রাজ্যে বাঙ্গুর হাসপাতালে ট্রান্সজেন্ডার (রূপান্তরকামী) করোনা রোগীদের জন্য নির্ধারিত হল চারটি বেড

রাজ্যের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য্যের সঙ্গে রূপান্তরকামী আন্দোলনকর্মী রঞ্জিতা সিনহা

নিজস্ব সংবাদদাতা, ২৬শে এপ্রিল, কোলকাতাঃ

দাবী ছিলো অনেকদিনেরই, সরকারি হাসপাতালে গেলে, শুধুমাত্র অন্যান্য রোগীর আত্মীয়স্বজনই নয়, অপমানিত হতে হতো স্বাস্থকর্মী এমনকি চিকিৎসকদের হাতেও। সেই জায়গায় দাঁড়িয়েও লড়াই থামাননি রুপান্তরকামী আন্দোলনকর্মী রঞ্জিতা সিনহা। করোনার আক্রমণ যখন সবে শুরু হচ্ছে, সেই ১৯শে মার্চেই, তিনি চিঠি পাঠান রাজ্যসরকার এবং কেন্দ্রসরকারের কাছে। দাবী জানান তাদের মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকারের। তারপর কেন্দ্র সরকারের তরফে আসে কিছু টাকা, আর রাজ্যের তরফেও রেশনের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু যদি সত্যিই কোন রূপান্তরকামী মানুষকে আক্রমণ করে মহামারী করোনা, কি হবে তখন?

“নিরুপায় হয়ে ২০ থেকে ৩০ জন রূপান্তরকামী মানুষেরা একসাথে রাস্তায় বসবাস করেন, যদিও কোলকাতা পুলিসের তরফে তাদের খাবার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, তবে তাদের হাইজিন? তারা জানেইনা কি করে স্যানিটাইসার ব্যবহার করতে হয়। সর্দিকাশি হলে নিজেদেরকে সকলের থেকে আলাদাই বা এরা কি করে রাখবে? আমরা, যেসকল রূপান্তরকামীরা খানিকটা হলেও সচ্ছল, রোগ হলে মোটামুটি একটা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে নিজেদের চিকিৎসা চালাতে পারি, তারা হয়তো বেঁচে যাবো, কিন্তু আমার এই গরীব ভাইবোনেরা, ভিক্ষে অথবা যৌনপেশা থেকে যাদের হাতে উঠে আসে সামান্য কিছু পেট ভরানোর রসদ, তাদের কি হবে?”

তাই দাবী ছিলো আলাদা ওয়ার্ডের। অবশেষে গতকাল বিকেলে ফোন আসে রাজ্যের উপস্বাস্থ্যমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য্যের কাছ থেকে। বর্তমান সময়ে একদম আলাদা একটি ওয়ার্ড গঠন প্রায় অসম্ভব হলেও আপাতত চারটি বেড নির্দিষ্ট করা হলো রূপান্তরকামী ভাইবোনেদের জন্যে এরকমই জানানো হয়। না কোন সরকারী কাগজ হাতে আসেনি, বর্তমান সময়ে হয়তো এতোটা লেখাপড়া করে অর্ডার পাস করাটাও কষ্টসাধ্য। তবু একেও এক আশ্চর্য সাফল্য হিসেবেই দেখছেন কোলকাতার বেশ কিছু রূপান্তরকামী মানুষেরা। এম আর বাঙ্গুর হাসপাতালের সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ইলনেস বিভাগের যেসকল ওয়ার্ড আপাতত রাজ্যের ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের জন্য নির্ধারিত হলো সেগুলি এরকমঃ

  • পুরুষ বিভাগের ৭ নং ওয়ার্ডের ১২ নং বেড (ট্রান্সমেন বা রূপান্তরকামী পুরুষদের জন্য নির্ধারিত)
  • পুরুষ বিভাগের ৮ নং ওয়ার্ডের ৭ নং বেড (ট্রান্সমেন বা রূপান্তরকামী পুরুষদের জন্য নির্ধারিত)
  • মহিলা বিভাগের ১ নং ওয়ার্ডের ১৩ নং বেড (ট্রান্সউওম্যান বা রূপান্তরকামী নারীদের জন্য নির্ধারিত)
  • মহিলা বিভাগের ১০ নং অয়ার্ডের ২ নং বেড (ট্রান্সউওম্যান বা রূপান্তরকামী নারীদের জন্য নির্ধারিত)

হাসপাতালে নিজেকে নারী অথবা পুরুষ হিসেবে মৌখিক পরিচয় দিলেই, তার ভিত্তিতে এই বেডগুলি পাওয়া যাবে। কিন্তু শুধু এখানে থেমে থাকলেই হবেনা, কোলকাতার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় যাতে রূপান্তরকামী ভাইবোনেদের জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা করা যায়, সেটাও চেষ্টা করতে হবে বলে মনে করেন আন্দোলনকর্মী রঞ্জিতা। একজন রূপান্তরকামী মানুষকে কোন ওয়ার্ডে কাদের সঙ্গে রাখা হচ্ছে, তা তাদের স্বাচ্ছন্দ্য এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। রাজ্যসরকারের এই সদর্থক পদক্ষেপের পর অনেক রূপান্তরকামী ভাইবোনেরা নিজেদের রোগ না লুকিয়ে বরং চিকিৎসার পথই বেঁছে নেবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি। বলাই বাহুল্য, করোনা মহামারীর সংক্রমণ রোখার জন্য, এবং শুধুমাত্র রূপান্তরকামী ভাইবোনেদের জন্যই নয়, গোটা সমাজের জন্যেই এই সিদ্ধান্ত অনেকটাই সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

কাঁচালঙ্কার তরফে শ্রীমতী রঞ্জিতা সিনহা এবং রাজ্যসরকারের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানানো হলো। স্ব-লিঙ্গ-নির্ধারনের এবং সংরক্ষণের যে প্রতিশ্রুতি ভারতের রূপান্তরকামী জনগণকে সুপ্রিমকোর্টের নালসা রায় দিয়েছিলো, সেই মর্মেও এই সিদ্ধান্ত এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আশা করি দেশের কেন্দ্রসরকার এবং সমস্ত রাজ্যসরকার, এভাবেই, এই অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকারগুলিকে সুনিশ্চিত করবে। আর শুধু এ দেশেই নয়, সাম্য আর মানবিকতার জয়গান ধ্বনিত হোক সমগ্র বিশ্বে।

ছবি সূত্রঃ রঞ্জিতা সিনহার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *