কাঁচালঙ্কা

ভাঙা মূক প্রাচীর

আমার ফোনে দু-একটা পরিচিত ফোনই আসে। অপরিচিত নম্বর থেকে যেগুলো আসে সেগুলো মাথামুণ্ডুহীন, এলেবেলে, বিরক্তিকর। সেদিন কাজে বেরোবো বলে নিজে তৈরী হচ্ছি, এমন সময়, একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন। প্রথমটা ভাবলাম ধরবোনা, কিন্তু মত পাল্টে ধরেই ফেল্লাম।

– “কল্লোলের কাছ থেকে তোর নম্বরটা পেলাম। সঞ্চয়ন বলছি।” কণ্ঠস্বর যে সঞ্চয়নেরই তাতে সন্দেহ নেই। জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনিয়রিং কলেজের বি.টেক এর সহপাঠী।

– “হ্যাঁ বল, হঠাৎ কি মনে করে আমায় ফোন করলি? বেশ তো ভুলে গেছিস!” আমি বল্লাম।

– “শোন না! তুই একবার আমার এখানে, গঙ্গারামপুরে আসতে পারবি? ব্যপারটা খুব জরুরী।”


কিছুক্ষণের জন্য আমি নিজেকে কোথাও যেন হারিয়ে ফেল্লাম। তার হঠাৎ এই আমন্ত্রণ আমায় বিহ্বল করে তুল্লো। কলেজে পড়াকালীন সঞ্চয়নটার ওপর আমার বেশ ফিদা ও ব্যাথা ছিলো। চাবুকমারা ছোটখাটো গড়ন। ওর সেই মেদহীন চেহারার সঙ্গে যেন ব্রুশ-লী বা জ্যাকি চ্যানের সাদৃশ্য খুঁজে পেতাম। খুবই দায়ীত্ববান ছেলে, মিশুকে, দরদী। ফেসবুকে রিকুয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম। কিন্ত ও ফেসবুক করে বলে মনে হয়না। তাহলে এতদিনে অ্যক্সেপ্ট করতো। সঞ্চয়ন এখন পিডব্লু সেকসনে গঙ্গারামপুরে আছে।


– “কিরে! কবে আসছিস?” ওপার থেকে আওয়াজ।
আমি বল্লাম, “এখন কাজে বেরোচ্ছি, তোকে দুপুরে ফোন করছি। এটাই তো তোর নম্বর?”


জলপাইগুড়ি গভর্ণমেন্ট ইঞ্জিনিয়রিং কলেজে আমাদের পড়াশুনো। আমি পাশ করার পর বক্রেশ্বর থার্মালে বয়লার সেকশনে জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র হিসেবে জয়েন করেছি। দুপুরে ফোন করে বল্লাম, “হ্যাঁরে? ব্যাপারটা কি? তুই যেতে বলছিস? দরকার তো তুই আয় না!”

– “আমার এখন যাওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়। তোকে সব বলছি। তুই সকালে বেরোনোর তাড়ায় ছিলি, তাই কিছুই বলিনি। ফিরোজস্যারের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। খুব বাজে অবস্থা, ডেলিরিয়াম বকছেন। তাতে অস্পষ্ট ভাষায় তোর নাম নিচ্ছিলেন। তাই তোকে ডাকছি। ফোনে সব বলা যাবেনা।”


তারপর ও বলে চললো কিভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, কিভাবে কল্লোলের কাছ থেকে আমার ফোন নম্বর জোগাড় করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি।


ফিরোজস্যার ছিলেন আমাদের মাই ডিয়র টীচর। আমাদের থেকে আট দশ বছরের বড়। হাইড্রোলিক্সের যাদুকর। হাতে ধরে উনি আমাদের সমস্ত শেখাতেন। যেমনি করিৎকর্মা তেমনি সুদর্শন। আড্ডায় ওনার নাম দেওয়া হয়েছিলো রনধীর কাপুর। বিষয়ের প্রতি যে কতটা অনুরক্ত ছিলেন তা বোঝা যেত বিশ্বকর্মা পূজোর দিন।


পরেরদিন গঙ্গারামপুরের বাস ধরে রওয়ানা দিলাম। বাস হুহু করে দৌড়োতে শুরু করলো। আমার মনটাও হুহু করে ডুকরে উঠলো অতীৎকে আঁকড়ে ধরে।


একটা প্র্যকটিক্যাল ক্লাস আমি কোনওদিন ভুলবোনা। হাম্প এনালিসিসের প্র্যকটিকাল ক্লাস। আমরা একটা ঢালু নালা ব্যবহার করতাম। এই নালার ঢাল বাড়ানো কমানো যেত কন্ট্রোলিং মিটারের সাহায্যে। বইয়ের ভাষাতে এই নালাটার নাম টিল্টিং ফ্লুম্। সাড়েতিন ফুট উচ্চতায় ফ্লুমটা রাখা থাকত। নিরীক্ষার বিষয় হল, চলমান কোনও ফ্লুইডের স্রোতে কোনও বাধা বা হাম্প থাকলে বাধা পার করার পর স্রোতটা লাফিয়ে ওঠে। এটা খুবই সাধারণ ঘটনা। আমরা সকলেই সামান্য নালির প্রবাহমান স্রোতেও জলের এই লাফ দেখতে পাই। তবে, এই লাফানোটা নির্ভর করে কয়েকটা রাশির ওপর। বাধা বা হাম্পের উচ্চতা, স্রোতের গভীরতা ও ফ্লুইডের স্রোতের বেগের ওপর। এই লাফানোটাকে বলে হাইড্রলিক জাম্প। ক্রিটিক্যাল হাম্প হাইট আর ক্রিটিক্যাল স্রোতের বেগের একটা চার্ট করাই ছিলো আমাদের এসাইনমেন্ট।


আমার বেশ মনে পড়ে আমি মনযোগ সহকারে নিখুঁত ভাবেই নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছি। বাঁহাতে কন্ট্রোলিং মিটার ধরে স্রোত বাড়াচ্ছি কমাচ্ছি আর আমার ডান হাতে গভীরতা মাপার জন্য রয়েছে হুক গেজ।

– “উঁহু ওভাবে নয়। হচ্ছেনা।” কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন ফিরোজ স্যর বুঝিনি। পেছন থেকে দুহাত দিয়ে আমার দুটো হাত ধরে সঠিকভাবে যন্ত্রগুলো ধরা দেখিয়ে দিতে এগিয়ে এলেন। উনি এতটাই ঝুঁকে আমাকে দেখিয়ে দিলেন যে, আমার ডান দিকের গালের সঙ্গে ওনার বাঁগাল ঠেকে গেলো। আমার পৃষ্ঠদেশের সঙ্গে ওনার অঙ্কদেশের স্পর্শে ছিলো শুধুমাত্র আমাদের বস্ত্রের ব্যবধান। আমার শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ খেলে গেল।


বাসের জানলার বাইরে তাকিয়ে অশ্রুছলছল চোখে বিড়বিড় করে উঠলাম। “সেবার পিকনিকে, আমরা ছাত্রেরা আপনাকে ঘিরে এক আড্ডার আখড়া বসিয়েছিলাম। মনে পড়ে স্যর? জীবক সেন আপনাকে এক বেয়াড়া প্রশ্ন করেছিলো। ও জানতে চেয়েছিলো আপনার প্রেমিকার কথা। আপনার প্রতিক্রিয়া ছিলো বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। বেশ মনে পড়ে, আপনি রেগে যাননি, বিরক্ত প্রকাশ করেননি, প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাননি অথচ প্রশ্নের সামনে নত হননি। মিস্টি ভাষায় দিয়েছিলেন মোক্ষম জবাব। আপনি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, “তুই কোন প্রেমিকার কথা বলছিস?- “কেনো স্যর আপনার কজন প্রেমিকা?

“কেনো? তোর চোখে পড়েনি আজ অব্দি? কলেজে আসিস তো? নাকি অন্য জগতে থাকিস?
চটপটে চাঁছাছোলা এই জবাবে জীবক হতবম্ভ হয়ে যায়। পাল্টে যায় আড্ডার প্রসঙ্গ।


দীপ্ত, চনমনে, ব্যস্ত মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছি কেমন শান্ত হয়ে শুয়ে আছেন। চোটের আঘাতে মুখে কালসিটে পড়েছে। হাইন্ড ব্রেনে আঘাত গুরুতর। পাঁজরের নীচে জখম হয়েছে। প্রচণ্ড রক্তপাত হয়েছে। গঙ্গারামপুরে কেন এসেছিলেন জানা নেই। পরে জেনেছিলাম স্যারের পিসির বাড়ী গঙ্গারামপুরে। পিসতুতো দাদার সাথে সিরাজিদার বোনের বিয়ে হয়েছে। পিসির বাড়ী আসার বাহানাতে স্যর সঞ্চয়নের সঙ্গেই দেখা করতে এসেছিলেন। স্যর সঞ্চয়নের কাছে প্রায়ই এসে থাকতেন। সময় কাটিয়ে যেতেন। মিস্টি স্বভাবের মিশুকে সঞ্চয়ন স্যরের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলো। বুঝতে পেরেছিলাম স্যারের সঙ্গে সঞ্চয়নের সম্পর্ক গভীরে ঠেকেছিলো।


গুটি গুটি পায়ে আইসিইউ থেকে বেরিয়ে এলাম। সঙ্গে সঞ্চয়ন। বুকে দম বন্ধকরা বেদনা। বাইরে এসে দেখি উজান, সুকৃত, প্রসূন আর ফয়জান জনৈক মাঝবয়সী ভদ্রলোককে ঘিরে দাঁড়িয়ে। রক্ত লাগবে। সেই নিয়ে আলোচনা চলছে। সঞ্চয়ন ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। স্যরের দূর সম্পর্কের দাদা। নাম ডঃ কবীর সাহাবুল সিরাজী। ইনিই সেই দাদা, যাঁর কথা স্যরের কাছে শুনেছিলাম। এই দাদাই ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা।

উজান আমাকে বলল, ” রক্ত লাগবে। সঞ্চয়নের সাথে রক্ত মিলে গেছে। তোর গ্রুপটাও টেস্ট করতে দিয়েদে। আমরা রক্তদিয়ে আমাদের স্যরকে বাঁচাবো।” উজানের এই কথাটা আবেগে কেঁপে উঠলো। “দুঘন্টার মধ্যে আরো কজন জুনিয়র ভাইয়েরা এসে পৌঁছচ্ছে। কলেজের বর্তমান ছাত্ররাও আজ এসে রক্ত দেবে বলেছে। রাতে থাকতে হবে। থাকবি তো?” আমি মাথা নাড়িয়ে বল্লাম, “নিশ্চয়ই”। আমরা পালা করে হসপিটালে থাকব তা ঠিক করে ফেললাম। সঞ্চয়ন নাওয়া খাওয়া ছেড়ে হসপিটালেই পড়ে রইল। ছায়ার মত আমি সাথী হলাম।


আমি রক্তপরীক্ষা করালাম। আমার রক্ত মিললোনা। সঞ্চয়ন রক্ত দিলো। বড় হিংসে হচ্ছিলো সঞ্চয়নের ওপর। চোখ মুছে মনে মনে বললাম, “রক্তটা তুইই দিলি! শেষ বাজিমাৎ তুই করার সুযোগ পেলি আর আমি এক কোণে পড়ে রইলাম?
পরেরদিন সিরাজিদা রক্ত দিলেন। আরও একজন কারেন্ট স্টুডেন্টের সঙ্গে রক্তের মিল হলেও দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। আমরা রাতে হসপিটালের লাউঞ্জেই থাকছিলাম। সেই রাতটা বেশ স্বস্তিতেই ছিলাম। রক্ত দেওয়ার পর ডাক্তারও আশার আলো দেখিয়েছিলেন। বড় আশাতে ছিলাম। সারারাত লাউঞ্জে জেগে আমি আর সঞ্চয়ন। ভোর সাড়েপাঁচটায় চোখ লেগে গিয়েছিলো। মাইকের এনাউন্সও কানে পৌঁছোয়নি। তন্দ্রাভঙ্গ হল সঞ্চয়নের হাতের ছোঁয়াতে। বুকটা যেন ছ্যাঁৎ করে উঠল। আমি ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। আমার কাঁধে হাতটা রেখে সঞ্চয়ন ধীরে আমার বাঁ পাশে বসল। জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, ” কি অভিমান? কীসের এত অভিমান? রক্ত তো দিলাম।” ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলো সঞ্চয়ন। “কেনো প্রাণ দান করা যায়না? তাহলে প্রাণও দিতাম। আমার রক্তে প্রাণ ছিলোনা অনুপ। স্যারের প্রাণ তো তোর রক্তে ছিলো। তোর রক্ত মিলে গেলে স্যরকে নিশ্চয়ই বাঁচানো যেতো।” হাউ হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে সঞ্চয়ন।

আমি ধরা গলাতে শুধুই বললাম, ” জানিনা বাঁচতেন কিনা! তবে রক্তটাতো তুইই দিলি। তোর দেহের রস তাঁর শরীরে মিশলো।” এরপর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারলামনা। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলাম, আর বলতে থাকলাম, “আমার বড় হিংসে হয়েছিলো সঞ্চয়ন। তোর ওপর। যখন তুই রক্ত দিচ্ছিলি। আমাকে মাফ করিস সঞ্চয়ন। তুই।” কান্নাতে আমার কথা কেটে কেটে যাচ্ছিলো। “স্যর তোরই ছিলেন। স্যরকে তুইই জড়িয়ে ধরতে পেরেছিলি। আমি পারিনি।”


কলেজের কচি যুবক ছাত্র কাউকে বুঝতে দেয়নি যে সে মাস্টারমশাইকে ভালোবাসতো। ছাত্রের কাঁচা মন এটাও বুঝতে পারেনি যে তাকেও মাস্টারমশাই ভালোবাসতেন। আজ সেই ভালোবাসা প্রকাশ্যে এসে গেছে। সেই মাস্টার মশাইয়ের অবচেতন মানসের প্রলাপের মাধ্যমে। বড্ড দেরী হয়ে গেছে ততক্ষণে।

ছবিঃ ভুটান


<< কালিজা ২০২১ (৪র্থ বর্ষ) – সূচিপত্র


Exit mobile version