কাঁচালঙ্কা

সত্য ঘটনা অবলম্বনে — একটি আত্মহত্যা

সত্য ঘটনা অবলম্বনে — একটি আত্মহত্যা

-অনিরুদ্ধ (অনির) সেন (নিজস্ব প্রতিনিধি)

শুক্রবার দুপুরে কোলকাতার টালিগঞ্জের বাড়ী থেকে ফেসবুকে লাইভ হলো এক সমকামী তরুণ, আর সেই লাইভের দর্শকদের হতভম্ব করেই গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করলো। আমাদের জন্য রেখে গেলো অনেক অনেক প্রশ্ন।

১৫ই ডিসেম্বর’ ২০১৯ : সে অনেক কাল আগের কথা নয়। অমুক দেশে তমুক নামে কেউ থাকতো কিনা তা নিয়েও মাথাব্যথা নেই আমার। এই লেখাটা আমাদের আশেপাশে তৈরি, আমাদের আশেপাশেই শেষ। হ্যাঁ, এই শহরেই হৃদয় (নাম পরিবর্তিত) থাকতো। থাকতো, কারণ এখন আর থাকেনা।
হৃদয়ের সাথে আলাপটা হঠাতই, যেমন আর পাঁচজনের সাথে হয়। দুটো ছোট্ট দল ঠিক করলো, তারা একসাথে প্রাইড ওয়াক করবে ছোটখাটো, ফেসবুকিও কায়দায় ইভেন্ট তৈরি করে, পুলিশের পারমিশন নিয়ে টিয়ে জনাকয়েক তো হাজরায় হাজির। সেখানেই আবির্ভাব এই কিশোরের। বৃষ্টি প্রচুর, তার মধ্যেই জনাকয়েক হাটলো। বন্ধুত্ব হয়ে গেলো সবার সাথে সবার। জানা গেলো হৃদয় খুব ছোট বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়েছে, বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে। সাংঘাতিক! এ তো অপহরণ কেস। তবে আরো জানা গেলো হৃদয়ের বাড়ির লোকেরাও খুব একটা থানা পুলিশ করেনি এটা নিয়ে। অতএব দুজনে থাকা শুরু করে একসাথে। হৃদয় আর হৃদয়ের সে, ও বলতো বর। হৃদয় স্কুলে যায়, বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করে, বর চাকড়ি করে ঘরে ফিরে হৃদয়কে আদর করে।আমরা কিন্তু কখনো হৃদয়ের বরকে দেখিনি। দেখেছিলো শুধু আত্মারাম। হৃদয় আর আত্মারামকে একই সাথে দেখা যেতো হামেশাই। প্রাইড ওয়াকে দুজনে একসাথে চেঁচাতও “ছেলে ছেলেকে কিস করেছে, বেশ করেছে, বেশ করেছে”। দুই বোনের মতো ছিলো দুজন। কিন্তু হৃদয় যেখানেই যাক, বিকেল বিকেল ফিরে যেতো ঘরে। বর আসবে, রান্না করতে হবে।

হৃদয়ের বাড়ীতে কখনো যাওয়া হয়নি। কথা হয়েছে যাওয়ার, হৃদয় রান্না করে খাওয়াবে। কিন্ত কেন জানিনা যাওয়াই হয়নি কখনো। হৃদয় কিন্তু আসতো। অমুক ম্যাগাজিনের কভারে মডেল লাগবে, তমুক সিনেমায় কোতি কম পড়ছে, ইভেন্টে ভলান্টিয়ার হতে হবে। হৃদয়ের যেন কোন সংকোচই ছিলোনা। আসলে ওর মধ্যে লুকিয়ে থাকতো একটা অদ্ভুত সাহস, যেই সাহসটা আমাদের বড়োদের মধ্যেও অতো জলদি আসতোনা। সাহসের অবলম্বন ছিলো বোধ হয় ওর ভালোবাসার সম্পর্ক, হয়তো, জানিনা। নইলে ভাবি, ১৬/১৭ বছরের ছেলেটা এতো স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে সব কাজে ঝাঁপিয়ে পরতো কি করে। তারপর আস্তে আস্তে আমরা বুড়োরা কাজ করাই কমিয়ে দিলাম। যোগাযোগ আলগা হলো। মাঝেসাঝে প্রাইড ওয়াকে, আর নয়তো নন্দনে দেখা হতো হৃদয়ের সাথে। একদিন হঠাত দেখলাম ডেটিং অ্যাপে হৃদয়, মোটা হয়েছে। বয়স তার এখন ১৯ কি ২০।কি ব্যপার? সতীলক্ষ্মী বৌ এখানে কি করে? জানলাম সম্পর্কে ঝামেলা চলছে। শেষ কথা বোধহয় পুজোর আগে আগে, শুনলাম, ওদের ছাড়াছাড়ি হবে, বর নাকি এবার একটা মেয়েকে বিয়ে করে ঘর করবে ঠিক করেছে জিজ্ঞেস করেছিলো আমি বেড়াতে যাবো কি না পুজোয় কোথাও, তাহলে ও যাবে আমার সাথে। তার পর কথা আর হয়নি সেরকম। আমাদের এক লেসবিয়ান বান্ধবীর কদিন আগেই পেটে স্টোণ অপারেশন হয়। ওকেও বলেছিলো দেখা করবে। কিন্তু…
গত শুক্রবার দুপুরে হৃদয় আত্মহত্যা করে। ফেসবুকে লাইভ হয়ে সবাইকে জানায় সে এই পদক্ষেপ নিচ্ছে যাতে আর কোন বর, কখনো কোন হৃদয়কে ছেড়ে চলে না যায়। ফেবু লাইভে ট্যাগ করে শুধু তার সেই বর-কে। যারা সেই ফেবু লাইভ দেখেছে তারা তাকে কমেন্টে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, অনেকেই ভয়েস বা ভিডিও কল করে তাকে আটকনোর চেষ্টা করে, কিন্তু হৃদয় কারো ফোন তোলেনা।
আত্মহত্যার আগে হৃদয় ফোন করেছিলো আত্মারামকেই। আত্মারামই পুলিশ জোগাড় করে হৃদয়ের বাড়ি গিয়ে পৌঁছায়। হৃদয় গলায় ফাস লাগিয়েছিলো দুপুর ১টায়, পুলিশ পৌঁছায় দুপুর ৩টেয়। হৃদয়ের বাড়ীতে খবর গেলে তারা পৌঁছায়, প্রায় বিকেল ৫টায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে।
প্রশ্ন হচ্ছে এই লেখাটা লিখছি কেন? লিখছি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যে ঠিক কি কি করলে হৃদয়কে আমরা হারাতামনা। এই নিয়ে একটা আলোচনা হওয়া উচিৎ, এই জন্য। হৃদয় তার বরের উপর প্রতিশোধ নিলো এভাবে? নাকি তার জীবনটাকে সে এমনভাবে সাজিয়েছিলো, যেখানে সে তার বরকে বাদ দিয়ে আর কিছু ভাবতেই চায়নি। শুনেছিলাম সে বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে ভেবেছিলো, কিন্তু গেলোনা কেন? তার বাবা মা, যারা তার এই যৌন অভিমুখিতা বা সেক্স্যুয়ালিটিকে অনেক বছর আগে সমর্থন করেনি, তারা কি এখন করতো? এই লেখাটা লিখছি শুধু এই প্রশ্নগুলো তুলে ধরার জন্য। সাদা-কালোর বাইরে গিয়ে ভাবার চেষ্টা করেছি অনেক, হৃদয়ের বর যদি এখন হঠাত অন্য সম্পর্কে জড়াতে চায়, সেই অধিকার কি তার ছিলো? হয়তো একজন প্রাপ্তবয়স্ক স্বাধীন মানুষ হিসেবে, হ্যাঁ, ছিলো। কিন্তু এই মানুষটাই যে একটা ১২/১৩ বছরের ছেলেকে নিয়ে কোলকাতায় এসে সংসার পেতেছিলো? বিশেষ বে-আইনি ভাবেই, তার পরেও কি আর এই অধিকার থাকে? হৃদয়ের বেড়ে ওঠার মধ্যে, তার চরিত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছিলো পরনির্ভরশীলতা। বা আরো সঠিকভাবে বললে “বর”নির্ভরশীলতা। আজকাল একজন বাবা-মা তার প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরই সমকামিতাকে মানতে চায়না, তাহলে হৃদয়ের বাবা-মা তাদের ১২ বছরের বাচ্চার সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেবে, এটা ভাবা কিন্তু বাড়াবাড়ি, কিন্তু ভাবা কি একেবারেই যায়না? না না সেক্স না, কিন্তু এটা মেনে নেওয়া যে আমার বাচ্চার ভালোবাসাগুলো একটু অন্যরকম, আর কবে মানতে পারবে এই সমাজ? কবে থেকে স্কুলে আমরা চালু করতে পারবো সেক্স এডুকেশন যেখানে আমরা ভিন্নধর্মী লিঙ্গ পরিচয়ের বা যৌন অভিমুখিতাকে সহজভাবে তুলে ধরতে পারবো? পুলিশ কেন খবর পাওয়ার পর দ্রুততম তৎপরতায়, ছেলেটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারলোনা?

অনেক প্রশ্ন। উত্তর নিশ্চয়ই ভবিষ্যতের আরেকটা আত্মহত্যা নয়।
ও হ্যাঁ, শনিবার তার সেই ফেসবুক লাইভ হাওয়া হয়ে যায়। আর রাতে শ্মশানে তার দেহ সৎকার হয়। উপস্তিত ছিলো আত্মারাম, হৃদয়ের বাবা এবং অন্যান্য বাড়ির লোক, হৃদয়ের বর, আর হৃদয়ের লাশ।

— * — * —

ছবি – ভূটান (নিজস্ব প্রতিনিধি)

Exit mobile version