সাপোর্টিভ পেরেন্ট

-সত্যি চলে যাবি আমাকে ছেড়ে? আরেকবার ভেবে দেখবি না?
-ভাবার কী আছে? ভাবার মতো কি ছিল কিছু কখনো?
-হ্যাঁ ছিল, আজও আছে। তোর জেদটা একটু সরিয়ে দ্যাখ কিছুক্ষণ।
-সব কিছু খারাপ তো শুধু আমার মধ্যেই, তোর তো সব ভালো।
সুমন মুখটা ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। রনিত গিয়ে জড়িয়ে ধরল ওকে পেছন থেকে। প্রত্যেকবার ঝগড়া হলে এটা রনিতের কর্তব্য। সুমনের রাগ ভাঙাতে খুব বেশি কিছু লাগে না, একটা সামান্য ফিজিক্যাল টাচ আর এক-দুবার “আমি তো আছি”। কিন্তু এবারের সমস্যাটা একটু গভীর। ওদের দুজনের বিয়ের বয়স হতে যায়, দুজনেই চাকরি করে কিন্তু কেউই বাড়িতে ওপেন নয়। যতবার ওপেন হবে বলে ঠিক করে কোনো না কোনো কারণে পিছিয়ে যায়। তবে গত সপ্তাহে সুমন ওদের সাড়ে চার বছরের সম্পর্কের ব্যাপারে ওর বাড়িতে জানায়। রাতারাতি যেন আকাশ ভেঙে পড়ে সুমনের বাবা-মায়ের মাথায়। ওদের বাড়িতে রনিতের একটা আলাদা কদর ছিল। সব জানাজানি হবার পর খুব স্বাভাবিক ভাবেই সম্পর্কের সমস্ত সমীকরণ বদলে যায়। ভাগ্যিস চাকরীটা কলকাতায় ছিল ওদের দুজনেরই। রনিতের বাড়িতে এসে উঠেছে সুমন। কিন্তু সেটাই বা কদিন! যে কোনো মুহূর্তে ওর বাড়ি থেকে রনিতের বাড়িতে ফোন আসবে। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে দ্বিতীয় আশ্রয়টাও। সুমন ছোট থেকেই ওর বাড়িটাকে খুব ভালো বাসত, ওটাই ওর শিকড়, ওই বাড়িতে ও ভীষণ রকম নাড়ির টান অনুভব করত। ছোটোবেলায় মেয়েলি স্বভাবের ছিল বলে কখনো পাড়ায় ওকে খেলতে নিত না কেউ, ওর সমস্ত শৈশবটাই কেটেছে ওর নিজের বাড়ির আনাচে কানাচে। কখনো সিঁড়ির নীচে তো কখনো চিলেকোঠার ঘরে নিজের মতো করে খেলনা সাজিয়ে খেলেছে। একটু বড় হতে গল্পের বই পড়েছে, কবিতা লিখেছে, ছবি এঁকেছে সেই জায়গা গুলোতে। বাড়ির সমস্ত ইঁটগুলোতে খোদাই করা আছে ওর শৈশবের সমস্ত যন্ত্রণা, অপ্রাপ্তি ও তার সাথে মানিয়ে নেওয়ার স্মৃতি। আজ এত বছর পর হঠাৎ শিকড় উপড়ে নতুন মাটিতে, তাও সেই মাটির যদি একটা স্থায়িত্ব থাকত ও হয়তো একটু নিশ্চিন্ত হত। কিন্তু রনিত কিছুতেই বাড়িতে কিছু বলতে পারত না। আজ ও পারছে না। সুমন আজ সকালে ওকে দিব্যি দিয়েছিল। রনিত দিব্যি-টিব্যি মানে না আবার সুমনের জেদটাকে মনে মনে ভয় ও করে। সুমন বলেছিল “আজ অফিস থেকে ফিরে যেন দেখি তুই কোনো মিথ্যা জীবন কাটাচ্ছিস না, যদি বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে তাতেও রাজি”। যথারীতি রনিতের হিম্মৎ হয়নি বলার।
নাহ! আজ জড়িয়ে ধরলেও কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। সুমনকে এই মাঝরাতে ব্যাগ গোছানো থেকে আটকাতে কী করা উচিত কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ ওদের দরজায় টোকা পড়ল। রনিতের মা।
-কী ব্যাপার সুমন? ব্যাগ গোছাচ্ছিস কেন?
-না মানে ইয়ে কাকিমা
-খাবারটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, কখন থেকে ডাকছি
(রনিত মাঝখান থেকে ফোড়ন কেটে বলে বাবুর গোঁসা হয়েছে)
-কাকিমা আসলে তোমাদের বাড়ি থেকে অফিসটা অনেকটা দূর হয়ে যাচ্ছে তো, যাতায়াতে বেশী সময় লাগছে
-তাই এই মাঝরাতে তুই এখন বাড়ি খুঁজতে যাচ্ছিস? কাকীমাকে কি বোকা পেয়েছিস?
-না আসলে আমি কাল সকালে যেতাম
-ব্যাপারটা কী বলতো! তোর মা’কে সেদিন ফোন করেছিলাম, ধরলেন না। আজ তুই তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গোছাচ্ছিস। সব ঠিক আছে তো বাড়িতে?
-হ্যাঁ কাকিমা, আসলে বাড়িতে ঝগড়া করে এসেছি তো তোমাদের বাড়ি, তাই হয়তো।
রনিত এতক্ষণ চুপ ছিল এবার ও মুখ খুলল। বলল “মা তোমাকে আমার কিছু বলার আছে।”
-হ্যাঁ বল।
-না মানে কাল আমার একটু বেলায় বেরোনো। সকালে ডাকতে হবে না।
-ঠিক আছে, আগে তোরা আয়, খেয়ে যা। তোর বাবাও না খেয়ে বসে আছে। তাড়াতাড়ি আয়।
-ঠিক আছে তুমি যাও, আমি সুমনকে নিয়ে আসছি।

সুমনের চোখদুটো রাগে গজগজ করতে লাগল।
-তুই এবারেও পারলি না বল।
-না পারলাম না, আমার দরকার নেই। আমার দরকার নেই অত সত্যির। আমার কাছে তুই সত্যি, আমার মা সত্যি আর আমার বাবা সত্যি। এছাড়া আর কোনো সত্যি নেই। তুই নিজের জীবন দিয়ে দ্যাখ, এত সত্যি বলে কী পেলি তুই? আর তুই কি ভাবিস? ওরা কিছু বোঝে না? সব বোঝে। আমার মা প্রথম দিন থেকেই সব বোঝে। প্রথম যেদিন তুই আমাদের বাড়ি এলি, আমার মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছিলি আমার বিশ্বাস ওরা সেদিন থেকেই বোঝে। এবার সমস্ত বোঝাকে যে সবসময় মেনে নিতেই হবে তার তো কোনো মানে নেই বল। ওঁরা ওদের মতো করে বুঝেছে, আমার বিশ্বাস মেনেও নেবে। কিন্তু তুই যদি আজ আমায় কষ্ট দিয়ে চলে যাস তুই এতগুলো মানুষের কষ্টের কারণ হয়ে ভালো থাকবি তো? আমি তোকে ভালোবাসি সুমন। আমি তোকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। তুই শুধু আমার মতো করে আমাকে মেনে নে। দেখবি সবটা অনেক স্বাভাবিক থাকবে। দিনের শেষে কী দরকার হয় জানিস? একটা হাত ধরার মানুষ। যে সারাদিনের সমস্ত ঝগড়া, মান-অভিমান সব কিছু মিটিয়ে দেবে আলতো করে জড়িয়ে ধরে। তোকে জড়িয়ে ধরার জন্য আমি আছি। তোর কাকে নিয়ে অনিশ্চয়তা?
-আমি কি ওভার-রিয়্যাক্ট করে ফেললাম রনি?
-না রে। তোর জায়গায় তুই একদম ঠিক, কিন্তু আমার জায়গাতেও আমি ঠিক। তোর দিকটা আমি বুঝছি, আমার দিকটাও তুই একটু বোঝ। তোর রাগ হলে রাগ দেখা, কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাস না। এটা ছেড়ে যাবার কারণ হতেই পারে না। আমরা দু’জনেই দুজনের মতো করে ঠিক, কেউই ভুল না। শুধু শুধু দোষারোপ করিস না বুঝলি। আর রেগে থাকে না সোনা। চল মা ডাকছে। এসব রাখ। খেয়ে এসে জামাকাপড় গুলো আলমারিতে তুলে রাখিস বুঝলি।

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনেছে রনিতের মা। মনে মনে খানিকটা প্রস্তুত ছিলেন তবুও আজ সবটা শুনে প্রথমে একটু কেঁপে উঠেছিলেন, পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে নীচে চলে গেলেন।

খাবার টেবিলে সেই পুরনো ছবি। রনিতের বাবা আর রনিত খালি রনিতের মায়ের পেছনে লাগছে, আর সুমন ওর কাকিমাকে ডিফেন্ড করে যাচ্ছে। রনিতের মা সুমনের মাথায় হাত রেখে বললেন “আমার নিজের ছেলেটা তো উচ্ছন্নে গেছে, তুই একটু ওকে দেখে রাখিস বাবা বুঝলি”
রনিত, সুমন কেউই বুঝল না একটা অসম্ভব ঝড় সামলে নিয়ে একজন মানুষ কতটা সাপোর্টিভ পেরেন্ট হয়ে উঠলেন সব্বার অগোচরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *