[শুরুর আগেঃ
ইন্দ্রনীল ঘোষ, কোলকাতার লিটিল ম্যাগ দুনিয়ায় বেশ চেনা একটি নাম। অনেক বিশিষ্ট মানুষের সাথে কাজ করেছে ইন্দ্র, অনেক লিটিল ম্যাগাজিনে লিখেছে, কখনো গল্প, কখনো কবিতা, আবার কখনো নতুন ধরণের কোন সাহিত্য মাধ্যম। সম্প্রতি একটি ছবিও বানাচ্ছেন তিনি, গুজবে প্রকাশ। শিল্পের শৈল্পিকতা, শিল্পীর ভাবনা, আর আন্দোলনের প্রগতি একসাথে এসে মেশে তার সৃষ্টির মধ্যে। তাই হয়তো অনেক পাঠক শুধু তার লেখার জন্যেই মুখিয়ে থাকে পথ চেয়ে, হয়তো আমিও। এই সুযোগে আবারও ধন্যবাদ তোমাকে লেখাটি আমাদের প্রকাশ করার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে। আরো কাজ করা যাবে একসাথে, এই আশাটুকু নিয়ে এখানেই আপাতত থামছি।]
দৈত্য
ইন্দ্রনীল ঘোষ
।। ১ ।।
“তা ধিন ধিন ধা.. তা ধিন ধিন ধা.. না তিন তিন না.. তেটে ধিন ধিন ধা”
গ্রীষ্মকাল। ডাইরিয়া রুগির উস্কোখুস্কো চুলের মতোই পৃথিবী ধুঁকছে। আর সেই দিগন্ত ছড়ানো অবিন্যাসের মধ্যে জায়গায় জায়গায় ঘনিয়ে আসা তাপের জটলা। উত্তাপ তার গল্প-মুখ খুলে দিয়েছে।
বিকম্ব আর একম্ব পাথুরে মাটির ওপর গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। আচমকা উত্তর থেকে আসা এক ভয়াবহ খিন খিনে আওয়াজে আরেকবার কান পাতলো। অমনি –
“তা ধিন ধিন ধা.. তা ধিন ধিন ধা.. না তিন তিন না.. তেটে ধিন ধিন ধা”
গলার আওয়াজটা যেন শুনেছে আগে তবু চিনতে পারে না তারা।
বিকম্ব আদ্ধেক ভুরু কুঁচকে একটু গম্ভীর গলায় বলল, “কোনো চেনা আওয়াজের যমজ। সীতা অউর গীতার মতো…”
এই বিকম্বের এক বদ-অভ্যাস। লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দ্যাখার। আর তারপর কোনো সিরিয়াস আলোচনার সময়, মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতিকে “সীতা অউর গীতা”, “শোলে”, “দিলওয়ালে দুলহনিয়া” বানিয়ে দেওয়ার। দৈত্যদের মধ্যে সিনেমা দ্যাখার চল নেই। তারা প্রথম দিকে বিকম্বের মুখ থেকে এই অদ্ভুত নামগুলো শুনে কৌতূহলী হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝলো, কৌতূহলের উত্তরে আগামী দু’ তিন ঘন্টা ধ’রে বিকম্বের বকবক আর নাচন-কোঁদন মুখ বুঝে হজম করতে হবে, সাবধান হলো। বিকম্ব ওই সব নাম তুললেই সবাই তেড়ে আসত। বিকম্বকে শিকারে পাঠানো বন্ধ হলো। খুব স্বাভাবিক। যে শিকার বাকিরা নিমেষের মধ্যে বীর বিক্রমে ক’রে ফেলতে পারত, সেই শিকারেই বিকম্ব ঢুকত পা টিপে টিপে, বাড়ির পিছন দরজা বা জানলা গ’লে। মানুষ মারার আগে অন্তত ঘন্টা কয়েক ঘাপটি মেরে টিভি সে দেখবেই।
তাই তো শিকারের বদলে তারা ভাইয়েরা আজ এলো মাটি কুপোতে। শক্ত পাথুরে মাটির ওপর গ্রীষ্মকালে শুয়ে ঘাম ঝরাতে হয়, সেই ঘামে নরম হবে মাটি, তারপর এক লম্বা ঘুমের পর একটু আধটু গড়াগড়ি খেলেই সে নরম মাটি একদম তুলোর মতো পেঁজা পেঁজা। তখন তাতে মহুয়া লাগাও হে… সামনের পরবে কাজে লাগবে।
“হৃম্ব কোথায় রে?” একম্ব আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে জিজ্ঞেস করে।
– কী ক’রে জানব? আমিও তো ঘুমোচ্ছিলুম।
– বোধহয় ওই আওয়াজটা শুনেই গেছে। শিকার-টিকার হতে পারে। চ’ না একবার দেখে আসি।
কিন্তু কোথাও যেতে হয় না। উঠে দাঁড়াতেই, সামনের কাঁঠাল গাছটা ছাড়িয়ে তাদের চোখ যায় একটু দূরে টিলাটার দিকে। পাথুরে টিলা। তার মাথার পিছনে গোলগাল সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে। আর সূর্যকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ওই খিনখিনে আওয়াজের তালে তালে যে নেচে চলেছে, সে আর কেউ নয় – স্বয়ং হৃম্ব। বিশাল তার পায়ের চাপে পাথর ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে টিলার নিচে। টিলা ছোট হয়ে আসছে ক্রমশ।
– হৃম্ব!
প্রায় প্রতিবর্ত ক্রিয়ার মতো, একম্ব আর বিকম্ব একে অপরের মুখ চায়। এগিয়ে আসে। হৃম্বের কাছাকাছি এসে চেঁচিয়ে ওঠে একম্ব।
– ভাই, হোই ভাই… কী হচ্ছে?
হৃম্ব উল্টোদিকে ঘুরে সে সময় যত্ন দিয়ে একটা মুদ্রা করার চেষ্টা করছিল। আচমকা চিৎকারে নাচ-টাচ মেয়েলি গলা সব মিলিয়ে এমন ভ্যাবাচাকা খেল, যে বেচারা গলা এবং মুদ্রা কোনোটারই কোনো পরিবর্তন করতে পারলো না। ঘুরে দাঁড়িয়ে তার শক্ত-সোমত্থ দুই হাত কোনো নৃত্যপটিয়সীর মতোই দু দিকে ছড়িয়ে এক ভয়ের ভঙ্গীতে বলে উঠল,
– উরি বাবা! তোরা কখন!
পরমুহূর্তেই নিজেকে আত্মস্থ করে। চোখ বন্ধ ক’রে দুবার শ্বাস নেয় গভীরে। গলা স্বাভাবিক করে। বলে,
– ঘুম ভাঙল তোদের?
– এটা কী করছিলি? – হৃম্বের কথার উত্তর দেওয়ার চেয়ে এই প্রশ্ন একম্বের কাছে বেশি গুরুতর।
– ছাড় না, আমি দেখেছিলাম একটা কোন সিরিয়ালে অর্জুন ব’লে একটা লোকও ওর’ম করেই নাচত। – বিকম্ব ফুট কাটে পাশ থেকে।
– তুই থাম। এরকম বিশাল মাসল, লম্বা গোঁফ দাড়ি, বুক ভর্তি লোম… এরকম এক ভয়ংকর দৈত্য হয়ে এইভাবে মেয়েছেলের মতো হাত পা ঘুরিয়ে নাচবে! ছিঃ… ওকে এভাবে দেখলে আর কোনোদিন কেউ ভয় পাবে ভাবছিস? বাড়িতে জানুক না… ওর হাড় চিবিয়ে খাবে।
– আরে আমি স্রেফ পাথর ভাঙছিলাম। তোদের পাশেই শুলাম প্রথমে। কিন্তু ঘুম এলো না। তাই ভাবলাম পা দিয়ে ঠুকে ঠুকে কিছু পাথর যদি ভাঙা যায়। – হৃম্ব সহজ হওয়ার চেষ্টা করে।
– তা ব’লে দৈত্য হয়ে মেয়েদের মতো হাবভাব! দৈত্যরা বীরের রক্ত, জানিস না?
– সরি… আর কোনোদিন করব না। চ’ এবার ফেরা যাক।
তিন ভাই সহজ ভাবে বাড়ির পথে ফিরে চলে। তিন দৈত্য। সূর্য ডুবে গেছে ততক্ষণে। বিকম্বের কানে কানে হৃম্ব বলল, “কেমন লাগছিল রে? আমার নাচটা?”
একটা ফিসফিস ফেরত আসে বিকম্বর দিক থেকে -“হেব্বি”
।। ২ ।।
পুকুরের ধারে বসে, নিজের প্রতিচ্ছবি দেখছিল হৃম্ব।
একসময় বিকম্ব তাকে বলেছিল, “তোর নামে মানুষদের এক ফিল্ম-স্টার আছে জানিস? আমি দেখেছি। ইয়া মাসল… দৈত্যের মতো ফাইট করে…”
কী নাম বলেছিল যেন দাদা? হৃম্ব? না না। বোধহয় র্যাম্বো। সেই অজানা র্যাম্বোর কথা ভাবতে থাকে সে। তারও কি এখন হৃম্বর দশা? তার বুঝি কখনও মেয়েদের মতো কথা বলতে নাচতে কাপড় পরতে ইচ্ছে করে না? অন্তত নিজের হাতকে নিজেই আদর করতে? তাও করে না, না? কত্ত ভালো! মানুষ হয়েও র্যাম্বো দৈত্যের সম্মান পেলো। আর হৃম্বের পোড়াকপাল, দৈত্য হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে সামলাতে পারল না সে। নিজের কপালে তর্জনী রাখে। দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে। “দিনে দিনে হলো আমার দিন আখিরি”। বাড়িতে সব্বাই জেনে গ্যাছে। গোপন রাখতে পারছিল না আর। অনেক চেষ্টা করেছিল। কিছুতেই কিছু হলো না। কাল শাড়ি প’রে নিজের ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে নিজেকে আদর করছিল। বাবা দেখতে পেয়ে যায়। কি চিৎকার! মা গো মা! পাড়া মাথায় তুলে নিলো এক্কেবারে। কি এমন ক্ষতি শাড়ি পরলে? কার কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে শুনি। তা-ও চিৎকার, গালাগাল… শেষে সামনের অশ্বত্থ গাছটা তুলে এমন মার মারল, সারা গায়ে এখনও কালশিটের দাগ, কপালটাও ফুলে আছে দ্যাখো।
কপালে আঙুল বোলাতে বোলাতে কেমন শরৎকালের মতো গভীর অচেনা লাগে নিজেরই প্রতিচ্ছবি – একটা টিপ পরলে ভালো হতো। হাল্কা দুলতে থাকা পুকুরের জলকেই যেন সে ব’লে ওঠে,
– পোড়ারমুখী, দৈত্যের মতো বড় বড় দাড়ি গোঁফ বুক ভর্তি লোম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। মা গো মা! তোর কি একটু লজ্জাও নেই রে হতভাগী!
পুকুরের নিশব্দতায় প্রতিফলিত হয়ে হৃম্বের এই নবপরিচিত ভাষা যখন সম্পূর্ণতা চাইছে আকাশে, ঠিক সেই সময়, ঠিক সেই একই আকাশের নিচে তাদের বাড়ির বারান্দায় অন্য দৃশ্য সাজানো হচ্ছিল।
– শোনো হে কর্ণকূট, এভাবে চললে তো, তোমার ওই হৃম্বটিকে আমাদের রিহ্যাবে দিতে হবে।
ডাক্তারবাবু বরাবরই এ’ কায়দায় কথা বলেন। বিকম্ব যখন প্রথম তাকে দেখেছিল, সাইডে মুখ ঘুরিয়ে ফিক ক’রে হেসে হৃম্বর কানে কানে বলেছিল, “এ’ তো জলসাঘরের ছবি বিশ্বাস!”
আজ অবশ্য সে ফিচকেমির অবকাশ নেই। বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁতে আঙুলের নখ কাটছিল বিকম্ব। পাশে একম্ব – উনুনের মতো গনগনে চোখের মধ্যে যেন ওটা ঠিক তার মণি নয়, মণির পুড়ে যাওয়া কালো ছাই ভাসছে। কর্ণকূট – তাদের বাবা – বলল,
– কী আর বলি, বদ্যি? তোমরা যা ভালো বোঝো করো। চোখের সামনে এসব তো সহ্য করা যায় না। মান-সম্মান সব ধুলোয় মিলিয়ে দিল হে… ছ্যাহ।
– তা এসব হলো কী ক’রে বল তো? তোমার বংশেই যত সমস্যা। আগে থেকে এই বিকম্বটা আধপাগল। কী সব টিভি সিনেমা… মানুষের মতো গালগল্প হাবভাব। তার ওপর হৃম্বটারও মাথা গেল।
বিকম্ব এক মনে নখ কামড়াচ্ছিল, হঠাৎ তার প্রসঙ্গ এসে পড়বে বুঝতে পারেনি। আচমকা হাতটা মুখ থেকে বার করতে গিয়ে একদলা লালা প’ড়ে যায় মাটিতে। মাথা নিচু ক’রে সে ওই লালাটুকু পায়ের বুড়ো আঙুলে ঘষতে থাকে।
কর্ণকূট বলে,
– সব তো ঠিকই ছিল, এই কয়েকদিন আগ অবদি। কী যে বলি…
তারপর বিকম্বের দিকে তাকিয়ে ধমকায়, – কিরে তুই বলবি? না আমি?
বিকম্ব মাথা আরও ঝুঁকিয়ে দ্যায়, যেন তার ওই আধ-শুকনো লালার দাগে খুব গুরতর কিছু হারিয়ে গ্যাছে। এক্ষুনি খুঁজে না পেলে চলবে না। এই ভঙ্গীতে মাটির দিকে দেখতে থাকে।
– বিকম্বর কারণে ওদের সব ভাইয়েরই শিকারে যাওয়া মানা। জানোই তো?
– হুম। – ডাক্তার তাল দ্যায়।
– তো আমরা যা শিকার করি তার থেকেই ওরাও খায়। কাজের মধ্যে কাজ ওদের একটু মহুয়া চাষ করতে পাঠাই। তাতেই বাবুরা কান্ড ঘটিয়ে এসেছেন।
– কী কান্ড?
– গেল রবিবার… একম্বর শরীরটা খারাপ ব’লে ও যেতে পারেনি। হৃম্ব আর বিকম্বকে পাঠালুম চাষে।
এতটুকু ব’লে কর্ণকূট থামে। তারপর বিকম্বের মাথায় দুম ক’রে এক চড় মেরে বলল, – বল। এখন লজ্জা কীসের? করার সময় লজ্জা হয়নি?
বিকম্ব জলভরা চোখে মাটির দিকে তাকিয়েই বলতে থাকে,
– আমরা সত্যি শিকার করিনি। শিকারে না যেতে যেতে আমাদের তো নখ ব’সে গেছে। দাঁত ঘ’ষে গেছে। ওটা মরা মানুষ ছিল। রাস্তার ধারে মেরে কেউ ফেলে গেছল। আমরা একটু খেয়েছিলাম কেবল।
– মানুষ না মেয়েমানুষ? – কর্ণকূট হুঙ্কার দেয়।
– মেয়েমানুষের মতোন পোষাক ছিল না… আমরা তাই বুঝতে পারিনি প্রথমে।
– হারামজাদা ছেলে! মেয়েমানুষ তুমি পোষাক দে বোঝো?
বাপের বকুনিতে ভ্যাঁ করে কাঁদতে থাকে বিকম্ব – হৃম্বের কোনো দোষ নেই… সত্যি… ওর দাঁতের ফাঁকে ওই মেয়েমানুষের মাংস আটকে গেছল। কত খোঁচাখুঁচি, মুখ রক্তারক্তি… ওয়াক ওয়াক ক’রে বমিও করল আমার সামনে, তবু সে মাংসের কুচো বেরোল না। সেদিন সারারাত চিন্তায় ঘুমোতে পারেনি হৃম্ব। পরদিন বিকেল থেকে কেমন যেন বদলেই গেল…
ঘেন্নায় থুতু ফেলল ডাক্তার…
– ছি ছি ছি… দৈত্য হয়ে মেয়েমানুষের মাংস খেয়েছিস? আমাদের বৌরাও যা ছোঁয় না… তোরা বেটাছেলে হয়ে সেটা খেলি? জানিস না, এ খাওয়া আমাদের ধর্মে নিষিদ্ধ, দৈত্যের জাত যায় এতে… এই সেদিন ভাল্গা রাজ্যে পাঁচ দৈত্যকে মেয়েমানুষের মাংস খাওয়ার সন্দেহে পাহাড়ে আছড়ে মারল। – এত অবদি ব’লে ডাক্তার কর্ণকূটের দিকে তাকায়। – আর তুমিই বা এসব শুনে এদের ঘাড় ধাক্কা দাওনি কেন?
– আমি তো গোটা ব্যাপারটা জানলামই আজ সকালে। তা-ও অনেক মারধরের পর। তাই তো তোমায় ডাকলাম। তুমিই যা হোক একটা উপায় বাতলাও…
– দ্যাখো। মেয়েমানুষের মাংস খাওয়া অধর্ম… কিন্তু শুদ্ধিকরণ সম্ভব। তোমার বিকম্বটি তাই এ’ যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু হৃম্বের জন্য কিচ্ছু করার নেই। ওটাকে হয় রিহ্যাবে দাও। নয় তো সোজা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করো। আমি তোমার জায়গায় থাকলে অবিশ্যি দ্বিতীয়টিতেই সচ্ছন্দ হতাম। এমন ছেলের জন্য কোনো মায়া আমার অন্তত নেই।
– আমারও – কর্নকূট দৃঢ়ভাবে উত্তর দেয়।
।। ৩।।
গল্পটা এখানেই শেষ হলে ভালো হতো। কারণ এত কম স্পেসে, দুটো গল্প একসাথে ধরে না। যেমন হৃম্ব বলল, একটু পরেই…
হৃম্বকে আবার জেলে পোরা হয়েছে। যদিও সে এতদিনে – এই দশ বছরে – দৈত্য সমাজে সুপরিচিত। দৈত্যদের মধ্যে বোধহয় প্রথম হৃম্বই এ’ ধরণের আন্দোলনকারী। মিডিয়া কভারেজ তার সর্বত্র। এবং অবশ্যই তার গ্রেফতার হওয়াও।
জেলেও তার জন্য সুবন্দোবস্ত। তার ঘরের দরজাটা খুলে তাই অন্য আরেক কয়েদীকে যখন ডাকা হচ্ছিল, হৃম্ব বিরক্তিতে চেঁচিয়ে ওঠে,
– আবার কে? তোমাদের বলেছি না, এত কম স্পেসে দুজন দৈত্য হয় না।
– আরে ম্যাম, ওর শুঁয়োপোকার মতো চেহারা। প্লিজ কিছুক্ষণের জন্য এডজাস্ট ক’রে নিন। আমরা একটু বাদেই ওকে অন্য ঘরে দেবো।
– মা গো মা! শুয়োপোকার মতো দৈত্য! সে আবার কী? – হৃম্ব হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে।
দৈত্যটি ঘরে ঢুকতে, তাকে দেখে খুব রগড় হয় হৃম্বের। তালি বাজিয়ে ওঠে – “তুই কে রে?”
– দৈ।
– দৈ?
তারপর হাসতে হাসতে বলে, – না ছানা। বা ওই গোল গোল রসোগোল্লা…
দৈ আবার বোঝায়, যে সে দৈ। যত হৃম্ব হেসে লুটোপুটি যায় ততই যেন দৈ মরিয়া হয়ে ওঠে নিজের আইডেন্টিটি বোঝাতে। দৈ-এর এক হাতে ছিল বিস্কুটের প্যাকেট। আর হাতে খেতে থাকা বিস্কুট। শেষে না পারি হয়ে সেসব মাটিতে রেখে, সে মাটি থেকে প’ড়ে থাকা এক কাঠকয়লার টুকরো তোলে। তারপর মেঝেতে লেখে, – আমিও দৈত্য। কিন্তু দাঁত শিরশিরায়। কী ক’রি? মাংস খাইতি পারি না, যুক্তাক্ষর বলতি পারি না। তাই আমায় জেলে পোরা হইছে।
– দূর হ মুখপোড়া। দৈত্য হয়ে মাংস খেতে পারিস না, যুক্তাক্ষর বলতে পারিস না! তুই জন্মেছিস কেন রে? মর…
ঠোঁটটা একটু বাঁকিয়ে, হৃম্ব ধাক্কা মারে দৈ-কে। দৈ ততক্ষণে লেখা শেষে বেশ কাজ-মিটেছে গোছের আরামে নিজের আধখাওয়া বিস্কুটটুকু তুলে খাচ্ছিল। এ’ হেন হঠাৎ-কান্ডে সে চমকে যায়।
ভারী অভিমানে মেঝের ওই লেখা দ্রুত আরেক হাত দিয়ে মিটিয়ে দেয়। দৈ। মেঘলা মুখে কীসব ভাবে কিছুক্ষণ। তারপর উদাসভাবে ওই কালি লেগে থাকা মেঝের ওপর পুনরায় লেখে,
– বিস্কুট খাবা?
[ছবিঃ ভুটান]
Pingback: কালিজা ২০১৮- সূচীপত্র - কাঁচালঙ্কা