কন্যাশ্রী

প্রীতিলতার হাত টা নিয়ে নিজের হাতে রাখলো দীপক। ফুলশয্যার রাত বলে ঘরে বিশেষ আলো নেই । কিন্তু মেয়েটার মুখটা যে বিবর্ণ সেটা বোঝা যাচ্ছে।
— কী হলো? পছন্দ হয়নি আমাকে!
দীপক নরম স্বরে বললো। উত্তর না পেয়ে, একটু অপেক্ষা করে নিয়ে মৃদু হাসলো
— জানো তোমাকে প্রথম দেখাতেই বেশ পছন্দ হয়েছিল আমার। আমাকে তোমার পছন্দ কিনা জানিনা। কতটুকুই বা চেনার সময় পেয়েছো । তাড়াহুড়ো করে বিয়েটাও হয়ে গেলো। কিন্তু কথা দিচ্ছি প্রীতি, আমি সারাজীবন তোমার পাশে থাকবো । এই তো আমাদের একসাথে পথ চলা শুরু হলো আজ থেকে। আমার যতটুকু সামর্থ্য তার সমস্তটা দিয়ে তোমাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবো।
প্রীতিলতা মুখ তুলে তাকালো। প্রথম যেদিন দীপকের সাথে আলাপ হয় প্রীতিলতারও ওকে খুব পছন্দ হয়েছিল। দীপক গ্রামেরই একটি সরকারি স্কুলের ইতিহাসের মাস্টার। প্রীতিলতার বাবা পঞ্চায়েত প্রধান। সাংঘাতিক দাপুটে লোক। একদিন কন্যাশ্রীর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছিল দীপক ওদের বাড়িতে। প্রীতিলতার কলেযে ছুটি ছিল কোনও কারণে সেদিন।
— কলেজ নেই আজকে?
— না মাস্টারমশাই, ছুটি দিয়েছে।
— আচ্ছা! তাহলে আজ সারাদিন কিকরে কাটাচ্ছো শুনি?
— কবিতা লিখে..
— বাহ! এটা কিন্তু দারুন একটা জিনিস
দীপক সোফায় এসে বসলো “জানো তো, আমিও তোমার বয়সে খুব কবিতা লিখতাম। তোমার মতো ভালো হয়তো লিখতে পারতাম না। কিন্তু যখনই অবসর পেতাম ডায়েরী নিয়ে বসে যেতাম।.. এক গ্লাস জল হবে?
— আনছি, আপনি বসুন।
জলের গ্লাস টা দীপকের হাতে দিয়ে সরে এসে দাঁড়ালো প্রীতিলতা।
— আমি, ভালো কবিতা লিখি আপনাকে কে বললো?
— তুমিই বললে এখন! বলে মুচকি হাসলো দীপক।
— তা আর কি কি করতে ভালোবাসো। বলে ফাঁকা জলের গ্লাস টা এগিয়ে দিল।
— আঁকতে৷
— বাপরে! কতকিছু পারো তুমি! তা, কি আঁকতে বেশী পছন্দ করো? মানে পোট্রেট না ল্যান্ডস্কেপ নাকি..
— স্বপ্ন আঁকতে… আর..
বলতে বলতে প্রীতিলতার বাবা চলে এসেছিল। তারপরে কন্যাশ্রীর কথা উঠলো..

দীপককে ভাল লেগেছিল প্রীতিলতার । কিন্তু বিয়েতে ওর মত ছিল না, আর সেটা বাবাকে বললে অনর্থ হতো। বাবা ভেবেই নিত নির্ঘাত কোনো ছেলের সাথে চক্কর চালাচ্ছে । মাঝখান থেকে ওর কলেজ ছাড়িয়ে দিতো। বাড়ি থেকে যে পালিয়ে যাবে সেই দুঃসাহস থাকলে তো কোনো কথাই ছিল না — এমনিতেই মুখচোরা, ঘরকুনো একটা মেয়ে। সারাদিন ঘরের এক কোণায় বসে কবিতা লিখে যায়। কারো সাথে কথা বলে না। বোনেদের উপর বাড়ি থেকে বেরোনোর ব্যাপারে হাজারটা নিষেধাজ্ঞা, আর প্রীতিলতাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়েও বাড়ির বাইরে এক পা বের করানো যায় না।

— কি হলো? প্রীতি? বলো, আমাকে ভালবাসো না?
দীপকের কথায় ঘোর ভাংলো প্রীতিলতার। স্থির দুটো চোখে অপর দুটো চোখ তখন তন্ন তন্ন করে উত্তর খুঁজে চলেছে। দীপক নিপাট ভালো একটা মানুষ, ভালো বাসা যায় এমন একটা মানুষ ও বটে। তবুও প্রীতিলতার বুক কেঁপে উঠলো। উত্তর একটা দিতেই হবে।
— আমিও আপনাকে ভালবাসি মাস্টারমশাই।
প্রথম দুটো শব্দ আমতা আমতা করে হলেও “ভালবাসি” এই শব্দটা স্পষ্টই শোনালো।
— আপনার সাথে থাকতে চাই। কিন্তু..
দীপকের আর কোনো কিন্তু নিয়ে কাজ নেই। প্রীতিলতার মুখ থেকে এই একটা উচ্চারণ শুনবে বলেই এতদিনের অপেক্ষা!
— আমি তোমাকে আমার সবটুকু দেবো প্রীতি.. কি চাও শুধু বলো..
দীপকের হাত টা আলগা করে দিয়ে নিজেরটা ছাড়িয়ে আনলো প্রীতিলতা।
— এভাবে বলবেন না। আপনি জানেন না কিছু!
অজানার ভয়ে দীপক ভীত নয়, তার মনে কেবল একটাই সংশয়
— সত্যি করে বলো তুমি আমাকে ভালবাসো না প্রীতিলতা??
প্রীতিলতা অধৈর্য হয়ে উঠেছে। সরল মনের মানুষটা কেবল ভালবাসা বোঝে, কেন তার মনে অন্য কোনো আশংকা নেই, আর কোনো প্রশ্ন নেই, জিজ্ঞাসা নেই?
— আমিও আপনাকে ভালবাসি মাস্টারমশাই!! সত্যিই খুব ভালবাসি!
গলা ধরে এল প্রীতিলতার।
—কিন্তু আপনি কেন আমাকে ভালবাসলেন? কিছু না জেনে কেন ভালবাসলেন আমাকে মাস্টারমশাই??
চেপে রাখা কথাগুলো অভিমানী কান্নায় একে একে ভেঙে পড়তে লাগলো । দীপক ঘনিষ্ট হয়ে বসতে চাইলে প্রীতিলতা বাধা দিল।
— কাঁদছো কেন প্রীতিলতা? কী হয়েছে আমাকে বলো।
একটা হাত প্রীতিলতার চোখ দুটো আলতো করে মুছিয়ে দিল শুধু।
— আমি..
চোখদুটো আবার জলে ভরে উঠলো। দীপক স্বাস চেপে স্থির হয়ে বসে রইলো পাছে সেটুকুও যদি প্রীতিলতাকে কোনোরকম বিচলিত করে! ওর বলা প্রতিটা অক্ষর মন দিয়ে শুনতে চায় সে।
— আমি আপনার মতো হতে চাই মাস্টারমশাই। আপনার মতো সুপুরুষ।
শেষের বাক্যটা শেষ হতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, তবে মাথা তুলে তাকানোর সাহস হলো না প্রীতিলতার। “সুপুরুষ” এই শব্দটা কানে লাগলেও অগ্রাহ্য করে গেলো দীপক
— তুমি আমার মতো কেন, আমার থেকেও অনেক বেশি সফলতা অর্জন করবে! পড়াশুনা করবে, তারপর চাকরি করবে, কবিতা লিখবে, আর যা যা ইচ্ছে তোমার সব করবে প্রীতিলতা! আমি সবসময় তোমার পাশে আছি..
প্রীতিলতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকা সাব্যস্ত করল। সময় দেওয়া দরকার। বুঝতে পেরে দীপক ও কোনো কথা বললো না। তবে আশ্বস্ত হতে পেরেছে সে, প্রীতিলতা যে ভয় টা পাচ্ছিল সেটা কাটাতে পেরে এখন স্বস্তি।
— আপনি যেটা শুনেছেন, ঠিক শুনেছেন মাস্টারমশাই । আমি পুরুষ ই বলেছি..
দীপকের ঠোঁটে লেগে থাকা ম্লান হাসি টা হঠাৎ নিভে যাবার পথ পেলো না যেন।
প্রীতিলতা বলে চললো “এই বিয়ে মিথ্যে মাস্টারমশাই। এই এতো আয়োজন, এতো আড়ম্বর সব মিথ্যে। আপনি কোনো মেয়েকে নয়, আপনি মেয়ের মুখোশ পরে থাকা একটা ছেলেকে ভালবেসেছেন। বিশ্বাস করুন মাস্টারমশাই, ছোট থেকে অনেক চেষ্টা করেছি নিজেকে ঠিক করবার, অনেক বুঝিয়েছি নিজের মন কে, অন্তরের সত্ত্বাটাকে মেরে দিয়ে নতুন করে বাঁচার একশোরকম পরিকল্পনা করেছি। মা বোনেরা ভাবতো আমি মেয়েদের কে পছন্দ করি তাই ছেলেদের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাইনা। বাবাকে বলে দেবার ভয় দেখাতো রোজ। এটা সম্পুর্ন ভুল একটা ধারণা তাদের।আমার মেয়েদের প্রতি কোনোদিন কোনো আকর্ষণ ছিল না। শুধু নিজেকে মেয়ে বলে ভাবতে পারিনা। বাবাকে বলতে পারিনি যে বিয়েতে আমার মত নেই। কি বলতাম আপনিই বলুন?? বাবা একরকম আপনাকে ঠিকই করে রেখেছিল আমার জন্য। আপনি প্রস্তাব দিতেই তাই বিয়ে দিল তৎক্ষনাৎ। আপনাকে আমি কষ্ট দিতে চাইনি মাস্টারমশাই। ভেবেছিলাম বিয়ের পর হয়তো ঠিক হয়ে যাবো… কিন্তু এই আমি পারবোনা মাস্টারমশাই!! এভাবে পারবো না। এই শরীর নিয়ে আর চলতে পারবো না। আপনাকে আমি সত্যিই বড্ড ভালবাসি.. কিন্তু নিজের উপরে যে বড্ড ঘেন্না হয়!!
অঝোরে কাঁদছিল প্রীতিলতা। অনেক কথা একনাগাড়ে বলতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিল।
“যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেবো। এর বেশি আর কিছু বলবো না মাস্টারমশাই।”

কী এমন শাস্তি দেওয়া যায় ভালোবাসার মানুষটাকে? উঠে গিয়ে জানলার পাশে এসে দাঁড়ালো দীপক। একটু আগে বোনেরা সব ঘরে ঢুকে হুটোপাটি করে জানলাটা বন্ধ করে দিয়ে গিয়েছিল। এখন খুলে দেওয়াতে ঘরের গুমোট ভাবটা একটু কমলো। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে, যুক্তি বুদ্ধি বিবেচনাশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে এক এক করে । সারাদিনের অপরিসীম ধকলের পরে অবশিষ্ট শক্তিটুকু প্রীতিলতার জন্য সাশ্রয় করে রেখেছিল দীপক। মুহূর্তের মধ্যে যেন সব ওলোটপালোট হয়ে গেল।
দীপক শুধু একজন স্কুলশিক্ষক নয়, সমাজকর্মী ও বটে। সে জানে এই গ্রামের মানুষ পৃথিবীটাকে একভাবে দেখতে শিখেছে। তাদের জ্ঞানের আওতায় আনতে পারা অত সহজ নয়। আর নিজেকে কী বোঝাবে? কীভাবে বোঝাবে? প্রশ্ন আসলে তার উত্তরগুলো কার কাছে পাবে? এতশত ভাবতে ভাবতে হ্যাঁচকা টানে কাঠের আলমারি টা খুলে ফেললো দীপক। প্রীতিলতা বিচলিত হলো না, মনে মনে একরকম প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। আলমারি খুললেই একদম সামনে প্রীতিলতার একটা ব্যাগ রাখা জামাকাপড়ে ভর্তি। তার পিছনে দীপকের কিছু পুরোনো কাপড়চোপড় রাখা আছে, সেখান থেকে একটা নীল রংএর পাঞ্জাবী তার সাথে একটা সাদা পায়জামা টেনে বার করলো দীপক। তার গায়ে ছোট হয়ে এসেছে অনেকদিনই। আলমারিটা বন্ধ করে ওই দুটো প্রীতিলতার হাতে দিয়ে বললো “পালটে এসো যাও”। প্রীতিলতা একরকম অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে দীপক একটু বিরক্ত হলো
” কী হলো যাও, পালটে এসো”
বলে নিজেরই খারাপ লাগলো। প্রীতিলতাকে শাসন করবার কোনো অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু ওকে বাথ্রুমে পাঠিয়ে দিয়ে একটু ঠান্ডা মাথায় কয়েকটা জিনিস ভাবতে বসবে । প্রীতিলতাকে প্রতিজ্ঞা করেছে ওরা একসাথে পথ চলবে। কিন্তু সেই চলার পথে ওরা একা…
একটা ট্রান্সফার পেলে ভালো হয়…

~*~~***~~**~

ছবিঃ ভুটান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *