ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের মতে স্বেচ্ছায় নিজের শরীর বিক্রি করলে পুলিশ নাক গলাবেনা, রক্ষণশীল কেন্দ্র

ছবি সূত্রঃ উইকিপিডিয়া (ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স)

২৮শে মে, ২০২২, শনিবারঃ কি খবর পৌঁছায় আমাদের কাছ অবধি, তা নিয়ন্ত্রণ করে টি-আর-পি লোলুপ সংবাদমাধ্যমতন্ত্র। তাই হয়তো এই সপ্তাহের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অধরা হয়ে রয়ে গেলো আমাদের অনেকের কাছেই। অথচ খবরটি আমাদের দেশের এক অবহেলিত গোষ্ঠীর কাছে সম্ভবত সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র তথাকথিত বিপরিতকামী পুরুষ, মহিলা নয়, প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষেরা, যারা অর্থের বিনিময়ে নিজেদের ক্রেতাদের শারীরিক যৌনসুখ দিয়ে থাকেন তাদের জন্যেও। কিছু তথাকথিত বিপরীতকামী পুরুষ, যারা শারীরিক সুখ দিয়ে থাকেন অন্যান্য সমকামী অথবা উভকামী পুরুষদের তাদের জন্যেও।

সাল ২০১১, সুপ্রিম কোর্ট অর্থাৎ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত একটি দল গঠন করেন মূলত ৩টি বিষয় খতিয়ে দেখার জন্য।

  • পাচার বন্ধ করা
  • যেসকল যৌন-বিনোদন কর্মী নিজেদের বর্তমান পেশা ছাড়তে চান, তাদের পুনর্বাসন
  • যেসকল যৌন-বিনোদন কর্মী স্ব-মর্যাদায় নিজের পেশা চালিয়ে যেতে চান, তাঁর স্বর্তবিন্যাস

পরবর্তীতে তৃতীয় বিষয়টিকে সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদের ছায়ায় নির্ধারন করা হবে, এমনটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৬ সালে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট এই দলের তরফে কেন্দ্র সরকারের কাছে পাঠানো হয়। কেন্দ্র সরকার জানায় এই রিপোর্টটি খতিয়ে দেখে একটি আইন প্রণয়ন করা হবে, কিন্তু এতো বছর পড়েও সেরকম কোন আইন পাশ না হওয়ায় বুধবার, ২৫শে মে, অনুচ্ছেদ ১২৬ -এ প্রাপ্ত বিশেষ অধিকার প্রয়োগ করে, সর্বোচ্চ আদালত নিজেই এ বিষয়ে বেশ কিছু নির্দেশিকা জারি করলো। বিচারকমন্ডলীর তরফে উপস্থিত ছিলেন বিচারক এল. নাগেস্বরা রাও, বিচারক বি. আর. গওয়াই, এবং বিচারক এ. এস. বোপান্না।

এই নির্দেশিকাগুলি দু ধরণের। প্রথম নির্দেশিকাগুলিতে কেন্দ্র সরকার সম্মত হয়েছে, এবং এ বিষয়ে কোন আইন প্রণয়ন না হওয়া অবধি সমস্ত রাজ্য সরকার এবং এবং কেন্দ্র একে মান্যতা দিতে বাধ্য। কি বলা হয়েছে এতে?

  • যদি কোন যৌন-বিনোদন কর্মী যৌন-অত্যাচারের স্বীকার হন তাহলে, যৌন অত্যাচারের স্বীকার হওয়া আর পাঁচজনের মতো তিনিও চিকিৎসা সহ সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাবেন।
  • রাজ্য সরকার সমস্ত আইটিপিএ সংস্থাগুলিতে জরিপ চালাবে আর সেসমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা, যাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের ধীরে ধীরে মুক্তি দেওয়ার ব্যাবস্থা করবে।
  • দেখা গেছে যৌনকর্মীদের প্রতি পুলিশের ব্যবহার বেশ কিছু ক্ষেত্রেই নির্মম এবং হিংস্র। যেন এই গোষ্ঠীর অধিকারগুলিকে মান্যতাই দেওয়া হয়না। পুলিশ এবং অন্যান্য আইন-রক্ষন সংস্থাকে যৌনকর্মীদের মৌলিক মানবাধিকার এবং সংবিধানপ্রদত্ত সাধারণ নাগরিক হিসেবে সমস্ত অন্যান্য অধিকার বিষয়ে সজাগ করতে হবে। পুলিশ সমস্ত যৌনকর্মীদের প্রতি সম্মানসূচক ব্যবহার করবে, এবং মৌখিক বা শারীরিকভাবে তাদের হেয় করবেনা। তাদের প্রতি কোনরকম হিংসা অথবা বলপূর্বক যৌনাচার করা যাবেনা।
  • ভারতের প্রেস কাউন্সিলকে অনুরোধ করা হচ্ছে সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে নির্দেশিকা জারি করে ছাপামারি, গ্রেপ্তার অথবা মুক্তির সময় যাতে কোন যৌনকর্মীর পরিচয় আসামি অথবা নির্যাতিত হিসেবে প্রকাশ না করা হয় সেই নিয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়ার অনুরোধ করতে, এবং এই সংক্রান্ত কোন ছবি যা থেকে তাঁর পরিচয় প্রকাশিত হতে পারে সেগুলিও সামনে না আনতে। আর, নতুন ধারা ৩৫৪সি, যা ভয়েউরিজমকে বেআইনি ঘোষণা করেছে, তা কঠোরভাবে সমস্ত ইলেক্ট্রনিক সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হবে, যদি তারা কোন যৌনকর্মীর সাথে তার ক্রেতার কোন ছবি গ্রেপ্তার অথবা মুক্তির মুহূর্তের নিরিখে প্রকাশ করে।
  • নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য যৌনকর্মীরা যেসকল পন্থা নিয়ে থাকেন (যেমন কন্ডোম ব্যবহার করা ইত্যাদি), সেগুলিকে অপরাধ অথবা অপরাধের প্রমাণ হিসেবে ধরা যাবেনা।
  • কেন্দ্র এবং রাজ্যের সরকারেরা রাষ্ট্র, রাজ্য এবং জেলার লিগাল সার্ভিসেস অথারিটির সাহায্যে যৌনকর্মীদের তাদের অধিকার, অর্থাৎ যৌনকর্মের অধিকার, পুলিশের অধিকার এবং বাধ্যতা, আইনের আওতায় কি করা যাবে, আর কি করা যাবেনা ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন কর্মশালার মাধ্যমে সজাগ করবে। নিজেদের অধিকার সুরক্ষায় এবং পুলিশ আর পাচারকারিদের অযথা হয়রানির বিরুদ্ধে তারা কিভাবে আইনি সাহায্য নিতে পারেন তাও জানাবে।

এই নির্দেশিকাগুলি বাদে, আরো কিছু নির্দেশিকা সর্বোচ্চ আদালতের তরফে প্রস্তাবিত, যাতে কেন্দ্র সরকার এখনও রক্ষণশীল। আগামী ৬ সপ্তাহের মধ্যে কেন্দ্রকে এ বিষয়ে নিজেদের জবাব দিতে বলেছে আদালত। পরবর্তী শুনানির দিন ২৭শে জুলাই এগুলির সম্পর্কে পরবর্তী পদক্ষেপ নির্ধারিত হবে। কেন্দ্রের কাছে আটকে থাকা এই নির্দেশিকাগুলিতে কি বলা হচ্ছে?

  • যৌনকর্মীরা আইনের আওতায় সমস্ত সুরক্ষার অধিকারী। আইন বয়স এবং সম্মতির উপরে ভিত্তি করে সবার উপরে সমানভাবে প্রযুক্ত হবে। যখন কোন যৌনকর্মী একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক এবং নিজের ইচ্ছেয় এতে অংশগ্রহণ করেছেন বলে স্পষ্ট, পুলিশ এতে কোনভাবে হস্তক্ষেপ বা যৌনকর্মীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারবেনা। পুলিশ যৌনকর্মীদের অন্য চোখে দেখে, এ বিষয়ে চিন্তাজ্ঞাপন করা হয়েছে। কোন যৌনকর্মী যদি কোন যৌন/ক্রিমিনাল/অন্যান্য অপরাধের ব্যাপারে পুলিশকে জানান, তাহলে পুলিশকে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • কোন জায়গায় ছাপামারি হলে, যেহেতু স্বেচ্ছায় যৌনকর্ম করা অপরাধ নয়, কিন্তু এরকম গণিকালয় চালানো বেআইনি, সেক্ষেত্রে যৌনকর্মীদের গ্রেপ্তার, পিনালাইজ অথবা হয়রান করা যাবেনা।
  • যৌনকর্মীদের নিয়ে কোন আইন প্রণয়ন এবং পরিবর্তন অথবা নীতি নির্ধারণ, ছক তৈরি করা এবং কার্যকরী করার আগে রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকারকে তাদের অথবা তাদের প্রতিনিধির সাথে পরামর্শ করা আবশ্যিক। এটা করার জন্য সংশ্লিষ্ট দল এবং/অথবা সংস্থাকে যেসকল সিদ্ধান্ত তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করবে, তা সম্পর্কে এদের মতামত নিতে হবে।
  • ২২/০৩/২০১২ -এর অন্তর্বর্তী রিপোর্টে যেমন বলা হয়েছে, কোন সন্তানকে তার মায়ের থেকে শুধুমাত্র এই কারণে আলাদা করা যাবেনা যে তাঁর মা যৌনকর্মে নিযুক্ত। এ ছাড়াও, কোন অপ্রাপ্তবয়স্ককে যদি গণিকালয় অথবা যৌনকর্মীদের সাথে বসবাস করতে দেখা যায়, তাহলে এটা ধরে নেওয়ার কারণ নেই, যে তাকে নিশ্চয়ই পাচার করেই আনা হয়েছে। যদি কোন যৌনকর্মী তাকে নিজের পুত্র/কন্যা হিসেবে দাবী করেন, আহলে জরুরি ডাক্তারি পরীক্ষা করতে হবে, এবং প্রামাণ্য ফলাফল পেলে কখনোই তাকে তার অভিবাবকের থেকে আলাদা করা হবেনা।

বস্তুত, বছরখানেক আগে করোনায় ডঃ স্মরজিত জানা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তার অবদান যৌন-বিনোদন কর্মীদের আন্দোলনে এক অমোঘ স্ফুলিঙ্গ। তাঁর নাম উঠলেই যে সংস্থার কথা মাথায় আসে তার নাম দুর্বার। দুর্বারের তরফে শ্রীমতী তৃপ্তি টন্ডন জানান এই রায় আসলে যৌনকর্মকে আইনি মান্যতা দেয়না, তবে এই রায় বলে এই যৌনকর্মীদের গোষ্ঠী যাদেরকে অবজ্ঞা আর ঘৃণার দৃষ্টিতে সমাজ দেখে তাদেরও অনুচ্ছেদ ২১ -এর আওতায় পুর্ন সম্মান দাবী করে”।

এ বিষয়ে একটা কথা মনে রাখার দরকার, যেহেতু এই নির্দেশিকায় অনেক জায়গাতেই প্রাপ্তবয়স্ক মহিলাদের কথা নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, অতএব, পুরুষ যৌনকর্মী এবং সমান্তরাল লিঙ্গচেতনার মানুষেরা এর সবকটির আওতায় আসবেননা। আবার ভয়েরিজমের ৩৫৪সি ধারাও শুধুমাত্র মহিলাদেরই সুরক্ষা দিয়ে থাকে। তবে এই রায় নির্দ্বিধায় যৌনকর্মীদের অধিকার বিষয়ক লড়াইকে এক অন্য মাত্রা দিলো। উল্লেখ্য নালসা জাজমেন্টকে লঘু করে কেন্দ্রীয় সরকার যে ট্রান্সজেন্ডার আইন পাশ করেছে, তাতেও এক সমান্তরাল লিঙ্গচেতনার মানুষকে ধর্ষণ করার সাজা, এক মহিলাকে ধর্ষণ করার সাজার চেয়ে অনেকটাই কম।

বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এই একই দিনে সর্বোচ্চ আদালতের আরো একটি নির্দেশের। এই তিনজন বিচারক, এদিন ইউআইডিআই -কে নির্দেশ দেন যাতে কোনরকম ঠিকানার প্রামাণ্য নথি ছাড়াই যৌনকর্মীদের আধার কার্ড দেওয়া হয়, এ ক্ষেত্রে গেজেটেড অফিসারের শংসাপত্রকেই প্রামাণ্য নথি হিসেবে ধরা যেতে পারে। সমগ্র প্রক্রিয়ায় আবেদনকারীর পরিচয় গোপন রাখতে হবে সংস্থাকে।

সূত্রঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *