“তোকে কি রেপ করবো? তুই কি মেয়ে?” — খাস কোলকাতায় সমকামী তরুণের বিরুদ্ধে পুলিশি নিগ্রহের অভিযোগ

— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন / নিজস্ব সংবাদদাতা

** কাঁচালঙ্কার তরফে পুলিশে যোগাযোগ করে এই ঘটনা প্রসঙ্গে তাদের মতামত যাচাই করা হয়নি

কোলকাতা, ২৫শে জুলাইঃ এ শহর দেখেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম প্রাইড ওয়াক বা রামধনু যাত্রা। এ শহরে বছরে বছরে ফিরে আসে ক্যুয়ের চলচ্চিত্র উৎসব। আর এই শহরেই এখনো ঘটে চলে অসংখ্য নিগ্রহ আর হিংসার ঘটনা লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষের উপরে। কিন্তু এবারের অভিযোগ খোদ বিধাননগর পুলিশের বিরুদ্ধেই !! ঘটনার প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই ইমেইলের মাধ্যমে বিধিবদ্ধ অভিযোগ জানিয়েছে এই ঘটনার শিকার ২৩ বছরের মেয়েলী সমকামী তরুণ সঞ্জিত। ঠিক কি হয়েছিলো সেদিন? কাঁচালঙ্কার তরফে তরুণের সাথে কথা বলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে এই ঘটনার বর্ননা বন্ধুদের জন্য এখানে উপস্থাপিত হলো।

অভিযোগ অনুযায়ী, রাজারহাটের জ্যাংড়া অঞ্চলের সঞ্জিত ২০শে জুলাই, সোমবার, রাত ৯টা নাগাদ হেঁটে বাড়ি ফিরছিলো, আর তখনই তার দিকে ধেয়ে আসে অশালীন কুরুচিকর মন্তব্য। আর এই মন্তব্যগুলি করছিলেন দুজন সিভিক পুলিশ। রাস্তাঘাটে চলার সময় সমকামী আর রূপান্তরকামীদের টোন-টিটকিরি নতুন কোন ঘটনা নয়, দুর্ভাগ্যজনক হলেও, অনেকেরই এখন এ সব গা-সওয়া হয়ে গেছে, তাই বলে পুলিশ? রক্ষকের এই ভক্ষক বেশ মেনে নিতে পারেনি সঞ্জিত, প্রতিবাদ করে সে। এর ফলে যেন আরও হিংস্র হয়ে ওঠে তারা। এগিয়ে এসে একজন তার গালে সজোরে চড় মাড়ে, “চ! তোকে দেখছি!” এই বলে জোর করে তাকে টেনে নিজেদের বাইকের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে তারা। ঘাবড়ে গিয়ে সঞ্জিত চেঁচামেচি শুরু করলে, আশেপাশের লোক ছুটে আসে, তাদেরকে সেই সাদা পোশাকের পুলিশেরা অথবা স্বেচ্ছাসেবকেরা সাফ জানায় “চুরি করেছে, তাই ধরছি”।

এগিয়ে এসে একজন তার গালে সজোরে চড় মাড়ে, “চ! তোকে দেখছি!” এই বলে জোর করে তাকে টেনে নিজেদের বাইকের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে তারা।

হতচকিত সঞ্জিত সাদা পোশাকের পুলিশদের সাথে যেতে অস্বীকার করে, বিশেষত বাইকে। “চল তোকে থানায় নিয়ে যাই। তোকে কি রেপ করবো? তুই কি মেয়ে?” এই ধরনের কুরুচিকর মন্তব্যও করে তারা। কিন্তু সঞ্জিত প্রতিবাদ জানিয়ে বলে সে কিছুতেই ইউনিফর্ম ছাড়া কোন লোকের সাথে যেতে রাজি নয়, এবং বইকে তো নয়ই। অতএব তারা ফোন করে পুলিশের একটি জিপগাড়িকে ঘটনাস্থলে ডেকে পাঠায়, এবং তাতে একজন উর্দি পরা পুলিশকে দেখে খানিক ভরসা পায় সঞ্জিত। কিন্তু তার আশা ধোপে টেকেনা। তার কোন কথাই না শুনে তাকে সরাসরি জিপে তোলা হয়। অনেক কাকুতি মিনতি করেও কোন ফল হয়নি। জিপের মধ্যেও তাকে বিভিন্ন ভাবে নিগ্রহ করা হয় এবং গোপনাঙ্গেও স্পর্শ করা হয় বলে অভিযোগ জানিয়েছে সে।

“চল তোকে থানায় নিয়ে যাই। তোকে কি রেপ করবো? তুই কি মেয়ে?” এই ধরনের কুরুচিকর মন্তব্যও করে তারা।

নারায়ণপুর থানায় নিয়ে আসার পরে সঞ্জিতের মোবাইল কোনটি কেড়ে নেওয়া হয়, আর তার উপরে আবারো চলে বিভিন্ন হেনস্থা। তার পেছনে লাঠি দিয়ে খোঁচা দেওয়া, তার পুরুষাঙ্গ আছে না স্তন, ইত্যাদি ইংগিতপূর্ণ প্রশ্ন চলতেই থাকে। “এই সব ছক্কাগিরি করলে কেটে পুকুরে ভাসিয়ে দেবো” এধরনের সাংঘাতিক মন্তব্যেরও সম্মুখীন হতে হয় তাকে। অবশেষে অনেক রাতে বাড়ির সাথে তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়, তারা আসতে চাইলেও বিধাননগর পুলিশের পক্ষে জানানো হয় যে সকালের আগে সুজয়কে ছাড়া যাবেনা, অতএব বাড়ির লোকেরা যেন পরদিন সকালে ৫০০ টাকা নিয়ে থানায় আসেন। সারারাত ধরে সুজয়ের উপরে চলে অত্যাচার। তাকে লকআপে না রেখে বাইরে বেঞ্চে বসতে দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু হিংস্র পুলিশ তার হাটুতে লাঠি দিয়ে নির্মম আঘাত করে এবং এই কোভিড মহামারীর সময়েও তাকে নোংরা অস্বাস্থ্যকর মেঝেতে বসতে বাধ্য করে। তার ফোন থেকে ব্যক্তিগত ছবি বের করে তাই নিয়ে চলে হাসি ঠাট্টা, এবং মাঝে মধ্যেই হোমো, ছক্কা ইত্যাদি সম্বোধন।

“এই সব ছক্কাগিরি করলে কেটে পুকুরে ভাসিয়ে দেবো” এধরনের সাংঘাতিক মন্তব্যেরও সম্মুখীন হতে হয় তাকে।

পরদিন সকালে এক পারিবারিক বন্ধু থানায় এসে অবশেষে তাকে বাড়ি নিয়ে যান। ছাড়ার সময়েও অত্যন্ত নিন্দনীয় ভাবে পুলিশ সেই অভিবাবককে জানান “দেখবেন ছেলে একটু ছক্কা আছে।”

ছাড়ার সময়েও অত্যন্য নিন্দনীয় ভাবে পুলিশ সেই অভিবাবককে জানান “দেখবেন ছেলে একটু ছক্কা আছে।”

৩৭৭ ধারায় এখন স্বেচ্ছায় দুজন প্রাপ্তমনষ্ক মনুষ্যের সমকামী দৈহিক সম্পর্ক আর বেআইনি নয়। নালসা জাজমেন্ট, যা পরবর্তীতে সংকীর্ন ট্রান্স-বিল হিসেবে সংসদে পাস হয়েছে তাতেও কিছুটা হলেও ভিন্নধর্মী লিঙ্গস্বত্বা সরকারী ছাড়পত্র পেয়েছে। সুপ্রিমকোর্টের তরফে কেন্দ্র সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিলো যৌন-লিঙ্গ-প্রান্তিক মানুষের সাহায্যার্থে আইন প্রণয়ন করার, যা এখনো বিশ বাঁও জলে। কিন্তু কোন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি ? এই পুলিশ, যাদের দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের সাধারণ অধিকারগুলি রক্ষা করার, তারা নিজেরাই যদি এতোটা উদাসীন, হিংস্র আর সংকীর্নমনা হয়, তাহলে একজন লিঙ্গ-যৌণ-প্রান্তিক মানুষ, সে সমকামী হোক, অথবা উভকামী, অথবা রূপান্তরকামী, অথবা অন্যান্য (ক্যুয়ের), কিভাবে সে ভরসা রাখবে আইনের উপরে? সঞ্জিত আর্থিকভাবে অতোটা সচ্ছল নয়, তার পরিবারও এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি তাদের সন্তানের এই ভিন্নধর্মী যৌনতা। খাস কোলকাতার বুকে যদি এরকম একটা ঘটনার সাক্ষী হই আমরা, ভাবতেও গায়ে কাঁটা দেয়, গ্রামে, মফস্বলে আমাদের বন্ধুবান্ধবদের উপরে আরও কি ভয়ানক আঘাত নেবে আসতে পারে?

কাঁচালঙ্কা আশায় রইলো বিধাননগর পুলিশের সি-পি এই ঘটনার উপযুক্ত নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেবেন। নইলে হয়তো গোটা কোলকাতার শুধু নয়, গোটা বাংলা, বা হয়তো গোটা ভারতবর্ষের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা আরও তীব্রতর আন্দোলনের পথে হাটতে বাধ্য হবে। আমাদের অধিকার আমরা আদায় করেই ছাড়বো। লড়াই করে আজ আমরা যে স্বীকৃতি পেয়েছি, তার সম্মান বজায় রাখতে অনেক লড়াইই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। না হয় সেই তালিকায় আরেকটা প্রতিবাদ যুক্ত হলো।

সূত্রঃ ঘটনার শিকার তরুণ, প্রান্তকথা এবং মিডিয়াম.কম

ছবিঃ ভুটান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *