কাল সুপ্রিম কোর্টে ৩৭৭ ধারার শুনানি – অপেক্ষায় আমরা সবাই
— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন / নিজস্ব সংবাদদাতা
কাল ভারতের সুপ্রিম কোর্টে সেই মহা লগ্ন, যার অপেক্ষায় ছিলো ভারতবর্ষের আপামর লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক বা এলজিবিটি নাগরিক। হ্যাঁ, কাল সুপ্রিমকোর্টের পাঁচজন বিচারকের সামনে কাঠগড়ায় ধারা ৩৭৭, যা সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদন্ডের অভিশাপ বয়ে আনতে পারে তাদের জীবনে যারা পুরুষ-লিঙ্গ-দন্ড আর নারী-যোণীর সংগমব্যাতিত অন্য কোনভাবে সংগমসুখে আনন্দলাভ করেন। স্বভাবতই শুধুমাত্র বিছানায় নয়, বিছানার বাইরেও এই ধারা বারবার প্রযুক্ত হয়েছে এলজিবিটি+ মানুষদের হেয় করার জন্যে,বা কখনো ব্ল্যাকমেল করার জন্যেও। ৩৭৭ না সরলে সম-দৈহিক-লিঙ্গে বিবাহের ক্ষেত্রেও রয়ে যাবে এক বড়ো বাধা। বিভিন্ন দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ন মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার স্পষ্ট করেছে যে সমকামী যৌনাচার সম্পূর্ন স্বাভাবিক । তবুও ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন হিসেবে ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধানেও জায়গা করে নেয় এই বস্তাপচা আইন। শুধু ভারত নয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ আরো অনেক দেশই এখনো এই আইনের আওতায় বাঁধা, তারা তাদের লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক নাগরিকদের সমানাধিকার সুনিশ্চিত করতে অক্ষম। তবে কি কাল অন্তত ভারতের ইতিহাস থেকে অবসান হতে চলেছে এই কলঙ্কিত অধ্যায়ের?
২০০৯ সালে দিল্লী হাইকোর্টের কলমের খোঁচায় অসাংবিধানিক তকমা পায় ৩৭৭, কিন্তু ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে, সুপ্রিমকোর্ট সেই রায়কে নস্যাৎ করে ভারতের সরকারের হাতে দায়িত্ব চাপায় ৩৭৭ ধারা নিয়ে আলোচনা করে তাতে প্রয়োজনীয় রদবদল আনার। কিছু মন্ত্রী আমলা লোকসভা/রাজ্যসভার ভিতরে বা বাইরে এই নিয়ে মাঝেমধ্যে মন্তব্য করেছেন, বা বিল আনারও চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। অন্যদিকে সুপ্রিমকোর্টের সামনে এই নিরিখে দাখিল হয়েছে একের পরে আরেক পিটিশন, কখনো মুখচেনা মানবাধিকারকর্মীদের তরফে, কখনো বা সাংস্কৃতিক মহল থেক।
সম্প্রতি আইআইটির ২০জন প্রাক্তনী এবং ছাত্রেরা মিলে আবারো সুবিচার চেয়ে দারস্থ হন সুপ্রিমকোর্টের কাছে, এর নিরিখে মে মাসে কোর্ট বয়ান জারি করে এ বিষয়ে সরকারকে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে নির্দেশ দেয়। গড়িমসি করে সরকার সে ব্যাপারে কোন ইঙ্গিত না দেওয়ায়, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় ১০ই জুলাই শুনানির তারিখ হিসেবে ধার্য করেন৷ এর পরেই তড়িঘড়ি সরকারের তরফে আর্জি জানানো হয় শুনানির তারিখ আরো এক মাস পিছিয়ে দেওয়ার জন্যে। কোর্টের তরফে জানানো হয়েছে, যেহেতু এই বিষয়ে অবস্থান নেওয়ার জন্যে সরকার প্রায় সাড়ে চার বছর সময় পেয়েছেন, তবুও কিছুই করেনি, তাই আর সময় দেওয়া সম্ভব না। অতএব কাল শুনানি হচ্ছে সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই।
প্রসংগত উল্লেখ্য, ৩৭৭ ধারার বন্দুকের ডগায়, শুধুমাত্র সমকামী পুরুষেরা নয়, সমকামী নারী, উভকামীরা, এবং সম্পুর্ণরূপে দৈহিক-লিঙ্গ পরিবর্তন না করে ওঠা অথবা করতে না চাওয়া রূপান্তরকামীরাও এর আওতায় আসেন৷ এ ছাড়া প্যান্সেক্স্যুয়াল প্রভৃতি অন্যান্য যৌন-সমান্তরাল মানুষেরাও বাদ যাননা। বিছানায় “পাপ-কাজ” করেছো কি মরেছো।
তবে আর নয়। সম্প্রতি গোপণীয়তার অধিকার, নিজের ইচ্ছে মতো সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, ইত্যাদি কালজয়ী রায়গুলি অনেকাংশে সুপ্রিমকোর্টকে খানিক বাধ্যই করবে, হয় ৩৭৭ ধারাকে কলমের খোঁচায় বাতিল করতে, অথবা প্রয়োজনীয় রদবদল আনতে। ঐতিহাসিক নালসা রায়ও কাল কোর্টে লিঙ্গ-সমান্তরাল মানুষদের যৌনতার সমানাধিকারকে আবার করে ভাবতে বাধ্য করবে। তবুও না আঁচালে বিশ্বাস নেই বাবা।
সবার পাখির চোখ অতএব কালকের সুপ্রিমকোর্ট। শুনানি কতোদিন ধরে চলবে জানিনা। রায় কি আসতে চলেছে সে ব্যাপারেও আমরা অনিশ্চিত। ধর্মীয় এবং সামাজিক গোঁড়া সংগঠনগুলি এর বিরুদ্ধাচরণ করবে তাও মোটামুটি সুনিশ্চিত । সরকার কি অবস্থান নেবে তাও জানা যাবে হয়তো, যদি আদৌ তারা কোন অবস্থান নেয়। তবে যাই হোকনা কেন, লড়াই এখনো যে অনেকটা বাকি সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই৷ হয় আবার করে লড়াই, নয়তো বৃহত্তর আইনি/সামাজিক পদক্ষেপ, কালকের রায় আমাদের দেখাবে, এরপরের পথচলার রাস্টাটুকু। আপাতত আমাদের শ্লোগান হয়ে উঠুক “৩৭৭ ভারত ছাড়ো”। রামধনু আওয়াজে মুখরিত হোক দেশের আকাশ-বাতাশ-মাটি। ব্রিটিশদের নিজের দেশে ৫০ বছরেরও আগে লুপ্ত আইন, সরে যাক, তাদের এক সময়ের উপনিবেশগুলির থেকেও। ভারতবর্ষ, আবারো পথ দেখাক, সত্যিকার স্বাধীনতার মানে পৌঁছে দিক, ৩৭৭ এর অভিশাপ বয়ে চলা বাকি দেশগুলিকেও।
ছবিসূত্রঃ উইকিপিডিয়া (ক্রিয়েটিভ কমন লাইসেন্স)