রেঙ্গু

      No Comments on রেঙ্গু

[শুরুর আগেঃ

রিয়াজকে প্রথম দেখেছিলাম ইউটিউবের একটি ভিডিওতে, অনেক বছর আগে। তখন বাংলাভাষায় সমকামিতা নিয়ে ইউটিউব ভিডিও সত্যি দুর্লভ একটি বস্তু। কথা বলছি প্রাক-রূপবান সময়ের। কিন্তু লাজুক আমি তার সাথে আলাপ করতে অনেকটা সময় লাগিয়ে দিলাম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রিয়াজ খুব সক্রিয়ভাবে নিতে চলেছে কিছু উদ্যোগ, অদূর ভবিষ্যতে। সুরক্ষার খাতিরে সে’সব বিষয়ে কথা আপাতত এড়িয়ে যাচ্ছি। তবে ইতিমধ্যে “বৈচিত্র্য.বাংলা” নামক জালপাতা (ওয়েবসাইট) -এর মাধ্যমে সে সুযোগ করে দিয়েছে অগণিত বাংলাদেশী বন্ধুদের, তাদের নিজের যৌনতা আর লিঙ্গচেতনার কথা, নিজেদের কলমে প্রকাশ করবার। তার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ কর্মসূচীর সবগুলির সফল রুপায়ন আশা করবো বাংলাদেশকে আরো আধুনিক করে তুলতে সাহায্য করবে। এক নতুন বাংলাদেশ, যেখানে এলজিবিটি+ মানুষদের চাপাতির ভয়ে দিন গুজরান করতে হবেনা।]

রেঙ্গু

 রিয়াজ ওসমানী

দু’হাজার (২০০০) সাল কিংবা তার থেকে এক বা দুই বছর আগের কথা। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে নেটের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব খবরাখবর আর যোগাযোগ রাখতে শুরু করি। বাংলাদেশেও তখন থেকে আস্তে আস্তে নেটের প্রসার শুরু হয়। ভ্রমণ সংক্রান্ত জালপাতা থর্নট্রি’র বাংলাদেশ শাখায় এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়। সেখানে আমার মত তিনিও বাংলাদেশে বেড়াতে আসার জন্য উদগ্রীব বিদেশী পর্যটকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতেন এবং বাংলাদেশ সম্বন্ধে সাধারণ তথ্য বিলি করতেন। দেখলাম যে এই দিক থেকে তাঁর আর আমার চিন্তাভাবনা এক। তবে বিরাট একটা পার্থক্য ছিল আমাদের নিজস্ব অবস্থানে। আমি বাস করতাম মিশিগান অঙ্গরাজ্যের এন আরবার উপশহরে আর তিনি থাকতেন বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। কিন্তু এই দুই প্রান্ত থেকেই আমরা বিদেশী প্রশ্নদাতাতের সাহায্য করতে থাকি এবং সময়ের সাথে সাথে নিজেদের মধ্যে একটা ভাল বন্ধুত্ব তৈরি করে ফেলি।

আমি আস্তে আস্তে তাঁর একটা গভীর আসক্তির সাথে পরিচিত হই। তিনি একটি ভ্রমণ সংস্থা চালাতেন যার নাম বাংলাদেশ ইকোট্যুরস। এ কোন পাঁচ-দশটা ট্রাভেল এজেন্সির মত ছিল না। এ ছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন আদিবাসীদের নিয়ে একটা “লাভের জন্য নয়” সংস্থা। বিদেশী বা প্রবাসী বাংলাদেশী পর্যটকরা অল্প সংখ্যায় কিন্তু প্রতিনিয়ত বেড়াতে এসে আদিবাসী পল্লীগুলোতে আতিথেয়তা গ্রহণ করতেন স্থানীয় প্রাকৃতিক পরিবেশ ও রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে। বিনিময়ে অতিথিরা পেতেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এবং এ থেকে পাওয়া উপার্জনের সিংহভাগই ব্যয় করা হত আদিবাসী পরিবারগুলোর কল্যাণে।

আমি এতই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম তাঁর এই উদ্যোগে যে আমি ক্ষণিক সময়ের জন্য আমার তখনকার আরামদায়ক জীবন ছেড়ে দিয়ে চলে আসতে চেয়েছিলাম তাঁর কাছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম – এইসব জায়গায় ঘাটি করে তাঁর সাথে কাজ করবো পর্যটক আর আদিবাসী পরিবারের কল্যাণে। সাথে তাঁর ব্যাবসার সহায়তা আর প্রসার করে বাংলাদেশের পর্যটন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখারও সুযোগ পেতাম। কিন্তু তা আর হয়নি নানা কারণে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকেই কিভাবে তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারি সেই নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাই। এবং সেই থেকেই তাঁর আরেকটি লক্ষনীয় ব্যাপার সম্বন্ধে জানতে পারি।

তিনি নিজে ছিলেন একজন সমকামী পুরুষ। আমার যত দূর মনে পড়ে, তিনি অর্ধেক বাংলাদেশী আদিবাসী আর অর্ধেক ক্যানাডিয়ান অর্থাৎ মিশ্র জাতির ছিলেন। আমার সাথে পরিচয় হওয়ার সময় তাঁর বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মত হবে। দীর্ঘ দিন ক্যানাডাতে বড় হওয়া ও বাস করার পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন আদিবাসীদের কল্যানে জীবনটা উৎসর্গ করতে। ভদ্রলোকের নাম ছিল রেঙ্গু। তবে তিনি খালি ম্রো, চাকমা, ইত্যাদি মানুষদের জন্যই নিজেকে নিবেদিত করেন নি – তিনি সতর্কতার সাথে বাংলাদেশের বিভিন্ন সমকামীদেরকেও সহায়তা করতেন। তিনি ইয়াহুতে যথাযথ নাম দিয়ে একটি দলের পাতা খুলেন যেখানে নেটের মাধ্যমে দেশের সমকামীরা নিজের গোপনীয়তা বজায়ে রেখে একে অন্যের সাথে মিলিত হতে পারতো, কথা বলতে পারতো। আমার জানা মতে এটাই ছিল বাংলাদেশী যৌন সংখ্যালঘুদের জন্য প্রথম আন্তর্জাল ভিত্তিক একটি মিলন স্থান। এখানে তিনি ডেভিড নামে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন এবং তখন শুধু ইংরেজীতেই কথোপকথনের ব্যাবস্থা ছিল।

আমি তো এতো দিন ভেবে বসেছিলাম যে আমিই একমাত্র বাংলাদেশী সমকামী। বাংলাদেশে আর কোন সমকামী নেই, থাকতেও পারে না। কিন্তু সেখানে ঢুকে দেখি অজস্র প্রোফাইল। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশী গে দের সাথে কথাবার্তাও শুরু হয়ে গেলো। আমি নতুন এক ভুবন আবিষ্কার করলাম। আমার বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ভালবাসার মানুষটা আমাকে বলেছে যে সে নাকি তখন থেকেই আমাকে চেনে যদিও আমরা দুই বছর আগ পর্যন্ত ভালভাবে কথা বলার সুযোগ পাইনি (এখন ২০১৮ সালের জানুয়ারী মাস)। এবং এর সব কিছুরই উদ্যোক্তা ছিলেন রেঙ্গু। আমি আর রেঙ্গু তারপর প্রায়ই চিন্তা করতাম কি ভাবে বাংলাদেশ ইকোট্যুরসে বিদেশী সমকামী পর্যটকদেরকেও আকৃষ্ট করা যায়।

বেশ কিছু দিন তার কোন খবর না পাওয়ার পর তাকে একটা ইমেল পাঠাই খোঁজ নেয়ার জন্য। অনেক দিন পর একটা উত্তর এলো তাঁর এক ঘনিষ্ট বাঙ্গালী সহকর্মীর কাছ থেকে যে রেঙ্গু আর নেই – পার্বত্য এলাকায় ভ্রমণের সময়ে তিনি এক প্রকার মশার কামড়ের ফলে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। তারপর তিনি মারা যান। এই খবর আমি কি ভাবে হজম করতে পেরেছি এখন আর মনে নেই। নিজের জীবন তখন বেশ চড়াই উতড়াইয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল এবং আমি ২০০৩ সালে বিলেতের লন্ডনে নতুন জীবন শুরু করি। সেজন্যই বোধ হয় শোক প্রকাশ করার সময় পাই নি। কিন্তু আজ তাঁর কথা মনে না করলেই নয়। আমার জীবনে দুইজন মানুষ আমাকে সবচেয়ে বেশী অনুপ্রাণিত করেছে। দুইজনই বাংলাদেশের ভ্রমণ শিল্পের সাথে জড়িত ছিলেন আর দুইজনই আজ আর নেই। আর বেঁচে থাকার সময়ে রেঙ্গু বাংলাদেশের সমকামীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যেই অবদান রেখে গেছেন তার জন্য বাংলাদেশের যৌন সংখ্যালঘুরা চিরকাল ঋণীই হয়ে থাকবে। তিনিই বলতে গেলে বাংলাদেশে তখন নবাগত আন্তর্জালের মাধ্যমে সামান্য হলেও সাংগঠনিক কাজ শুরু করে দিয়ে গেছেন আমাদের জন্য। আর আদিবাসীদের জন্য তিনি যা করে গেছেন সেটা তো প্রশংসার দাবীদার বটেই। বাংলাদেশ ইকোট্যুরসকে ভুলে না গিয়ে আমরা সেটাকে সমর্থন করতে পারি। রেঙ্গুর অনুসারীরা এখনও এটা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে আমার বিশ্বাস।

—————————————————–

বিঃ দ্রঃ দ্বিতীয় ব্যাক্তি যিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন তিনি হচ্ছেন মাহমুদ হাসান খান যার সাথেও থর্নট্রি’র বাংলাদেশ শাখায় পরিচয় প্রায় দশ বছর আগে। তিনি নিজের সফল কর্মজীবনের বাইরে দেশ প্রেমে উদবুদ্ধ হয়ে বিদেশী ও কিছু প্রবাসী বাংলাদেশীদের দেশ ভ্রমণ নিয়ে সব রকম সহায়তা করতেন। প্রাথমিক তথ্য বিলি থেকে শুরু করে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানো, সব বাজেট অনুযায়ী আবাস জোগাড় করে দেয়া, সকল ট্রেন, বাস, লঞ্চের টিকিট কেটে দেয়া এবং সূযোগ পেলে বরিশালে তার গ্রামের বাড়ির দেশে আতিথেয়তা প্রদান করা – কোন কিছুই বাকি রাখেন নি তিনি। এবং এগুলো সব তিনি অনেক বছর করেছেন সম্পূর্ণ বিনে পয়সায় এবং দেশব্যাপী তার স্বেচ্ছাসেবক মানুষদের কাজে খাটিয়ে। পরে বিদেশীদেরই অধিক অনুরোধে তিনি একটি ভ্রমণ সংস্থা ট্রিপটুবাংলাদেশ খুলে বসেন স্বল্প বাজেটের বিদেশী পর্যটক বা ব্যাকপ্যাকারদের স্বল্প মূল্যে সকল প্রকার সেবা প্রদান করার উদ্দেশ্যে। সেই সাথে ফেসবুক দল বেড়াই বাংলাদেশ এর মাধ্যমে তিনি দেশের ভেতরে বিভিন্ন জানা অজানা জায়গায় দেশী ভাই-বোনদের বেড়ানোর একটা চল শুরু করে দিয়েছেন। রেঙ্গুর সাথে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু মাহমুদ ভাইয়ের সাথে দেশে দেখা হয়েছে অনেক বার। তিনি ঢাকায় বসে কাজ করতেন, আমি ছিলাম লন্ডনে অবস্থিত তারই এক সহকর্মীর মত। তবে এক বছরও হয়নি তিনি হৃদ রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে তার ছোট্ট পরিবার ও আমাদেরকে ছেড়ে চলে গেছেন। দেশ-বিদেশের বহু অনুরাগী এই শোকে আজ মর্মাহত।

[ছবিঃ ভুটান]


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *