দুটো শব্দ “ছাত্রীদের সমকামিতা”,ব্যাস, বেড়িয়ে এলো সমাজের সর্বস্তরের জুজুর ভয়

দুটো শব্দ “ছাত্রীদের সমকামিতা”,ব্যাস, বেড়িয়ে এলো সমাজের সর্বস্তরের জুজুর ভয়

অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

(কোলকাতা) ঘটনা ১ঃ

মনে আছে তখন কলেজে। অফ পিরিয়ড কি টিফিন, মনে নেই। ক্লাস প্রায় খালি। আমরা কয়েকজন ডেস্ক বাজিয়ে গান করছিম আর আমাদের ক্লাসের অন্যতম জুটির একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে, আংগুলের ফাঁকে আংগুল গুঁজে ফিসফিসিয়ে প্রেমালাপে মগ্ন। একটি অবাঙ্গালী ছেলে, একটি বাঙ্গালী মেয়ে। তাতেই সেদিন আমার বেশ কিছু বন্ধুর আড়চোখ আর চাপাঠোঁটে ধিক্কার দেখেছিলাম।

(কোলকাতা) ঘটনা ২ঃ

স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নাচ করছিলো মেয়েলি ছেলেটি, সামনের সারীতে বসে ছিলেন শিক্ষিকা, যিনি নিজের সমকামী সত্বা নিয়ে যথেষ্ট সোচ্চার। নাচের শেষে হাতজোড় করে লুটিয়ে পড়লো দর্শকদের সামনে নাচেরই অংশ হিসেবে। কিন্তু পড়বি তো পড় একেবারে সেই শিক্ষিকার সামনেই, এবং না জেনেই। শিক্ষক মহল থেকে মন্তব্য উড়ে এলো “মওগায় মওগা চিনেছে”।

এবং গতকালঃ

কমলা গার্লস, কোলকাতার নামী স্কুলগুলির মধ্যে অন্যতম। ক’দিন আগে যৌন-নিগ্রহের ঘটনায় তোলপাড়, আর গতকাল আরেক ঘটনায় হঠাৎ নতুন করে নজর কাড়লো তারা। অভিযোগ ১০জন ছাত্রীর নামে সমকামীতার। ব্যাপারটা সম্পর্কে সত্যি এর থেকে বেশী কিছু বলা মুশকিল। কামের প্রকাশ বিচিত্র। অনেক মনস্তত্ববিদেরা মনে করেন, ভালো পোশাক পড়া থেকে, গান গাওয়া, সবেতেই কোথাও পছন্দের যৌনসঙ্গীকে লালায়িত করার ফল্গু ইচ্ছে বয়ে চলে। তাই “আমি স্কুলে সমকামিতা করেছি” এর মানে যে ঠিক কি দাঁড়ায় তা বলা বেশ মুশকিল। তবে ঘটনাটা যে “আমি স্কুলে চুরি করেছি”, অথবা “আমি স্কুলে ফেল করেছি” এর থেকেও সাংঘাতিক গুরুতর এক বস্তু, অন্তত সমাজের কাছে, তা অন্তত বেশ স্পষ্টই বোঝা গেলো। নাহ শুধু সমাজ কেন? সংবাদমাধ্যমই বা বাদ যায় কিসে? কোলকাতা২৪x৭ এই বিশয়ে যে খবরটি অনলাইনে প্রকাশ করেছে তার ইউ-আর-এল -টি বেশ চমৎকার। “ভয়াবহ ঘটনা”। বিশ্বাস হলোনা? এই যেঃ

https://kolkata24x7.com/ভয়াবহ-ঘটনা-কলকাতায়-নামী-স.html

জঙ্গিহানার চেয়েও ভয়াবহ হয়তো, ছবিতে দুই নারীর রগরগে (কি তাই তো মামা?) চুমু খাওয়ার দৃশ্য।

খবরটা এক বন্ধু কাল ওয়্যাটসাপে পাঠাতেই চমকে উঠি। ছাত্রীদের যৌনতাসংক্রান্ত স্বীকারোক্তি দিতে হয়েছে লিখিতভাবে, সেই স্বীকারোক্তি নিয়ে ধুন্ধুমার, অভিভাবকদের জোড় গলায় কাম এবং বন্ধুত্বের মধ্যেকার ব্যবধান চিহ্নিত করা, আর সব শেষে সংবাদমাধ্যমের ঝাঁপিয়ে পড়া এই “ভয়াবহ” “নোংরামো” -এর হালহকিকত জানার এবং জানানোর জন্য।

সমকামীতার অভিযোগের কি অর্থ? আমি সমকামী তাই কি অভিযোগের ভিত্তি? সেটুকু নিশ্চয়ই হতে পারেনা। আমার মেয়ে সমকামী হলে আমারই বা এতো রাগ কিসের? যৌনতা যেখানে চরিত্রের এক প্রধান অঙ্গ, সেখানে স্কুলের গন্ডির মধ্যে একজন সমকামী ছাত্রী ঠিক কি কি ভাবে নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা রাখে, আর কি কি পারেনা, তাও কিন্তু বেশ তর্কের দাবী রাখে। একজন ছেলে আর একজন মেয়ের মধ্যে স্কুললাইফের প্রেম তো বাঙালীর রোম্যান্টিকতা আর রোম্যান্ঠিকতার পরাকাষ্ঠা, তখনো কি এভাবেই চোখ গোল্লা গোল্লা করে তাকাতাম আমরা? স্কুল লিখিয়ে নিতো? বাবা-মায়েরা ছেলে এবং মেয়েটির হাতে হাত ধরাকে “বন্ধুত্ব বন্ধুত্ব” চিল্লিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাতো?

ঠিক কি ঘটেছে জানা নেই। ১০জন ষোড়শবর্ষীয়া শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আগ্রহও নেই, নেই এই ঘটনাকে মই বানিয়ে হাততালি জোগাড়ের ইচ্ছে। তবুও লিখছি। কারণ ঘোর আপত্তি। আপত্তি “সমকামীতা” শব্দটিকে মুছে দেওয়ার চেষ্টায়। স্কুলের চার দেওয়ালের মধ্যে কিছু নিয়ম থাকবে অবশ্যই। যদি এই অভিযোগ সত্যি হয়ও, তাহলে এটি স্বাভাবিকভাবে অশালীন আচরণের অভিযোগ হিসেবেই চিহ্নিত হওয়ার কথা। কৈ? তা তো হলোনা? নাকি ছাত্রীদের একটু অন্যরকম আচরণ অভিযোগের মাত্রা বাড়িয়ে দিলো দ্বিগুণ!! “বালক বিদ্যালয়” বা “বয়েজ স্কুল” -এ এরকম ঘটনা ঘটলেও কি একই গাম্ভীর্যে আহত হতো এই সমাজ আর মিডিয়া?

বিসনেস স্ট্যান্ডার্ড নামক একটি ওয়েবসাইটে কর্তব্যরতা প্রধান শিক্ষিকার বয়ান খানিক এভাবে উল্লিখিত হয়েছে….. (লক্ষ্য করার বিশয়, প্রধান শিক্ষিকা এখানে ছাত্রীদেরকে সঠিক পথে চালিত করার প্রসংগ উল্লেখ করেছেন, যা অত্যন্ত আপত্তিকর একটি মন্তব্য।)

“কিছু ছাত্রী এই ১০জন ছাত্রীর বিরুদ্ধে নালিশ জানিয়েছিলো আমাদের যে তারা নাকি এরকম করে। তখন আমরা এই ১০জনকে ডেকে পাঠাই আর তারা সেই কথা স্বীকারও করে। বিশয়টি সংবেদনশীল, তাই আমরা তাদের কাছ থেকে এ’মর্মে লিখিত স্বীকারোক্তি নিই। এরা সবাই সেই লিখিত স্বীকারোক্তি দিয়েছে। বিশয়টি তাদের অভিবাবকদের জানানোর জন্যে আজ আমরা তাদের ডেকে পাঠাই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো, যাতে বাড়িতে এবং বিদ্যালয়ে যুগপৎ চেষ্টার মাধ্যমে আমরা ছাত্রীদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে পারি।” (সূত্রঃ http://wap.business-standard.com/article/news-ians/pandemonium-in-kolkata-school-over-allegation-of-lesbianism-against-students-118031201386_1.html)

সঠিক পথ মানে? কোনটি সঠিক কোনটি বেঠিক সেটা আপনি ঠিক করে দেবেন? আপনি? যিনি কয়েকদিন আগে স্কুলের এক কর্মচারীর বিরুদ্ধে ছাত্রীর যৌন-নিগ্রহের অভিযোগ ওঠা সত্বেও চুপ করে ছিলেন।

কি ঠিক করবেন? কিভাবে?

আর অভিভাবকেরা? হাতে হাত কাঁধে কাঁধ শুধু বন্ধুরাই রাখেনা কিন্তু। হতেই পারে আপনার মেয়ে সমকামী নয়। কিন্তু বন্ধুত্ব/প্রেম/কাম এই সমস্তের মধ্যে চুলচেড়া পার্থক্য করতে হঠাৎ আপনারা উঠেপড়ে লাগলেন যে? সমকামীরা কোথায় কি কি রাখে সে বিশয়ে আপনাদের এতো সম্যক জ্ঞান আসে কোত্থেকে? সমকামী শব্দটা ঝেড়ে ফেলতে পারলে বাঁচেন? ঘা ঠিক কোথায় লেগেছে? মেয়ে পরিক্ষায় নকল করতে গিয়ে ধরা পড়েছে এরকম অভিযোগে এতোটাই আক্রোশ জন্মাতো আপনার ভিতরে?

নাহ! কিছুতেই মানতে পারছিনা। সমাজের সব মানুষেরা মিলে যেন মুছতে চাইছে এই পাঁচটা অক্ষর। স-ম-কা-মি-তা। কখনো চোখ রাঙিয়ে, কখনো গলা ফাটিয়ে, কখনো ভয়াবহ শিরোনামে খবর ছাপিয়ে। আর হয়তো সারাদিন ঝামেলার শেষে মেয়েকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে প্রশ্নবাণে নাজেহাল করে।

“বাঁচাও সমকামীতা এসেছে”… ভাবখানা এমনই।

হঠাৎ সবাই মিলে আকাশ থেকে পড়লেন যে? কেন? হোমোদের অস্তিত্ব স্বীকার করতে অসুবিধে? বয়ঃসন্ধিতে অনেকেই নিজের যৌনতা আবিষ্কার করে সেটা মেনে নিতে অসুবিধে? যৌন-শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করে, ছাত্রীদের স্বাভাবিক মানসিক/শারীরিক ইচ্ছেগুলোকে অস্বীকার করে, তাদের শুধু লেখাপড়া করার মেশিন ভাবার আপনার স্বাচ্ছন্দ্য ভেঙে পড়ছে, তাতে? নাকি সবগুলোই?

কমলা গার্লসে “সমকামীতার অভিযোগ” -এর সত্যাসত্য আমি জানিনা। কিন্তু শুনুন মশাই, আপনি যদি মনে করে থাকেন, কোলকাতার স্কুলে আজ অবধি দুজন ছাত্র অথবা দুজন ছাত্রীর মধ্যে কখনো বন্ধুত্বের বেশী কিছু শারীরিক/মানসিক ভাবে ঘটেনি, আর ঘটবেনা, দেন আই এম সরি টু সে হানি, আপনার ঠুলি পড়া মগজ না জানলেও পৃথিবীতে অনেক কিছুই হয়।

সমর্থন করা না করা অবশ্যই তর্কের উর্ধে নয়, আপনার ব্যক্তিগত মতামত রাখতেই পারেন, কিন্তু ভবিষ্যতের অনেক গলাফাটানো সমকামী পুরুষ এবং সমকামী নারীরা, তাদের মনের কারখানায়, নিজেদের যৌনতাকে স্কুল লাইফে খুঁজে পেয়েছে, এবং অনেক সময় তাকে আটকে রাখেনি শুধুমাত্র নিজের একার মন/শরীরের মধ্যে , এটা একেবারে নাকে ঝাঁঝ আনা সর্ষের তেলের মতো সত্যি, আর মাইরি বলছি, বিশ্বাস করুন, এই সর্ষের মধ্যে কোন ভুত নেই। যদি থেকে থাকে সেটা আপনার মগজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *