নাটকেও সস্তা ফর্মুলায় হাসির খোরাক লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষেরা আর প্রতিবন্ধীরা
— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন
মনে আছে কয়েক মাস আগে, অথবা হয়তো বছরখানেক, “জয় মা কালী বোর্ডিং” নাটকটি নিয়ে উগড়ে দিয়েছিলাম আমার ক্ষোভ। লিঙ্গ-যৌন-সমান্তরাল মানুষেরা, যাদের চাওয়া-পাওয়াগুলো একটু অন্যরকম, তাদেরকে কেন বারবার উপহাসের খোরাক বানানো হবে, সিনেমায়, গল্পে, নাটকে – সেই সোজা প্রশ্নের সরল উত্তর দাবী করেছিলাম। কিন্তু সে দাবী হয়তো আরো অনেক কন্ঠের সাথে মিলে যেতে পারেনি সেদিন, নইলে গত ১৯শে আগস্ট, রবিবার সন্ধ্যেয় সেই একই অযাচার আবারো আরেকটি দলের হাত দিয়ে, অন্য নাটকের স্ক্রিপ্টে ফিরে আসবে, তা হয়তো হতোনা। এবার আর সেই ভুল না করে, বরং চেষ্টা করি যাতে আমার কথা সকলের সামনে পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। তাই কলম ধরার প্রয়োজন ছিলো খুব করে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে নাটকের। এমন এক মঞ্চশিল্প, যা বিভিন্ন জাতীর মানবাধিকার থেকে স্বাধীনতার লড়াই, কখনো বা সামাজিক বর্বরতার বিরুদ্ধাচারের মুখ হয়ে ফুটে উঠেছে বারেবার। কিন্তু সেই মঞ্চ থেকেই যখন আঘাত আসে মানবাধিকার লড়াইয়ের রাস্তায়, যখন সেই আলো আঁধারের রঙচঙে প্রেক্ষাগৃহ হাসির রোল তোলে সংখ্যালঘু এক মানবসম্প্রদায়ের অস্বাভাবিক স্বাভাবিকত্বে, তখন বোধহয় ঘা আরো গভীরে গিয়ে ধাক্কা মারে, তাই না? ঠোঁটে চলে আসে সেই বিখ্যাত লাইন, “ব্রুটাস! তুমিও?”
এবারের স্পটলাইটে “রাজডাঙ্গা দ্যোতক” প্রযোজনায় নাটক “নিশিকান্ড”।
নাটকঃ সৌমেন চৌধুরী।
প্রয়োগঃ অরিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়।
হাস্যরস, এর সৃষ্টির পিছনে লুকিয়ে থাকে অনেক রহস্য, অনেক বর্বরতা। চ্যাপলিনের একের পর আরেক ছবি, যেগুলিকে সাধারণত হাস্যরস বলে ধরে নেওয়া হয়ে থাকে, অথবা উৎপল দত্তের “টিনের তলোয়ার”, বা হয়তো তপন সিনহার “গল্প হলেও সত্যি” – এগুলি দেখতে দেখতে আমরা হাসি ঠিকই, কিন্তু কোথায় গিয়ে কেঁদেও ফেলি, কখনো বা গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, কখনো বিষাদ মিশে যায় হাসির ফোঁকরে ফোঁকরে। কোন সোজা বস্তাপচা ফর্মুলায় এদের ধরা যায়না।
কিন্তু এনারা তো হলেন দিকপাল, এদের চিন্তাশক্তি অপরিসীম। এদের ফর্মুলা এরা নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারতেন। সৃজনশীলতা, নতুন ফর্ম, নতুন কনটেন্ট, নতুন ধারণা, নতুন ফর্মুলা – এই তো প্রকৃত শিল্প। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে জার্মানির প্রেক্ষাগৃহে এরা নিশ্চয়ই জুইশদেরকে তাচ্ছিল্য করে হাততালি কুড়োতেন না। কারণ এখনকার কিছু তথাকথিত শিল্পীদের মতো সেই প্রয়োজন তাদের তৈরিই হয়নি।
হ্যাঁ, তুলনায় আসতে বাধ্য হলাম বটে, কারণ রাজডাঙ্গা দ্যোতককে এই বার্তাটুকু পৌঁছে দেওয়া আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, যে তাদের মঞ্চস্থ নাটক “নিশিকান্ড” অমানবিক এবং শিল্পসত্ত্বাবিহীন। ছেলেরা মেয়েদের মতো কথা বললে সেটা হাস্যকর, এটা মধ্যযুগীয় ধারণা। এই এক বস্তাপচা জিনিষ নিয়ে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে, অনেকে হাসিয়েছেন, অনেকে হেসেছেন। আজ ২০১৮ সালে দাঁড়িয়ে এই ধারণা কিন্তু অচল। বিজ্ঞান / বিভিন্ন রাষ্ট্র এখন ভিন্নধর্মী লিঙ্গচেতনা, আর সমকামিতার স্বাভাবিকত্বের পক্ষে। কথা চলে ইতিহাসের নজিরে খুঁজে বের করা মানুষের যৌনতা আর লিঙ্গের বিভিন্নতাকে। আলোচনা চলে, তর্ক হয়। থিওরি তৈরি হয়, ভেঙ্গে আবার নতুন একটা থিওরি। মানুষকে মানুষ ভাবতে শেখে বর্তমান আস্তে আস্তে, তাই এখানে অতীতের ভুলের কোন জায়গা নেই। আপনারা যদি হাস্যরস তৈরির জন্যে এই ধারনার বাইরে গিয়ে না ভাবতে পারেন, তাহলে অত্যন্ত দুঃখের সাথেও জানাতে বাধ্য হচ্ছি, আপনাদের প্রযোজনার জন্যে আমার কাছে একটাই বিশেষণ আছে “সস্তা”।
আর যেই গোষ্ঠীকে নাটকে “হাবাগোবা” অর্থাৎ “ইক্যুয়াল টু হাস্যকর” হিসেবে শুরুর দিকে উপস্থাপন করা হয়েছিলো, তাও আপনাদের অত্যন্ত কুরুচিকর হীনমন্যতার পরিচয় বৈ আর কি? বোবা-কালাদের, পাগলদের আর ছক্কাদের সস্তা হিন্দি ছবিতেও ঠিক একইভাবে দেখানো হয়। সেখানে আপনারা যদি প্রচার করার চেষ্টা করেন, যে আপনারা নাট্যদল, উন্নততর শিল্পী, তাহলে আমায় কিন্তু পার্থক্য খোঁজার জন্যে সত্যিই বেশ কষ্ট করতে হবে।
প্রতিবন্ধীরা, শারীরিক, অথবা মানসিক, তারা আমার আপনার ফুসফুসের ব্যায়াম করার জন্যে জন্মাননি, অতএব তাদের দেখে এবং দেখিয়ে, হাসা এবং হাসানো দুইই প্লিজ এবার আপনারা বন্ধ করবেন কি?
আর কেউ সমকামী অথবা সমান্তরাল লিঙ্গ-চেতনার মানুষ হলে তো আপনাদের শুধু হাস্যরস না, আরো কি কি যে রস বেরোয়, যেন রসগোল্লার চেয়েও রসালো বস্তু। আপনাদের নাটকের রাজা চরিত্রটি নিষ্ঠুর, কিন্তু তার নিষ্ঠুরতাকে হাস্যস্পদ করে তুলতে তাকে মেয়েলী সমকামী বানানোর কি প্রয়োজন ছিলো?
আর সবচেয়ে বড়ো কথা সেই রাজা যখন সবাইকে “তুই তোকারিতে” কথা বলেন, তখন স্পষ্ট ইঙ্গিতটা কোনদিকে, বা কার দিকে যায়, সেটা কি সবাইকে বুঝিয়ে দিতে হবে? সমকামী মানেই সে তুই বলবে, সে হাত নাড়বে, সে ঋতুপর্ণ হবে? ছি!! মানুষটাকে মড়ার পরেও আপনারা শান্তি দিচ্ছেননা? নাটক বাদ দিয়ে খোকাবাবু সিরিয়ালের এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর হওয়ার আবেদন করুন না। এই মঞ্চশিল্পটুকু অন্তত নিজের মহিমা আর গৌরব নিয়ে বেঁচে থাকুক। বাংলা সিরিয়াল থেকে তো বিদ্বজ্জনমহল এমনিতেও কিছু আশা করেননা। অন্তত নাটককে তো বাঁচতে দিন।
আপনারা জানেন না হয়তো, কতো নাট্যগোষ্ঠীরা আজ সমকামী আর রূপান্তরকামীদের হয়ে সওয়াল করছেন, নাটক বাঁধছেন। জানেন না হয়তো, যে অনেক নাট্যশিল্পীরা নিজেরা সমকামী অথবা সমান্তরাল লিঙ্গচেতনার ধারক। আর যারা নাটকের দর্শক, তাদের মধ্যেও এলজিবিটি মানুষেরা ঠিক কতোটা সংখ্যায় রয়েছেন, ধারণা আছে আপনাদের? শিল্পের প্রতিটি শাখায় এদের বিস্তার, এদের অংশগ্রহণ – এ নিয়ে নাটকটি মঞ্চস্থ করার আগে একবারও ভেবেছেন আপনারা?
কথাগুলো গায়ে লাগবে জানি, লাগারই কথা। আপনারা হাস্যস্পদ বানাবেন এক গোষ্টীকে, আর তাদের তরফে কেউ আপনাদের পাটকেলটুকুও ছুঁড়ে মারবেনা, এতো হয়না সোনা। আর প্রতিবাদটাও এবার শুরু করতেই হতো। অনেকদিন আপনাদের এই বস্তাপচা ট্রেন্ড লক্ষ্য করছি, সিনেমায়, সিরিয়ালে, নাটকে। আর নয়।
শুনে রাখুন আর শেখার চেষ্টা করুণ। কেউ অন্যরকম হলেই তাকে নিয়ে হাসা যায়না। এই শিক্ষা সব মানুষেরই তাদের পরিবার, পারিপার্শ্বিক, শিক্ষাস্থান থেকে পাওয়ার কথা, আপনাদেরও। আর যেহেতু আপনারা এক মাধ্যম হিসেবে সমাজের কিছু মানুষের কাছে সঠিক/বেঠিক-এর পার্থক্য তুলে ধরেন, ফুটিয়ে তোলেন সমাজের অবক্ষয়-চিত্র, পরিবেষণ করেন রাষ্ট্রের দুর্নিতি – তাই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া আপনাদের পক্ষে কোনওভাবেই সম্ভব না। দর্শক হল থেকে বেড়িয়ে কি ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরবেন, সেটা ভাবার প্রয়োজন আপনাদেরও আছে। চেষ্টা করে দেখুনইনা, হয়তো পরের নাটকটা দেখে মা বাড়ি গিয়ে নিজের মেয়েলী ছেলেটাকে চড় না মেরে বরং চুমোয় চুমোয় আদর দিক। হয়তো নিজের হাবাগোবা ছেলেটাকেও পড়ানোর জন্যে আরেকটা প্রাইভেট টিউটার রাখুক। একে অন্যকে নিয়ে তামাশা করা মানুষের কাজ না। সমস্ত গোষ্ঠীকে সম্মান দিয়ে শিল্পকে আরো নতুন রঙ্গে রাঙ্গিয়ে তুলুন। নইলে এই লেখা শুধু লেখাতে সীমাবদ্ধ রাখার বাধ্যতা কিন্তু কারোর থাকবেনা। নাটককে তো দর্শক হিসেবে আমিও ভালোবাসি, হয়তো আপনাদের মতো নয়, কিন্তু যতোটুকু ভালোবাসি, সেটাকেও তো অস্বীকার করা যাবেনা। হাস্যরস হোক মধুর, যেন কোন গোষ্ঠীকে অপমান না করে – ব্যস এটুকুই তো চাওয়া আপনাদের এবং অন্য সমস্ত দলের কাছে। পারবেননা দিতে এটুকু, মানবতাকে?
ছবিঃ নাটকের টিকিট থেকে