স্টোনওয়াল, এক বৈপ্লবিক রামধনুর স্বর্ণজয়ন্তী (দ্বিতীয় পর্ব)

স্টোনওয়াল, এক বৈপ্লবিক রামধনুর স্বর্ণজয়ন্তী

(দ্বিতীয় পর্ব)

— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

<<প্রথম পর্ব -এর পর

১৯৬৯ সালের স্টোনওয়াল সরাইখানা। (ছবিসূত্রঃ উইকিপিডিয়া)

চলছিলো এভাবেই। লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক / এলজিবিটি মানুষের কথা ধৃষ্টতার সাথে একসাথে বলার কণ্ঠ ছিলো অনুপস্থিত। ম্যাটাশিন সোসাইটির মতো কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উপস্থিতি থাকলেও, জনসংযোগ অথবা গোষ্ঠীর স্বকীয়তারক্ষা সব নিরিখেই তারা ছিলো কল্পলোকের বাশিন্দা। রাষ্ট্র যেমন চায়, যেভাবে আচরণ করো, সেভাবেই জামাকাপড় পরো, এরকম তত্ব নিয়ে তারা কখনোই আপামর এলজিবিটি জনগোষ্ঠীর মনের কাছে আসতে পারেনি। অন্যদিকে রাষ্ট্রেরও কোন মাথাব্যাথা ছিলোনা সাদাকালো পোশাকের কিছু অসুস্থ(?) মানুষগুলির অধিকার নিয়ে কথা বলা এই সংগঠনকে নিয়ে। ফলস্বরূপ, জনমোহিনী রাষ্ট্র আর তার সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি ব্যবধান কমিয়ে আনতে ম্যাটাশিন ছিলো অক্ষম। কিন্তু, সমাজের এক কোণে ধিকিধিকি জ্বলবে আগুণ, আর দাবানল ছড়াবেনা তা কি হয়? অতএব…

স্টোনওয়াল সরাইখানা, ২৮শে জুন, ১৯৬৯, অন্যান্যদিনের মতো সন্ধ্যের সময় নয়, রাত তখন যুবতী, স্থানীয় সময় রাত ১টা ২০ মিনিট। সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হাজির পুলিশ, মোট আটজন। এতো রাতে পুলিশ? এই ভিড়ের সময় তো পুলিশ আসেনা সাধারনত। অবাক স্টোনওয়ালের কর্মীরাও। ভিতরে তখন প্রায় ২০০রো বেশী লোক। কিন্তু পুলিশও ঠিক খদ্দের গ্রেপতারের জন্যে আটঘাট বেঁধে আসেনি এবার। উদ্দেশ্য অন্য। তাদের কাছে ব্ল্যাকমেলের নালিশ ছিলো, তল্লাশিতে এসে হয় নিজেদের বখরা পেয়ে অথবা না পেয়ে, পুলিশ সিদ্ধান্ত নেয়, স্টোনওয়ালটাই বন্ধ করে দেবে। এদিকে খদ্দেরগুলোকে নিয়ে কি হবে? সাধারণত মহিলা পুলিশ থাকে। তারা মহিলাদের কাপড় পরা মানুষদের নিয়ে যায় বাথরুমে। তাদের দৈহিক লিঙ্গ দেখে প্রয়োজনে জেলে পোরা হবে তাই। আজ তো মহিলা পুলিশও সাথে নেই। মেয়েদের পোশাক পড়া কেউ ছেলে পুলিশের সাথে বাথরুমে যেতে রাজি নয়। তথাকথিত পুরুষ খদ্দেরদের কাছে পরিচয়পত্র চাওয়া হলে তারাও দেখাতে অস্বীকার করছে। পুলিশ ঠিক করলো কর্মী হোক বা খদ্দের সবাইকে জেলে নিয়ে যাওয়া হবে। কিছু সমকামী নারীদেরকে শারীরিক নিগ্রহ করা হয়েছে, এই অভিযোগও উঠলো। সারীবদ্ধ লিঙ্গযৌনপ্রান্তিক মানুষের বাধ্য দলটা আজ কেমন যেন বেয়াড়া আর অগোছালো। কিছু লোককে ছেড়েও দিলো তারা, কিন্তু সেই কজন সামনের দরজা দিয়ে বেড়িয়েই চলে গেলোনা। কেমন যেন একটা ভিড় জমাট বাঁধছিলো সরাইখানাটার সামনে। বাড়তে বাড়তে ১০০, তারপর দেরশো। কেউ ভিতর থেকে বাইরে আসা, কেউ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে উপস্থিত। যাদের পুলিশ ছেড়ে দিচ্ছে, তারা বাইরে এসেই নানা ব্যঙ্গাত্মক অঙ্গভঙ্গি করে পুলিশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, বাইরের দলটা হাততালি দিচ্ছে। প্রথম পুলিশের ভ্যানটা যখন ঢুকলো, দেখা গেলো যে কজনকে গ্রেপ্তার করা হবে, বাইরে তো তার দশগুন লোক!! দ্বিতীয় ভ্যানটাও এসে থামলো। স্টোনওয়ালের কর্মীদের একে একে তোলা হচ্ছে এই ভ্যানদুটিতে। বাইরে জমাট বেঁধে সবাই। আওয়াজ তুলছে তারা, হাততালি দিচ্ছে, গান করছে। সবাই হাসছে, ঠাট্টা করছে, আসলে রাগেরই অভিব্যাক্তি। ভিন্নধর্মী মানুষদের রাগ দেখানোর উপায় তো অন্যরকমই হবে। এরমধ্যে খুছরো পয়সা আর ভাঙ্গা মদের বোতল এসে পড়তে লাগলো পুলিশের ভ্যানে। এর মধ্যে এক পুরুষালী সমকামী মহিলাতে টেনে বাইরে নিয়ে এলো চারজন পুলিশ। সেই মহিলা লড়ে যাচ্ছেন চারজন পুলিশের সাথে। হাতে শক্ত করে হাতকড়া। বাইরের ভিড়ের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো “কিছু করুন না আপনারা”। পুলিশ জোড় করে মহিলাকে পুড়লো ভ্যানে, এবার আগুনে ঘি পড়লো।

উত্তেজিত জনতাকে শায়েস্তা করার চেষ্টা করতেই আরো ক্ষেপে গেলো তারা। এই ফাঁকে যাদেরকে হাতকড়া পরিয়ে ভ্যানে তোলা হয়েছিলো তারাও নেমে আসলো ভ্যান থেকে। জনতা পুলিশের গাড়ি অবধি উল্টে দেওয়ার চেষ্টায় প্রায়। পুলিশের গাড়ি আর ভ্যান বেগতিক দেখে দে চম্পট। এতে ভিড়ের উৎসাহ আর সংখ্যা দুই যেন বেড়ে গেলো।
— “মামারা এবার ঘুষ পাইনি রে!”
— “দে শুয়োরগুলোকে!”
পুলিশদের দিকে উড়ে আসলো পয়সা, বিয়ারের ক্যান। হতভম্ব পুলিশ, সামনে ৫০০/৬০০ লোক। যাকে পারলো ধরপাকড় করা শুরু করলো তারা। সবাই কিন্তু সমকামীও নয় সেখানে, কেউ ফুটপাথে শোয়া কিশোর, কিছু যৌনকর্মী, কেউ বা কাছেপিঠের জায়গা থেকে আসা এমন কিছু মানুষ যারা পুলিশের কাজকর্মে এমনিতেই বিরক্ত। ভয় পেয়ে পুলিশরা আবার ঢুকে গেলো স্টোনওয়ালের ভিতরে। বাইরের ভিড়টা এবার ইট/পাথর/জঞ্জাল/বোতল ছুড়তে লাগলো স্টোনওয়ালের উপর, জানলা ভেঙ্গে যেতে লাগলো, দরজার সামনের জঞ্জালের স্তুপে কারা যেন আগুণ ধরিয়ে দিলো। জলকামান হাতে নিলো পুলিশ, কিন্তু জলের সেরকম জোড় নেই। বাইরের লোকগুলো ভয় পাবে কি, আনন্দে ভিজতে থাকলো সেই জলে, যেন তারা আরো মজা পেয়েছে। কিন্তু পানি টিপটিপ বরসা বা সজোরে, আগ ঠিকই লগায়ি। পেরেক-আঁটা তক্তাগুলো উপড়ে এবার ভাঙ্গা জানলা-দরজা দিয়ে ঢুকে এলো উত্তেজিত জনতা। কাঁপা কাঁপা হাতে বন্দুক হাতে নিলো পুলিশও। গুলি ছুড়লেই কি পরিস্থিতি আরো হাতের বাইরে চলে যাবেনা? আক্ষরিক অর্থে এবার আগুণ জ্বলছে স্টোনওয়ালে। কেউ বোধহয় ছড়িয়ে দিচ্ছে জ্বালানী তেল এদিকে সেদিকে। ফায়ার ব্রিগেডের সাইরেন শোনা গেলো না?

ক্রমশ …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *