ত্যাগী

      No Comments on ত্যাগী

পুরোনো বইগুলো ঘাঁটতে ঘাঁটতে বেরিয়ে এলো একটা ছোট্টো চিরকুট। তাতে লেখা, ” শোন্, ঠিক নটা কুড়িতে বড় ল্যাম্পপোস্টটার তলায় দেখা করিস। – তোর সূদোনদা।” এক লহমায় সরে গেল অতীতের পর্দা।

সূদোনদা-নামটা আমারই দেওয়া। তুমি কি আমায় আজও মনে রেখেছ সূদোনদা? তোমার আসল নাম রঘুনাথ। একদিন ভলিবল খেলার মাঠে তোমাকে ডাকতে গিয়ে রঘুদার বদলে সূদোনদা ডেকে ফেলেছিলাম। হঠাৎই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিলো। তুমি ভ্রূকুঁচকে নামটা সানন্দে গ্রহণ করেছিলে। তারপর থেকেই তুমি হস্টেলের সবার কাছে সূদোনদা। তুমি চাইতে সবাই তোমাকে এই নামেই ডাকুক। এমনকি সেক্রেটারি মহারাজও তোমায় এই নামে ডাকতেন। তাই কেউ তোমায় নাম জিজ্ঞেস করলেই তুমি এই নামটাই বলতে। হারিয়ে ফেললে তোমার আসল নাম। ত্যাগ করলে তোমার পূর্বনাম।

তুমি খুব ভালো ভলিবল খেলতে, ব্রতচারী গান করতে, ইতিহাসের লোক হয়েও কেমিস্ট্রি আর বাংলা ব্যাকরণ দূর্দান্ত পড়াতে। তখন আমাদের ক্লাস নাইন। তুমি প্রথম আমাদের মধ্যে এসেছিলে। খুব ছোটবেলায় তুমি বাবা মাকে হারিয়েছিলে বলে সন্ন্যাস নেবে ঠিক করেছিলে। তোমাকে সবসময় ঘিরে থাকতো ছেলেরা। তুমি শাসন করতে, রাগতে না। তুমি বকুনি দিতে, কিন্তু গলা চড়তো না, কিন্তু কাঁদিয়ে দিতে। তোমাকে আমরা সকলে ভালোবাসতাম। কিন্তু, তুমি যে আমাদের থেকে একজনকেই ভালবাসতে, তা সেই দিন বুঝতে পারিনি।

কিন্তু আজ অনুভব করি সূদোনদা, তুমি আমাকে আলাদাভাবে ভালোবাসতে। আর সেটা নেহাৎই স্নেহ নয় – প্রেম। আজ তা বুঝি। টুকরো টুকরো ঘটনা আজ আমায় নাড়া দেয়। হু হু করে ওঠে ভেতরটা। বেশ মনে পড়ে, আমার বিছানাতেই তুমি বসতে, আমার খাতা, আমার বই, আমার পেনই তুমি ব্যবহারের জন্য তুলে নিতে।

একদিনের কথা। সেটা এক গ্রীষ্মের দুপুরবেলা। সকালে স্কুল শেষ। দুপরে সবাই ঘুমোচ্ছে। এসময় হস্টেলের বাইরে বেরোনো বারণ। পুকুরে স্নান করে লুকিয়ে লুকিয়ে ফিরছি। আমার পরনে হাফ প্যান্ট, খালি পা, খালি গা, মাথায় ভিজে গামছাটা জড়ানো। হোস্টেলের কোণে আমবাগানে তোমার সঙ্গে সামনা-সামনি দেখা। এই সময় অনেকেই বাইরে থেকে এসে লুকিয়ে আম পাড়ে। তুমি তা দেখতে এসেছিলে। কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম আমি। তুমি আমার ডানহাতের কব্জিটা চেপে ধরলে। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলে আমার দিকে। দুজনেই চুপচাপ। কোনও কথা নেই, বকুনি নেই। কোনও প্রশ্ন করলে না। আজও মনে আছে তোমার সেই চাহনি। তোমার চোখ থেকে ঝরে পড়ছিলো কামাগ্নির বর্ষা। স্নাত হচ্ছিলো আমার সর্ব্বাঙ্গ। আমি মন্ত্রমুগ্ধ। তখন আমার কিশোর মন চাইছিলো তুমি আমায় জাপটে ধর।
কিন্তু তুমি তা করলেনা। অনেক্ষণ পর হাত ছেড়ে দিয়ে বললে, “যা ঘরে যা।”

খেলটা তারপর থেকেই জমে গেল। তুমি পড়াতে এলেই মনটা আনচান করে উঠতো। তুমি কি আর বুঝতে পারনি? ঠিকই বুঝেছিলে। সাধুপথযাত্রী বলে নিজেকে সংযত করে রেখেছিলে।

সেইরাতে নটা কুড়িতে আমি দেখা করেছিলাম। তুমি আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলে, “অন্য সেন্টারে যেতে হবে রে আমাকে! কাউকে বলিস না। জানাজানি হলেই বিপদ। তোর বন্ধুগুলো গোল বাঁধাবে। তাই সেক্রেটারি মহারাজ ব্যাপারটা জানাজানি হতে দিতে চাইছেননা। সন্ন্যাসীদের মায়াটান রাখতে নেই।”
আমার গলা রুদ্ধ, চোখ অশ্রু ছলছল। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। শুধু ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাচ্ছ?” তুমি বল্লে, “লাখুটি, নাগাল্যাণ্ডের লাখুটি। ” তুমি আরও কত কথাই না বললে! আমি শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম। কিচ্ছু কানে ঢোকেনি। তুমি চলে গেলে। জানিনা কে কতটা কষ্ট পেয়েছিলো, কালের স্রোত সব ভুলিয়ে দিলো।

তুমি বীর সন্ন্যাসীর ভক্ত। তুমি পিছুটান রাখলে না। পরে সন্ন্যাস ধারণ করে নতুন সন্ন্যাস নাম নিয়েছ। কি নাম নিয়েছ জানার আগ্রহ রাখিনা। কিন্তু, খবর পেয়েছি মঠের সবাই তোমাকে আজও সূদোন মহারাজ বলেই চেনে, জানে ও ডাকে। হে ত্যাগী! আমি তোমাকে পথভ্রষ্ট করতে চাইনা। আমার অভিমান একটাই, এতটা ত্যাগই করলে যখন, তখন আমার দেওয়া নামটা ত্যাগ করলেনা কেনো?

ছবিঃ অর্ক ঘোষ

<< কালিজা ২০২২ (৫ম বর্ষ) – সূচীপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *