বৃহন্নলা

।।১।।

তস্মাত্ত্বং নর্তনঃ পার্থ স্ত্রী মধ্যে মানবর্জিতঃ।
অপুমানিতি বিখ্যাতঃ ষণ্ডবদ্বিচরিষ্যসি।।

“হে পার্থ, আজ থেকে তুমি নপুংসক হও”! ক্রুদ্ধ অপ্সরার এ হেন উচ্চারণে, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন ভীষণ দুঃখিত হলেন। বিনা অপরাধে এমন অভিশাপ!!
করজোড়ে শ্বেতবাহন বললেন “হে দেবী উর্বশী, আপনি এ হেন অভিশাপে আমায় অভিশপ্ত করলেন, কিন্তু,এর হেতু সম্পর্কে আমি অবগত নই। আমার অপরাধ কি,হে দেবী”?
“ হে জিষ্ণু, তোমার পিতৃদেব দেবরাজ ইন্দ্রের আদেশানুসারে আমি আজ তোমার কাছে এসেছি এই অভিসারিকার বেশে!

তব পিত্রাভ্যনুজ্ঞাতাং স্বয়ঞ্চ গৃহমাগতাং।
যস্মান্মাং নাভিনন্দেথাঃ কামবাণবশং গতাম।।

আর তুমি আমায় পিতামহী সম্বোধনে প্রত্যাখ্যান করলে? হে ফাল্গুনী, কোনও কামাতুরা রমণী যখন কোনও সমর্থ পুরুষের কাছে আশ্রয় চায়, তাকে প্রত্যাখ্যান করা নপুংসোচিত কার্য। সেই হেতু, তুমি অভিশপ্ত হলে”।
অর্জুনের আচরণে বিব্রতা, ক্রুদ্ধা স্বর্গের অপ্সরা উর্বশী অন্তর্হিতা হলেন। বিমর্ষ, হতবাক, শোকাহত অর্জুন ক্ষেত্রজ পিতা ইন্দ্রদেবের শরণ নিলেন।
“হে পিতঃ, আপনি তো দেবরাজ,অন্তর্যামি। আপনি তো সকলই অবগত হয়েছেন। পিতামহ নৃপতি পুরুরবার পত্নী, দেবী উর্বশী সম্পর্কে আমার পিতামহী, পিতা। কি রূপে আমি তাকে নিজ শয্যায় স্থান দিতে পারি পিতা”?
“দুঃখ করো না ব্ৎস্য বিজয়। গন্ধর্ব চিত্রসেন আমায় সকল অবগত করেছেন। ঋষিকণ্যা উর্বশীর অভিশাপ খন্ডণ করা অসম্ভব, তা শিরোধার্য করো পুত্র। উর্বশীর এই অভিশাপ একপ্রকার তোমার মঙ্গলসাধনের জন্যই পুত্র।”
যারপরনাই বিস্ময়ে তৃতীয় পাণ্ডব বলে উঠলেন, “মঙ্গলসাধন? কিরূপে হে পিতা”?
“পুত্র, ভবিষ্যৎ কে দেখেছে? বলা কি যায়, কখনও আত্মগোপনের প্রয়োজন এলে? তখন এই অভিশাপই আশীর্ব্বাদ হয়ে ঝড়ে পড়বে গাণ্ডীবধণ্বা!পুত্র, তোমার মত সৎ-পুত্রের জননী পৃথা কুন্তী ধন্যা, ধৈর্য্যে তুমি ঋষিগণকেও জয় করেছো!”
“আপনি যেমন বলবেন। তবে, যদি অভয় দেন, একটি কৌতুহলের নিরসন ঘটাতে চাই পিতঃ”
“কি কৌতুহল? নির্ভয়ে প্রকাশ করো ধনঞ্জয়”
“আপনি উর্বশীকে ঋষিকণ্যা বললেন কেন পিতা”?
“সে এক কাহিনী পুত্র। ধৈর্য্যসহকারে শ্রবণ করো। পুরাকালে, হিমালয় পর্ব্বতের কোলে, কোন এক বদ্রীকাবৃক্ষের নীচে দুই অভিন্নহৃদয় যোগীপুরুষ তপস্যা করতেন, সাধনায় জীবন অতিবাহিত করতেন। তাঁরা হলেন নর এবং নারায়ণ। তপোবলে তারা তেজার্জন করে বহু অসুরকে হত্যা করেছেন। একটিমাত্র রথেই তাঁরা যুদ্ধে যেতেন, কখনও নর হতেন সারথী, নারায়ণ যুদ্ধ করতেন, আবার, কখনও বা নারায়ণ সারথী হতেন, নর করতেন যুদ্ধ। নর-নারায়ণের পরাক্রম সম্পর্কে ত্রিভুবন জ্ঞাত ছিলেন। একদিন তাঁদের আত্মসংযম পরীক্ষার হেতু আমি, দেবরাজ ইন্দ্র সহস্রাধিক সুন্দরী অপ্সরাদের পাঠালাম নর-নারায়ণের তপস্যা ভঙ্গের জন্যে। রম্ভা, মেনকা, ঘৃতাচী প্রভৃতি অনন্যরূপা অপ্সরারা গিয়েছিলেন। কিন্তু, কোনও ফল হল না। জাগতিক সৌন্দর্য্য বিমোহিত করতে অসমর্থ হল নর নারায়ণকে। তারা একে অপরের নেত্রে অনিমেষ চেয়ে রইলেন। অপ্সরাদের অবলোকন করে কামাতুর না হয়ে, স্থিরচিত্ত হয়ে রইলেন, এবং , নারায়ণ নিজ ঊরুতে বদ্রীকাবৃক্ষের পত্র নিঃসৃত আঠা দিয়ে এক পরমা সুন্দরী রমণীর চিত্র অংকন করলেন। সেই চিত্রের দিকে নর দৃষ্টিপাত করবামাত্র ঊরুতে অংকিত সেই চিত্র হতে এক রমণী বাহির হয়ে এলেন। পরমাসুন্দরী সে নারীর রূপে অপ্সরাদের সকলের রূপ ম্লান হয়ে গেলো। তার রূপে চারিদিকে ধন্য ধন্য পরে গেলো। নর-নারায়ণ আমাকে আশীর্ব্বাদস্বরূপ, উর্বশীকে দান করলেন। ঊরু হতে জন্ম হওয়ায় এই রমণীর নাম হল উর্বশী। তিনি দেবলোকের অন্যতমা সুন্দরী অপ্সরা। এই ভাবেই দুই পিতা নর এবং নারায়ণ হতে তোমার পিতামহীর জন্ম হয়েছিল পুত্র। এই কারণেই উর্বশীকে আমি ঋষিকণ্যা সম্বোধন করেছিলাম”।
কিঞ্চিৎ নীরবতার পর দেবরাজ ইন্দ্র আবার বলে উঠলেন, “পুত্র অর্জুন, এক মহাপ্রাক্রমশালী অসুরের পুনর্জন্ম হয়েছে। তাকে বধ করতেই এই মহাবীর্য নর এবং নারায়ণ পুনরায় ভূমিষ্ঠ হয়েছেন, ভূমির ভার লাঘবের অভিপ্রায়ে। বদরী-আশ্রমে যে নর-ঋষি তপস্যা করতেন,তিনিই তুমি পুত্র, এবং নারায়ণ-ঋষি স্বয়ং বাসুদেব কৃষ্ণ!

নরনারায়ণৌ যৌ তৌ পুরাণাবৃষিসত্তমৌ।
তাবিমাবনুজানীহি হৃষীকেশধনঞ্জয়ৌ।।”

নিজ জন্মের হেতু শ্রবণপূর্ব্বক ধনঞ্জয় অর্জুন দেবতাদের তুষ্ট করে একে একে প্রাপ্ত হয়েছিলেন আগ্নেয়, বারুণ, সৌম্য, বায়ব্য, বৈষ্ণব, ঐন্দ্র, পাশুপত এবং ব্রহ্মাস্ত্র। এরপর অর্জুন যাত্রা করলেন মর্ত্যলোকে।

।।২।।

গন্ধমাদন পর্বতে কৃষ্ণা এবং চার ভ্রাতার সাথে মিলিত হলেন অর্জুন। ইতোমধ্যে বনবাসে দ্বাদশ বৎসর অতিবাহিত হয়েছে, এবার ত্রয়োদশ বৎসরে অজ্ঞাতবাসের পালা পাণ্ডবদের। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করলেন তৃতীয় পাণ্ডবকে, “তোমার এই দেবতুল্য রূপ,গুণ,ব্যক্তিত্ব,বীরত্ব! কি উপায়ে আত্মগোপন করবে, ভ্রাতা অর্জুন”?
শ্বেতবাহন বললেন, “ হে অগ্রজ, আমার কড়া-পড়া হস্তদ্বয় আমি বলয় দ্বারা আচ্ছাদন করবো, হাতে শঙ্খবলয় পরিধান করবো, কর্ণে কুণ্ডল, এবং মাথায় বেনী রচনা করবো,

বেণীকৃতশিরা রাজন্নাম্না চৈব বৃহন্নলা।।

নাম নেবো বৃহন্নলা। অন্তঃপুরচারিনীগণকে নানা চিত্তাকর্ষক আখ্যায়িকা শুনিয়ে, নৃত্যগীতাদি পরিবেশন করে, বাদ্যযন্ত্রাদি শিক্ষা দিয়ে মনোরঞ্জিত করবো।”
মৎস্যরাজগৃহে প্রাগুক্ত বেশে প্রবেশ করে অর্জুন এই কথাই বলেছিলেন।

“গায়ামি নৃত্যাম্যথ বাদয়ামি ভদ্রো’স্মি নৃত্যে কুশলো’স্মি গীতে।
ত্বমুত্তরায়ৈ পরিদৎস্ব মাং স্বয়ং ভবামি দেব্যা নরদেব নর্তকঃ।।”

যদিও, বিরাটরাজ অর্জুনের অনুপম আকৃতি দেখে তাঁকে ক্লীব হিসেবে মনে করেননি। তিনি অর্জুনকে কোনও ছদ্মবেশী নৃপতিই ভেবেছিলেন। রাজাদেশে মহিলাগণ পরীক্ষা করে বৃহন্নলার ক্লীবত্ব সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হলে, তবেই বৃহন্নলা অন্তঃপুরকুমারীগণের সঙ্গীত-শিক্ষকরুপে নিযুক্ত হলেন। বৃহন্নলা অল্পদিনের মধ্যেই অন্তঃপুরে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠলেন।
অজ্ঞাতবাসের সমাপ্তিকাল সমাগত।আর মাত্র একদিন।এমন সময় ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা বিরাটরাজার গোধন হরণ করতে এসেছেন। মৎস্যরাজ বিরাট তাঁর সৈন্যসামন্ত নিয়ে সুশর্মার সঙ্গে যুদ্ধ যাত্রা করেন। ছদ্মবেশী যুধিষ্ঠির, ভীম, নকুল, সহদেব সকলেই গেলেন বিরাট্ রাজার সঙ্গে। রাজপুরী যোদ্ধাশূণ্য। সুযোগবুঝে বিরাটরাজের অনুপস্থিতিতে দুর্যোধনাদি কৌরবগণ হরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন মৎস্যরাজ্যের গোধন। সঙ্গে রয়েছেন পিতামহ ভীষ্ম, গুরু দ্রোণ, কৃপাচার্য্য, কর্ণ, অশ্বত্থামা প্রমুখ মহারথীরা। এই সংবাদপ্রাপ্ত হয়ে বিরাট-পুত্র রাজকুমার উত্তর তথা ভূমিঞ্জয় যুদ্ধে যাওয়া স্থির করলেন। বহু আস্ফালনপূর্ব্বক রাজকুমার উত্তর বললেন, “উপযুক্ত সারথি কেউ থাকলে, নিশ্চয়ই আমি কৌরবগণকে পরাজিত করে গোধন উদ্ধার করতাম। কিন্তু গত যুদ্ধে আমার সারথিটি নিহত হয়েছে। সারথি থাকলে আমি এরূপ যুদ্ধ করতাম, যে, ভীষ্ম-দ্রোণ সকলেই ভাবতেন, স্বয়ং অর্জুন গোরু উদ্ধার নিমিত্ত আবির্ভূত হয়েছেন।”
বালক রাজকুমার উত্তর ক্ষণে ক্ষণে নিজেকে অর্জুনের সাথে তুলনা করছিলেন, তখন সৌরিন্ধ্রীবেশ দ্রৌপদী বলেন, “হে রাজকুমার উত্তর, আপনাদের যে বৃহন্নলা আছেন, তিনি ধনুর্বিদ্যায় অর্জুনের শিষ্য। খাণ্ডব দহনের সময় এবং আরও অনেক ভয়ানক যুদ্ধে তিনি অর্জুনের রথের সারথি হয়েছেন। সুতরাং, তাঁকে যদি সারথি করা যায়, যুদ্ধজয় এক প্রকার নিশ্চিতই।”
উত্তরের কথায়, রাজকুমারী উত্তরা তার নৃত্যগুরুকে বললেন, “হে বৃহন্নলা, তুমিই আজ আমার ভাইয়ের রথের সারথি হয়ে তার সঙ্গে যুদ্ধে যাবে। আমি তোমাকে ভালোবেসে এরূপ অনুরোধ করছি। যদি তুমি আমার কথা না রক্ষা করো, তবে আমি প্রাণত্যাগ করবো।

অথৈতদ্বচনং মে’দ্য নি্যুক্তা ন করিষ্যসি।
প্রণয়াদুচ্যমানা ত্বং পরিত্যক্ষ্যমি জীবিতম।।”

প্রথমে অস্বীকৃত হলেও, বৃহন্নলারূপী অর্জুন শেষে সম্মত হলেন যুদ্ধে যেতে। বালক রাজকুমার উত্তর অন্তঃপুরে যেরূপ আস্ফালন করছিলেন, সম্মুখ-সমরে ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতিকে দেখে ভীত হয়ে পড়লেন। রথ হতে অবতরণ করে, পলায়োন্মুখ হলে, বৃহন্নলা রাজকুমার উত্তরের কেশ আকর্ষণ-পূর্বক তাকে রথে নিয়ে আসেন।অতঃপর বৃহন্নলা রাজকুমার উত্তরকে নিয়ে বনমধ্যস্থ শমীবৃক্ষের কাছে উপস্থিত হয়ে বৃক্ষস্থ কোটর হতে গাণ্ডীব, তীর প্রভৃতি অস্ত্র বের করে আনেন। বৃহন্নলা নিজ পরিচয় জ্ঞাপন করলে, আশ্বস্ত রাজকুমার উত্তর বৃহন্নলার সারথি-রূপে সমরক্ষেত্রে প্রবেশ করেন। অজ্ঞাতবাসের অন্তিমদিনে গোধূলীর শেষ সুর্যালোকে গাণ্ডীবধারী ধনঞ্জয় প্রবীষ্ট হন যুদ্ধক্ষেত্রে। বলাই বাহুল্য, কৌরব-পক্ষ সেদিন পরাজিত হয়। অনন্তবিজয় শঙ্খের ধ্বনি, গাণ্ডীবের টংকার-মুখরিত সমরক্ষেত্র ভবিষ্যৎ মহাসংগ্রামের পটভূমি রচনা করেছিল।

ছবিঃ ভুটান


<< কালিজা ২০২১ (৪র্থ বর্ষ) – সূচিপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *