রাগিবের বয়স ১৩। থাকে যশোর শহরে। পড়াশুনা করছে বি.এ.এফ.শাহীন কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে। এই বছর জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা দেবে। রাগিবের কোন ভাই-বোন নেই। ওর বাবা বিমান বাহিনীতে চাকুরী করেন। ওর বাবার অনেক ইচ্ছা ছিল একটা কন্যা সন্তানের। ওর মায়ের ইচ্ছা ছিল একটা পুত্র সন্তানের। রাগিব পুত্র সন্তান হিসেবে জন্মেছে বলে তার মায়ের কাছে খুব কদর। রাগিবের মা গৃহবধূ। রাগিবের জন্মের পরে তার জরায়ুতে একটা প্রকান্ড টিউমার হয়। ডাক্তার অপারেশন করে জরায়ু কেটে বাদ দিয়ে দেন। ফলে আর কোন সন্তান জন্ম দিতে পারেনি রাগিবের মা। তাই রাগিবের বাবার খুব আক্ষেপ। রাগিব আর দশটা ছেলেদের মত না। সে খেলাধূলা পছন্দ করে না। সে নাচ করতে ভালোবাসে। মেয়েলি যত প্রকার কাজকর্ম আছে, সেগুলো করতে সে ভালোবাসে। তার ইদানিং গলার স্বর পরিবর্তন হচ্ছে। বয়োঃসন্ধিতে থাকাকালীন সময়ে প্রতিটি মানুষের যেমন পরিবর্তন হয়, রাগিবেরও তেমনটা হচ্ছে। কিন্তু তার সাথে সাথে তার মেয়েলি আচরণও ফুটে উঠছে। রাগিবের মা তার ছেলেকে নিয়ে চিন্তিত। রাগিবের বাবা মেয়েলি আচরণ পছন্দ করেন না। রাগিবের হাঁটাচলায় মেয়েলি ভাব স্পষ্ট। বিমান বাহিনীর কিছু নিচু পদের কর্মচারী রাগিবকে হাসাহাসি করে। ক্লাসের কিছু ছেলে ওকে “হাফলেডিস” বলে ক্ষ্যাপায়, বুলি করে। মাঝে মাঝে প্যান্টের পিছনে চিবানো চুইংগামের আঠা লাগিয়ে দেয়, কিংবা শার্টের পিছনে কলম দিয়ে দাগিয়ে দেয়। টিচারদের কাছে নালিশ দিয়েও কোন লাভ হয় না। রাগিব মেয়েদের সাথে মিশতে পছন্দ করে। মেয়েরা ওকে বন্ধু বানাতে কোন আপত্তি করে না। টিফিন পিরিয়ডে আমড়া মাখা, চাটনি, আচার এগুলো ভাগাভাগি করে খায় মেয়ে বন্ধুদের সাথে। স্নিগ্ধা, স্বর্ণা, রিয়া এরা রাগিবের ভালো বন্ধু। মেয়েদের সাথে মেলামেশা করে বলে অন্য ছেলেরা ওকে নিয়ে ঈর্ষা করে। রাগিবের হাতের আঙ্গুলে স্নিগ্ধা নেইলপলিশ লাগিয়ে দেয়।
রাগিব নেইলপলিশ ভালোবাসে। কিন্তু কেউ ওকে নেইলপলিশ কিনে দেয়নি আগে। লিপস্টিকও ভালোবাসে সে। ওর মা যখন ঘরে থাকে না, তখন চুরি করে লিপস্টিক মাখে ঠোঁটে। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখে নিজেকে। মা বাড়িতে ফেরার আগেই মুছে ফেলে টিস্যুপেপার দিয়ে। রাগিবরা যশোর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় থাকে। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় অনেক সুঠাম দেহের সৈনিকদের দেখতে পাওয়া যায়। রাগিব এদেরকে পছন্দ করে। কেন পছন্দ করে তা সে জানে না। তবে একটা আকর্ষণ তার মনে কাজ করে। ইন্টারনেট থেকে ভারতীয় নায়ক জন এ্যাব্রাহামের ছবি ডাউনলোড করে প্রিন্ট করে নিয়ে যায় স্কুলে, তার বান্ধবীদেরকে দেখাবে বলে। বান্ধবীরা জন এ্যাব্রাহামকে পছন্দ করে। রাগীবের চলন-বলন মেয়েলী কিন্তু সে মেয়েদের সাথে ভালো বন্ধুত্ব করতে পারে। সে মন খুলে তাদের সাথে গল্প করতে পারে। ক্লাসে সে মনোযোগী এবং ভালো ফলাফল করে বিধায় শিক্ষকরা তাকে বকুনি দেয় না। কিন্তু ওর মেয়েলী ভাব নিয়ে গল্পগুজব করে। রাগীবের বাবা মা ওর এই মেয়েলী ভাব, মেয়েলী চলন-বলনের ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করে। রাগীবের দাদী বলেন যে সৃষ্টিকর্তা হয়তো তাকে মেয়ে বানাতে বানাতে ছেলে বানিয়ে ফেলেছে। রাগীবের দাদী রাগীবকে অনেক আদর করে। পিঠা বানিয়ে খাওয়ায়। রাগীব পিঠা বানাতে তার মা ও দাদীকে সাহায্য করে। পাড়ার বখাটে ধরনের ছেলেগুলো রাস্তায় তাকে দেখলে ‘হাফলেডিস’ বলে উত্যক্ত করে। রাগীব কান্না করতে করতে বাড়ীতে আসে। কাউকে কিছু বলে না।
রাগীব যখন আরো ছোট ছিল, তখন তার এক কাজিন যে কিনা তার চেয়ে বয়সে কমপক্ষে পনেরো বছরের বড়, রাগীবদের বাসায় বেড়াতে আসে। সে রাগীবকে যৌনভাবে হেনস্তা করে রাগীবের মেয়েলী চলন-বলন দেখে। রাগীবের কাছে সে সব স্মৃতি বিভীষিকাময়।
মাঝে একদিন সে দোকানে যাচ্ছিলো কিছু একটা কিনে আনতে। একদল হিজড়া তাকে দেখে তালি দিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো; “অ্যায়, কোতি! এ্যায় মাইগ্গ্যা! কই যাস? আমাদের সঙ্গে যাবি? চল, আমাদের সাথে চল। তোকে ছিবড়িয়ে দেবো, আয়…………এত দেমাগ কেন লা?”
রাগীব তাদেরকে দেখে এবং তাদের অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি দেখে ভয় পেয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে চলে আসলো বাসায়। ওর মা এবং দাদী জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। সে ঘটনাটা খুলে বললে পর, তার মা ও দাদী তাকে বাইরে যেতে নিষেধ করলো।
সেদিনের পর থেকে বাসার সবাই ওকে চোখে চোখে রাখে যাতে হিজড়ারা ওকে চুরি করে নিয়ে যেতে না পারে।
আট বছর পরে
রাগীব ঢাকা শহরে থাকে ওর খালামনির বাসায়। রাগীব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে অনার্সে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে। রাগীব আবাসিক হলে সিট পেয়েছিলো। কিন্তু সেখানে তাকে রাজনৈতিক নেতা বড় ভাইয়েরা মিলে ধর্ষণ করে। সে এই বিষয়ে কাউকে কিছু বলতে পারে না। কারণ, সমাজের মানুষের বিশ্বাস শুধুমাত্র নারীরাই ধর্ষণের শিকার হতে পারে। পুরুষ দেহের অধিকারী কেউ ধর্ষণের শিকার হয় না। তাছাড়া ঐ নেতা ওকে পিস্তল দেখিয়ে হুমকি দেয় যে সে যদি কাউকে কিছু বলে তাহলে তাকে মেরে লাশ বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হবে। তাই রাগীব বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ছেড়ে মিরপুরে তার খালামনির বাসায় থাকে। কিন্তু সেখানেও সে নিরাপদ নয়। মেয়েলী চলন-বলনের কারণে তার খালাতো ভাই প্রায় প্রতিদিনই তাকে ধর্ষণ করে চলে। রাগীব কাউকে কিছু বলতে পারে না। কারণ, প্রথমতঃ তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না, দ্বিতীয়তঃ সে এই বিষয়ে কিছু বললে তাকেই দোষী করা হবে ও বাসা থেকে বের করে দেওয়া হবে। বাসা থেকে যদি বের করে দেওয়া হয়, তাহলে তখন সে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাকে তো কেউ আশ্রয় দেবে না এই এত বড় শহরে। ঢাকা একটা মেগা সিটি। প্রায় দুই কোটি লোক এখানে বাস করে। খুব নিষ্ঠুর এই শহর। এখানে দিনের বেলায় মানুষ মরে পড়ে থাকলেও কেউ ফিরেও দেখে না।
গত এক মাস হলো, রাগীব একটা ছেলেকে ভালোবেসে ফেলেছে। ছেলেটির নাম রোমেল। রোমেল ধনীর ছেলে, গুলশানে থাকে। প্রায় প্রতিদিন টিউশন পড়ানোর নামে রাগীব গুলশানে চলে যায় রোমেলের সাথে দেখা করতে। রোমেলের দিক থেকে এটা একটা ক্যাজুয়াল ডেটিং বৈ কিছু নয়। রোমেল নিজেকে “টপ” দাবী করে এবং যথেষ্ট পুরুষালীও বটে। তথাপি সে রাগীবের মত মেয়েলি “বটম” সমকামী ছেলেকেই পছন্দ করে। কিন্তু সমস্যাটা অন্য যায়গায়। রোমেলকে তার বাবা-মা আমেরিকায় পাঠিয়ে দেবে পি.এইচ.ডি. করানোর জন্য। রোমেলের দিক থেকে এই সম্পর্কটা তাই বন্ধুত্ব ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু রাগীব মনে মনে মনকলা খেয়ে ফেলেছে। পানিতে পড়ে গেলে মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চেষ্টা করে, তেমনি রাগীবও রোমেলকে আকড়ে ধরে বাঁচার স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন সত্যি হবে কি? স্বপ্নেরা সত্যি হয় না।
কিছু কিছু মানুষ সুখী হয় না, প্রবঞ্চিত হয়। রাগীবের অবস্থাও তেমন। অভাগা যেদিকে চায়, সাগরও শুকিয়ে যায়। ‘সাগর’ বলতেই মনে পড়ে গেল রাগীবের বন্ধু সাগরের কথা। সাগর ছেলেটা হেটারোসেক্সুয়াল (বিষমকামী) কিন্তু সে রাগীবের ক্লাসমেট ও খুব ভালো বন্ধু। রাগীবের মত সে সমকামী না হলেও মানুষের প্রতি তার সমানুভূতির ঘাটতি নেই। সে রাগীবের ব্যাপার স্যাপার সব জানে। রাগীবকে সে সাহস যোগায় এবং সব রকমভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করে।
ছেলেটা গরীব কৃষকের ছেলে ঢাকা শহরে তার কেউ নেই। বেচারা একটা মেয়েকে পছন্দ করে, কিন্তু মেয়েটা তাকে পাত্তাই দেয় না। রাগীব ভালোবাসার কাঙ্গাল কিন্তু সে ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। সাগরের সাথে ঠিক এই যায়গাতেই রাগীবের মিল। দোনোজনই প্রান্তিক এক অর্থে।
কার্ল মার্ক্সের দর্শণের আলোকে বললে বলতে হয় “প্রলেতারিয়েত”।
সে যা হোক, গ্রাম এবং ছোট মফস্বল শহরগুলোর লোকেরা মেগা সিটি ঢাকায় আসে ভাগ্য বদলানোর জন্য। ঢাকার লোকেরা এই শ্রেণির লোকদেরকে নিয়ে ঠাট্টা করে, “ক্ষেত্তুশ” বা “গাইয়া” উপাধি দেয়, হাসাহাসি করে।
অনেক দিন পর, রাগীব এক জন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে পরিচিত হয়। ভদ্রলোক একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ধানমন্ডিতে একটা এ্যাপার্টমেন্টে থাকে, বাইসেক্সুয়াল। তার বাবা-মা, পরিবার সবাই কানাডাতে সেটেল্ড। আগে একটা মেয়েকে বিয়ে করেছিলো, পরে ডিভোর্স হয়ে যায়।এখন একা, ডিভোর্সি, সিঙ্গেল। রাগীবের সাথে তার গ্রাইন্ডারে পরিচয়। ধীরে ধীরে সম্পর্কটা প্রেম এবং শেষে লংটার্ম রিলেশনে পরিণত হয়।
রাগীব তার বাবা-মাকে সব খুলে বলতে চায়। কিন্তু পারে না। তাই চিঠি লিখে জানায়। ফিরতি চিঠিতে উত্তর আসে।
“স্নেহের রাগীব, ভালোবাসা নিও, তোমার চিঠি পেলাম। সবকিছু পড়লাম এবং বুঝলাম। তুমি আমাদের একমাত্র পুত্র সন্তান। আমি সব সময় একটা পুত্রের মত ‘পুত্র’ আশা করেছিলাম, কিন্তু আল্লাহ আমার কথা শোনেননি। তোমার বাবা একটা কন্যা সন্তান আশা করেছিলেন, আল্লাহ তাঁর কথাও শোনেননি। আমরা কখনও ‘সমকামী’ সন্তান আশা করিনি। কিন্তু তুমি আমাদেরকে সম্পূর্ণ নিরাশ করেছো। কেন? তোমাকে আমরা ঘৃণা করি না, কারণ তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান। তুমি জানো ইসলাম ধর্মে সমকামিতা একটি কবীরা গুনাহ (মহা পাপ)। তুমি সেই পাপ কাজটিই করলে। মৃত্যুর পর তোমার এই পাপ কাজের জন্য আমাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে।
তুমি সুখী হয় এটা আমরা চায়, কিন্তু তোমাকে আমরা পাপকাজের জন্য উৎসাহিত করতে পারি না। তুমি যশোরে থাকলে তোমাকে মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম। যা হোক, তুমি যদি তোমার পাপময় জীবন পরিত্যাগ করতে পারো, তাহলে আমাদের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা আছে জেনে নিও। আমি তোমার মা, আর মা কখনও তার সন্তানকে ঘৃণা করতে পারে না। কিন্তু যেহেতু আমি তোমার বাবার অধিনস্ত, তাই তোমার পাপময় জীবনকে নিয়ে উল্লসিত হতে পারছি না। নিজেকে পরিবর্তন করে আবার আমাদের কাছে ফিরে এসো। ইতি, তোমার মা”
চিঠি পেয়ে রাগীবের মাথায় যেন বাজ পড়লো। সে কখনও ভাবেনি যে এরকম প্রতিক্রিয়া সে তার বাবা মায়ের নিকট থেকে পাবে।
পৃথিবীতে সবকিছু থাকা সত্বেও রাগীবের মত মানুষেরা নিঃস্ব, দুঃস্থ্য! সমাজ কি পারে না তাঁদেরকে একটু সমানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে?
ভালোবাসা কি অপরাধ? ভালোবাসা কি পাপ??
পবিত্র বাইবেল বলেঃ “কারণ ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার এক জাত পুত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়। কেননা ঈশ্বর জগতের বিচার করিতে পুত্রকে জগতে প্রেরণ করেন নাই, কিন্তু জগৎ যেন তাঁহার দ্বারা পরিত্রাণ পায়।” – যোহন 3:16-17
ছবিঃ ভুটান
<< কালিজা ২০২১ (৪র্থ বর্ষ) – সূচিপত্র