একটি বই, কালেনবাখ, গান্ধী, মোদী এবং উভকামিতা
— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন
“বৈষ্ণবজন তো তেনি কহিঁয়ে যে পিঁর পরায়ি জানে রে”
আমাদের ভারতপিতার দর্শন মেনে যদি আমাদের দেশনেতারা নাগরিকদের দুঃখকষ্ট নিয়ে ভাবতেন, তাহলে দেশটা হয়তো পাল্টাতো আরেকটু। কিন্তু সত্যি কি তা হওয়ার? কয়েকদিন আগের ঘটনা, বিজেপির এক নেতা, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা ব্যানার্জিকে হিজড়ে হিসেবে অভিহিত করলেন। আমাদের ভারতীয় রাজনীতিতে এই নোংরামো নতুন নয়। মনে আছে কয়েকমাস আগে তৃণমূলের এক নেতাও শ্রী নরেন্দ্র মোদীর তালি বাজানোকে ঠিকড়ির সাথে তুলনা করে নজির সৃষ্টি করেছিলেন। নাহ! হিজড়ে শব্দটা নোংরা নয়, ঠিক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শ্রমিক, সাংসদ, ইত্যাদির মতো “হিজড়ে” বর্তমান সময়ের নিরিখে একটি পেশা। আপত্তি, কারন “হিজড়ে” পেশায় নিযুক্ত হাজার হাজার ভারতীয় নাগরিকদের কিছু নেতা “গালাগাল”এর সমার্থ মনে করছেন। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ক্ষোভ জন্মেছে ট্রান্স এবং হিজড়ে মহলে। এক ট্রান্স-অ্যাক্টিভিস্ট শুনেছি আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদীর কাছে এ বিষয়ে বিচার চাওয়ার কথা ভাবছেন। ভাবনাগুলোর শুরু তখন থেকেই। কে এই মোদী? ইনি কি এই বিচার করার জায়গায় আদৌ দাঁড়িয়ে আছেন? নাকি তিনিও মনে মনে তার দলের নেতাকে সমর্থন করেন? প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে অভিযোগ জানাতে গেলে এখন “ছেলে”, “মেয়ে” ব্যাতিত অন্যান্য হিসেবেও নিজের পরিচয় দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তা কি প্রধানমন্ত্রীর সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ? নাকি সুপ্রিমকোর্টের রায় মেনে চলার বাধ্যতামাত্র? সুপ্রিমকোর্টের নালসা রায়ের আগে কি এইভাবে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ জানানো যেত? উত্তরঃ নাহ! মাঝেসাজে অর্থমন্ত্রী শ্রী অরুণ জেটলি ৩৭৭ ধারার বিরুদ্ধে মুখ খুললেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর তরফে এ বিষয়ে কোন ইতিবাচক বিবৃতি পাওয়া যায়নি। তিনি সম্পূর্ণভাবেই মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। সম্প্রতি ইউনাইটেড নেশান্স-এর মিটিং-এ ভারতকে ৩৭৭ ধারা অপসারণ করতে বললে ভারতের তরফে জবাব ছিলো এই, যে যেহেতু এখনও বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে শুনানি বাকি, তাই সরকার এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ৩৭৭ এখন আর আমাদের চোখ রাঙায় না, অথচ সুপ্রিমকোর্ট তার পূর্ববর্তী ৩৭৭ রায়ে দিল্লী হাইকোর্টের রায়কে নাকচ করার সময় এটাই বলেছিলেন, যে আদপে কোন ধারাকে অপসারণ করার দায় সরকারের, সংসদে এ নিয়ে বিল পাশ করে রায়টিকে পালটানো যেতে পারে। কোর্ট এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চায়না। কিন্তু যৌন-লিঙ্গ-প্রান্তিক মানুষদের অধিকার রক্ষায় সরকার আদৌ কিস্যু করেনি। আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী, তিনি কি সত্যিই হস্তক্ষেপ করবেন, যাতে “হিজড়ে” অথবা অন্য কোন প্রান্তিক গোষ্ঠীর পরিচয়কে গালাগাল হিসেবে ব্যাবহার না করা হয়, তার উদ্দেশ্যে? উত্তরটা খুঁজতে, এসো বন্ধুরা, আমরা কয়েক বছর আগে চলে যাই।
সময়টা ২০১১ সালের মার্চ-এপ্রিল। পুলিৎজার পুরষ্কারবিজয়ী শ্রী জোসেফ লেলিভেল্ড প্রকাশ করেছেন একটি বই “গ্রেট সোলঃ মহাত্মা গান্ধী অ্যান্ড হিস স্ট্রাগল উইথ ইন্ডিয়া”, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “মহান আত্মাঃ মহাত্মা গান্ধী এবং ভারতকে সাথে নিয়ে তার সংগ্রাম”। বইটিতে একটি চিঠি প্রকাশ করা হয়। যেখানে গান্ধীজি তার সাউথ আফ্রিকান বন্ধু হার্মেন কালেনবাখ-কে লিখছেন “তুমি যেন কেমন আমার এই পুরো শরীরটার উপরে কব্জা করে নাও, … এ যেন এক প্রতিহিংসাপরায়ন দাসত্ব”। (How completely you have taken possession of my body, … This is slavery with a vengeance.) আর এই বাক্য নিয়েই আমেরিকা এবং ইউরোপে কিছু খোলামেলা আলোচনা শুরু হলো। ইংরেজ দার্শনিক এন্ড্রু রবার্টস “ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল”-এ মন্তব্য করলেন, যে গান্ধীজির শয়নকক্ষে তার খাটের উল্টোদিকে শুধুমাত্র একজনেরই পোরট্রেইট ছবি আছে, আর তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং হার্মেন কালেনবাখ । প্রসঙ্গত গান্ধীজি এবং ক্যালেনবাখ জোহানেসবার্গে প্রায় দু’বছর একসাথেই ছিলেন। আলোচনা শুরু হলো গান্ধীজি কি তাহলে উভকামী বা বাইসেক্স্যুয়াল ছিলেন? আর এর উত্তরে ক্ষোভে ফেটে পড়লো ভারতের কিছু মিডিয়া। লেলিভেল্ড যদিও তার বক্তব্যে জানালেন, যে এই কথাটার ভুল মানে দাঁড় করানো হচ্ছে। পুরো বইতে “বাইসেক্স্যুয়াল” থবা উভকামী শব্দটা কোথাও ব্যাবহার করা হয়নি। অনেকের মতে লেলিভেল্ডের এই বক্তব্য চাপের মুখে নতিস্বীকার ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু ততোক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে, আর যায় কোথা, ভারতে প্রকাশ পাওয়ার আগেই ভারতের রাজ্যগুলি বইটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে লাগলো। সবার আগে যে রাজ্য বইটি নিষিদ্ধ করলো তার নাম গুজরাট, হ্যাঁ ঠিক ধরেছো, সমকামীতার (যেহেতু সরকার সমকামিতা আর উভকামিতার পার্থক্য বোঝেনা আদৌ) ইঙ্গিত থাকায় বইটিকে নিষিদ্ধ করলো গান্ধীজির এবং নরেন্দ্র মোদীজির রাজ্য, গুজরাট, তখন মোদীজিই মুখ্যমন্ত্রী। আর শুধু এখানেই শেষ নয়, মোদী জানালেন যে লেলিভিল্ডের ক্ষমা চাওয়া উচিৎ ভারতীয়দের কাছে তাদের অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্যে। তিনি তখনকার কেন্দ্রীয় সরকারকেও আহ্বান জানালেন, পুরো দেশে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্যে।
তাহলে এই ছিলো সেই ছোট্ট ইতিহাস, অর্থাৎ আমাদের প্রধানমন্ত্রী “সমকামী”/“উভকামী” এই শব্দগুলিকে সম্মানসূচক মনে করেননা, এটা স্পষ্ট। অর্থাৎ আমরা যৌন-লিঙ্গ-প্রান্তিক মানুষেরা তার চোখে ঘৃণ্য। গান্ধীজির সেক্স্যুয়ালিটি নিয়ে গোটা একটা বই লেখা যায়। তাই সে প্রসংগে আমি যাচ্ছিনা। কিন্তু তার সেক্সুয়ালিটি যাই হোক না কেন, তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা কমবে কেন? আমি কি তাকে তার সেক্সুয়ালিটি দিয়ে চিনি? নিশ্চয়ই না। আমি তাকে চিনি এমন একজন মানুষ হিসেবে, যিনি সবাইকে ভালোবাসতেন, যিনি সংগ্রামের এক নতুন পন্থা শিখিয়েছেন গোটা পৃথিবীকে, যিনি আমার দেশকে স্বাধীন করেছেন ব্রিটিশ শাসন থেকে। তিনি আমাদের সবার পিতা, আমাদের জাতির জনক। আমি যদি জানতে পারি আমার বাবা গে ছিলেন, তাতে আমার কোনরকম অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা নয়, আমি তাকে একটুকুও কম ভালোবাসবোনা, কম শ্রদ্ধা করবোনা। তিনি আমার “স্ট্রেইট বাবা” থেকে “গে বাবা” হয়ে যাবেননা মুহুর্তে। তিনি আমার শুধু “বাবা” ছিলেন, আর তাই থাকবেন।
তাই জাতির জনকের সেক্স্যুয়ালিটী নিয়ে ভাবাটাই, অথবা তা নিয়ে কথা বলাই অপ্রাসঙ্গিক। যে মানুষটা “সমকামী”, “উভকামী”, “হিজড়ে” ইত্যাদি শব্দকে নোংরা ভাবে, সে আসলে এই শ্রেণীভুক্ত মানুষদেরকেই নোংরা ভাবে। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী সেই গোত্রেরই মানুষ। জানিনা ৭ বছরে উনি কতোটা পাল্টেছেন। প্রধানমন্ত্রী পদটার একটা ভারিক্কী ব্যাপার আছে। চট করে যেকোন কমেন্ট সেখানে করা যায়না। কিন্তু আমার যে ট্রান্স অ্যাক্টিভিস্ট বন্ধু “হিজড়ে” শব্দের অবমাননা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করার কথা ভাবছেন, হয় তিনি এই ঘটনা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন, অথবা তার নিজের নাম ফাটানোর ইচ্ছে হয়েছে। তার প্রতি আমার খিকখিকে “বেস্ট অফ লাক”!!
[পুনশ্চঃ কাঁচালঙ্কার নিজস্ব ফেসবুক পাতায় পূর্বপ্রকাশিত এবং খানিক পরিবর্তিত ]