কাঁচালঙ্কা

জন্মকথাঃ গজানন গণেশ

জন্মকথাঃ গজানন গণেশ

(শিব পুরাণ এবং হরচরিতচিন্তামণি অবলম্বনে)
-ডঃ অভিষেক বব চক্রবর্ত্তী

            

“সখী, যদিও নন্দী-ভৃঙ্গী পরিচালিত সকল গণই(শিবের অনুচর) আমাদের অধীন, তথাপি, বাস্তবে তারা কেবলমাত্র তোমার স্বামী দেবাদীদেব মহাদেবের আদেশই মান্য করেন। আমাদের আদেশ মান্য করবার মতো কেউই তো নেই এই কৈলাশে!! হে অপাপবিদ্ধা সুন্দরী সখী, তোমার নিজেরই উচিৎ এমন কাউকে সৃষ্টি করা, যে শুধুই আমাদের আদেশ পালন করবে”।
বিজয়ার কথা মনে ধরলো দেবী পার্বতীর। গিরিরাজ হিমালয় পর্বতের কণ্যা পার্বতী কৈলাশে এসেছেন বহুকাল হয়ে গেল। স্বামী, কৈলাশপতি মহাদেব শিব বেশ কিছুদিন হল প্রবজ্যায় গিয়েছেন। জয়া, বিজয়া সহ চৌষট্টী সখী পরিবৃতা হয়েই এখন দিন কাটে গিরিনন্দিনী পার্বতীর।
কিন্তু, এতদিনেও নিজের ব্যক্তিগত বলে কিছুই নেই কৈলাশস্বামিনীর। অন্তরাল বলে কিছু নেই। নেই নিজে একা একা কালাতিপাতের কোনও নিভৃত নিরালা স্থান। সবই মহাদেবের সাথে ভাগ করে নিতে হয়। এমনকি, স্নানের ব্যক্তিগত সময়টুকুও একা রইবার সুযোগ নেই!! নইলে, এই, এই তো, কিছুদিন আগেই, পার্বতী স্নানে গিয়েছেন, সেই সময় মহাদেব এসে উপস্থিত। নন্দী বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেও, মহাদেব তা উপেক্ষা করে সোজা ভিতরে এসে প্রবেশ করেছেন, পার্বতী লাজে মরেন, আর কি!!!বিবসনা জগজ্জননী কোনরকমে নিজের লজ্জা রক্ষা করেন, আর কি!! সেই মুহুর্ত্তেই মনে হয়েছিল পার্বতীর, তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত পরিসর প্রয়োজন একটা। একান্ত ব্যক্তিগত কিছু সময় সবারই প্রয়োজন হয় সারা দিনের কাজের মাঝে। সেই একান্ত ব্যক্তিগত সময়টা রক্ষা করবার জন্যে একজন পাহারাদার প্রয়োজন। কিন্তু, নন্দী দের দিয়ে তা হবার নয়। তারা তো তাদের প্রভূর কথার দাস।
আর ভৃঙ্গীর কথা তো ধরাই উচিৎ নয়।এই কয়েকদিন আগে পর্যন্তও তো সে দেবী পার্বতীকে মাতা বলে স্বীকারই করত না। শুধুই মহাদবের পুজা করে যেত। দেবী পার্বতী আর মহাদেব সমভিব্যহরে সহাবস্থান করলেও, ভৃঙ্গী শুধুমাত্র মহাদেবের চতুর্দিকেই প্রদক্ষিণ করত। ক্ষুব্ধ দেবী পার্বতী একদিন বলেই ফেললেন, “পুত্র ভৃঙ্গী, আমি আর মহাদেব দম্পতী। শাস্ত্রমতে আমি ওনার অর্ধাঙ্গিনী। ওনার পুজা সম্পূর্ণরূপে করতে গেলে আমার পুজাও তোমায় করতেই হবে ব্ৎস্য। একারণে তোমার উচিৎ আমাদের দুজনকেই প্রদক্ষিণ করা”।
কিন্তু, ভৃঙ্গী তো সে কথা শোনার পাত্রই নয়। সে মহাদেবের চারিপার্শ্বেই প্রদক্ষিণ করে যেতে থাকল। তখন ক্রুদ্ধ দেবী পার্বতী মহাদেবের বামউরুর ওপরে আসীন হলেন। ভৃঙ্গী তখন মৌমাছির আকার ধারণ করে মহাদেব এবং পার্বতীর মাঝে প্রবেশ করতে চাইলেন। দেবী পার্বতী তখন মহাদেবের দেহের সঙ্গে একাকার হয়ে অর্ধনারীশ্বর রূপ ধারণ করলেন। ভৃঙ্গী তাতেও না দমে, হুলের দ্বারা ছিদ্র তৈরীতে উদ্যত হলে, দেবী পার্বতী ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলেন ভৃঙ্গীকে, যে, মাতৃ-শরীর থেকে ভৃঙ্গী যা যা প্রাপ্ত হয়েছেন, সবই তাকে ছেড়ে চলে যাবে। হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে, পিতৃ শরীর থেকে অস্থি-মজ্জা, আর মাতৃ-শরীর থেকে রক্ত এবং মাংস নিয়ে সন্তানের শরীর গঠিত হয়। দেবী পার্বতীর অভিশাপে ভৃঙ্গী পরিণত হয়েছিল শুধুমাত্র হাড়ের একটি কাঠামোয়। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে যখন ক্ষমা চেয়েছিল দেবীর কাছে, কৃপাপরবশতঃ দেবী তাকে আরও একটি পা প্রদান করেন, যাতে সে তিনটি পা দ্বারা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। দেবী ভৃঙ্গীকে রক্ত-মাংস ফিরিয়ে দেননি, কারণ, নারীশক্তিকে অপমান করার ফলাফল যাতে সবাই চোখের সমুখে দেখতে পায়। এরপর থেকেই সবাই একটু হলেও দেবীকে মেনে চলে, কিন্তু, মহাদেবের মতন অগাধ ভক্তি এখনও করে না।
পার্বতীও মনে মনে উপলব্ধি করলেন, “আমার নিজের একজন সেবক প্রয়োজন, যার কাছে আমার আজ্ঞাই শেষ, চরম, পরম। অপর কারুর আজ্ঞা সে মান্যই করবে না”।
দেবী পার্বতী কৈলাশের বিশাল সরোবরে সখীদের নিয়ে গিয়েছেন স্নান করতে। সখী বলতে তাঁর ৬৪ যোগিনী সখী। সেদিন এক আশ্চর্য সমাপতন ছিল, দেবী পার্বতী আর তাঁর সখী বিণায়কী দু’জনেই ঋতুমতী ছিলেন। দেবী পার্বতী নিজের দেহমল জমিয়ে জমিয়ে এক বালকের অবয়ব তৈরী করেছিলেন, যা প্রাণ পেল, যখন দেবী পার্বতী এবং তার সখী বিণায়কীর রজঃ মিশ্রিত হলে দেবীর দেহমলের সঙ্গে। জন্মনিল পার্বতী এবং বিণায়কীর পুত্র। শৌর্য বীর্জ মহত্বে সে সকলের সেরা হবে, গণেরা তাকে আরাধনা করবেন, এই আশায় দেবী তার পুত্রের নাম রাখলেন গণেশ। আবার, গণেশ তো একাধারে বিনায়কীরও পুত্র, তাই তার অপর নাম হল বিণায়ক।(মতান্তরে, বি-নায়ক,অর্থাৎ,নায়ক-বিহীন সঙ্গমে জন্ম হয়েছিল বলে পার্বতী-পুত্রের নাম বিণায়ক।) বিণায়কীর মস্তক হস্তীর মস্তক। বিনায়কীর পুত্র হওয়ায়, দেব গণেশের মুণ্ডও হল হস্তীর। সর্বাঙ্গসুন্দর, প্রাজ্ঞ, ধীসম্পন্ন বিশালাকায় পুত্রকে মাতা পার্বতী আদেশ দিলেন, “ পুত্র গজানন,তুমি আমার পুত্র, শুধু এবং শুধুমাত্রই আমার সন্তান, অপর আর কারুর নও।এই নাও দণ্ড, তুমি আমার স্নানাগারের দ্বারে প্রহরায় থাকো পুত্র। আমার অনুমতি ভিন্ন কাউকেই তুমি প্রবেশাধিকার দিও না পুত্র। তুমি বই আমার আর কে আছে বলো? পালন করবে না তুমি তোমার মাতৃ আজ্ঞা?” পুত্র মায়ের আদেশ মাথায় তুলে নিলেন ।খর্ব, স্থূলতনু, গজেন্দ্রবদন, লম্বোদর পার্বতীপুত্র গণেশ এরপর থেকে রোজ পাহারা দিতে থাকলেন মা-এর দ্বারের সম্মুখে।
প্রবজ্যা সেরে মহাদেব ফিরে এলেন কৈলাশে। নিজের স্ত্রীর ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধা পেলেন কৈলাশপতি। দেখলেন,দুয়ারে এক বিচিত্রদর্শন শিশু দণ্ডায়মান,হস্তে দন্ড।শিশুটিকে উপেক্ষা করে অগ্রসর হতে গিয়েই শঙ্কর পড়লেন বাধার সম্মুখে। শিশুটি তার হস্তের দণ্ডটি প্রসারণ পূর্ব্বক বলে উঠলে, “হে তাপস! এই স্নানাগার আমার মাতার। তাঁর অনুমতি ব্যতীত আমি আপনাকে এই কক্ষে প্রবেশের সুযোগ দিতে অপারগ। কৃপা করে আপনি মাতার আগমন পর্যন্ত প্রতীক্ষা করুন”।
“হে মূর্খ হস্তিমুণ্ড শিশু, তুমি কি জ্ঞাত, কার সাথে কি প্রকারের ধৃষ্টতা প্রদর্শন করছো? দুরাচারী মন্দবুদ্ধি বালক, তুমি কি জানো না যে আমিই কৈলাশপতি দেবাদীদেব মহাদেব?” ক্রুদ্ধ মহাদেব বলে উঠলেন। কিন্তু, মাতৃ আজ্ঞা পালনে দৃঢপ্রতীজ্ঞ পার্বতীপুত্র গজানন গণেশ এসবের কিছুই কর্ণপাত করলেন না। দেবী পার্বতী প্রদত্ত দণ্ড দ্বারা আঘাত করলেন মহাদেবকে। ক্রুদ্ধ মহাদেব গণেশকে আহবান করলেন যুদ্ধে। ভয়ংকর, রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধে মহাদেবের অনুচরেরাও অংশ নিলেন, এলেন দেবসেনাপতি মহাদেব-পুত্র কার্তীকেয়। শিশু গণেশ একা সকলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে গেলেন। মাতা পার্বতী তখন তাঁর চৌষট্টী যোগিনীদের সাথে দুই শক্তির সৃষ্টী করলেন গণেশের অংশ থেকে। এঁদের সম্মিলিত যুদ্ধে পরাস্ত মহাদেব অবশেষে স্বীকার করে নিলেন পার্বতী-পুত্র গণেশকে। সুরলোকে বেজে উঠলো শঙ্খঘন্টাধ্বনি। পুষ্পবৃষ্টি হল শিশু গজাননের উপর। উত্তরের হাওয়ায় ভেসে আসা সুগন্ধীপুষ্পের ঘ্রাণে, শঙ্খনাদের আনন্দে বিষাদ ঘনিয়ে এলো পাতালে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্যের আশ্রমে, দেউলটির প্রদীপ গেলো নিভে। আবাহন আর বিসর্জনের আশঙ্কার মিলিত সুরে অনুরণিত হল সন্ধ্যার বাতাস।

অঙ্কন – শ্রী গুঞ্জন চক্রবর্ত্তী

Exit mobile version