জুলহাজ, আজ তোমার জন্মদিন

সাঁঝবাতি, ঘনকালো মেঘ আর ঝড়জল, কাঁপা কাঁপা, দপ করে জ্বলে ওঠা, ছিলো কি সেই চোখের কোনে, নিভে যাওয়ার আগে?

জুলহাজ মান্নান, তাকে আমি সত্যি চিনিনা। নাকি সত্যিই চিনিনা? অনেককেই তো সামনাসামনি দেখিনি, কথা/আলাপ হয়নি মোটেও। তবু কি চিনিনা?
কেন? তার লেখা তো পড়েছি, ছবি দেখেছি, ভিডিও দেখেছি, আর তার প্রোডাকশনে তৈরি হওয়া ম্যাগাজিন রূপবান? হ্যাঁ, তাও হাতে পাওয়ার সুযোগ ঘটেছে।
তাই নামটা শুনলেই হয়তো কেমন যেন…

গুলিয়ে যায় বোধহয়, ঠিক যেমন লিখতে গিয়ে গুলিয়ে গেলো, আটকে গেলাম “যেন”-র পরে। “যেন”, অদ্ভুত শব্দ। কতো কল্পনা তৈরি হতে পারে এই “যেন” শব্দের হাত ধরে। শরীরী অথবা মানসিক। জুলহাজ মান্নান আমার কাছে ঠিক সেরকমই এক কল্পনা।

২৫শে এপ্রিল ২০১৬, রূপবানের কথা আগেই শুনেছি, ছবি, আলোচনা – সবের উপরেই নজর গিয়েছে। পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখিনি তখনো। তবে এটুকু জানতাম, বেশ কয়েকটা চাপাতি-চালিত খুনের পরেও বাংলাদেশ সরকারের হাত গুটিয়ে বসে থাকা, নাস্তিকতার বিরূদ্ধে বজ্রনির্ঘোষ নিষেধাজ্ঞা, এর মাঝে কোথাও সে দেশের যৌন-লিঙ্গ-সংখ্যালঘুরা এক নতুন লড়াই শুরু করে দিয়েছে। আর তার পুরোধায় যে নামটা বারবার উঠে আসছে, তা “জুলহাজ”। যে মানুষটা পাহাড় থেকে পায়ে দড়ি বেঁধে লাফ দিতে পারে, যে মানুষটা অসাধারণ বাকপটুতায় জয় করে মানুষের হৃদয়, যে মানুষটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর হাতে তার ধৃষ্টতার নমুনা তুলে দেয় নম্র অথচ সাহসী পদক্ষেপে, যে মানুষটাকে খুব কমই রাগতে দেখেছে সবাই। বরং দেখেছে বন্ধুর সাহায্যে নাওয়া-খাওয়া ভুলে জেলের বাইরে বসে থাকতে, শুনেছে অক্লান্ত নিঃস্বার্থ পরিশ্রমের মধ্যে এক নতুন মানবাধিকারের স্বপ্নকে জাগিয়ে তোলার তার সেই ভোরাই সুর। আমি শুনিনি। শুধু শোনার গল্প শুনেছি। যারা দেখেছে, শুনেছে, তাদের হিংসে হয়, আর দুঃখ হয় এই ভেবে, যে আমার আর তা হবেনা কখনো। সেই দিনই ঘুমকাড়া খবরটা এসেছিলো। শেষ।

জুলহাজ, আজ তুমি বেঁচে থাকলে তোমার বয়স হতো চুয়াল্লিশ। হ্যাঁ, আজ তোমার জন্মদিন। আজ তুমি চেঁচিয়ে কেঁদেছিলে নিজের সমস্ত অস্তিত্বটুকুর নির্যাস নিয়ে, এই পৃথিবীকে জানিয়েছিলে তুমি এসে গেছো, পৃথিবী কি কিছু জেনেছিলো সেদিন? চিনেছিলো এই কালবৈশাখীর অঙ্কুরকে? কেঁপেছিলো মাটি? বৃষ্টি এসেছিলো গাঙচিলের শরীর বেয়ে? না হয়তো।

ঝিলে কিন্তু কিছু শালুক ফুটেছিলো। কিছু জোনাকির আলো ঘনঝোপের মধ্যে খুঁজেছিলো অন্ধকার পেরোনোর সন্ধান। পাড়ার খেন্তি ভোরবেলা ভৈরব রাগে রেওয়াজ করে ঘুম ভাঙ্গিয়েছিলো কিছু বদ্রীপাখির সাথে তাল মিলিয়ে। চাঁদের গায়ে আদর মাখিয়ে কিছু মেঘ সরে গেছিলো, ছাদের অন্ধকার সরে জোছনার সর পড়েছিলো চিলেকোঠার জানলায়। কাপড়ের কারখানা থেকে ফিরে সাবিনা সেদিনও হাড়িতে ফুটিয়েছিলো গরম ভাত, সেই গন্ধ উসকে দিয়েছিলো তার ঘুমিয়ে পড়া হাড়ভাঙ্গা স্বপ্নগুলোকে।

এই দেখো, আবার কেমন যেন, সেই “যেন”-এর চক্রব্যূহেই আটকে পড়লাম। আটকালে তুমি, অথচ তোমায়, নাহ! চিনিনা আমি, পরিচয় হয়নি কখনো। তবু এটুকু জানি পরশ পাথরের ক্ষমতা তোমার মধ্যে নিহিত ছিলো। তোমার চোখের দৃষ্টি দুর্বলের চোখের উপরে ঘষা খেলে, তাতে এঁকে যেতো দাবানল। পরাধীন কিছু মানুষকে সাময়িক স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিলে তুমি। নিজের বাড়ির আর মনের দরজা খুলে দিয়েছিলে সবার জন্যে।

আত্মায় বিশ্বাস করিনা, নইলে বলতে পারতাম, যেখানেই থেকো ভালো থেকো।

রজনীগন্ধার গন্ধে নয়, শুধু আমাদের মনে, এই রক্তমাখা তুমি, রয়ে যাবে ফুটে, লাল রঙ হয়ে, গোলাপের মতো।

— * — *** — * —

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *