আর মদ বিক্রি করা তখন বেআইনি রীতিমতো, তবুও পুলিশকে ঘুষ দিয়ে চলতো জল মিশিয়ে মদ বিক্রি।
যদিও এই চত্বরে এবং গোটা শহরে একমাত্র সমকামী পানশালা ছিলোনা স্টোনওয়াল, কিন্তু এর মূল আকর্ষণ ছিলো এর ডান্সফ্লোর/নৃত্যমঞ্চ। নিজের সঙ্গী অথবা বন্ধু, অনেক দিনের বা শুধু সেই রাতটুকুর, তাকে জড়িয়ে একটুকু সময় ঢিমে আলোয় নাচার ইচ্ছে অনেককেই টেনে নিয়ে যেতো ওখানে। কাছেপিঠে রাস্তায় যেসব ছেলেছোকরারা থাকতো, তারাও ঢুঁ মারতো কখনো সখনো, যদি কেউ ভালোবেসে কিনে দেয় এক-দু-পাত্তর পানীয়। চলতো অবাধে নিষিদ্ধ মাদক সেবন এবং বিক্রিবাট্টা। দুটি ঘর, বাইরের ঘরে “স্বাভাবিক(?)” জামাকাপড় পরে ছেলেমেয়ের দল, আর ভিতরের ঘরে পান-ভোজন-নাচ করতেন ক্রসডেসাররা।
এই ক্রসড্রেসিংও তখন আইনের চোখে ছিলো অপরাধ। আর সমগ্র লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদেরকেই দেখা হতো মানসিক রুগি এবং অপরাধী হিসেবে। তখনকার আমেরিকায় সমকামীরা মানুষ না, সাইকো। তারা এমন এক রোগে ভুগছেন যা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং ছোঁয়াচে, জীবনকে যা করে তোলে নরকের মতো। তাই বিভিন্ন স্টেট হিসেবে একদিকে যেখানে আইনের সাজা ছিলো ভিন্ন, অন্যদিকে হাসপাতালে কখনো ইলেক্ট্রিক শক দিয়ে, আবার কখনও বা মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে তাদের পাল্টে ফেলার চেষ্টা করা হতো। কেউ সমকামী, এই খবর সংবাদমাধ্যমের প্রচারে আসলে তাকে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ছিলো খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ধরা পড়া ব্যক্তির নাম, ছবি এবং কখনো সখনো বাড়ির ঠিকানাও ফলাও করে ছাপা হতো শহরের প্রথম সারীর দৈনিকিতে। সমকামী হিসেবে ধরা পড়লে ডাক্তার বা উকিল হওয়ার লাইসেন্সও পাওয়া যেতোনা। চিকিৎসার নামে চলতো তাদের স্থবির এবং জীবন্মৃত বানানোর প্রহসন।
সমাজের সামনে তাই নিজের যৌনতা/লিঙ্গচেতনা নিয়ে প্রকাশ্যে আসা ছিলো দূরের কল্পনা। পরিবার সমাজকে খুশী রাখতে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করা ছিলো জলভাত। এই অবস্থায়, কখনো সিনেমা হলে, কখনো সাবওয়েতে, কখনো পার্কে, কখনো টয়লেটে, কখনো মাংস বয়ে নিয়ে যাওয়া ট্রাকের ভিতরে অসুরক্ষিত দ্বৈত অথবা গণসম্ভোগে নিজের শরীরের খিদে মেটাতে বাধ্য হতো তারা। তার মধ্যেও কখনো ছদ্মবেশে, কখনো নিজমূর্তিতেই হানা দিতো পুলিশ। বিপদ ছিলো পদে পদে।
গ্রিনউইচ এলাকা ছিলো অপেক্ষাকৃত উন্নতমনা। সেখানে যদিও ছাপোষা মানুষেরা বসবাস করতেন না তা নয়, বসবাস করতেন বুদ্ধিজীবিরাও, কিন্তু এরই পাশাপাশি ঘাঁটি গেঁড়েছিলেন বেশ কিছু সমকামী নরনারীরাও। তাদের মধ্যে বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরতে ভালোবাসতেন, যাদের আমরা ক্রসড্রেসার বলি, তাদের সংখ্যাও কম ছিলোনা। শুধু যৌনতা নয়, কখনো রাস্তার ধারে একসাথে গল্প করার তাগিদে, বা নতুন বন্ধু পাতাতেও বিভিন্ন জায়গার সমকামীরা এবং রূপান্তরকামীরা চলে আসতেন এ পাড়ায়। অতএব এর অদূরে যখন কুখ্যাত মাফিয়ারা এক তথাকথিত সাধারণ আটপৌরে সরাইখানার দখল নিয়ে খুলে ফেললো সমকামীদের জন্যে একটি আস্তানা, তা ব্যবসায়িক স্বার্থে খুব ভুল সিদ্ধান্ত বলা চলেনা। পুলিশও গাছের খাবো তলার কুড়বো নীতি নিয়ে একদিকে যেমন এই মাফিয়াদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করতো, উল্টোদিকে শহরের বাকি সমকামী আড্ডাগুলির মতো স্টোনওয়ালেও হানা দিতো মাঝেসাঝে। পুলিশ আসলেই জ্বলে উঠতো উজ্জ্বল আলো। সারিবদ্ধভাবে দাঁর করিয়ে, একে একে সবার পরিচয়পত্র দেখে, তাতে চিহ্নিত লিঙ্গের সাথে পরিধীত জামাকাপড়ের হিসেব মিলিয়ে কাউকে ছেড়ে দেওয়া হতো, কাউকে আবার গ্রেপ্তার করা হতো। স্টোনওয়ালের লোকেরা কিন্তু জানতো পুলিশ কবে কখন হানা দিতে চলেছে। যে মাফিয়ারা পুলিশদের ঘুষ দিতো, তারাও উল্টোদিকে ব্ল্যাকমেল করতো একটু ধনী খদ্দের পেলে। নিজের পরিচয় গোপন রাখতে, চাকরী বাঁচাতে সেই দাবী মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকতোনা।
ক্রমশ …