কাঁচালঙ্কা

শাম্বর আজ – বাবু

শাম্বর আজ

—  বাবু

# দুপুর ১:৩০ –

সামনের বড় ডিসপ্লেটার দিকে বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছে শাম্বর। ডিসপ্লেটাতে এক বড়ো বিপনন সংস্থার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে ভারতের এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় দম্পতি বিরাট কোহলি এবং অনুষ্কা শর্মা হাসি মুখে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবনে এই সংস্থার জিনিসের কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তা প্রচার করছে। শাম্বর মনে চলছে অজস্র কথার কাটাকুটি। মনে হচ্ছে বিজ্ঞাপনটা যেন তাকে বিদ্রুপ করছে। কারণ সে এই প্রথাগত সমাজ থেকে স্বতন্ত্র। সে সমকামী। সে নিষিদ্ধ। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে সে এক সময় নিজের ভিতর হারিয়ে গেল। স্মৃতিরা সব ভিড় করে আসছে ওর মনে।

ছোট থেকেই ছোট করে চুল কাটা আর ছেলেদের মতো জামা পড়া শাম্বলীকে সকলেই ছেলে বলে ভুল করতো। পুতুল নয় ওর পছন্দের খেলনাও ছিলো গাড়ি, বন্দুক। ওর ভালো লাগতো ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতে। আর খুব প্রিয় ছিলো ওর ডাক নামটা, শাম্বলীর অপভ্রংশ শাম্ব।

সব ঠিকই চলছিলো। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় বোধ আর বুদ্ধির পূর্ণ বিকাশের সময় থেকে অর্থাৎ কৈশোরকাল থেকে। এই সময় থেকে ও নিজের ভিতর এক অন্য স্বত্বাকে অনুভব করতে শুরু করে। যে বাকি পাঁচ জনের থেকে আলাদা। কারন ওর বন্ধুরা যখন শাহরুখ খানের সাথে প্রেম করতো, তখন ও স্বপ্নে নিজেকে শাহরুখের জায়গায় দেখতো। ওর চারপাশে অজস্র সুন্দরী নায়িকা, যারা সবাই সাম্বলীর প্রেমে পাগল। শিউরে উঠতো ও। শরীর আর মন ভালো লাগায় ভরে উঠতো। এমনকি কতোবার ও স্বপ্নেও দেখেছে বৃষ্টিভেজা হয়ে কোনো নায়িকার সঙ্গে রোমান্স করছে। ওর মনে দ্বিধাবোধ হতো কারোকে এই স্বপ্নের কথা বলতে। তাই এই ভালোলাগা কে ও ওর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল।

হঠাতই চিন্তার জালটা কেটে দিয়ে ওর গন্তব্যস্থল মানে বাড়ি ফেরার বাসটা এসে দাঁড়ালো।

# বিকাল ৪টে –

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আজ বেশ দেরি হয়ে গেল। অন্যান্য দিন দুটোর মধ্যেই গিটার স্কুল ক্লাস থেকে ও চলে আসে। আজ বাসটা পেতেই বেশ দেরি হলো। তারপর রবিবার খাওয়া, তাও বেশ দেরি করে হলো। এখন ও বিছানায় চুপ করে শুয়ে আছে। অন্যান্য রবিবার এই সময় ও হয় জমাটি ঘুম দেয়, না হলে ল্যাপটপে সিনেমা দেখে। কিন্তু আজকের দিনটা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভিতরে ফসিল হয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো একটু একটু করে বেঁচে উঠছে। শাম্বলী থেকে শাম্ব হয়ে ওঠার দীর্ঘ পথটা আজ আবার ওর সামনে ভেশে উঠছে।

ওর মনে পড়ে যাচ্ছে সোমঋতাদিকে। প্রকৃতির নিয়ম মেনে যখন ওর বন্ধুদের জীবনে প্রেমিকেরা আসতে শুরু করেছে, ঠিক সেই সময় শাম্বলী মুগ্ধ হয়েছিলো সোমঋতাদিকে দেখে। ওর তখন নবম শ্রেণীর প্রথম দিন। হঠাতই পাসের দশম শ্রেণীর লাইনে ও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলো ওকে। গড়পড়তা বাঙালিদের থেকে ফর্সা লম্বা একটু ভারী গড়নের সোমঋতাদির চোখে ছিলো কালো ফ্রেমের চশমা। আরমুখে সবসময় হাসি লেগে থাকতো। বেশ ভালো লাগতো ওর। একটু আধটু কথা বলা অথবা চোখাচুখি হলে একটু হাসি। ব্যাস ঐ অবধি। ঘটনাটা ঘটলো স্কুল পিকনিকে। ঐ দিন বাসে উঠেই ও দেখলো সামনের সব সিট ভরে গেছে, কোথাও জায়গা নেই, পিছনেরও একই হাল। ও তখন হা করে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো এইবার হয় দাঁড়িয়ে যেতে হবে অথবা ওদের অঙ্কের দিদিমণির পাশে গিয়ে বসতে হবে। হঠাতই রূপা ওকে এক ধাক্কা দিয়ে খেচিয়ে উঠলো “কি গান্ডু!! তুমি হা করে দাঁড়িয়ে থেকে ঐ সিটটাও ছেড়ে দাও”… ওর দেখানো সিটটার দিকে তাকাতেই ওর হৃৎপিণ্ডটা হঠাত মনে হলো এক লাফ দিয়ে তেরে দৌড়াতে শুরু করে দিলো। হ্যাঁ, ওর জায়গা ধার্য হয়েছে সোমঋতাদিরই পাশে। যা হোক, সিটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই ওর দিকে এক গাল হেসে সোমঋতাদি বললো “আরে তুই বস, আমি তো এখুনি ঘুমিয়ে যাবো”। সুতরাং জানলার দিকে ও আর ওর পাশে সোমঋতাদি, আর ওর মাথা শাম্বলীর ঘাড়ে, উপরন্তু সওর হৃৎপিণ্ডটা যাচ্ছেতাইভাবে লাফাচ্ছে। ওর মনে হচ্ছিলো ক্রিকেট মাঠের বলটারও ওর থেকে ভালো অবস্থা থাকে। যাই হোক, পরের সময়গুলো হুল্লোর করে কেটে গেছিলো। ওদের বাস যখন ফেরার পথ ধরলো তখন সূর্য ডুবি ডুবি করছে। সারাদিন ছোটাছুটি করে সবার তখন হা ক্লান্ত দশা। তাই সকলেই সিটে গা এলিয়ে দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস্টা প্রায় চুপ হয়ে গেল। শুধু মাঝে মাঝে কিছু চাপা ফিসফাস কথা আর গাড় অন্ধকার ভেদ করে তীব্র বেগে ছুটে চলা বাসের হর্নের আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। ওর চোখটাও একটু লেগে এসছিল হঠাতই ওর বা হাতে জোড় চাপ লাগায় ঘুমের রেশটা কেটে গেল। সোমঋতাদি ওর বা হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে। ভয়ে ওর গলাটা শুকিয়ে গেলেও তা ছাপিয়ে গেছিলো সমস্ত শরীরে বয়ে চলা এক অন্য সুখানুভূতি। ফ্যাসফ্যাসে গলায় ও সোমঋতাদিকে কিছু বলার চেষ্টা করলো কিন্তু ওকে চুপ করিয়ে সোমঋতাদি বললো “কোনো কথা বলিস না, প্লিজ”। না, অ আর কোনো কথা বলতে পারেনি। কিন্তু সেদিন ওদের হাত বাঙ্ময় হয়ে উঠেছিল। তারপর একটা মাস ওরা আরো কাছাকাছি চলে এসেছিলো। কিন্তু এই সুন্দর সময়টাতেও বন্ধুদের বাঁকা হাসি বা খোঁচা ওকে কাঁটার মতো বিঁধতো। তারপর সোমঋতাদির মাধ্যমিক এগিয়ে এলে আর ও বিশেষ স্কুলে আসতোনা। শ্মবলীর মনে পড়ছে সোমঋতাদির ফেয়ারওয়েলে ও খুব কেঁদেছিল। তারপর আর ওদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ ছিল না। অনেক পরে এক বন্ধুর কাছে শুনেছিল সোমঋতাদি বিয়ে করেছে, দিল্লীতে থাকে। ঐ বন্ধুকে ওর ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিল শাম্বলীকে দিতে। কিন্তু শাম্বলীই আর ফোন করেনি।

শরীরে তারুণ্যের ছোঁয়া লাগার সাথে সাথে ওকে ছাড়তে হয়েছিল প্যান্ত টি শার্ট। সালোয়ার কামিজের সাথে সাথে মেয়েলী রূপে গ্রহণযোগ্য হতে চুলও বড়ো করতে বাধ্য হয়। সব কিছু মেনে নিয়েছিলো ও। শুধু কেউ যখন ওর বাবা মাকে বলতো “বিয়ের বয়েস হলো, এইবার মেয়েকে পাত্রস্থ করো”, কোনো এক অজানা কারণে এই কথাটা ওর মনে ভয় তৈরী করতো। প্রেমিক, স্বামী এই শব্দগুলো যে ওর মনে কোনো বিশেষ অনুভূতির সৃষ্টি করতোনা। ওর মন বারে বারে প্রশ্ন করতো “কেন পুরুষমানুষের প্রতি প্রেম ওর কাছে এতো কঠিন?”। কলেজের বন্ধুরা যখন তাদের প্রেমেইক বা স্বামী কতোটা ভালো বা তাএর প্রেমে কতোটা পাগল তার গল্প করতো, তখন ও চুপ করে এক কোনায় বসে থাকতো। অথবা দিদি বোনেদের আড্ডায় ও উপহাসের পাত্র হয়ে থাকতো। কারণ কো-এড কলেজে পড়া শাম্বলীর প্রেমিক নেই। এই ভাবে কোনঠাসা হতে হতে ও ধীরে ধীরে নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়েছিলো। বলা ভালো ওর ভিতরের সেই স্বতন্ত্র স্বত্বাটা একটু একটু করে মরে গেছিলো।

# সন্ধ্যা ৬টা –

এক কাপ চা নিয়ে জানলার পাশে চুপ করে বসে আছে শাম্ব। আজ আর আলো জ্বালাতে ইচ্ছা করছে না ওর। আজ ও আবার অতীতের পথে হাঁটছে।
যুবতী শাম্বলীকেও পাত্রপক্ষের সামনে বসতে হয়েছে। পাত্রের পছন্দ হলেও সে বেঁকে বসেছে। কারন ও আর কিছু হোক না হোক এইটুকু বুঝেছিল যে আর পাঁচটা মেয়ের মতো ও বিয়ে করে সুখী হবেনা। ও নিজেকে বুঝতে চায়, ওর নিজেকে নিয়ে চলা প্রশ্নগুলোর উত্তর দরকার।
ঠিক এই সময়ে এক দিন হঠাতই টিভিতে চলা একটা আলোচনায় ওর চোখ যায়। এই আলোচনার বিষয় ছিল যৌনতা ও তার সাথে জুড়ে থাকা মানষিক ও শারীরিক চাহিদা। এই প্রথম শাম্বলী জানতে পারে সমকাম কোনো নিষিদ্ধ গুপ্তরোগ নয়। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এও এক অতি সাধারণ চাহিদা। এ কোনো মানসিক বিকারও নয়।
সমস্ত আলোচনাটা ও মন দিয়ে শোনে। শুনতে শুনতে ওর মনে হয় এতো দিন ধরে জমে থাকা সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। সমস্ত জটিল ধাঁধার একটাই সহজ উত্তর – ও সমকামী। সত্যি বলতে কি ও প্রথমে জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু পরিবারকে হাজার হাজার প্রশ্নের মুখে ফেলে রেখে পালিয়ে যেতে ওর মন সায় দেয়নি। বরং দ্বিধাদ্বন্দ্বের শেষ সিমানায় দাঁড়িয়ে ও শুরু করলো এক অন্য যুদ্ধ। যে শাম্ব ওর ভীতরে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েছিল, ওর সেই স্বত্বাকে এইবার সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করার যুদ্ধ।

# রাত ২টো –

এখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে আছে। সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। খোলা জানলার সামনে বসে গিটার বাজাচ্ছে শাম্ব। যে ছেলেদের পোশাকে সাছন্দ্য, আর চলতি হেয়ার স্টাইল মেনে চুলেও এসেছে নতুন কাট। অনেক মতানৈক্যের পর ও আজ কিছুটা হলেও যুদ্ধটা জিতে গেছে। ও গর্বিত যে, ও সমাজের বিপরীত স্রোতের মানুষ, ও আলাদা, ও স্বতন্ত্র। কিন্তু এই এত্তো বড় কঠিন যুদ্ধটার একটুখানি অংশ জেতার জন্য ওকে অনেক মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছে। অনেককে দুঃখ দিয়েছে কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশী কষ্ট ও নিজে পেয়েছে, ও সত্যিই হয়তো অপরাধী।
একটা গভীত দীর্ঘস্বাস বেড়িয়ে আসে ওর ভিতর থেকে। ধীরে ধীরে গিটারটা বুকের কাছে চেপে ধরে শাম্ব। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে গিটারটার উপর। কেন এই সমাজ ওকে অথবা ওর মতো মানুষদের মানতে পারে না। কোনো অপরাধ না করেও কেনো ওরা মানসিক শাস্তি মেনে নিতে বাধ্য হয়। পরিবারের একজন হয়েও ওদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। এই সমাজ আর সমাজে প্রচলিত সব কিছু কেন শুধু বিরাট অথবা অনুষ্কার মতো বিপরীতকামী মানুষের কথা ভেবে বানানো হয়? কেন ওর মতো মানুষেরা চিরকাল অন্তরালে থেকে যায় উপহাসের পাত্র হয়ে। ও তো শুধু নিজের মতো বাঁচতে চায়। কিন্তু ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে একা বেঁচে থাকাকে কি সত্যিই বাঁচা বলে?
গিটার ওর হৃদস্পন্দন জানিয়ে উত্তর দেয় “শাম্ব তুমি উজার করে দাও তোমার মনের কথা। সমাজের চোখে আমি হয়তো স্থবির, কিন্তু আমি জানি এই স্থবিরতা আসলে সমাজের চিন্তায়। যারা আমাকেও ভাবে নির্জীব জড়পদার্থ। রোজ রোজ সুরের মূর্ছনা তুলেও আমি প্রমাণ করতে পারিনা যে আমি সজীব। সমাজের চোখে আমি আর তুমি দুজনেই মৃত।”
অন্ধকার ঘরের সচল ঘড়ির কাঁটাটা ওদের সাথে টিকটিক শব্দ করে জানান দেয় সময়ের পরিবর্তন হয়ে চলেছে, কিন্তু সামাজিক চিন্তার নয়।

ছবিসূত্রঃ needpix.com (ফ্রি টু ইউজ অ্যান্ড শেয়ার)

~~ o ~~ o ~~ o ~~ o ~~


<< কালিজা ২০২০ (৩য় বর্ষ) – সূচীপত্র


 

Exit mobile version