কাঁচালঙ্কা

“আ জানেজা” নাকি “লো ম্যায় আ গয়ি”? ফারহানা আফরোজ প্রসঙ্গে

YouTube Poster
কে এই ফারহানা আফরোজ?

নাহ! সত্যিই মাথায় হেলমেট নেই। মুখে নেই মাস্ক। তার উপরে দেশের করোনা পরিস্থিতিতে ধুমধাম করে গায়ে হলুদ? খুব অন্যায়। কিন্তু অসুবিধে যদি হেলমেট নিয়ে থাকতো, বা বিয়ের ধুমধাম নিয়ে, তাহলে হয়তো ভাবতাম, ফেসবুকের মাধ্যমে সমাজ এবং দেশের কল্যাণসাধনে ব্রতী হয়েছেন কিছু শিক্ষিত মানুষজন। কিন্তু নাহ! আপত্তির জায়গাটা অন্য। একজন মেয়ে হয়ে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নিজের নারী এবং পুরুষ বন্ধুদের মধ্যমণি হিসেবে যাকে দেখা যাচ্ছে…

আরে! এডা তো পোলা না, মাইয়া!!

সেখানেই সমস্যা। মানে, হেলমেট কেন? যদি ল্যাঙটো হয়েও কোন পুরুষ বাইক চালিয়ে নিজের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে হাজির হয়, তাহলে চাপ নেই। কিন্তু একটা মেয়ে? মানে মেয়েটা বেশ্যা, তার যে ছেলেটির সাথে বিয়ে হবে, সে হিজড়ে, আর আমরা সব নিন্দুকেরা “সহমত ভাই”-এর দল। এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানানো আমাদের সবার কর্তব্য। তাজ্জব ব্যাপার, কিন্তু এটাই আমাদের জাতীর পুরুষতান্ত্রিক সত্যিকারের রূপ। একে তো বোর্খা নেই, তার পরে বাইকে আসীন, আর সবশেষে মুখে নেই সেই সুপরিচিত লাজুক হাবভাব। স্বাভাবিক বদহজম তো হওয়ারই কথা। আসলে কিছু মানুষের ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিক রুগ্ন পাকস্থলীতে আধুনিকতার মালমসলা হজম না হলে, দোষটা যেন তার ধর্ম্মান্ধতা আর পুরুষতান্ত্রিক গোঁড়া রোগটার না, যতো দায় যেন, খাবারে ঝাল বেশী, সেটার। তা বাপু, তুমি ঝাল খাওনা বুঝলাম, তাই বলে আর কেউ ঝাল খাবার রান্না করতে পারবেনা, তা তো নয়। কিন্তু যারা এক লাইন বাংলা লিখতে গিয়ে, সেই লাইনে যেক’টি শব্দ থাকে তার থেকেও বেশী বানান ভুল করে, তাদেরকে বোঝায় কার সাধ্যি?

তাই এদেরকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে নয়, নিজের ইচ্ছে হয়েছে তাই এই লেখা লিখতে বসা। সমস্যাটা কতোটা ধর্ম নিয়ে আর কতোটা নয়, সে বিষয়ে বেশ ধন্দ্ব আছে আমার। যদিও তাতে আমার খুব যে বিশেষ কিছু আসে যায় তা নয়। লোকে আমায় ফেমিনিস্ট বলে গালি দিলেও আমার বিদীর্ণ গিয়াছে, নাস্তিক বলে গাল দিলেও আমি খুশীই হবো। যদিও এতো সুললিত ভাষায় ধর্মান্ধরা গাল দেয় বলে অমার বিশ্বাস হয়না।

ছবিসূত্রঃ Ishita’s Art

আ জানেজা / আ মেরা ইয়ে হুস্ন জওয়া / তেরে লিয়ে হ্যাঁয় আস লগায়ে / ও জালিম আ যা না

১৯৬৯ সালের ইন্তকাম ছবির গান। লিরিক্সগুলো শুনলে মনে হয় হে মহিমময় পুরুষ, আমি অধম নারী, তোমার করুণাশ্রীতা ভোগ্য বস্তু। আমার চোখের থেকে সুখানুভূতির প্রতিশ্রুতি চুইয়ে পড়ছে, বুকের সাগর উথালপাথাল। হে কঠোর আমার কাছে এসে আমায় ভোগ করে ধন্য করো। সমস্যাটা এখানে। বিয়ে এমনিতেও একজন পুরুষকে একটি নারী শরীর ভোগ এবং ব্যবহার করে সন্তান উৎপাদন করতে দেওয়ার সামাজিক কাঠামো। অর্থাৎ এখানে একজন পুরুষ আসবেন এক নারীর কাছে, তাকে তুলে নিয়ে যাবেন নিজের বাড়িতে, তারপর সেখানে ভদ্র ভাষায় বলতে গেলে তার সাথে ফুলশয্যা সারবেন। এই তো হওয়ার কথা। রাজকন্যা থাকবে রাক্ষসের কাছে। রাজপুত্তুর ব্যাঙাচির ফুলকা ফুটোবুকে গুঁজে একডুবে তাকে উদ্ধার করবেন। সইটাকে রামের কবল থেকে বাঁচিয়ে এনে রাম তাকে চাইলে আগুনে ঠেলে দিতেই পারেন, কিন্তু আপনি যাবেন রামের বাড়ি মেয়ে হয়ে তাকে প্রেম নিবেদন করতে, তাহলে আপনি রাক্ষুসি সুর্পনখা, অতএব আপনার নাক-কান-কাটা হালাল। তো আমাদের গপ্পের এই সুর্পনখা থুকু ফারহানা আপারও নাককান কাঁটা পড়েছে। আক্ষরিক অর্থে না হলেও, ফেসবুক আর ইউটিউবে তো বটেই। চলেছে একের পর আরেক, টাইপ করা, বানানের-মা-বাপ-নেই কথা দিয়ে তৈরি চাপাতির কোপ।

একজন আকাট ধর্মান্ধ পুরুষতান্ত্রিক মানুষের স্বাভাবিক মন্তব্য যার কাছ থেকে এর থেকে বেশী কিছু আশাও করা যায়না।

কে এই ফারহানা? ভিডিওগুলি এখনো দেখা হয় নাই বুঝি? অ। আপনারা দেখি আমার মতোই আলসে। তো আমাদের গল্পের নায়িকা বা রাক্ষুসি ফারহানা ঢাকায় থাকেন। ২০১৭ সালে বিয়ে। ২০২০-তে অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান হয় যশোরে। পার্লার থেকে বাইক চালিয়ে তিনি নিজের বরের বাড়ি গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন। ঢাকায় তিনি দেখেছেন কোন এক গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে বর বাইকে করে এন্ট্রি নিয়েছিলো। সেটা তার ভালো লাগে, আর তাই এবার নিজের গায়ে হলুদে একই কাজ করতে গিয়ে পড়লেন বিপাকে।

বর যে ছেলে, আর বৌ যে মেয়ে এটা তার ভাবনায় আসুক বা না আসুক, আমাদের সাধের “সমাজ” কি এতো সহজে ভুলে যাবে? আর তার সাধে ধর্মান্ধতা তো ভস্মে ঘি। মা বোনেদের “ইজ্জত” নাকি রসাতলে গেলো। গেলো গেলো বেশ হলো? মা বোনেরা লজ্জার বোর্খায় আর ঘোমটায় মুখ লুকিয়ে ভয়ে গুটিয়ে থাকবেন যাতে করে আপনাদের লুঙ্গী ধুতি প্যান্টালুনের ভিতরে নুংকু-বাবাজি শান্ত থাকে? কেন শুনি? তাদের দায়টা কি? আপনারা বাবা-দাদা-রা চোখে ঠুলি পরে নিজের নিজের সংযমের দায়ীত্বটা নিন না।

নাহ! ফারহানাকে আমি চিনিনা। তার বংশমর্যাদা ইত্যাদি প্রসংগে সাফাই গাওয়ার সাথেও আমি খুব একমত নই। বংশ পরিচয় আমার কাছ খুবই খেলো, বর্ণবাদদুষ্ট আর অপ্রয়োজনীয় একটা বস্তু। আমি এটাও জানিনা তিনি এলজিবিটি+ অথবা লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের সম্পর্কে কিরকমের ধ্যানধারণা রাখেন। আমার যেটা ভালো লেগেছে, সেটা হলো ফুউউউশতন্ত্রের গালে এই সপাট চড়টা।

ও মেরে সজনা / লো ম্যায় আ গয়ি… / লোগোনে তো দিয়ে হোংগে বড়ে বড়ে নজরানে / লায়ি হু ম্যায় তেরে লিয়ে দিল মেরা / দিল ইয়েহি মাংগে দুয়া হাম কভি হো না জুদা / মেরা হ্যায়, মেরা কি রহে দিল তেরা / ইয়ে মেরি জিন্দেগি হ্যায় তেরি

এই তো। ১৯৮৪ সালের শরাবি সিনেমার এই গানটাই যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছে। আহা! কি আনন্দ। মনে হয় যেন ধেই ধেই করে নাচি। কি অদ্ভুত লিঙ্গচেতনার ব্যকরণের মুখে এক অমোঘ নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধি। নারী বনাম পুরুষ, উত্তম বনাম অধম, চুলোয় যাক। বাইক কেন ছেলেরা চালাবে খালি? হলুদ মেখে মেয়েদের কেন লাজুক মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে? এই ভাঙনগুলোই তো চাই। এতো ছেলেদের এটা মেয়েদের ওটা, এগুলো থাকাটাই তো অনুচিত। ঠিক যে কারণে আজ ফারহানা কাঠগড়ায় ঠিক সেই একই কারণে কতো বাংলা-ভাষাভাষী রূপান্তরকামী (লিঙ্গ-প্রান্তিক অথবা লিঙ্গ-সমান্তরাল হয়তো আরো সঠিক বাংলা হবে) বা ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা সমাজে শোষণের শিকার। আমাদের আর ফরহানার লড়াই তাই আলাদা নয় এক।

ফারহানা সুবিধেজনক জায়গায় আছেন অনেকটাই। তার বর (স্বামী শব্দটায় আমার অ্যালার্জি আছে), বাবা, মা, শ্বশুর, শাশুড়ি, বন্ধুবান্ধব সবাই তার পাশে। অনেক মানুষেরই সমাজের তৈরি খেলো যুক্তিহীন লিঙ্গকাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াইটা আরো অনেক অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুনেছি তার শ্বশুর নাকি তাকে নতুন বাইকও কিনে দেবেন। জানিনা এরপরে সরকার প্রশাসনের তরফে কোন চাপ আসবে কি না। জানিনা ধর্মান্ধরা তার প্রাণনাশের চেষ্টা করবেন কি না। জানিনা, তার বিরুদ্ধে ধর্ষন আর খুনের আস্ফালন করা অশিক্ষিত অমানুষগুলোর কোন সাজা হবে কিনা। তাই আপাতত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, আর তার লড়াইয়ের সাথে একমত জানিয়ে এখানেই থামছি দুটো উক্তিকে পাশাপাশি রেখে। মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে কি?

“ভাই, আমার শখ আমি আমার মতো করে পূরণ করসি। আমার বিয়ে ছিলো, আপনাদের না।”

— ফারহানা আফরোজ (ফেসবুক লাইভ থেকে)

“আমার শরীর আমার মন, দূর হটো রাজশাসন”

— সমবেত জনতা, কোলকাতা রেইনবো প্রাইড ওয়াক (রামধনু গৌরব যাত্রা)

— * — *** — * —

Exit mobile version