— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন – নিজস্ব সংবাদদাতা
৩রা জুলাই’ ২০২০ঃ যা রটে,তা কিছু তো বটে। একটা অভিযোগ ক্রমাগত উঠে আসছে বেশ কিছু সমাজকর্মীদের ভাষ্যে। করোনায় সবচেয়ে বেশী আক্রান্ত যে সম্প্রদায়, তারা হলেন পরিচয়হীন রূপান্তরকামীরা। পরিচয়হীন, সমাজের চোখে কারণ সামাজিক পরিকাঠামো তাদের বুঝতে পারেনা, পরিচয়হীন রাষ্ট্রের চোখেও, কারণ রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের কাছে এখনো এদের নিয়ে কোন পরিসংখ্যানই নেই। আজকের গল্প আরেকটু আন্তরিক। আজ কথা বলতে বসেছি শুধুমাত্র তাদের নিয়ে নয় কিন্তু, তাদের পরিবার নিয়ে। দিদি আমার মা, মেজ বৌ, ছোট বৌ ইত্যাদি ছবিতে যে পরিবার ফুটে ওঠে সেরকম কিছু একটা। অথবা জলনুপুর, বৃষ্টিঘুঙুর, এখানে আকাশ নীল, মঙ্গলের আকাশ লাল — ইত্যাদি বস্তাপচা ধারাবাহিকের পরিবার, যারা দুটো বর, চারটে বৌ নিয়েও সুখী। কিন্তু, আস্তে লেডিস, বা হয়তো লেডিস না, আবার ছেলেও না, কোলে যাদের বাচ্চা নেই, সেসব মানুষেরা তো এই সব ছবিতে, ধারাবাহিকে থাকেননা। কোন্ সিনেমায় আমরা বলতে শুনেছি, রাখী গুলজারকে “মেরে শিখন্ডী-অর্জুন আয়েংগে”? শুনিনি, কারণ কেউ বলেনা, আজ আমরা না হয় সেই না-বলা মানুষদের নিয়েই একটু আড্ডায় বসি।
যেকোন আত্মহত্যাই দুঃখজনক। সেটা কিছু মানুষ যেন জুন মাসের ১৪ তারিখেই হঠাৎ বুঝে ফেললেন। নামটা জাঁকালো ছিলো বটে। সুশান্ত সিং রাজপুত। কিন্তু তার কদিন আগে, জুন মাসেরই ৩ তারিখে যখন আত্মহত্যা করলো চন্দা (নাম পরিবর্তিত), কজন জানলো সে খবর? দক্ষিণ দিনাজপুরে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে, বালুরঘাটের রূপান্তরকামী চন্দা, অষ্টাদশী রূপান্তরকামী যুবতী, নিজের আর তার পরিবারের পেট চালাতো লন্ডা নেচে। তারই গোষ্ঠীর বন্ধুরা জানান, লকডাউনে কি ভীষণ আর্থিক চাপের মধ্যে পরতে হয় তাকে। কাজ নেই। কি করে চলবে? তার পেট, তার পরিবারের পেট? পরিবার, যাদের জন্য সে ভাবতো, কিন্তু একসাথে থাকতে পারতোনা। তার বাবা আর ভাই কখনো মেনেই নেয়নি তাকে। তার পেট চলছে কিনা সেই নিয়ে সেই পরিবারের চিন্তাভাবনা কিন্তু মোটে ছিলোনা। কিন্তু চন্দা ভাবতো। রোজগার নেই, পরিবারের পেট চলছেনা, আর এদিকে এস-আর-এস (চিকিৎসার মাধ্যমে লিঙ্গ প্রতিস্থাপন) -এর জন্য যে টাকা জমাবে ভেবেছিলো, তারই বা কি হবে? কেন চাইতো সে পুরোপুরি একটা মেয়ের শরীর পেতে? কেউ বলে তার মনের চাহিদা, কেউ বলে তা র পারিক (পুরুষ সঙ্গী) -এর ইচ্ছে। তাকে বুঝিয়ে নাকি কোন লাভ হয়নি।
নাহ! লাভ হয়নি। কেউ আসেনি।
না সেই পরিবার, না সেই পারিক। দক্ষিণ দিনাজপুরের রূপান্তরকামী ভাইবোনেরাই স্থানীয় এক বন্ধুমনোভাবাপন্ন উকিল আর প্রশাসনের সাথে কথা বলে তার শেষযাত্রার ব্যবস্থা করে। তারা নাকি এটাও চেয়েছিলো, যাতে চন্দার ফেলে যাওয়া সম্পত্তি অকৃতজ্ঞ পরিবার দখল করতে না পারে। শেষমেশ কি হলো, জানা নেই।
এগুলো কিন্তু নতুন কোন গল্প নয়, নিজের পরিবারকে পাশে পাওয়া, না পাওয়ার এই নিদারুণ যন্ত্রণা কিছু রূপান্তরকামীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। কিন্তু করোনা এসে, যেন সেই না-পাওয়ারই আরও ভয়াল রূপকে সামনে তুলে আনলো। যন্ত্রণার গল্পগুলো আরো বেশী করে সামনে এলো যখন রূপান্তরকামী নারী, রূপান্তরকামী পুরুষ এবং অন্যান্য ভিন্নধর্মী লিঙ্গচেতনাসম্পন্ন মানুষেরা লকডাউনের আগের এবং পরের, নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে জানালো বার্তা ট্রাস্ট সিটিজেনশিপ জার্নালিজম প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। প্রোগ্রামটির উদ্দেশ্য ছিলো বাছাই করা কিছু আবেদনকারীদের সাংবাদিক হিসেবে গড়ে তোলা। তাদের দায়িত্ব ছিলো, শহর থেকে দূরে, সমাজের অল্পশিক্ষিত পিছিয়ে পরা মানুষদের সাথে কথা বলা, এবং সাংবাদিক হিসেবে তা লিপিবদ্ধ করা। ফলস্বরূপ উঠে এলো, লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের উপরে ঘটে চলা অনীহা, অশ্রদ্ধা আর হিংসার রোজনামচা। কিছু মানুষেরা জানালেন কিভাবে তাদের দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর চিন্তা কেড়ে নিয়েছে রাতের ঘুম। অসুস্থ পরিবারপরিজন, অথবা অন্যান্য নির্ভরশীল পরিবারবর্গের ভরণপোষণ, আর কখনো এস-আর-এস থেকে টাকার অভাবে বেড়িয়ে আসা, তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে অবসাদের মধ্যে।
৩৫ বছরের রাইমা, আরেকজন লন্ডা-শিল্পী, উত্তর ২৪ পরগণার মসলন্দপুর থেকে বার্তার সিটিজেনশিপ জার্নালিজম প্রোগ্রামের একজন সাংবাদিককে জানায় “ভবিষ্যতের কথা ভাবতে গেলেই ভেঙ্গে পরি, কোন কাজ পাবো আর? আমার মা আছে, কিন্তু বাকি লোকজন, বিশেষ করে আমার দাদা কোন দায়িত্ব নেয়না, সব আমার উপরে”…
টিংকুও একই কাজ করতো, তার বাড়ি একই জেলার হাবরায়। ভাগ্যিস, লগন চলাকালীন, লকডাউনের ঠিক আগেই সে বিহার থেকে নিজের বাড়িতে ফিরে আসতে পেরেছিলো। মায়ের কয়েক টাকা মাত্র পেনশন, টিংকুর টাকাতেই সংসারটা টিকে আছে। টিংকুর ভাই বিয়ে করেছে, কিন্তু বেকার। সেই ভাইয়ের সংসারের দায়িত্বও তার কাঁধে। তার দাদা আলাদা থাকে, তাদের কোন দায়িত্বই নেয়না। “একবার আমার একটা এক্সিডেন্ট হয়, কিন্তু পয়সার অভাবে ডাক্তারই দেখাতে পারিনি। ভবিষ্যতে কি যে হবে, ভেবে রাতে ঘুমোতে পারিনা” – জানায় টিংকু।
মে মাসের প্রথম দিক নাগাদ যখন এই সাক্ষাৎকারগুলি নেওয়া হচ্ছিলো, তখনও অবধি, টিংকুসহ পশ্চিমবঙ্গের বাকি রূপান্তরকামীরা, ভারত সরকারের সামাজিক ন্যায় এবং অধিকারিতা মন্ত্রক থেকে এককালীন ১৫০০ টাকা সাহায্যই পেয়েছিলো মাত্র, তাও বিভিন্ন সমাজকর্মীদের অনেক বলাকওয়ার পরে। কিন্তু ভারত সরকারের সেই বিতর্কিত ট্রান্স বিল, যা কেন্দ্র সরকার অনেক বিরোধিতা স্বত্বেও সংসদে পাস করায়, তার প্রেক্ষিতে এধরণের সাহায্য তো রূপান্তরকামীদের এমনিই পাওয়ার কথা ছিলো।
সেই ট্রান্স বিল যা, রূপান্তরকামীদের জন্য তাদের পরিবারকেই সবচেয়ে নিশ্চিন্ত আর নিশ্ছিদ্র আস্তানা হিসেবে ঠাউরেছিলো।
যদিও নিজের পরিবারের রূপান্তরকামী সদস্যদের মেনে নেওয়ার নিদর্শনও রয়েছে। কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে সেগুলি আসলে মানিয়ে নেওয়া, এবং হয়তো খুব স্বার্থপর ভাবেই। কোলকাতার বেসরকারি আপিসে কর্মরত পূজা ২৮ বছরের একজন রূপান্তরকামী নারী, এবং নিজের পরিবারের একমাত্র চাকুরে। অতএব সেই তার সংসারের সমস্ত খরচ চালায়, এমনকি লকডাউনের মধ্যেও তাই চালিয়ে এসেছে। মাইনে কাটা যাবেনা তো, বাকিদের মতো, চাকরিটা থাকবে তো, এই নিয়ে চিন্তায় পূজা অস্থির। এই পূজার বাবা-মা পূজাকে মেনে নিয়েছে বটে, কিন্তু নিজের পরিবারের “সম্মান” আর চাকরির কথা পূজাকে এখনো মাথায় রেখেই চলতে হয়। নিজের মতো সাজতে চাইলে তাকে চলে যেতে হয় শহরতলীতে, তার বন্ধুর বাড়িতে। সেখানে যাও, নিজের মতো থাকো, হোমো-ছহক্কা-দের ফাংশানে যাও এইটেই নিদান। আর এখন লকডাউনের বাজারে, সে গুড়েও বালি।
২৯ বছরের রুপান্তরকামী পুরুষ মিঠ (নাম পরিবর্তিত), এই একইরকম নিজেকে উজাড় করে দেওয়া আরেক উদাহরণ। প্রোমোটিং-এর কাজ করে মিঠ। এমনিতে এখন বাজার খারাপ, তার উপরে মায়ের চোখের খারাপ অবস্থা, লকডাউনে চিকিৎসাও বন্ধ – এর মধ্যে শুধু নিজের সংসারের খরচ চালানো আর কর্মচারীদের মাইনে দেওয়াই না, পাড়ার দুই দুঃস্থ মানুষকে প্রয়োজনীয় রেশন পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্বও স্বেচ্ছায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে মিঠ। “আমি খুব খরচে ছিলাম, আর প্রচুর টাকা মদে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু লকডাউন আমায় টাকার মূল্য বুঝিয়েছে, আর মদ খাওয়াও আমি এখন কমিয়ে দিয়েছি” – জানালো মিঠ। আচ্ছা, রাইমা আর টিংকুর ভাইয়েরাও তো এভাবে ভাবতে পারতো, একইভাবে নিজের, পরিবারের, সমাজের ভালোর জন্য এগিয়ে আসতে পারতো নিজেদের “স্বাভাবিক(?)”, “বিয়ে করা”, “কাচ্চা-বাচ্চা-ওয়ালা” জীবনের গণ্ডি পেড়িয়ে। তাদের কি মনে হয়েছিলো?
পরিবারের “ঠিকঠাক(?)” সদস্য হিসেবে নিজের বোনের সাথে একসাথে থাকতে পারা, এতেই তারা মহান হয়ে গেলো?
আমাদের চারপাশের এইসব চন্দা, টিংকু, রাইমা, পূজা, মিঠ – এদের নিজেই ছিলো আজকের সত্যি গল্প। এমন কিছু চরিয়ত, যারা নিজেদের চেয়ে বেশী করে ভাবে নিজেদের পরিবারের কথা,চারপাশের মানুষদের কথা। আর এদের জন্য কে ভাববে? এদের পরিবার? রাষ্ট্র? কেমন তাদের দরদ সে গপ্পো তো শুনলামই আমরা। আমরা, মানে আমি, তুমি, আমরা যাদেরকে বোঝাতে পারবো তারা, এই আমরা সবাই মিলেও কি কিছু ভাবতে পারিনা এদের জন্য? মানুষের জীবনকে জীবন হিসেবে ভাবা, তার সম্মানকে প্রাপ্য সম্মান দেওয়া, নাই বা হলো ছকে বাঁধা পুরুষালী অথবা মেয়েলী সেই জীবনের সংজ্ঞা — খুব কঠিন?
বিঃ দ্রঃ এই প্রতিবেদনটি vartagensex.org -র অনুরূপ একটি ইংরিজি প্রতিবেদনের ছায়ায় লেখা।
~~~~~~~~ * ~~~ * ~~~ * ~~~~~~~~
ছবি-সূত্রঃ pxhere.com (বিনামূল্যে ব্যবহারযোগ্য)