একটি আষাঢ়ে গল্প
— অভিষেক বব চক্রবর্ত্তী
সরু গলিটার গা ঘেঁষে, ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে ছরছর করে পেচ্ছাপ করছিল লোকটা। শ্যাওলা ধরা দেওয়ালটায় পানের পিক ফেলল। পেচ্ছাপের ঝাঁঝালো এমোনিয়ার গন্ধে আগে নাক জ্বালা করতো তার। আজকাল আর করে না। লোকটার পাশ দিয়ে চলে যেতে যেতে সে তাকালো একবার লোকটার দিকে, লোকটা কেমন অদ্ভূত দৃষ্টিতে কিছু খুঁজছিল, কিন্তু পেলো বলে মনে হয় না। সন্ধ্যে থেকেই খুব ঘুড়তে ইচ্ছে করে তার, এ গলি, সে গলি পেড়িয়ে, প্রাচী সিনেমা হলের পাশ দিয়ে বেড়িয়ে, এসে দাঁড়ায় ওভার ব্রীজটার উপরে। দেখতে থাকে পায়ের তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক বাস, ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার। সব্বাই কত্ত ব্যাস্ত, শুধু তারই কোনও কাজ নেই। অখণ্ড অবসর। দেখতে থাকে ইঁদুর দৌড়ে ব্যাস্ত থাকা মানুষের দল… রাস্তার এপাশ-ওপাশ করছে, কিন্তু এই ওভার ব্রীজ প্রায় ব্যাবহারই করে না কেউ। সাদা-নীল এই শহরে রঙ ওঠা, মর্চে ধরা, খয়েরী রঙ এর এই ওভার ব্রীজটা কেমন যেন বেমানান লাগে তার। ওভার ব্রীজের একদিকে শেয়ালদা স্টেশন দেখা যায়। অন্যদিক ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলেই জেম সিনেমা। শুনেছিল, তার জন্মেরও আগে ওখানে ফিল্ম দেখানো হত, কিন্তু, অনেক বছর বন্ধ ছিল। বছর দুয়েক আগে খুব ভালো একটা ইনস্টলেশন আর্টের এক্সিবিশন হয়েছিল। গিয়েছিল সে, রূপের হাত ধরে। হাতের মধ্যে হাত নিয়ে রূপ ঘুড়িয়ে দেখিয়েছিল পুরোটা। তারপরে, তিনতলার ওই ফ্লুরোসেন্ট আর্টের ঘরে নিয়ে গিয়েই তার নীচের ঠোঁটে প্রথমে আলতো করে কামড়ে দিয়েছিল রূপ। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রথমে চমকে গিয়েছিল সে। পরে নিজেই এগিয়ে গিয়েছিল রূপের দিকে। রূপের কামড়ে ঠোঁট কেটে রক্ত বেড়িয়েছিল তার। তবুও খুব তৃপ্তি হয়েছিল, ভালোলাগার রেশ লেগেছিল জিভে লাগতে থাকা নোনতা রক্তের স্বাদে। বছর দুয়েক আগেকার কথা, এখনও যেন মনে হয়, এই তো, সে দিন। আচ্ছা, রূপ কি এখনও তার কথা ভাবে? তার কথা একবারের জন্যেও মনে পরে তার?
রোজ রাত ন’টায় সে এসে পৌঁছায় শেয়ালদা স্টেশনে, ট্রেনে উঠে পড়ে, নামে ব্যারাকপুরে। আস্তে আস্তে হেঁটে যায় সেই লোহার ব্রীজটার দিকে। না, নিজের ইচ্ছেয় সে যায় কি না, জানে না। কিসের যেন আকর্ষনে সে ওদিকেই চলতে থাকে রোজ। ব্রীজটার ওদিকটায় পুরোই অন্ধকার, খুব একটা কেন, কোনওদিন সে কোনও লোককে দেখেনি। সে আর রূপ মাঝে মাঝে ব্রীজে উঠতো। একান্তে, নিরিবিলিতে নিজেদের কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতো তারা। সেই পুরোন জায়গাগুলোই বারে বারে ঘুড়ে দেখে সে। অতীত নিয়ে চলা ছাড়া আর তো কিছুই করবার নেই তার। ব্রীজটার একটা পাশ ভাঙ্গা ছিল। ওদিকটায় যেতে ভয় লাগতো তার। রূপ জোর করে, তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত ও দিকটায়।
বলতো, “নীচের দিকে দেখো।”
সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলতো “না না”
রূপ “ভীতু ভীতু” বলে ক্ষেপাতো তাকে।
বলতো “কিচ্ছু হবে না, আর, মাথা ঘুড়লে তো আমিই আছি”!!!
না, সে তাকাতে পারতো না। মুখ ঘুড়িয়ে সোজা রূপের বোতাম খোলা বুকে মুখটা গুঁজে দিত। বুকের ওম নিতে নিতে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরতো রূপকে।
রূপ হোহো করে হেসে উঠে বিলি কেটে দিত তার মাথায়, বলতো, “পাগল একটা”!!!
রূপের হো হো হাসি ছাপিয়েও বুকের ধুকপুকুনিটা শুনতে পেতো সে।
এই সব পুরোন স্মৃতি ঘিরেই দিন কেটে যায় তার। আর কি-ই বা করবে সে!!
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই চোখ পরে তার, ওই বড়ো ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে আট-টা চল্লিশ। তড়িঘরি ব্রীজ থেকে নেমে আসে সে। স্টেশনে যেতে হবে তো!!! কিছুক্ষণ বিরতির পর আবার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কিন্তু,তার আজকাল আর বৃষ্টির ছাট লাগে না গায়ে। ছাতা, রেইনকোট কিছুরই আর প্রয়োজন হয় না। বীরের মতো বুক-চিতিয়ে বৃষ্টি, ঝড়, রৌদ্রের মোকাবিলা করতে পারে সে এখন।
ঝলমলে আলো দেওয়া এই বড় শপিং কমপ্লেক্সের সামনে দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ শুনতে পেলো, ফোনে কেউ যেন বলছে, “দোহাই রূপ, আমার কথাটা শোনো। এরকম করে না। তুমি ব্রীজের ওখানেই থাকো, আমি এক্ষুণি ব্যারাকপুরে আসছি।”
বুকের জায়গাটা কেমন যেন করে উঠলো তার। রূপ… ব্যারাকপুর… ব্রীজ… নিছকই কি সমাপতন? না কি এখন এই ছেলেটাই রূপের… কেমন একটা অদ্ভূত লাগছিল তার। বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে তার। আগে তো এরকম হত না… এখন হয়। ছেলেটাকে কি ফলো করবে সে? বুঝতে পারে না ঠিক। মনে হয়, সে-ও তো ব্যারাকপুরেই যাবে। দেখুকই না সেখানে গিয়ে… সেই ব্রীজের ওপরেই তো সে উঠবে… সেই রেলিং ধরেই তো দাঁড়াবে!! সেই ভাঙ্গা রেলিং এর ধার, যেখানে তার শান্তিনিকেতনি ঝোলাটা ঝুলছিল… লাল, সবুজ, নীল আর হলুদ রঙের সুতোর কাজ করা সেই ঝোলাটা, গায়ে কুঁচি কুঁচি কাঁচের টুকরো লাগানো। ঝোলার ভিতরে থাকা বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। কুড়িয়ে নিতে গিয়েছিল পরে, কিন্তু, আর নেয়নি সে। ওখানেই ফেলে রেখে এসেছিল। পরে কেউ হয়তো কুড়িয়ে নিয়েছিল। ব্যাগটা খোঁচা লেগে ছিঁড়ে গিয়েছিল। সেটা আর ফিরিয়ে নেয়নি সে। ক’দিন হাওয়ায় পতাকার মতো উড়তো। ফাঁকা জায়গা, তাই হাওয়াও অনেক বেশি। তারপরে, ঝড়ে, জলে… কোথায় গেছে এখন, কে জানে!!!তবে ব্যাগটা এখনও মিস করে সে। সবচেয়ে পছন্দের ব্যাগ ছিল যে!!
আর দেরী না করে সে পিছু নেয় ছেলেটার। রোগা, ফর্সা, টিঁকালো নাক, গালে হাল্কা দাড়ি ছেলেটার। রূপের পছন্দ বুঝি আজকাল এরকমই হয়েছে!! আগে তো এত রোগা ছেলেদের রূপ পছন্দই করতো না! পছন্দ করত না গালের দাড়িও। অবশ্য সময় সবই পরিবর্তন করে দেয়। হাল্কা করে একটা লাফ দিয়ে সে উঠে পড়লো ট্রেনে। ছেলেটার কম্পার্টমেন্টেই উঠল সে। মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে ছেলেটার। সুশ্রী মুখ। এই ভিড়ের মধ্যেও অনেকেই তাকাচ্ছে ছেলেটার দিকে। ছেলেটার ভ্রুক্ষেপ নেই। ছেলেটার গাল বেয়ে জলের রেখা, বার বার মুছছে সে। খারাপই লাগছে তার। আবারও কি সেই একই ঘটনা ঘটতে চলেছে! কে জানে!!! তাই তো বলে, “স্বভাব যায় না ম’লে”।
ট্রেন ব্যারাকপুরে ঢুকতেই লাফিয়ে নামলো সে স্টেশনে, প্ল্যাটফর্ম পেড়িয়ে দৌড় লাগালো সেই ভাঙ্গা ব্রীজটার দিকে। একেই বলে সমাপতন! এতদিন সে শুধুই শুনে এসেছিল, কিন্তু, আজ মিলিয়ে নিলো। সত্যি, সমাপতন!! সেই ছেলেটাও ওই দিকেই যাচ্ছে। তবে, তবে কি এই রূপই সেই রূপ!!! ছেলেটাকে পিছু নিয়ে, সে-ও পৌঁছে যায় সেই ব্রীজে। তার আর রূপের সেই ব্রীজ। তাদের গোপন ভালোবাসার সাক্ষী সেই ব্রীজ। তাদের আবেগ-ভালোবাসা-ঘনিষ্ঠতা-আশ্লেষের স্মৃতি জড়ানো সেই ব্রীজ!!! তার মানে, সে রূপের জীবন থেকে হারিয়ে যাবার পরেই রূপ আবার নতুন কাউকে নিয়ে এখানে আসতো, এখানেই সে সব কিছু হতো, যা একসময় শুধুই সে করেছে রূপের সাথে!! নাহ, এখন আর রাগ হয় না তার। কিন্তু, দিনের পর দিন চলে আসা এই খেলাটা তো বন্ধ হওয়া দরকার!
ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে ব্রীজের ভাঙ্গা দিকটায় এগিয়ে গেলো সে। হ্যাঁ, রূপ আজকেও সেই ভাবেই রেলিংটার ধারে দাঁড়িয়ে… শুধু… শুধু তাকে দেখেই চমকে উঠেছে রুপ… “তু… তু… তুমি?”
সে হেসে এগিয়ে যায় রূপের দিকে। বলে, “চেহারাটা আগের থেকে খোলতাই হয়েছে তো!! জীম জয়েন করেছ বুঝি? ভালোই!!”
রুপ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আস্ফুটে বলে ওঠে, “ বিশ্বাস করো, বিশ্বাস করো, সেদিন ইচ্ছে করে করিনি আমি, বিশ্বাস করো”
“তুমি কাকে কি বলছো রূপ? ঠিক আছ তো তুমি?” ছেলেটা এসে জিজ্ঞেস করে রূপকে।
রূপ আঙ্গুল দিয়ে কিছু একটা দেখাতে চায়, কিন্তু, রূপের হাত কাঁপছে।
রূপ আবার বলে ওঠে, এবার চিৎকার করে, “বিশ্বাস করো, আমি ইচ্ছে করে করিনি কিছুই, বিশ্বাস করো!!! সে দিন রেলিং-টা ভিজে ছিল, বিশ্বাস করো, বেসামাল হয়ে তো তুমিই পা পিছলে…”
হিসহিস করে বলে ওঠে সে, “রূপ, পা পিছলে নয়, আমি নীচে পরে যাওয়ার পরেই তুমি হেসে উঠেছিলে, মনে আছে?”
“না না, অভীক, না, বিশ্বাস করো” বলতে বলতেই রূপ পিছতে থাকে।
ছেলেটা কিমকর্তব্যবিমূঢ়, অভীককে তো রূপ ছাড়া কেউ দেখতেই পাচ্ছে না!!! ছেলেটা শুধু বুঝতে পারে, রূপ কিছু একটা দেখে ভয় পাচ্ছে… কিন্তু, এ কি!!! ছেলেটা সতর্ক করবার আগেই রূপের শরীরটা ব্রীজের উপর থেকে ফেলে দেওয়া সিগারেটের মতো কয়েক পাক ঘুড়ে পড়লো গিয়ে নীচে, জমাট অন্ধকারের ভিতরে।
এই শরীরবিহীন অবস্থায় অভীকের সেরকম আনুভূতি আর নেই কিছুই, তবুও, কোথাও যেন নিজেকে খুব হাল্কা লাগছে। অন্ধকারেই সে দেখতে পাচ্ছে, রূপের দোমড়ানো শরীরটা। তরমুজের মতো ফেটে ছড়িয়ে গেছে মাথাটা…
হতভম্ব ছেলেটাকে পিছনে ফেলে অভীক নেমে আসে সিঁড়ি বেয়ে, ছেলেটা মনে হয় যেন, কপাল এর ঘাম মুছছে, মুছবেই। বারবার মোবাইলে তোলা সেই অন্তরঙ্গ ছবি দেখিয়ে, এই ছেলেটার থেকেও কত টাকা শুষেছে রূপ, কে জানে!! হয়তো, সেদিনের মতো এই ছেলেটাও আজকে মোবাইলে কেড়ে নেওয়ার জন্যে ধ্বস্তাধস্তি করতো!! হয়তো, আজকেও রূপ সেদিনের মতোই, তার মতোই এই ছেলেটাকেও…
গল্পের বইয়ে পড়েছিল অভীক, ভুতেদের শরীর নেই, তারা না কি হাল্কা, আজ সে সত্যি-ই হাল্কা অনুভব করছে নিজেকে। পূবালী হাওয়ায় যেন ভেসে যাচ্ছে সে।
[ছবিঃ প্রিয়াঙ্কা ভদ্র]