কাঁচালঙ্কা

ওরা এবং যদু

।। যদুর কথা ।।

দুপুেরর এই সময়টায় কিছুটা ফুরসৎ পায় যদু। তখন কেলেজে ক্যান্টিনের পাশে বটগাছের তলায় বসে ও বিড়িতে সুখটান দেয় আর কান খাড়া করে হাঁড়ির খবর শোনে। এই ভাবে অনেক গোপন খবর ওর জানা হয়ে গেছে। এই কলেজে কার সাথে কার ইন্টুপিন্টু চলছে, কে ক্রমশ নেশায় জড়িয়ে যাচ্ছে, সব। আসলে এই জায়গাটা বেশ নিরিবিলি, তাই সবাই গোপনে কথা বলতে এইখানে আসে। সবাই ভাবে যদু আপনভোলা, ওইসব কথায় ওর মন থাকেনা। ও মনে মনে হাঁসে। তবে খবর পাঁচকান করা ওর স্বভাব নয়। খবরগুলো তাই ওর কাছেই থেকে যায়।

আজও চোখ বুজে বিড়ি টানছিলো ও। গরমের দুপুরে মৃদু হাওয়ায় চোখটা বুজে এসেছিলো। হঠাত কানে আসে ঠাস করে চড় মারার আওয়াজ। শব্দটা শুনে ওর চটকা ভেঙ্গে গেলো। কানটা একটু খাড়া করতেই শুনতে পেলো রাগি গরগরে গলায় ছেলে কণ্ঠের শাসানি – “শালা, আমার সাথে ক্যাওরাবাজি করিস তুই? আমাকে ইগনোর, না?…”। আর এর সাথে এক নারী কণ্ঠের মৃদু আহ শব্দ। ও একটু উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করে ঘটনাটা। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছে, সেই দৃপ্ত আর বৈশালী।

ও মনে মনে দৃপ্তকে কাঁচা খিস্তি দিয়ে আরেকটা বিড়ি ধরায়।

।। বৈশালীর কথা ।।

ওড়না দিয়ে মুখটা জড়িয়ে কোনরকমে কলেজের মেইনরোডে এসে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো বৈশালী। আয়নায় ও দেখেছিলো বাঁ-গালে পাঁচ আঙ্গুলের দাগটা বড়ো বেশী স্পষ্ট হয়ে আছে। তবে এই সব মাড়ের যন্ত্রণা ওর আর লাগেনা। অনুভূতিগুলো মনে হয় ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। শুধু চোখটা কড়কড় করে আর ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে। দৃপ্তর সাথে এই একবছরের সম্পর্কে ও অনেককিছু পেয়েছে। জন্মদিনে বা ভ্যালেন্টাইন ডে-তে ভালো গিফট থেকে শুরু করে লং-ড্রাইভে ঘুরতে যাওয়া, ফাইভস্টার হোটেলে ক্যান্ডললাইট ডিনার – সব কিছু। ওর বন্ধুরা ওকে বলে দৃপ্তর মতো বয়ফ্রেন্ড পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কলেজের সব মেয়ে ওর নামে পাগল। আর সেই দৃপ্ত ভালোবাসে শুধু বৈশালীকে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ও। মনে মনে ভাবে, সত্যিই কি ও ভাগ্যবান? পরম যে দিন দৃপ্ত ওকে চড় মেরেছিল, ওর মাথা ঘুরে গেছিলো। ও হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। পড়ে অবশ্য ও ওকে ক্যান্ডললাইট ডিনারে নিয়ে গেছিলো আর ফিসফিস করে মনে হয় ক্ষমাও চেয়েছিলো। বৈশালী সেদিন সব ভুলে দৃপ্তকে ক্ষমা করে দিয়েছিলো।

আজও ও মারগুলোকে অদেখা করতে চায়। সত্যিই হয়তো দৃপ্ত ওকে ভালোবাসে। মা যেমন ওকে বলে – পুরুষমানুষের রাগ না থাকলে হয়! মাও তো শরীরে লেগে থাকা মারের দাগগুলো ওর থেকে লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টা করতো। তবে এর সাথে সাথে আরও এক অদ্ভুত অনুভূতি ওর মনে ক্রমশ পরিবর্তন আনছে। দ্যুতি ওর খুব ভালো বন্ধু। ওর দুঃখ, আনন্দ – সব কিছু, কি করে যেন ও বুঝতে পারে। বৈশালী দ্যুতিকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু আজকাল ওর কাছে এই ভালোবাসা ক্রমশ যেন বন্ধুত্বের থেকেও বেশি কিছু হয়ে যাচ্ছে। ও ভয় পায়। এমন চাওয়া যে নিষিদ্ধ! সমাজের চোখে এ মানুষিক অসুখ, অথবা গা-ঘিনঘিনে যৌন চাহিদা। তাই মা-বাবার সম্মান, সমাজ – সব কিছুর কথা ভেবে ও এই অনুভূতিটাকেই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে।

।। দৃপ্তর কথা ।।

ক্যান্টিনের পিছন-বেঞ্চে বসে দৃপ্ত ভুরূ কুঁচকে চিন্তা করে চলেছে। ওর সামনে রাখা গরম চায়ের কাপটা প্রায় ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে, আর হাতের সিগারেটটা একমনে পুড়ে চলেছে। মাথার ভিতরটা রাগে দপদপ করছে ওর। বৈশালী ওকে ইগোনোর করছে? দৃপ্ত ব্যানার্জিকে ইগনোর করে, এমন মেয়ে থাকতে পারে? – এ অসম্ভব! আর এটা মেনে নেওয়া যায়না। ধনী বাবার একমাত্র সন্তান, ও তার উপরে নজরকাড়া চেহারা – এ’ দুইকে হাতিয়ার করে ও প্রচুর মেয়ে চড়িয়েছে। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে ও মেয়েদের ছিপে গেঁথেছে। এই মেয়েধরা খেলায় ও একধরনের আত্মতৃপ্তি পায়। আর বন্ধুরাও অকে সমীহ করে চলে। এ বারেও বাজি ধরে বৈশালীকে গেঁথেছে। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরেছে আর কিছু দিনের মধ্যে ও ওকে হোটেলে নিয়ে যাবে। সও ঠিকই চলছিলো। কিন্তু হঠাত করে ওর মনে হচ্ছে সুরটা কেমন যেন কেটে কেটে যাচ্ছে। বৈশালীর নতুন প্রেমিকটা যে কে তা ঠিক ধড়তে পারছে না ও। দ্যুতি ওর সাথেই থাকে। ও অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে দ্যুতিকে বৈশালীর নতুন প্রেমিকের নাম কিন্তু ও এড়িয়ে গেছে, না হয় না শোনার ভান করেছে।

ওর বন্ধুরাও আজকাল বলতে শুরু করেছে এইবার ও বাজি হারছে। কিন্তু বাজিটা ওকে জিততেই হবে, এর সাথে ওর সম্মান জড়িয়ে আছে। তাছাড়া দৃপ্তর মনে হচ্ছে বৈশালী আর ওর খেলার পুতুল নয়। রূপের সাথে সাথে বৈশালীর এক অন্যয় ধরনের তেজ আছে, যা দৃপ্তকে আকর্ষণ করে। ওর মনে হয়সত্যি সত্যিই ও হয়তো বৈশালীকে প্রপোজ করবে, ওকে হোটেলে নিয়ে যাবে। তারপর বন্ধুদেরকে বলবে বৈশালীকে দয়া করে ওর সাথে ও সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে।

।। দ্যুতির কথা ।।

কেমিস্ট্রি ল্যাবে কিছুতেই মন দিতে পারছিলনা দ্যুতি। ল্যাব শুরু হতেই ও বুঝে গেছিলো বৈশালী ক্লাস অফ করেছে।

দ্যুতি পড়াশোনায় বরাবরই তুখোড়। সবাই বলে দ্যুতি এই কলেজের গর্ব, ও এই বারেও দুর্দান্ত রেজাল্ট করবে। ও নিজে অবোধ্য এই সব কথা কানে নেয় না। ও শুধু এই দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে সেটেল্ড হতে চায়। আসলে ও পালাতে চায় এই চেনা সমাজ, চেনা মানুষদের থেকে। ভয় পায় একদিন সবাই ওর পরিচয় জেনে যাবে। ও জানে মা-বাবার সম্মান বাঁচাতে ওকে এই দেশ ছাড়তেই হবে।

দ্যুতি ওর পনেরো বছর বয়সেই জেনে গেছিলো আর পাঁচটা মেয়ের মতো ও ছেলেদের প্রতি আকৃষ্ট হয় না। দ্যুতিকে মেয়েরা আকর্ষণ করে। ও সমপ্রেমী। এই সমাজ ওকে মেনে নেবেনা। মা-বাবাও ওকে রেখেছে আত্মীয়স্বজনের কাছে তাদের মান যেন বজায় থাকে। দ্যুতি তাই প্রতিদিন নিজের সাথে লড়াই করে। চাপা দিয়ে রাখে নিজের ভালোলাগাগুলোকে। স্কুলজীবনে ও প্রেমে পড়েছিলো সৃজার। সৃজা থিল ওর বেস্টী। ও ভেবেছিলো ও ওকে বুঝবে। তাই অনেকটা ভয় আর একটু আশা নিয়ে ও একদিন ওর মনের কথাটা ওকে বলেছিলো। কিন্তু সৃজা স্পষ্ট দ্যুতিকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো ও মানসিক রুগী। শুধু তাই নয়, দায়িত্ব নিয়ে ওর মা-বাবাকেও তা জানিয়ে এসেছিলো। এরপর সৃজা ওর জীবন থেকে দ্যুতিকে একরকম ছেঁটে ফেলে। ফেসবুক বলে সৃজার জীবনে দ্বিতীয় প্রেমপর্ব শুরু হয়েছে। তাই বন্ধুবান্ধব থাকা সত্ত্বেও ও আর কারুকে ওর মনের কাছে ঘেষতে দেয়না,মন খুলে.কথা বলতে ওর ভয় হয়। ওর গভীর একাকীত্বের একমাত্র সঙ্গী বই।

কিন্তু বৈশালীর প্রতি ও যে ক্রমশ আকৃষ্ট হচ্ছে! চোখ বুজলে আজকাল ও শুধু বৈশালীকে দেখে। ক্লাস বা ল্যাব চলাকালেও আড়চোখে ও বৈশালীকে দেখে। যদিও ও জানে দৃপ্ত-বৈশালী হ্যাপি কাপ্ল, ওদের প্রেমের সাক্ষী পুরো কলেজ। কিন্তু বৈশালীর চোখজোড়ায় ও কেন শুধু বিষাদ দেখতে পায়? আর হাসিটা, যেন জোর করে টেনে রাখে। দ্যুতি অকে অনেকবার প্রশ্ন করেছে কিন্তু কোনো উত্তর পায়নি। ও বৈশালীর নাম্বারে কোল করে। আজ ওকে সবটা জানতেই হবে।

।। যদুর দুপুর ।।

যদু আজ বিড়ি টানতে টানতে দুটো মেয়ের কথা শুনছে। মেয়েদুটোকে ও চেনে। অরা দ্যুতি আর বৈশালী। একজন এই কলেজের কৃতী ছাত্রী, অপরজন খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু ওদের কি এতো গোপন কথা থাকতে পারে? ওরা খুব ভালো বন্ধু সেটা ও জানে। কিন্তু ওদের কথাগুলো কেমন যেন বন্ধুত্বের নয়, প্রেমের সম্পর্কের মতো শোনায়। ধুর! মেয়েতে-মেয়েতে প্রেম? – তাও হয় নাকি? ও সন্দেহটা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বয়স হচ্ছে, ভুলভাল শুনছে আজকাল।

।। দ্যুতি আর বৈশালী ।।

কাল সন্ধ্যায় দ্যুতি ছুটে গেছিলো বৈশালীর কাছে। তার পরের মুহূর্তগুলো ঝড়ের গতিতে উড়ে যায়। এই প্রথম বৈশালী দুটির কাছে ভেঙ্গে পড়েছিলো। দৃপ্তের দেওয়া প্রতিটা যন্ত্রণা ও ওকে উজাড় করে বলেছিলো। শুনতে শুনতে ও রাগে জ্বলে উঠেছিলো। ওর চোখের জল ক্রমে দ্যুতিকে দুর্বল করে দিচ্ছিলো। আর সব বাঁধা পেড়িয়ে ও এই প্রথম বৈশালীকে গভীর আলিঙ্গনে বেধে নেয়, আর ওর থরথর করে কাঁপতে থাকা ঠোঁটে দ্যুতি নিবিড় প্রেমের চুম্বন এঁকে দিয়েছিলো। তারপর দুজনে ভেসে গেছিলো আবেগময় প্রেমে। সেই প্রেম মন পেড়িয়ে দুজনের দেহ স্পর্শ করেছিলো। দ্যুতি প্রেমের নিবিড় বন্ধনে বেঁধে নিয়েছিলো বৈশালীকে।

বৈশালীর মনে ভয়টা ক্রমশ চেপে বসছে। দ্যুতির প্রতি আকর্ষণবোধটা ও কখনোই প্রশ্রয় দিতে চায়নি। ও জানে এ সম্পর্কের কথা জানাজানি হয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তবে ও নিজের থেকে বেশি দ্যুতির চিন্তা করে। ও চায়না ওর জন্যে দ্যুতির কেরিয়ার নষ্ট হয়ে যাক। তাই ও ঠিক করেছে দৃপ্তকেই ওর ভাগ্য বলে মেনে নেবে।

আজ গাছতলায় দাঁড়িয়ে বৈশালী দ্যুতিকে তাই বলেছে, ওর প্রতি বৈশালীর কোনও আকর্ষণ নেই। গতকালের ঘটনাটা নিছক আবেগের মুহূর্তে ঘটেছে। তাছাড়া, দৃপ্ত যেমন ওকে ভালোবাসে, ও-ও তেমন দৃপ্তকে ভালোবাসে। ও জানে এই কথাগুলো দ্যুতির মনে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে। কিন্তু ও চায় দ্যুতি সত্যি সত্যিই দ্যুতিময়ী হয়ে উঠুক। তার জন্যেই ও ওর থেকে সরে যেতে চায়।

বৈশালী যখন ওকে বলেছিলো ওর মনে দ্যুতির জন্যে কোন অনুভূতি নেই, দ্যুতি তখন ওর চোখদুটোয় লেগে থাকা জলের ফোঁটা দেখেছিলো। ও জানে সমাজের বিপরীতে যাওয়াটা খুব কঠিন। এর জন্যে অনেকটা সাহস, আর একটা নির্ভরযোগ্য মানুষ থাকা প্রয়োজন। ও বৈশালীর সেই নির্ভরতা হতে চেয়েছিলো। কিন্তু ও আর কথা বাড়ায়নি। শুধু চলে আসার আগে ও বৈশালীকে বলেছিল ‘তুই সাহস করে এক পা এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধর, বাকি লড়াইটা একসাথে লড়ে নেবো।”

… এবং যদু ।।

চোখ বুজে বসে যদু চিন্তা করছে। আজ ওর অনেককিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। যেন অতীত, বর্তমান, সব মিশে যাচ্ছে। আজ ওর হারুকে বড়ো বেশী মনে পড়ছে। হারু ছিলো মেয়েলী গোছের, তাই বন্ধুরা ওকে মাগী বলে টিটকিরি কাটতো। আরো কতো কি বলতো ওরা; কিন্তু হারু ওদের সব কথা উড়িয়ে দিতো। শুধু খুব রেগে গেলে বলতো, “দেখবি, একদিন আমার বড় এসে নিয়ে যাবে আমাকে।”

তারপর একদিন সন্ধ্যায় ওরা হারুর দেহটা জলে ভাসতে দেখেছিলো। কিন্তু কেউ মাথাও ঘামায়নি সেদিন।

আজও ও এমনই এক ঘটনার সাক্ষী ছিলো। সমস্ত কলেজকে চমকে দিয়ে দ্যুতি-বৈশালী স্বীকার করেছে তাদের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক আছে। শুধু তাই নয়, যদু নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ধনী বাপের কুলাঙ্গার ছেলের আসল চেহারা ফাঁস করেছে। আর সবচেয়ে অবাক ঘটনা হলো সমস্ত কলেজ মেয়েদুটোর পাশে দাঁড়িয়েছে।

মনটা তাই আজ খুশি খুশি লাগছে যদুর, কিন্তু তবুও মনের ভিতর কাঁটার মতো একটা দুঃখ বিঁধে আছে। যদু একটা বিড়ি ধরিয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে বলে, “ভাই হারু, ক্ষমা করে দিস রে, বড়ো ভুল করে ফেলেছিলাম তোর সাথে।”

যদু একটা বড়ো শ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আবার কাজে লেগে যেতে হবে, সময় নেই।

— * — *** — * —

ছবিঃ ভুটান

Exit mobile version