‘রিচ আউট’ উদ্যোগ নিল লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের জন্য একটি অসামান্য অনলাইন লোকেটারের
-ভুটান (নিজস্ব সংবাদদাতা)
যৌন প্রান্তিক মানুষদের শারীরিক ও মানসিক হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয় জীবনের প্রতি পদে পদে। নানাবিধ হেনস্থার প্রমান গোটা দেশে কম নেই , কখনও কর্ম ক্ষেত্রে তো কখনও আপনজনেরাই স্বাভাবিক সম্পর্কের মাঝে দেওয়াল তুলে করে দেয় ব্রাত্য। তাছাড়া অনেকেই জটিল আইনি ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত অসুবিধাতেও প্রতিনিয়ত জেরবার হচ্ছেন। আর এই ধরনের সমস্যার হাত থেকে মুক্তি পেতে তারা অনেকেই বেছে নেন আত্মহত্যার মত ভয়ানক কোনো রাস্তা। সমস্যাগুলোর সমাধান কোথায় পাওয়া যায় বিশেষ করে কোনো প্রফেশনাল হেল্প কিভাবে পাওয়া যাবে তা খুঁজতেই চলে যায় অনেকটা সময়। এইসব সমস্যার সুরাহার স্বার্থেই বার্তা ট্রাস্ট(কলকাতা) , গ্রাইন্ডার ফর ইকুয়ালিটি (লস এঞ্জেলস) এবং সাথী(চেন্নাই) এক সাথে একটি অনলাইন লোকেটার তৈরি করেছেন যাতে ক্লিক করলেই ভারতের নানা প্রান্তে অবস্থিত যৌন স্বাস্থ্য , মানসিক স্বাস্থ্য ও আইনি বিষয়ক সমমনস্ক ও সহানুভূতিশীল ক্যুয়ের বান্ধব সাহায্যের খোঁজ পাওয়া যাবে সহজেই।
জুন মাস প্রাইড মান্থ হওয়ার সুবাদে কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে আয়োজিত হয় নানা অনুষ্ঠান সেখানেই ২৮শে জুন এই লোকেটারের উদ্বোধন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি রিচ আউট বলে এক মাল্টিমিডিয়া ক্যাম্পেইনের অন্তর্গত আয়োজিত হয়। বার্তাকে সেই শুরুর দিন থেকেই যৌন প্রান্তিক মানুষেরা স্বাস্থ্য ও আইনি বিষয়ক নানা প্রশ্ন করে থাকেন , সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতেই এই প্রচেষ্টা।
বার্তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পবন ঢাল জানান – “কিছু এলজিবিটি মানুষ স্থানীয় স্তরে স্বাস্থের পরিষেবা গ্রহণ করে থাকেন। অনেকেই নির্ভর করেন অন্যের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের উপর। যদিও বা তথ্যের আদান প্রদান ,আলাপ আলোচনা অনেকটাই আজ অনলাইন হয়ে থাকে, ক্যুয়ের মানুষদের কাছে আজও আইন ও স্বাস্থ্য নিয়ে তথ্যের অভাব লক্ষ করা যায়। তথ্য প্রযুক্তির দৌলতে আজ নিজের পছন্দ মত যৌনসাথী বা সম্পর্ক তৈরি করা অনেকটাই সহজ। কিন্তু যদি কোনো সমস্যা তৈরি হয়? যদি স্বাস্থ্য বা আইন সংক্রান্ত কোনো জটিলতা তৈরি হয় বা আপনার সাথী যদি আপনার যৌনতা নিয়ে ব্ল্যাকমইল করে? আমাদের লোকেটার তখন আপনার ভারতে ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী সাহায্যকারীদের যোগাযোগ করার তথ্য দিয়ে দেবে। সাহায্যকারীদের জন্যেও এই ব্যবস্থা খুব জরুরী কারণ তারা যত ক্যুয়ের মানুষ দেখবেন, তাদের বিকল্প যৌনতা ও লিঙ্গ পরিচিতি সম্বন্ধে চিন্তাধারাও পালটাবে।”
এই মুহূর্তে ভারতের ১৬টি রাজ্য ও ৩০টি বড় ও ছোট শহর সম্বন্ধে তথ্য প্রদান করছে লোকেটরটি। সব থেকে বেশি তথ্য এসেছে পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু ও অসম থেকে। পশ্চিমবঙ্গের মালদা , বারাসাত, বারুইপুর, বহরমপুর ও ইটাহারের মত ছোট জেলা বা শহর থেকেও তথ্য এসেছে। আরও তথ্য আসলে বোঝা যাবে পরিষেবা কেমন লাগছে সবার এবং এই পরিষেবাকে আরও কিভাবে উন্নততর করে তোলা যায় সেই বিষয়ে একটি সম্যক ধারনাও পাওয়া যাবে। লোকেটারটি আরও আপডেট করতে সকলের মতামতও গ্রহন করা হবে। পশ্চিমবঙ্গ ও তামিলনাড়ুতে বিকল্প যৌনতা এবং লিঙ্গ পরিচিতি নিয়ে অনেকেই কাজ করছেন ফলে তারা এই দুটি রাজ্যের নাগরিক সমাজে কিছু সচেতনতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, তাছাড়া সরকারী সাহায্যও পাওয়া গেছে কিছুটা তাই এই দুটি রাজ্য থেকেই সবচেয়ে বেশি তথ্য এসেছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে বছরখানেক আগে কাঁচালঙ্কাও পশ্চিমবঙ্গ , বাংলাদেশ তথা বিভিন্ন বাংলা ভাষাভাষি অঞ্চলে লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের স্বার্থে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের তালিকা তৈরির প্রয়াস নেয়। তাই আমাদের তরফেও আশা থাকল যে রিচ আউট এর এই অভিনব উদ্যোগ আমাদের সেই তালিকাকেও আরও সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে।
এই লোকেটারটি পাওয়া যাবে বার্তার নিজস্ব ওয়েবপেজে (http://www.vartagensex.org/
অনুষ্ঠানের শুরুতে পবন ঢাল লোকেটারটি কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা দেখালেন। ব্যবহারের প্রক্রিয়াটি নিতান্তই সহজ , চারটি বক্স একটিতে বেছে নিতে হবে নির্দিষ্ট শহরের নাম অপরটিতে রয়েছে রাজ্যের নাম, বাদ বাকি দুটো বক্সে ক্লিক করে বেছে নিতে হবে কি ধরনের সাহায্য চাই আপনার, ব্যাস তারপরেই পাওয়া যাবে সাহয্যকারীদের নাম ও অন্যান্য তথ্যের একটি লিস্ট। এই সব পরিষেবা প্রদানকারীরা অত্যন্ত কুয়ের বান্ধব এবং যৌন প্রান্তিক সমস্যা সম্পর্কেও যথেষ্ট সচেতন। পবন ঢাল আরও জানান যে এই লোকেটারের সাহায্য নিতে কোনরকমের লগ ইন করতে হবেনা আর এই লোকেটারটিও কোনও ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করবেনা।
তবে এই লোকেটার ক্যুয়ের বা যৌন প্রান্তিক মানুষ ছাড়াও মহিলা , যুব সমাজ , প্রতিবন্ধী ব্যক্তি , এইচ আইভি পজিটিভ ব্যাক্তি প্রভৃতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের কথা মাথায় রেখেই বানানো হয়েছে। ফলে যারা ক্যুয়ের নন তারাও এর সাহায্য থেকে বঞ্চিত হবেন না।
সুপ্রিম কোর্টে আসন্ন ৩৭৭ধারার শুনানি এবং লোকসভায় ট্রান্সজেন্ডার বিল পেশ করার পর এই আইনিপ্রক্রিয়াগুলো নিয়ে মানুষের মনে নানা প্রশ্ন আসবেই, সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই কাজে আসবে এই লোকেটার। গ্রাইন্ডার ফর ইকুয়ালিটির অধিকর্তা জ্যাক হ্যারিসন কুইন্টানা জানালেন যে তাঁরা এই লোকেটারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অন্যান্য দেশেও লোকেটার তৈরি করার কথা ভাবছেন। তিনি আরও বলেন যে গ্রাইন্ডার এর আগে এর চেয়ে বড় কোনো তথ্য ও পরিষেবা সংক্রান্ত লোকেটারের সঙ্গে যুক্ত হয়নি।
এই উদ্বোধনের পরে এলজিবিটি মানুষদের স্বাস্থ্যের ও আইনি অধিকার নিয়ে একটি আলোচনাসভা বসে। বক্তারা ছিলেন মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী ও সমিক্ষনি সেন্টার ফর মেন্টাল হেলথ এন্ড থেরাপির প্রতিষ্ঠাতা জলি লাহা, কলকাতা হাই কোর্টের অ্যাডভোকেট ও যৌনতার অধিকার কর্মী কৌশিক গুপ্ত, এইচ আইভি কাউন্সেলর এবং ন্যাশনাল ইনস্টিউট অফ কলেরা এন্ড এন্টেরিক ডিসিসের যৌন স্বাস্থ্য কর্মী পিয়ালী ঘোষ এবং রুপান্তরকামী অধিকার কর্মী সুদেব সাধু। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন রিচ আউট ক্যাম্পেন ম্যানেজার বৃন্দালক্ষী।
এই আলোচনায় উঠে আসে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেমন সুদেব সাধু বলেন সাম্প্রতিক কালে এলজিবিটি সংক্রান্ত সমস্যা বলতে শুধুই এইচ আইভি সংক্রান্ত সমস্যা নিয়েই কথা হয়, মানসিক স্বাস্থ্যের কথাকে প্রায় অবজ্ঞাই করা হয়। জলি লাহা সুদেব সাধুর কথায় একমত হয়ে আরোও জানান যে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে যারা কাজ করছেন তাঁরা যৌন প্রান্তিক মানুষদের মানসিক সমস্যার ব্যাপারে একেবারেই অবগত নন আর এর কারণ যথাযথ ট্রেনিং এর অভাব। পিয়ালী ঘোষ এর মতে এই বৈষম্য অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারের কাছ থেকেও জোটে, অনেক ডাক্তারই যৌন স্বাস্থের ক্ষেত্রে বিষমকামীদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যাকেই প্রাধান্য দেন সমকামিদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যার চেয়ে।
তবে আলোচনা শেষে প্রত্যেকেই একমত হন যে আগামীদিনের যাবতীয় পরিবর্তনের জন্য বিকল্প যৌনতার মানুষদের তৈরি থাকতে হবে।
(ছবি সৌজন্যে – বার্তা ট্রাষ্ট)