নসুমামা ও আমি — বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

নসুমামা ও আমি

— বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

[শুরুর আগেঃ জন্ম – ১৮৯৪ খ্রীঃ, মৃত্যু – ১৯৫০, বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কাণ্ডারির নাম “বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়”। চাঁদের পাহাড়, আদর্শ হিন্দু হোটেল, আরণ্যক, দেবযান — প্রভৃতির স্রষ্টার হাতে উঠে এসেছে বিভিন্ন বিষয়, বিভিন্ন গল্প/উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে। “নসুমামা ও আমি”, এই মহান স্রষ্টার এমনই এক অনবদ্য সৃষ্টি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অখণ্ড ভারত/পাকিস্তান/বাংলাদেশের এক লেখকের লেখা এই গল্পে, নারীস্বাধীনতার পাশে ফুটে উঠেছে লিঙ্গচেতনার এক অদ্ভুত মিশ্রণ।  “ট্রান্সজেন্ডার”/”রূপান্তরকামী” শব্দগুলি সৃষ্টিরও বহু আগে এই রচনায় নারী/পুরুষ পরিচয়ের বিভাজনের উর্দ্ধে মানুষের মানবতা হয়ে উঠেছে চরিত্রের পরিচয়। এই রচনা দেশ/কাল-এর গণ্ডী পেড়িয়ে যাওয়া, কালজয়ী, বাংলা সাহিত্যে এলজিবিটি+ অথবা লিঙ্গ-যৌন-সমান্তরাল চিন্তাভাবনার এক বহু পুরাতন অথচ শাশ্বত গাঁথা। ১২ই সেপ্টেম্বর ছিলো বিভূতিভূষণের জন্মদিবস। তার প্রতি অসীম শ্রদ্ধার্ঘ্যে কাঁচালঙ্কার তরফে বন্ধুদের জন্যে রইলো এই গল্প।]

ছেলেমানুষ তখন আমি। আট বছর বয়স।
দিদিমা বলতেন তোর বিয়ে দেব ওই অতুলের সঙ্গে।
মামার বাড়ীতে মানুষ, বাবা ছিলেন ঘরজামাই – এসব কথা অবিশ্যি আরও বড় হলে বুঝেছিলাম।
অতুল আমার দিদিমার সইয়ের ছেলে, কোথায় পড়ে, বেশ লম্বামত আধফর্সা গোছের ছেলেটা। আমাদের রান্নাঘরে বসে দিদিমার সঙ্গে আড্ডা দিত। অতুলকে আমার পছন্দ হতো না, কেমনধারা যেন কথাবার্তা। আমায় বলতো — এই পাঁচী যা – এখানে কি? ঐদিকে গিয়ে খেলা করগে যা —
কখনো বলতো — অমন দুষ্টুমি করবি তো বাঁশবনে লম্বা শেয়ালটা আছে তার মুখে ফেলে দিয়ে আসবো বলে দিচ্ছি —
অতুলকে সবাই বলতো ভালো ছেলে। লেখা-পড়ায় বছর বছর ভালো হয়ে ক্লাসে উঠতো, আমার ছোটমামার সঙ্গে কিসব ইংরিজি-মিংরিজি বলতো – যদি তার কিছু বুঝি।
এইসব জন্যেই হয়তো অতুলকে আমার মোটেই ভালো লাগত না। তা সে যতই
ভালো হোক, লোকে তাকে যতই ভালো বলুক।

ভালো আমার লাগতো মুখুজ্যে-বাড়ীর নসুকে। কি সুন্দর ফর্সা চেহারা, ননী-ননী গড়ন, ডাগর চোখ-দুটি, বেশ হাসি-হাসি মুখখানি। বয়সো অতুল মামার মত অত বেশি নয়, আমার চেয়ে সামান্য কিছু বড় হবে। অতুল মামার বয়স হয়তো ছিল ষোল-সতেরো।
নসু হাসলে তার মুখ দিয়ে যেন মুক্তো ঝরতো — দিদিমার সেই গল্পের মত। এমন সুন্দর মুখ আমার আট বছরের জীবনে এ অজ পাড়াগাঁয়ে কটাই বা দেখেছি। দিদিমার কাছে এসে বসে মাঝে মাঝে সেও গল্প করতো, সে যা বলতো তা যেন মধুর, অতি মধুর। আমি হাঁ করে ওর মুখের দিকে চেয়ে একমনে ওর কথাগুলো যেন গিলতাম। অতুলও তো কথা বলে, কিন্তু তার কথা এত ভালো লাগতো না তো?
দিদিমা বলতেন – অতুলের সঙ্গে পাঁচীর বিয়ে দেবো, বেশ মানাবে।
আমি মুখ ভারি করে বলতাম – ছাই মানাবে।
দিদিমা হেসে বলতেন – ওমা মেয়ের কাণ্ড দ্যাখো। কেন মানাবে না?
তুমি তো সব জানো!
তবে তোর মনটা কি শুনি? কাকে বিয়ে করবি তুই?
ওই নসুকে।
দিদিমা হেসে গড়িয়ে পড়ে বলতেন – এর মধ্যেই মেয়ে নিজের বর বেছে নিয়েচে। ধন্যি যা-হোক, একালের মেয়ে কিনা! শুনলে সই, নসু নাকি ওর বর হবে।
অতুলের মা হেসে বলতেন – কেন রে, অতুলকে তোর পছন্দ হয় না কেন?
অতুল মামার বয়েস বেশি।
বেশি আর কত? ষোল বছর।
তা যাই হোক, ষোল বছরের বুড়োকে আমি বুঝি বিয়ে করবো? নসু ছেলেমানুষ।
দিদিমা বলতেন – দ্যাখো সই একালের মেয়ের কাণ্ড। নসুর বয়স বারো, ওকেই বেশি পছন্দ। তোমার আমার কাল চলে গিয়েচে। তেরো বছর বয়সে আমার বিয়ে হলো, উনি তখন বিয়াল্লিশ, দোজপক্ষে আমায় ঘরে আনলেন। তোমারও তো —
অতুলের মা বল্লেন – আমার অত না! উনি তখন ঊনত্রিশ, আমার এগারো।
দোজপক্ষ তো বটে।
শুধু তাই? সতীন বেঁচে।
আমায় ভগবান সেদিক থেকে নিষ্কণ্টক করেছিলেন তাই খানিক রক্ষে।

মাঝে মাঝে নসুকে অনেকদিন দেখতাম না। আমাদের পাড়ায় সে আসতো না খেলতে। আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠতো, ছুটে যেতাম মুখুজ্যেবাড়ীতে।
নসুমামা উঠোনে বসে কঞ্চি কেটে খেলাঘরের বেড়া বাঁধছে। সঙ্গে আরও তিন-চারটি ছেলে, ওরই বয়সী।
আমি বলতাম — ও নসুমামা, আমাদের বাড়ী যাওনি যে?
কি রোজ রোজ যাবো! তুই এতদূর এলি যে? আসতে ভয় করে না?
না।
খেলা করবি?
হুঁ।
অন্য ছেলেগুলো তখুনি বলে উঠতো – মেয়েমানুষ আবার আমাদের সঙ্গে খেলবি কেন? যা তুই, পুঁটি মান্তিদের সঙ্গে খেলগে যা।
নসু বলতো — খেলুক আমাদের সঙ্গে — তাতে কি?
হাবু বলতো — ও কি দাঁ দিয়ে কঞ্চি কেটে আনতে পারবে? কি খেলা হবে ওকে নিয়ে? যা তুই —
আমাকে কাঁদো-কাঁদো দেখে নসু এসে হাত ধরতো। বলতো — কেন ওকে অমন কচ্ছিস তোরা? ও কেন কঞ্চি কাটতে যাবে? মেয়েমানুষ, চুপ করে বসে থাকবে। বোস তুই পাঁচী —
আমি অমনি কৃতার্থ হয়ে উঠোনের একপাশে বসে পড়তাম। নসুমামা খেলতে খেলতে হয়তো একটা পেয়ারা ছুঁড়ে দিতো আমার দিকে। বসে বসে পেয়ারা চিবুতাম। অনেকক্ষণ পরে বলতাম — নসুমামা, খিদে পেয়েচে —
হাবু অমনি বলে উঠতো – ঐ শোনো কথা। ও সব হ্যাঙ্গাম —
নসুমামা বলতো – তুই চুপ কর্ হাবু। খিদে পেয়েচে? চল্ পিসিমার কাছে, দুটো তালভাজা খাবি তেলনুন দিয়ে, না হয় একটা কচি শসা পেড়ে দেবো —
আমি বলতাম – না, তুমি বাড়ী দিয়ে এসো। আমি বাড়ী গিয়ে ভাত খাবো। একলা যেতে ভয় করে।
হাবু অমনি চোখ পাকিয়ে বলে — তবে একলা এলি কি করে? কে এখন তোর সঙ্গে যাবে পৌঁছে দিতে? উঃ ভারি পাজি মেয়ে —
নসু আমায় আগে আগে বাড়ী পৌঁছে দিতে আসতো, ধুলোমাটির পথের ধারে কত কেঁচোর মাটি, কত বেনে বৌ গাছে গাছে, পাকা বকুল পড়ে থাকতো বকুলতলায়। নসুকে পাকা বকুল খাওয়াতে ইচ্ছে করতো, আমি বড্ড ভালোবাসি পাকা বকুল। নসুমামাকে কুড়িয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে বলতো – দূর, ও কষা কষা লাগে। তুই খা, আমি খাবো না। নসুকে খেতে দিয়ে যেন আমার তৃপ্তি, সে সুযোগ ও আমায় দিত কই।
এইভাবে সারা শৈশব ও বাল্যকাল কেটে গেল সেই আমার ছেলেবেলাকার অপরিচিত মামার বাড়ীর গ্রামের গাছপালার ছায়ায় ছায়ায়, চৈত্র মাসের পাখী-ডাকা শীতল সকালবেলার মত। তারপরেই জীবনের রোদ খরতর হয়ে উঠলো ক্রমশ। ফুল-ফোটা পাখী-ডাকা বসন্তপ্রভাত গেল ধীরে ধীরে মিলিয়ে। বাতাস গরম হয়ে উঠলো।
সেই গাঁ, সে — ই তাঘরা-শেখহাটি এখনও আছে। মাঝে মাঝে এখনও সেখানে যাই, কত বদলে গিয়েছে সে জায়গা। সে মামার বাড়ী নেই সে দিদিমাও নেই।
বাবা কোথায় কাদের আড়তে কাজ করতেন। সামান্য ক’টি মাইনে পেতেন, দিদিমার সঙ্গে সংসারের খরচপত্র নিয়ে তার প্রায়ই ঝগড়া-তর্ক হোত। বাবা রাগ করে চলে গেলেন বাড়ী থেকে, দু-একমাস কোন খবর আসতো না, মা কান্নাকাটি করতেন, হঠাৎ বাবা একদিন এসে হাজির হোতেন। দিন এভাবেই চলতো।

তেরো বছর বয়সে আমার বিয়ে হোল আড়ংঘাটার কাছে এক গ্রামে। বিয়ের দিনকতক বাদে নসুদের বাড়ী গিয়েছিলাম। নসুর মার শরীর খারাপ। নসু রান্নাঘরে ভাত রাঁধছে। উনুনের আঁচে ওর ফর্সা মুখ রাঙ্গা হয়ে গিয়েচে। ওদের বাড়ীর কোন বিলিব্যবস্থা নেই। অনেকগুলো ভাই নসুর, তারা কেউ বাইরে পড়ে আছে, কেউ কাজ করে। নসুর মার শরীর চিররুগণ, সংসারের রান্নাবান্নার ভার নসুমামার উপরে। আজ অনেকদিন থেকেই নসুর এই অবস্থা দেখছি।
নসুর অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হলো। নসুর মুখের দিকে চাইবার কেউ নেই, ভাইয়েরা সব স্বার্থপর, সংসার চালানোর ভার তার উপর ফেলে দিয়ে সবাই তারা নিশ্চিন্ত হয়ে আছে।
নসুমামা আমায় দেখে হেসে বল্লে — আয় পাঁচী, বোস। কাল দই পেতেছিলাম, দইটা বসেনি। উনুনের পাড়ে রেখে দেবো, কি বলিস?
যত সব মেয়েলি গল্প নসুর। সাধে কি ওকে সকলে বলে জনার্দন মুখুজ্যের বিধবা মেয়ে? আমায় বল্লে — কাল বুঝলি, এক কাঠা মুগের ডাল ভাজলাম, ভাঙলাম। বেলা গেল ডালডুল করতে। গা-হাত-পা ব্যথা।
বল্লাম — তুমি ডাল ভাজলে? সত্যি?
হ্যাঁ রে। নইলে কে করবে? আবার কাল একগাদা ময়লা কাপড় সোডা-সাবান দিয়ে সেদ্ধ করতে হবে।
দুঃখিত সুরে বল্লাম — ওসব মেয়েলি কাজ। তুমি ওসব কর কেন? আমায় ডাকলে না কেন? আমি ডাল ভেজে দিতাম।
নসু বল্লে — আহা! আমি না পারি কি? তোকে আবার ডাকতে যাবো কেন?
লেখাপড়া করবে না নসুমামা? এসব কাজ কি তোমার সাজে? পুরুষমানুষ, লেখাপড়া কর।
আমায় কে পড়াবে? দাদারা এক পয়সা দেবেনা। তা ছাড়া মার শরীর খারাপ, আমি বাড়ী থেকে গেলে রান্নাবান্না কে করে বল্। পড়বার খরচ জুটলেও আমার পড়া হোত না।
আমি বসে বসে ওর কুটনো কুটে দিলাম। আমার বিয়ের কথা বল্লাম। নসুমামা বিশেষ কোনো আগ্রহ প্রকাশ করলে না। ও যদি একটুও আগ্রহ প্রকাশ করতো, শুনতো কোথায় আমার বিয়ে হচ্ছে ইত্যাদি, তাহলে আমার ভালো লাগতো। কিন্তু নাঃ, সে সুখ আমার অদৃষ্টে নেই। নসুমামা একটা কথাও জিজ্ঞেশ করলে না সে সম্বন্ধে।
আমার বিয়ের রাত্রে নসু নেমন্তন্ন খেয়ে এল পেট পুরে, কিন্তু না এল একবার বিয়ে দেখতে, না একবার বাসরঘরে উঁকি মেরে দেখলে। আমার মনটা যেন কেমন ফাঁকা ফাঁকা, ও যদি আসতো তবে খুব ভালো লাগতো। মনের মধ্যে ডুব দেবার সময় আমার নয় তখন, তবুও কি যেন একটা হয়ে গেল, এত বাজনা, এত খাবার-দাবার, এত লোকজনের যাতায়াত, আমার নতুন কাপড় গয়না — কিছুই ভালো লাগলো না। মনে উৎসাহ নেই।

আগেই বলেচি আমার বিয়ে হয়েছিল আড়ংঘাটার শিকারপুরে। স্বামীর বয়সও সতেরো-আঠারোর বেশি নয়, রোগা চেহারা, মাথার চুল-ওঠা। বিয়ের পরে জানা গেল স্বামী ম্যালেরিয়ার পুরনো রোগী। মাসে দুবার ম্যালেরিয়া জ্বর বাঁধা আছেই। আড়ংঘাটার যুগলকিশোর ঠাকুরের মেলার সময় ময়রার দোকান খোলেন আমার খুড়শ্বশুর, স্বামী তাড়ু দিয়ে সন্দেশ-মুড়কী ভিয়েন করেন।
শ্বশুরবাড়ীতে যাবার সময় মনে খানিকটা কৌতূহল নিয়ে যে না গিয়েছিলাম এমন নয়। না জানি কেমন বাড়ী-ঘর, কেমন খাওয়া-দাওয়া। গিয়ে দেখি, পুরনো আমলের ইঁট-বের করা কোঠাবাড়ী, দুটি মাত্র ঘর, ছোট একটা বারান্দা, তবে সব ঘরগুলির সামনে সান-বাঁধানো টানা রোয়াক এবং রান্নাঘরটিও কোঠা। খুব বড় একটা আম গাছ সমস্ত বাড়ীর উঠোন জুড়ে ঘুপসি করে রেখেচে।
আমার শাশুড়ী গর্বের সুরে বল্লেন — আমের সময় তো আসচে, দেখো বৌমা। এমন আম এ অঞ্চলে নেই আমার বাগানে যা আছে, ডাকসাইটে বাগান, কর্তা করে রেখে গিয়েছিলেন, এস্তেক গোয়াড়ি, এস্তেক শান্তিপুর, কোথা থেকে কলমের চারা এনে না পুঁতেচেন।
আমের সময় এল, কোথা থেকে ব্যাপারীরা এসে বাগান কিনে নিলে। দু-এক ঝুড়ি আম যা আমাদের বাড়ী এল, তা থেকে দুটো-একটা জুটল আমার ভাগ্যে। শাশুড়ী নিতান্ত বাজে কথা বলেন নি, আম ভালো।
স্বামীর সঙ্গে আলাপ জমলো মন্দ নয়। ক্রমে তাঁকে ভালোও লাগলো।
আমায় বল্লেন — তুমি কী খেতে ভালোবাসো?
আমি লজ্জা-টজ্জার ধার ধারিনে, বলে ফেল্লাম — তেলেভাজা খাবার।
স্বামী বল্লেন — দূর। অমন বোকা মেয়ে কেন? ভালো খাবারের নাম করো।
গজা। জিলিপি।
কেন খাজা?
সে আবার কি গা? আমাদের গাঁয়ে শুনিনি তো।
উনি হো হো করে হেসে বল্লেন — পাড়াগেঁয়ে ভূত। আমাদের এ শহর বাজার জায়গা। কাল খাজা আনবো লুকিয়ে। কিন্তু সাবধান, মা যেন টের না পায়। বকবে। আমি নিজে খাজা ভিয়েন করি।
সেই থেকে মাঝে মাঝে স্বামী লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার আনেন। কোনো দিন খাজা, কোনোদিন মিহিদানা। আমরা দু’জনে লুকিয়ে খাই। স্বামী বলেন — সবাইকে দিতে গেলে চলে না। খুড়তুতো ভাইয়েরা হাঁসের পাল, সবার মুখে দিতে গেলে তোমার আমার মুখে এক টুকরো ঊঠবে কি না উঠবে।

শ্বশুর বাড়ী ভালো লাগলো না বটে, তবে স্বামীকে কিছুটা ভালো লাগলো এই খাবার খাওয়া থেকে। উলোর জাতের মত বড় মেলা এ অঞ্চলে নেই, সে সময় ময়রার দোকানে কাজ বেশি। উনি ফেরেন অনেক রাতে। হাতে বড় বড় ঠোঙায় খাবার ভর্তি। উনি হেসে বলতেন — খাও, খাও, খুব খাও — এসো দুজনে পেট ভরে খাই।
একদিন কি করে খুড়শ্বশুর টের পেলেন লুকিয়ে খাবার আনার ব্যাপারটা। এ নিয়ে খুব ঝগড়া হলো বাড়ীতে। আমাকে আর ওঁকে যথেষ্ট অপমান গালি-গালাজ সহ্য করতে হলো।
খুড়শাশুড়ি বল্লেন — অমন নোলায় সাত ঝাঁটা মারি। লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার খেয়ে দোকানটা শেষ করে দিলে গা! এমন অলক্ষ্মী বৌ তো কখনও দেখিওনি, শুনিওনি। লজ্জাও করে না গুরুজনকে লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে।
স্বামীকে রাত্রে বল্লাম — আর ওসব এনো না। দ্যাখো তো কি কান্ড বাধালে।
স্বামী বল্লেন — না, আনবে না। আমায় কি মাইনে দেয় কাকা? বিনি মাইনের চাকর করে তো রেখেচে। পেটে দুটো খাবো না? ঠিক আনবো লুকিয়ে, তুমি দেখো। কেমন করে ধরবে কাকা তা দেখবো।
স্বামীর শরীর ভালো নয় অথচ ঘোর পেটুক। আমার কথা শুনতেন না। খাবার চুরি বন্ধ হলো না। রোজ রাত্রে একগাদা বাসি লুচি আর রসগোল্লার রস আনেন। নিজে খান, আমাকেও যথেষ্ট দেন। ওঁর পেটের অসুখ ছাড়ে না। আমার বারণ শোনেন না মোটে।
বলেন — খেয়ে যা উঠিয়ে নিয়ে পারি। কাকা একপয়সা উপুড়-হাত করবে না।
আমি বল্লাম — আমি বাপের বাড়ী যাবো আষাঢ় মাসে, আমায় নতুন কাপড় কিনে দেবে না?
উনি ঠোঁট উল্টে বল্লেন — কে দেবে? কাকা? তা দেখে আর বাঁচলাম না!
সত্যি আমার নতুন কাপড় হবে না? বাপের বাড়ীতে কিন্তু সবাই নিন্দে করবে।
যদি আমি দিতে পারতাম, সব হোত। আমার ইচ্ছে করেনা তোমায় কাপড় দিতে? কোথায় পাবো?
তাই তো। অনেকের নিন্দে শুনতে হবে তাই ভাবচি।

আষাঢ় মাসে বাপের বাড়ী এলাম। স্বামীও আমার সঙ্গে এলেন। তাঁকে দেখে গ্রামের সমবয়সী মেয়েরা নানা রকম নিন্দাবাদ করতে লাগলো।
আমায় একদিন রায়বাড়ীর মেজগিন্নী বল্লেন — হ্যাঁ! পাঁচী, জামাই নাকি তাড়ু ঘোঁটে ময়রার দোকানে?
আমি অতশত বুঝি নে — হ্যাঁ। খুব ভালো খাজা তৈরি করে। সবাই হাতের সুখ্যাতি করে মাসীমা।
মেজগিন্নী হেসেই খুন! তার বড় পুত্রবধূ যে বাপের বাড়ী থেকে আসতে চায় না, বাপের বাড়ীর গ্রামে কোন প্রতিবেশী ছেলের সঙ্গে প্রণয়াসক্ত, এসব কথা তিনি তখন ভুলে গেলেন। আমার স্বামীকে গ্রামের লোকে নতুন জামাই বলে খাতির করলে না। আমার তাতে মনে বড় দুঃখ হলো। নতুন জামাইকে সকলে নেমন্তন্ন করে খাওয়ায়, আমার স্বামীকে সবাই কেমন যেন হেনস্থা করলে।
নসুমামা ঠিক তেমনি ভাত রাঁধচে। আমি তার ওখানে গিয়ে গল্প করে একটু যা আনন্দ পেতাম। একটা জিনিস দেখলাম, নসু ধর্মে-কর্মে মন দিয়েচে এই বয়সেই। চন্দন ঘষচে দেখে বল্লাম — দিদিমা পুজো করেন বুঝি আজকাল? নসু হেসে বল্লে — মা নয়। পুজো করবো আমি। রোজ শিব গড়িয়ে পুজো করি। মানুষ হয়ে জন্মে শুধু খেয়ে যাব শুওরের মত?
আমার হাসি পেলো ওঁর মুখে তত্ত্বকথা শুনে। নসুমামা আমাকে শসা কেটে খেতে দিল, নিজেই নারিকেলের নাড়ু করেছে ঘরে, তা দিলে, চা খেতে দিলে।

বছর দুই-তিন কাটলো। আমার স্বামীর শরীর সারলো না। ক্রমেই যেন আরও খারাপ হয়ে উঠচে। শাশুড়ী ও খুড়শাশুড়ী বলেন — ওই অলুক্ষণে বৌ এসে বাছার শরীর একদিনও
ভালো গেল না।
শাশুড়ী বল্লেন — সংসারের কোনো জিনিসে আঁট নেই তা দেখছ লক্ষ্য করে?
কথাটা নেহাৎ মিথ্যে নয়, এ আমিও স্বীকার করচি। সত্যিই যেন আমার কোনো জিনিসে কোন আসক্তি নেই। ভালো কাপড় নয়, গহনা নয় — কোনো কিছুতে না। আমার স্বামী বলেন – পয়সা জমাও না কেন? যা মাঝে মাঝে হাতে এনে দিই, জমিও। তোমার আখেরে ভালো হবে।
ওসব কথা আমি শুনেও শুনিনি কোন দিন। কার আখেরে কি হবে সে ভেবে ফল কি!
আমার একটি ছেলে হলো, কয়েক মাস পরে মারাও গেল। স্বামীর অসুখ সারে না। সংসারে খেটেই মরি, মুখের মিষ্টি কথা কেউ বলে না। স্বামী আমায় নানারকম সাংসারিক উপদেশ দেন। তাঁর যে রকম শরীর, কবে মরে যাবেন, তখন কী উপায় হবে? আমি যেন কিছু কিছু হাতে রাখি। এ কথা আমি যখন শুনি তখনই মনে থাকে, তারপর আর মনে থাকে না।

সেই মাঘ মাসে আমি বাপের বাড়ী এলাম। গ্রামে এসে শুনি নসুমামার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েচে, সে দিন-রাত পূজো-আচ্চা নিয়ে থাকে, কারো সঙ্গে কথা বলে না, কিরকম যেন। আমি গিয়ে দেখা করলাম বিকেলের দিকে। নসুমামা বল্লে — কি খবর পাঁচী, কখন এলি?
কাল এসেছি। ভালো আছো?
ভাল আছি। খুব আনন্দে আছি।
সবাই তোমাকে পাগল বলচে যে?
নসুমামা হেসে চুপ করে রইল। তারপর আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বল্লে —
আমি আসল বস্তু পাওয়ার চেষ্টায় আছি। এতে যে যা বলে বলুক। আমি পাগলই হই আর ছাগলই হই — হি-হি-হি-হি হ্যাঁরে পাঁচী?
শেষের কথাগুলো আমার কানে একটু অসংলগ্ন ঠেকলেও নসুমামার ওপর আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। কি যেন একটা ওর মধ্যে আমি পেলাম, যা সাধারণ মানুষের মধ্যে দিখিনি। ওর মুখের চেহারা যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছে। লোকে টাকাকড়ি ঘর-জমি আঁকড়ে পড়ে আছে দেখছি আমার চারিপাশে, খুড়শাশুড়ীকে দেখেছি গাছের সামান্য একটা আম যদি গাছের তলা থেকে কোনো বাড়ীর ছেলে কুড়িয়ে নিয়ে যায় তবে ঝগড়া করে পাড়া মাত করেন। গাঁয়ের মধ্যে দেখেচি এক হাত জমি হয়তো এগিয়ে বেড়া দিয়েছে কেউ, তাই নিয়ে মামলা মোকদ্দমা দু-তিন বছর ধরে চলেচে। এমন আবহাওয়ার মধ্যে নসুমামা মানুষ হয়েও স্বতন্ত্র, ওর কাপড়ে-চোপড়ে, খাওয়ায়, বিষয়-আশয়ে কোনো আসক্তি নেই; পৈতৃক বিষয় আছে, কিন্তু ভায়েদের দিয়ে বসে আছে সর্বস্ব, একটা পয়সাও চায় না।
আমার স্বামী এসে দু-চারদিন রইলেন। স্বামীর ওপর আমার কেমন একটা মায়া হয়। এর মুখের দিকে কেউ যেন চায় না আমার শাশুড়ী ছাড়া — তাও তিনি বুড়ো হয়েছেন, দেওরের কাছে কোনো কথা তাঁর খাটে না।
আমাদের গ্রামেও তাঁর তেমন খাতিরযত্ন নেই।
বল্লেন — এই গাঁয়ে একটা ঘর করলে ভালো হয়।
আমি বল্লাম — কেন, শ্বশুরবাড়ী বাস করবে? কেউ কিছু বলবে না?
বলুক গে। কাকার ওখানে আর ভালো লাগে না।
দেখ ভেবে।
তোমাদের গাঁয়ের লোকগুলো যেন কেমন কেমন? ভালো করে কথাই বলে না।
আমার রাগ হলো, বল্লাম — তাড়ুঘোঁটা জামাইকে কে খাতির করবে শুনি?
স্বামী হেসে চোখ টিপে বল্লেন — ইঃ! রোজ রোজ রাত্তিরে খাজা খাওয়ার সময় তো খুব ভালো লাগে?

দু-একদিন পরে উনি চলে গেলেন। যাবার সময় আমার হাতে তেরো আনা পয়সা দিয়ে বলে গেলেন — এই পয়সা দিয়ে খাবার কিনে খেও। মাসখানেক থাকো, তারপর এসে নিয়ে যাবো।
আর আসেননি তিনি। সেই মাসের শেষের দিকে পুরনো আমাশা রোগে তিনি আমার সিঁথির সিঁদুর আর হাতের শাঁখা ঘুচিয়ে ইহলোক ত্যাগ করলেন। বাবা চিঠি পেয়ে আমাদের প্রথমে কিছু বলেননি, তারপর দু’দিন পরে মাকে একদিন বল্লেন — হ্যাঁ একটা কথা, জামাইয়ের বড় অসুখ, চিঠি পেয়েচি।
মা আড়ষ্ট সুরে বলে উঠলেন — সে কি গো! এতক্ষন বল নি কেন? হাটে চিঠি পেলে? কই দেখি চিঠি।
বাবা আমতা আমতা করে বলেন — তা — ইয়ে – মনে ছিল না। তা নয় — ইয়ে —
আমি কান-খাড়া করে পাশের ঘরে বসে সব শুনচি। আমার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করচে। মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে যেন। জিব শুকিয়ে আসচে। আমি বুঝতে পেরেচি সব। বাবা অত্যন্ত ব্যস্তবাগীশ লোক, জামাইয়ের অসুখ-সংবাদে চুপ করে বসে থাকবার মানুষ নন। মা ছুটে হাঁপিয়ে বাবার কাছে এসে বল্লেন — তার কাছে এখুনি চলে যাও। মেয়ের যাবার কথা লেখেনি? ওকেও নিয়ে যাও —
বাবা শুষ্কমুখে বল্লেন — আর সেখানে গিয়ে কি হবে গিন্নী। সব শেষ হয়ে গিয়েচে।
মা মেঝের ওপর আছড়ে পড়লেন আর্ত চীৎকার করে। আমি কিন্তু বেশ সহজ ভাবেই কথাটা শুনলাম কারণ আমি আগেই বুঝতে পেরেচি বাবা কি বলবেন।
এইভাবে আমার বিবাহিত জীবনের ইতি হয়ে গেল। কি করবো, আমার অদৃষ্ট। বাবা তো বুড়ো হাবড়া স্বামীর হাতে আমায় দেননি, ছোকরা দেখে দিয়েছিলেন, আমার কপালের লেখা, কারো দোষ নেই। আমার কিন্তু বিশেষ কোনো দুঃখ নেই মনে। বিশেষ কিছু যে হারিয়েচি, বিশেষ কোনো অভাববোধ নেই। লোকে বলচে আমার নাকি সর্বনাশ হয়ে গেল। কি সর্বনাশ হলো কিছু বঝতে পারচি নে। মাছ খেতে পাবো না, নাই বা পেলাম; একাদশী করতে হবে, করবো। ভালো খাওয়া বা পরার দিকে আমার কখনো কোন ঝোঁক নেই। তবে মানুষটার ওপর মায়া জন্মেছিল বটে। তাঁকে আর দেখতে পাবো না, এইটুকু যা কষ্ট।

বিধবা হওয়ার পরে আমি অনেকবার শ্বশুরবাড়ী গেলাম।
শাশুড়ীর সেবা করি, মুখরা জায়ের সংসারে পুত্রহীনা বৃদ্ধার বড় কষ্ট, যত দূর পারি সেটুকু ঘোচাবার চেষ্টা করি। একাদশীর দিন শাশুড়ী-বৌয়ে নিরম্বু উপোস করি, সন্ধ্যের সময় তাঁর পায়ে তেল মালিশ করি।
খুড়শাশুড়ী সর্বদা শোনান, আমি অলুক্ষুণে বৌ, আমায় ঘরে এনেই তাঁর সোনার চাঁদ ছেলে, দুধের বাছা মারা গেল।
ভাসুরপোর ওপর এমন স্নেহ ভাসুরপোর জীবদ্দশায় দেখেচি বলে মনে করতে পারলাম না। আশ্চর্য!
একবার বাপের বাড়ী এসে শুনলাম নসুমামা বাড়ী ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েচে। ছ’মাস পরে খবর এল হালিসহরের এক কালীমন্দিরে সে আছে, গঙ্গার তীরে দুখানা ভাঙা মন্দির, সেখানে সে পুজো-আচ্চা নিয়েই নাকি আছে।
খবরটা দিলে ও পাড়ার বুধো গয়লার মা, ঘোষপাড়ার দোল দেখে দেশে ফেরবার পথে সে হালিসহরে গিয়েছিল, সেইখানেই দেখা হয়েচে। আমি মনে মনে ভাবলাম ওর পক্ষে ভালোই হয়েচে। কি জানি কেন আমার মনে হয় নসুমামা যা করে তাই ভালো।
এই ভাবে দিনের পর দিন কাটে। বৃদ্ধা শাশুড়ীকে কত যত্নে আগলে নিয়ে বেড়াই, বাপের বাড়ী গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারিনে, পাছে বুড়ীর কষ্ট হয়। একদিন শাশুড়ী বল্লেন — চল মা, সান্যাল মশায়ের বাড়ী ভাগবত শুনে আসি —
সে কে মা?
পাড়ার বুড়ো সান্যাল দাদা, দ্যাখোনি বুড়োকে?
সান্যাল মশায়ের বাড়ী গেলাম। ওঁর অবস্থা বেশ ভালো বলে মনে হলো বাড়ীঘর দেখে। শুনলাম দুই ছেলে কলকাতায় চাকরি করে, তাদের স্ত্রী-পুত্র তাদেরই সঙ্গে কলকাতায় বাসায় থাকে। সান্যাল মশায় বিপত্নীক। বয়স ছিয়াত্তর বছর, নিজেই বল্লেন। একটি বিধবা বোন বাড়ীতে থাকে ও রান্নাবান্না করে। আমাদের দেখে খুব যত্ন করলেন, আমাদের সামনে ভাগবত ব্যাখ্যা করে শোনালেন।
সেই থেকে সান্যাল মশায়ের বাড়ীতে রোজ যাই। আমায় তিনি বড় ভালোবাসেন, যোগবাষিষ্ঠ ও ভাগবত তাঁর প্রিয় বই। যদি দু’দিন না যাই, সান্যাল মশায় আমার শ্বশুরবাড়ী আসবেন। আমার শাশুড়ী তাঁর বৌমা। ডেকে বলেন — ও বৌমা?
বৃদ্ধা শাশুড়ী মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে বলেন — কি দাদা?
নির্মলা (আমার ভালো নাম) কোথায়? ডেকে দাও।
আমি বের হয়ে এসে বলি — কি দাদু?
দাদু কি রে, তোমার জ্যাঠামশাই হই। তোমার শ্বশুরের চেয়ে এগার বছরের বড় আমি। আমার ওখানে ক’দিন যাওনি কেন? আজ অবিশ্যি যাবে।
আবার নিয়মিত ভাবে যাই। সান্যাল মশায় আজকাল আর কোন শ্রোতা চান না, আমার মধ্যে কি যে দেখেচেন — আমাকে পেয়ে খুব খুশি। যোগবাশিষ্ঠ পাঠ জমে না আমি না গেলে।
একদিন তাঁকে বল্লাম — জ্যাঠাবাবু, আমি তো মুখ্যু মেয়ে মানুষ, আমার মধ্যে কি পেলেন আপনি?
কি পেলাম কি জানি। কিন্তু তুমি এলে মা আমার গীতা আর যোগবাশিষ্ঠ জ্যান্ত হয়ে ওঠে। ওদের শ্লোকের মধ্যে থেকে নতুন ভাষ্য বেরিয়ে আসে। আনন্দ যদি শাস্ত্র-আলোচনায় উদ্দেশ্য হয়, তবে সেটার ষোল আনাই পাই তুমি আসলে মা!
আমি হেসে বল্লাম — তাহলে বলুন জ্যাঠামশায়, আমার মত শ্রোতা আপনি অনেকদিন পাননি।
সত্য মা, এতদিন জানতাম না যে লোককে শুনিয়ে এত আনন্দ হয়। নিজেই চর্চ্চা করতাম, এই পর্যন্ত। আজ কিন্তু অন্যরকম বুঝচি। উপযুক্ত শ্রোতা পেলে —
আমারও ভালো লাগে বলেই যাই। কেমন যেন মন বদলে যাচ্চে, যে মন আমার কোন কালেই সংসারে ছিল না — তা আরও নিরাশক্ত হয়ে পড়চে। বন্ধনের মধ্যে কেবল বৃদ্ধা শাশুড়ী। বৃদ্ধা কাঁদেন, আমি বসে যোগবাশিষ্ঠের উপদেশ শোনাই। কিন্তু তাতে তাঁর মন ভেজে না। ঘোর বিষয়ী মন। এ বয়সেও কাঁটালের ভাগ নিয়ে, সজনে ডাঁটার ভাগ নিয়ে খুড়শাশুড়ীর সঙ্গে ঝগড়া। আমি বলি — মা, কি হবে আপনার এঁচড় আর সজনেডাঁটার চুলচেরা ভাগে। ওর কি সার্থকতা? ভগবানের নাম করুন।

বাতাবী লেবু-ফুল ফুটলো ফাগুন মাসে — পথে পথে অপূর্ব সুগন্ধ ছড়িয়ে। ঘেঁটুফুলে বাঁশবনের তলা ভর্তি হয়ে গেল। কোকিলের ডাকে মন উদাস হয়ে ওঠে, কত কথা ভাবি। বাল্যকালের কথা, মা-বাবার কথা, স্বামীর কথা — জীবনে কিছু না পেয়েই যেন সব-কিছু পেয়েচি। যদি কোনো হিসাবী বিষয়ী লোক বলে, কি পেয়েচ, হিসেব দেখাও — হয়তো কিছু দেখাতে পারবো না — কারণ বাইরে আমার অর্ধমলিন সরুপাড় ধুতি আর দুগাছি অতি সরু বিবর্ণ সোনার চুড়ির মধ্যে কেউ কোনো লাভের সন্ধানই খুঁজে পাবে না, আমার মন বলে কি-এক জিনিসের ঠিকানা মিলেচে, যার দরুন অফুরন্ত আনন্দের ভান্ডার আজ আমার কাছে
খোলা। অন্য সব কিছু যেন তুচ্ছ হয়ে গিয়েচে।
একদিন আমার শাশুড়ী বল্লেন — ও বৌমা, তোমাদের গাঁয়ের একটি ছেলে আমাদের গ্রামে হরি কলুর বাড়ীতে এসে চাকরি করচে। বামুনের ছেলে, দিব্যি চেহারা। কিন্তু বাপু, কলুবাড়ী জল তোলে, গরুর জাব কাটে, এ আবার কেমন কথা! বড্ড গরীব বোধ হয়। আমি দেখিনি, কে কাল বলছিল ঘাটে। বল্লে বৌমার দেশের লোক। যেদিন শুনলাম, সেইদিনই পথে নসুমামার সঙ্গে দেখা। কিন্তু প্রথমটা চিনতে পারিনি। নসুমামার মাথায় বড় বড় চুল, পরনে শাড়ী, আধ ঘোমটা দেওয়া, হাতে কাঁচের চুড়ি, মেয়েলি বেশ, অথচ মুখে ঈষৎ গোঁফ-দাঁড়ি। আমার হাসি পেল ওর অপরূপ বেশ দেখে। আমায় দেখে মেয়েলি সুরে বল্লে — ও পাঁচী, ভাল আছিস তো ভাই?
আমি অবাক হয়ে বল্লাম — তোমার এ কি বেশ নসুমামা?
নসুমামা অদ্ভুত হাসি হেসে বল্লে — এই, থাকলেই হলো একরকম।
তুমি নাকি কলুবাড়ী বাসন মাজো, জল তোলো?
দোষ কি?
তুমি তা ভালো বোঝো।
বৃদ্ধা শাশুড়ী সেই শ্রাবণ মাসে দেহ রাখলেন। দিন-দশেক জ্বরে ভুগে গভীর রাত্রে মৃত্যুর কিছু পূর্বে অশ্রুভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে বল্লেন — তোমাকে কার কাছে রেখে যাচ্চি মা?
বৃদ্ধার আকুল সুরে মনে ব্যথা বাজল আমার। তাঁর জ্বরশীর্ণ হাত-দুটি ধরে বল্লাম — কেন, আমার সোনার চুড়ি আছে, এক বিঘে আমন ধানের জমি আছে — ভাবনা কি মা আমার? কিছু ভেবো না আমার জন্যে।
বিষয়ী লোককে বিষয়ের ভাষার সান্ত্বনা দিই। আমি জানি যাঁর কাছে আমি আছি, তিনি আমায় কোনোদিন ফেলবেন না, চরণে স্থান দেবেনই।
নসুমামার সঙ্গে দেখা আবার একদিন। সে একগাদা কাপড়-সেদ্ধ নিয়ে ঘাটে যাচ্ছে কাচতে।
আমি বল্লাম — ও-সব কাজ আমায় দাও নসুমামা। আমি তোমায় করতে দেবো না।
জোর করে সেগুলো তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নিজে কেচে দিলাম। আমার চোখের সামনে ও-সব খাটুনি খাটতে দেবোনা ওকে। বল্লাম — হরি কলুর বাড়ী গোয়াল পরিষ্কার আমি করে দেবো।
না পাঁচী, লক্ষ্মীটি, লোকে কি বলবে?
আমি গ্রাহ্য করিনে।
আমি করি।
মিথ্যে কথা, তুমি গ্রাহ্য কর না, কলুবাড়ী বাসন মাজচো অথচ —
পাঁচী, এ সব তুই বুঝবিনে। ওসব করিসনে কক্ষনো।

ওর কথা সান্যাল জ্যাঠাকে বলতে তিনি বড় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন ওকে দেখবার জন্যে। হরি কলুর বাড়ীর পেছনে একটা পুকুর, পুকুরের চারিধারে আম কাঁঠালের বাগান। তারই একটা গাছতলায় দেকা গেল ও চোখ বুজে বসে। সেই থেকে সান্যাল মশায়ের সঙ্গে ওর ভাব হয়ে গেল। যোগবাশিষ্ঠের দলে ভিড়ে পড়লো।
সান্যাল জ্যাঠা বলেন — ছেলেটি শুদ্ধসত্ত্ব।
শীতের প্রথমে কলুপাড়ায় কলেরা দেখা দিল। একদিন আঠারটার কলেরা হলো, পাঁচটা মরে গেল। নসুমামা কি ভীষণ পরিশ্রম করে সেবা শুরু করলে। হরি কলুর ছোট ভাই ওঁর সেবাতেই নাকি বেঁচে উঠলো। রাত্রে ঘুমোয় না। নিজে হাতে রোগীদের গা ও বিছানা পরিস্কার করে।
কলেরায় কলুপাড়া উজোড় হয়ে গেল — ধরলে কিছু দূরে মুচিপাড়াকে। ভয়ে তখন মুচিপাড়ার অনেক লোক পালিয়েছে। বুড়ো হিড়ু মুচি একদিনের অসুখে মারা গেল। কিন্তু তখন এমন ভয় হয়ে গিয়েচে সকলের, মড়া ঘরের মধ্যে পড়ে রইল সারাদিন, কেউ ফেলতে চায় না। সন্ধ্যের পর নসুমামা একা গিয়ে ঠ্যাঙে দড়ি বেঁধে ফেলে দিয়ে এল খালের ধারে শ্মশানে।
যোগবাশিষ্ঠের আসরে একথা শুনে আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। আমিও যাবো নসুমামাকে সাহায্য করবো। লোকে যে যা বলে বলুক গে।
জ্যাঠামশায় হেসে বল্লেন — মা, এ কাজ তোমার নসুমামার। তোমার জন্যে নয়। সব কাজে অধিকারী ভেদ আছে।
কেন? আমার অধিকার জন্মায়নি?
তোমার বুড়ো শাশুড়ী মরে গিয়েচে, জগতে কি আরও বুড়ো হাবড়া নেই?
আপনি বলুন নসুমামাকে। ও আমাকে নিতে চায় না কোন কাজে। আমি যাবো জ্যাঠামশায়।

এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন নসুমামা গ্রাম ছেড়ে চলে গেল। কলুপাড়ার সবাই হায় হায় করতে লাগলো। খুড়শাশুড়ী বল্লেন — ভালোই হলো চলে গেল সুবুদ্ধি হয়েচে। বামুনের মুখ অমন করে হাসাতে হয়? ছিঃ ছিঃ —
তারপর মুখ টিপে বল্লেন — বৌমার বাপের বাড়ীর লোক। খুব কষ্ট হয়েচে বৌমা তোমার — না? যখন-তখন দেখা হোত তো! অন্য গাঁ থাকতে এ গাঁয়ে এসেছিল সেজন্যই হয়তো, তবুও তো দেশের ঘরের লোক একটা।
ছিলে-খোলা ধনুকের মত সটাং হয়ে বলে উঠি — নিশ্চয়ই। আমার কষ্ট তো হবারই কথা।
হরি কলু একদিন সান্যাল জ্যাঠার কাছে বল্লে — অমন মানুষ হয় না। ছোট ভাইটা বেঁচে উঠলো পায়ে ধরতে গেলাম, বলি তুমি ব্রাম্ভণ, আমার ঘরে হেনস্থা কাজ করতে দেবো না। দু’মাসের মাইনে বাকি, একটা পয়সাও নিয়ে গেলেন না যাবার সময়। হঠাৎ পালিয়ে গেলেন। আমায় যেন ক্ষ্যামা করেন তিনি।
হাত জুড়ে সে উদ্দেশে প্রণাম করলে।
আবার ফাল্গুনে বনে বনে ফুল ফুটেছে। আবার কোকিলের ডাক পথে পথে। মুচুকুন্দ চাঁপার সুগন্ধে ঘাটের রানা ভুরভুর করে। আমি একদিকে যেন সম্পূর্ণ নিঃস্ব। জ্যাঠামশায়ের বৈঠকখানায় যোগবাশিষ্ঠ শুনতে যাই রোজ বিকেলে। সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে রিক্ত হয়েই বোধ হয় সেখানে পৌঁছুতে হয়।

—- o —- o —- o —-

[ছবিঃ অরূপ দাস] 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *