কাঁচালঙ্কা

নীড়ভাঙা

“বাহিরে কিছু দেখিতে নাহি পাই,
তোমার পথ কোথায় ভাবি তাই।
সুদূর কোন্‌ নদীর পারে, গহন কোন্‌ বনের ধারে
গভীর কোন্‌ অন্ধকারে হতেছ তুমি পার॥”

খিচুড়ি-ইলিশ খেয়ে চাতক দুপুরে বৃষ্টি দেখতে দেখতে ঘুমিয়েই পড়েছিলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে সবে। বাইরের ঝোলা বারান্দা থেকে মল্লার ভেসে আসছে। খুবই বিলম্বিত। হয়তো বা তালকাটা, তালছাড়া; হয়তো বা নয়। ময়না এসেছে। ময়না আবার এসেছে।মাঝে মাঝেই উড়ে আসে। ওই ঝোলা বারান্দায় বসে। নিজের মনে আসে, নিজের মনে যায়, নিজের মনে গান গায়। গান গাইতেই কি আসে? না কি, চাতককে ……? কে জানে? চাতক যায়না ময়নার বাসায়। তৃষ্ণাই ভালো লাগে তার বড্ড। অথবা হয়তো তার পৌরুষের দম্ভ তাকে আটকায়। বাবা-মা-র ছবিটার সামনে কিছু জুঁইফুল। বৃষ্টিমাখা সোঁদা গন্ধ আর ফুলের তীব্রতা মিলেমিশে একাকার।

এভাবে কোনদিনও তারা দুজনে মিলতেই পারলোনা কেন? ভালোবাসা ছিলো কি? হ্যাঁ, তা ছিলো। কিন্তু রাতের বিছানায় সেই ভালোবাসা শরির জাগাতে পারেনি কখনো। বিয়ে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগুনবাসার দরকার হয়। সন্তান জন্মায় তার হল্কাতে। ঠান্ডাবাসায় নিশ্চয়তা থাকে সহাবস্থানের। কিন্তু বিয়ে কি শুধুই সহাবস্থান? হয়তো কারো কারো কাছে। চাতকের ঘ্রাণ, আর ময়নার তান খুঁজেছিলো সহাবস্থানের মোড়কে শরীরজাগানো উন্মত্ততার শিহরণ আর সীলমোহর। তাই তাদের যদিদং তদস্তু ইত্যাদি টেকেনি।

– চা?

– চা? নাহ।

ব্যাস, কথা শেষ। ‘কেমন আছিস?’ প্রশ্নের সত্যি উত্তর আজ দুজনের কাছেই আধচেনা, সারা জীবন জুড়ে এমনটাই ছিলো। তাই এসব ভান্ডামির কোন প্রয়োজন নেই।আর ময়না তো বেশী কথা বলতেও আসেনা।কেন আসে? কেন এসেছিলো ময়না তার জীবনে? না আসলে কি হতো? বড়ো ভালোবেসে ফেলেছিল মেয়েটা তাকে। তাই হয়তো আর সেই ভালোবাসার টান ছিঁড়তে পারেনি চাতক।ভেবেছিলো যেমন চলছে চলুক না! আগুণ হয়তো নিজেই জ্বলবে। ভেবেছিলো শরীর বুঝি চকমকি পাথর, ঘষা লাগলেই ফুলকি ছোটে, হাওয়ার উষ্ণতা বাড়ে, মেঘ জমতে জমতে, ফেটে বৃষ্টির মতো ধারা নেবে আসে, মিশে যায় অতলে। নাহ! ফুলকি ছোটেনি কখনো। ময়না কি এখন আর কারো সাথে শরীর ঘষে? চাতক জানেনা। বিয়ে? চাতক জিজ্ঞাসা করেনি।

চাতক আটকায়না কাউকে। ঈগলকেও আটকায়নি। ঈগল, তার মন ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছিলো যেই ঈগল। ঈগল বলেছিল ময়নার সাথে বিয়ে করলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে। বলেছিলো ঈগল আর চাতকের শরীর ঘষা খেলে যেমন দাবানল ছড়ায়, যেমন কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে ঝড়, যেমন বিদ্যুতের ঝিলিকের সাথে বৃষ্টির ফিনিক শুষ্কতার উপরে মাখিয়ে যায় সান্দ্রতা, ময়নার সাথেও তেমনটাই হবে। আগুণ ছড়ায়নি শরীরে। ছড়ালো সেদিন, যেদিন চাতক ময়নাকে খুলে বললো সবটা। জ্বলেছিলো; দুটো চোখ। সেই দাউদাউ জ্বালিয়েছিলো অনেককিছু। কিছু কিছু ছাই হয়তো এখনো ……

– আমি আসি?

– হ্যাঁ। আয়।

– আগেই আসতাম। বৃষ্টিটার জন্য …

– দেরী করে ভালোই করেছিস। আগে যদি আসতিস তাহলে হয়তো ঘুমটাই হতোনা।

– তবু, তুই তো সন্ধ্যেবেলায় যাস হয়তো এদিক সেদিক।যাস কি?

– নাহ! আজ আর যাবনা। বাসাতেই থাকতে হবে।

দরজা অবধি একসাথে হাটা। এটুকু রাস্তাই এখন নদীর পাড়।এটুকুই বুলেভার্ড। দরজা খোলার যে ক্যাঁচ করে প্রতিবাদ, পরিচালকের কাট। ওহ! কাঠময়ূরী চলে এসেছে। পৌরুষ নারীত্বের সংজ্ঞার প্রতিকূলে তার ধূসর পেলবতা। ময়না তার দিকে চোখ বুলিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।

চাতক জানতো পরদিন সকালেই তিতির ফোন করবে। চাতক আর ময়নার বন্ধু তিতির।

– হ্যাঁ রে, তোরা কি একে অন্যকে কখনো ভালো রাখবিনা?

– কেন রে? কি হলো?

– ওই কাঠময়ূরী কে?

– এই উত্তরটা জানা কি তোর খুবই জরুরি?

– হ্যাঁ।

– যদি না বলি?

– মর শালা দুজনে।

খট করে ফোনটা কেটে দেয় তিতির। চাতকের মুখে করুন হাসি যেন চলকে উঠেই মিলিয়ে যায় ফের।

মনে পড়ে একটা কবিতা। ময়না খুব বলতো…

বলো কী বলব, আদালত, কিছু বলবে কি এরপরও?
— ‘যাও, আজীবন অশান্তি ভোগ করো!’

ছবিঃ ভুটান


<< কালিজা ২০২১ (৪র্থ বর্ষ) – সূচিপত্র


Exit mobile version