যতটুকু জেগে থাকি

[শুরুর আগেঃ

লেখাটি এই শর্মার নিজেরই লেখা। লোকের কাছে লেখা আদায় করতে করতে আর নতুন কিছু লেখার সময়ই করে উঠতে পারলুমনা। কিন্তু এবারে প্রকাশিত লেখাগুলির মধ্যে এইটেই সবচেয়ে জাবদা, কে জানে পড়তে পড়তে পাঠক ধৈর্য হারায় কিনা। চেষ্টা করলাম চেনা ছকের বাইরে গিয়ে এক অন্যধরনের যৌনতার কথা তুলে ধরতে। পাঠকের ভালো লাগলে, নিজেকে ধন্য মনে করবো।]

যতটুকু জেগে থাকি

অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

 

 

।। ১ ।।

জায়গাটা সত্যি খুব অদ্ভুত। নীল ধোঁয়ায় মাখা একটা পাবলিক টয়লেট। কিন্তু ছেলেদের আর মেয়েদের পাবলিক টয়লেট তো আলাদা হয়! কোথাও কোন ইউরিনাল নেই! সিমেন্টের চারটে দেওয়াল! সবাই এমনি এমনি স্রেফ দাঁড়িয়ে আছে? ছেলে, মেয়ে, সবাই?

কিন্তু হৃদিকা জানে এটা একটা টয়লেট। কি করে জানে সেটা ভাবার সময় ওর নেই। জায়গাটা কলেজের একদম কাছে,এটাও কেন জানি ওর অজানা নয়। এখানে যদি কেউ দেখে ফেলে? ছি!

কিন্তু ওরা? ওরা কোথায়? ওদেরকে না নিয়ে সে তো আর যেতে পারেনা। এই যে তাক থেকে নামালো একটু আগে? অ্যালেক্স, রাজা, ধুবলি, রোজি, পিটার, জেনিফার, শেলি, রাণী, পল, ডুগডুগি … কোথায় ওরা?

পাশের লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছে। ঠিক চিনতে পারছেনা। তাকেই জিজ্ঞেস করবে? করতেই হাতের ইশারায় সে ডাকলো হৃদিকাকে। আধোচেনা লোকটির পিছনে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বেরিয়ে এল সে। আর যে কোন উপায় নেই। ধোঁয়াটায় যেন পিছু নিয়েছে। খাঁখাঁ দুপুরে কলকাতার রাস্তায় এই ধোঁয়া থাকার কথা নয়। তবু…।

একটা বাড়ির দরজায় ঠকঠক করলো লোকটা। নাহ ভিতর থেকে জবাব এল “নেই”। আরেকটা বাড়িতে আবার ঠকঠক। সেই একই কণ্ঠস্বর বললো, নাহ! নেই। তারপর আরেকটা বাড়ি। আরো একটা। লোকটা এবার ঘুরে হৃএর দিকে তাকালো। মুখটা পাল্টে গেলো। অবিকল সোমনাথ।

“তোর তেনারা তো নেই, আমাকেই নিয়ে চ।”

আশ্চর্য! ভয় পেলোনা হৃদিকা, হাসিও না। কিন্তু কিছু একটা তো পাওয়ার কথা। কিছু একটা। হয় হাসিতে উত্তর দিক। বা চিৎকারে। কিন্তু সে সবের কোন চেষ্টাই করলোনা হৃদিকা। সোমনাথকে ছেড়ে নিজের মতো একাই হাঁটা দিলো। একটা বাড়ির বারান্দায় তাদের দেখতে পেলো সে। কিন্তু পাশে বসে ও কে? ঐ বাচ্চা মেয়েটা… বুল্টি না? ছোটবেলায় ওর সাধের ভুরিবাবুর পা ভেঙ্গে দিয়ে পালিয়ে গেছিলো চুপচাপ। পরে আবিষ্কার করে ভেজা চোখে সারাটা রাত কাটিয়েছিল হৃদিকা। কিন্তু ও বড় হয়নি কেন? একইরকম কি করে রয়ে গেছে? সে তো প্রায় ১০ বছর আগের কথা।

“বুল্টি!”

বিস্ময় মাখানো গলায় ডাকতে চেষ্টা করলো সে। তবু গলা দিয়ে চিঁচিঁ ছাড়া কিছুই বের হলোনা। এবার একটু ভয় পেল হৃদিকা। কথা বলার চেষ্টা করলেও গলা দিয়ে একটুকু আওয়াজ বেরোলোনা তার। বুল্টি এতক্ষণে তার দিকে ঘুরে তাকিয়েছে। মুখটা ভালো করে বুঝতে পারছে না সে।

“কি রে? কেমন আছিস?”

এই কথাতেই যেন আরো ভয় পেয়ে গেলো সে। ঝাঁপিয়ে পড়লো তার সাধের ‘তাদের’ উপর। মাঝের লোহার রেলিংটা যেন গায়েই লাগলোনা। যেন হাওয়ায় তৈরি আয়তক্ষেত্রের নকশা। বুল্টি বাঁধা দিতে চেষ্টা করলো। প্রেক্ষাপট আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে কি করে যেন পাল্টে গেলো। আবার সেই টয়লেট। সেই একই মানুষজন যাদের কাউকে ও চেনেনা। স্রেফ দাঁড়িয়ে থাকা কিছু ছেলে মেয়ে। বুল্টি উধাও। সোমনাথকেও দেখা যাচ্ছেনা। মেঝেতে শুয়ে হৃদিকা। আর চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে…তার পুতুলগুলো।

হাল্কা লাগলো। সবগুলোই আছে। ডুগডুগিকে বুকে টেনে নিলো সে। হাতের খঞ্জনি মার্কা সিম্বালসদুটো বাজাতে বাজাতে হৃদিকার বুকের উপর চেপে বসলো। ডুগডুগ! ডুগডুগ! অ্যালেক্সের পায়ে ছুঁচালো অথচ নরম স্কেটিং জুতো। সে পিছলে নেবে গেলো, কপাল থেকে, বুক বেঁয়ে সিল্করুটে নাভি, নাভি থেকে যোনি।

‘অ্যালেক্স! সোনা আমার। প্লিজ! জুতোটা খুলে নাও।”

আবার চিঁচিঁ। তবু অ্যালেক্সের বুঝতে কোন অসুবিধা হবেনা এ কথা হৃদিকা জানে। তাই এবার আর ভয় নেই তার। অ্যালেক্স কিছুটা মুচকি হাসলো। আর জুতো না খুলেই… ঊফফফফফ। অ্যালেক্সের পায়ের পাতাদুটো পারফেক্ট। নরম রবারের তৈরি। পায়ের পাতাটা ঠিক কোণাকুণি বসানো। একদম পাতা নয়। একবার, দুবার, ভিজে গেলো অ্যালেক্স। স্নান সেরে নিলো কষাটে মিষ্টি রসে। কোথায় কাছে পুজোর ঢাক বেজে উঠলো। জোরে। কেমন যেন তালে তালে কাঠি পরছেনা। দাম দাম দাম! হৃদিকার ‘ওরা’ সবাই মিলে ঘিরে ধরেছে হৃদিকাকে। হৃদিকা জড়িয়ে ধরছে হৃদিকার ওদেরকে। তাদের হৃ হৃ ডাক পরে নিচ্ছে কানে। আর মানুষগুলো? ধীরে ধীরে তার দিকে এগোচ্ছে, হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে তার পেলব শরীরের উদ্দেশে। আর… মিলিয়ে যাচ্ছে… হাওয়ায়।

 

।। ২ ।।

দাম দাম দাম! এবার ঘুম ভাঙলো হৃদিকার। মা ডাকছে। নিশ্চয়ই অনেকক্ষণ। কারণ টোকা দেওয়া ছেড়ে এবার রীতিমত দরজা ধাক্কাচ্ছে মা।

‘এই হৃ, ওঠ। সোমনাথ এসে পড়বে এবার।’

‘আসছি মামাই। একটু দাঁড়াও।’

দরজায় ছিটকিনি দিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস তার অনেকদিন থেকেই। মা বারণ করলেও শোনেনা। অনেকদিনের অভ্যেস। সেই মাধ্যমিকে পড়ার সময়… হ্যাঁ! তাই হবে। ষোড়শী রাইকিশোরী ধীরে ধীরে যখন পুতুল খেলতে খেলতে বুঝলো, তার খেলাটা একটু অন্যরকম, আর একটু আড়াল করে রাখার জিনিস, তখন থেকেই তো। সে এবার নিজের দিকে তাকালো। ম্যাক্সির খুটটা ওপরে নাভি অবধি তোলা। শরীরের চক্রযন্ত্রনা শেষ হয়েছে দুদিন আগেই। এই সময় প্যান্টি পড়ার অভ্যেস রাতে ঘুমানোর সময় তার নেই। সারা শরীরে পিষে রয়েছে অসংখ্য সফট টয়েজ আর রাবারের পুতুল। ঘামে ম্যাক্সিটা এমনভাবে ভেজা যে পর্দার ফাঁকচেরা সকালের এক ফিতে আলোতেও লজ্জা পেল সে। চাদরটাও থাইয়ের কাছে ভিজে আছে। দুটোকেই কাচতে হবে।

‘কি রে? আর কতোক্ষন? দরজাটা খোল। কয়েকটা টপ ইস্তিরি করেছি। একবারে তোর আলমারিতে রেখে দে।’

তড়িঘড়ি খাট থেকে নেবে ম্যাক্সিটা পাল্টে নিলো হৃদিকা। সঙ্গে চাদরটাও। জানলা খুলে দিলো। পুতুলগুলো চটপট তুলে দিলো তাকে। চটপট কিন্তু যত্নে। ঘরে একটা ঝাঁঝালো মিষ্টি গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। পারফিউমটা কয়েকবার স্প্রে করে ফ্যানটা জোরে চালিয়ে দিলো। মুখ-গলা-কাঁধ টাওয়েল দিয়ে মুছলো। দরজাটা খুললো।

‘এত সেন্ট দিস কেন ঘরে? আর এত জোরে ফ্যানই বা চালিয়েছিস কেন? ঠাণ্ডা লেগে যাবে না?’

চুপ করে তার হাত থেকে কাপড়গুলো নিলো হৃদিকা। মুখে কিন্তু সেই বিচ্ছু হাসি। প্রায় রোজ সকালে উঠে দরজা খুলে তার গালে একটা হামি খায় তার মেয়ে। হাসিটা রোজই থাকে। তবে একটা অদ্ভুত জিনিস, যেদিন তার ঘরে সেন্টের গন্ধ থাকে, আর ফ্যানটা একটু জোরে চলে, সেদিন মেয়ে একটু দুরে দাঁড়িয়ে থাকে, আর হামি খায়না। এ বয়সে এসব হওয়া স্বাভাবিক। তাই মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। নিজের রিটায়ারমেন্টের আগে মেয়ের একটা হিল্লে করলে তবে তার শান্তি। তারপর ঠাকুর যেদিকে টানবেন, চলে যাবেন তিনি।

তবে নিজের মেয়েকেই মাঝে মাঝে বুঝতে পারেননা। যেন কতো দুরের মানুষ। বিয়ে নিয়ে কথা উঠলেই হেসে উড়িয়ে দেয় হৃ। অলোক যাওয়ার পর, একা হাতে এই সংসারটাকে টানতে হয়েছে শর্মিষ্ঠাকে। মেয়ের পড়াশুনো, বাড়িভাড়া, খাওয়া, পড়া, সব। খুব কড়া ধাতের মহিলা হলেও মেয়ের গায়ে হাত তোলায় বিশ্বাস করেননি কখনো। আর অলোকও চাইতোনা তার মেয়েকে কেউ বকাঝকা করুক। আলোক আর নেই। তার ইচ্ছেগুলো অন্তত থাকুক।

ইচ্ছে? নিজের মনেই খানিকটা হেসে নিলেন শর্মিষ্ঠা। তার নিজের ইচ্ছেগুলো ধীরে ধীরে নিজের ইচ্ছেতেই মেরে ফেলেছেন; তিনি নিজে। নিজের জীবনকে অন্যের ইচ্ছের আধারে গলিয়ে ঢেলে দিয়েছেন। তার নিজের জীবন এখন সমতল। কোন ঢেউ নেই। কোন বুদবুদও খেলেনা। অলোক তাকে বলতো মেয়ের বন্ধু হতে। চেষ্টা করেছেন। তবে পুরোটা হয়তো পারেননি। একা মায়ের পক্ষে সমাজে বেঁচে থাকা সোজা নয়। শুধুমাত্র নিজের আত্মসম্মান আর স্বামীর অফিসে পেয়ে যাওয়া চাকরিটাকে সম্বল করে আজ তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। মেয়েকেও সুস্থ জীবন দিতে পেরেছেন। এটুকুই।

‘ব্রেকফাস্ট আর চা টেবিলে আছে। খেয়ে ধন্য করো। আমি ঠাকুরের জল দিতে গেলাম। এখন পুতুল আর ছবিআঁকা নিয়ে বসবিনা কিন্তু। এই বলে গেলাম।’

‘ওক্কিইইই মামাই। এখুনি স্নান সেরে যাচ্ছি।’

‘তোর মোবাইলে মীরাবাঈয়ের ভজন আছে না? শুনিস তো মাঝে মাঝে। শ্যামাসংগীত নেই কোনো?’

‘ধ্যুত। ওসব বাজে গান আমি মোবাইলে রাখবো? নেভার।’

‘তোমাদের জেনারেশনটাই এখন এরকম। শ্যামাসংগীত বাজে গান? ছি!’

‘আমি নাস্তিক মামাই। বাবার মতো। তুমি তো জানো।’

‘আচ্ছা? তবে মীরার ভজন শুনিস কেন?’

‘ও তুমি বুঝবে না মামাই।’

‘হ্যাঁ। আমি তো কিছুই বুঝিনা। যত বুঝিস তোরা।’

আবার বিচ্ছুদের মতো হাসিতে ভরে গেলো হৃদিকার মুখ।একবার এরকম হেসে দিলে মেয়েকে আর কিচ্ছুটি বলতে পারেননা শর্মিষ্ঠা। বড়ো মিষ্টি দেখতে তার মেয়ে। হাসলে আরো মিষ্টি লাগে। ব্যাবহারে সবার মন জয় করে নেয় এক মিনিটে। মা হয়ে হয়তো এরম প্রশংসা তিনি করতেই পারেন। তবে এ ভাবাটা মিথ্যে নয়। তিনি জানেন সবাই অন্তত এ ব্যাপারে তাকে সমর্থন করতে বাধ্য। হৃদিকা তার অহংকার।

‘বেশ! তাহলে ঐ মীরার ভজনই চালাও।’

এটুকু বলে গটগট করে বেরিয়ে এলেন মেয়ের ঘর থেকে। পিছনে বেজে উঠলো। ‘মেরে তো গিরিধর গোপাল, দুসরো না কোয়ে…’।

 

।। ৩ ।।

‘কি রে শালা? আবার আমাদের বাড়ি বসে চিঁড়ের পোলাও সাটাচ্ছিস? তোকে বাড়িতে খেতে দেয়না?’

খিল খিল হাসি আর এই ছোট্ট ইয়ার্কির উৎসের দিকে আড়চোখে তাকায় সোমনাথ। সুন্দর লাগছে হৃদিকাকে। একটু গাব্লুগুব্লু  হলেও হৃ সুন্দরী। ফর্শা টকটকে রঙের উপর কালো-রুপোলী শাড়ি।  কি শাড়ি সোমনাথ জানেনা, কিন্তু হৃকে অসাধারণ লাগছে। অথচ এসব বলতে গেলেই হুল্লাট চাট, তাই চেপে যাওয়াই ভালো।

‘চিঁড়ের পোলাওটা মাসিমা ফ্যান্টা বানায়। ছাড়া যায় নাকি?’ হঠাত গলায় অবাক করা কপট ভাব এনে অতিরিক্ত ভালোমানুষি গলায়…

‘শালা বলছিস যে। মুখে কথা ফুটেছে দেখছি। মাসিমা শুনলে…’

‘আর মাসিমা’ হাল্কা চোখ মারে হৃ, ‘মামাই স্নানে গেছে।’

সোমনাথ তাকিয়ে থাকে হৃএর দিকে। অন্য ধাতের একজন মেয়ে। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড়ো হওয়া, ঝগড়া, মারামারি, ভাব এসবের মধ্যে হৃ কবে যেন বাচ্চা মেয়ে থেকে নারী হয়ে উঠেছে। মাঝে দুজনের নিজস্ব বন্ধুসার্কেল হয়েছে। যোগাযোগ যে একইভাবে থেকে গেছে তা নয়। কিন্তু থেকেছে। শরীরে বাড়লেও মনে হৃ এখনো বাচ্চা। অন্তত সোমনাথের নিজের তাই বিশ্বাস। সোমনাথ, ওর বন্ধু, এবং সে যে একজন পুরোমাত্রায় যুবকও, সেসব বোধ হৃএর এখনো অতোটা হয়নি। কোথায় যেন সে শুনেছিলো, সাধারণত একজন মেয়ে, সমান বয়সের একজন ছেলের চেয়ে নাকি অনেক বেশি মানসিকভাবে পরিণত। কিন্তু হৃ? নাহ। ও আছে নিজের সারল্য নিয়ে, নিজের ছবি আঁকা নিয়ে, আর নিজের…, নাহ এর চেয়ে বেশি সোমনাথ জানেনা। এই সরল মেয়ে বন্ধুটির অনেক কিছুই এখনো সোমনাথ বুঝে উঠতে পারেনি। সুন্দর সাবলীল পুরুষ হিসেবে সোমনাথ গর্ব করতেই পারে। মেয়েরা তাকে ঝাড়ি মারে। অনেকে কাছে ঘেষতে চায়। সোমনাথ জানে, বোঝে, আমল দেয়না। শুধু নিজের মনে এই নিষিদ্ধ সারল্যকে কাছে পেতে চায়। নিজের সমস্তটা দিয়ে উপচে পরতে চায় তার বাল্যবান্ধবীর সমস্তটার উপর। শান্ত গাছে, বৃষ্টির মতন। সবুজ মাঠে, বাজের মতন।

‘ঐ শালা। ওরম ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে কি দেখছিস? আমার খাওয়া শেষ। তুই শেষ কর এবার। কলেজ যেতে হবে তো, না কি?’

‘আজ হঠাৎ শাড়ি? কলেজেই যাবি তো? নাকি কোথাও র‍্যাম্পে বিলাই-হন্টন আছে?’

‘আমি! আর বিলাই-হন্টন? আরে কলেজে আজ ফ্রেশারস আছে না? তাই আমরা মেয়েরা… আমার যদিও ইচ্ছে ছিলোনা, কিন্তু শালা অবন্তিকা কালকে এতো ঢং করলো…’

‘হৃ!’ ভারি মহিলা কণ্ঠস্বরে এবার একটু দমে যায় হৃ। হাল্কা ভিজে খোলা চুল মেলে, একটা খয়েরি সাদা তাঁতের শাড়ি পরে জগদ্ধাত্রির মতো যেন আবির্ভূতা হন শর্মিষ্ঠা। ‘ছি! তোমায় আগে আমি অনেকবার বারণ করেছি। এভাবে কারোর সাথে কথা বলবেনা। আজ যদি তোমার বাবা…’ চুপ করে গেলেন শর্মিষ্ঠা। শাসন থাক।

‘সরি মামাই।’ হৃ হাত মুখ ধুয়ে চুপচাপ দরজার দিকে এগোয়। আস্তে আস্তে। বন্ধুদের সাথে যতই ইয়ার্কি করুক, তার মায়ের মতো কড়া ধাতের মহিলার সামনে ফাজলামি মারার সাহস তার নেই। তার মা ছোটবেলায় তাকে মারধর করেছেন এমন নয়। খুব যে বকাবকি করেন তাও নয়। তবু কি যেন একটা অমোঘ অঙ্গুলিনির্দেশে এই দুযাত্রির নৌকোটাকে তিনি টেনে নিয়ে চলেছেন বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে। হৃ তার কাছে এতোটাই ঋণী, এতোটাই কৃতজ্ঞ যে কোনভাবে নিজের মামাইকে আঘাত দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। হৃ দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সোমনাথ হাসি চেপে, হৃএর পিছন পিছন বেরিয়ে যায়।

শর্মিষ্ঠা হাত দুটো জোড়া করে কপালে ঠেকান। পরম মমতায়, বিড়বিড় মন্ত্রোচ্চারণে মেয়ের যাত্রাপথ-সুরক্ষায় বহাল করেন ত্রিশুলা মহিষাসুরমর্দিনীকে। তারপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বেরোবার দরজাটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।

 

।। ৪ ।।

‘উউউফ!’ সোমনাথ চেঁচিয়ে ওঠে। ‘ঝুল্পি ধরে টানলি কেন?’

‘খুব মজা নিচ্ছিলি না যখন মামাই আমায় বকছিলো?’

‘হ্যা! বেশ করেছি। কি করবি?’

সোমনাথ একটু বেশিই রেগে গেছে দেখে হৃ ওর গায়ে মাথায় হাত বোলায়।

‘না লে বাবু, সলি। কিচ্ছু কলবোনা। তবে যা করার আমি করে ফেলিনি কি?’

খিলখিল হাসিতে রোদ খেলে যায় হৃএর মুখে। সোমনাথের রাগ পড়ে যায়। কপট সুরে বলে…

‘নাম, আমার বাইক থেকে। হেটে কলেজে যা। যা ভাগ।’

‘ঐ দেখো। বললাম তো সঅঅঅঅঅলি। প্লিজ চ এবার। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘হ্যা, আমি দেরি করালাম যেন।’

‘না তা ঠিক নয়।’ একটু থেমে… ‘যাকগে জিম করে তো ভালোই বাইসেপ আর বুক বানিয়েছো চাঁদু। কটা মামনি পটালে?’

উত্তর না দিয়ে সোমনাথ বাইকে স্টার্ট দেয়। হৃদিকা খুব ক্যাসুয়ালি জড়িয়ে ধরে ওর সুগঠিত অ্যাবস। সোমনাথের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে। নাহ! হৃকে এবার বলতেই হবে। মনে মনে ভেবে চলে… শান্ত গাছে, বৃষ্টির মতন। সবুজ মাঠে, বাজের মতন।

 

।। ৫ ।।

সোমনাথকে নিয়ে কলেজে অনেকেই ক্ষ্যাপায় হৃদিকাকে। হৃ কখনোই ব্যাপারটাকে আমল দেয়না।

‘যাই বল। সোমনাথ বললে আমি ওকে এখনই বিয়ে করবো।’ নীলাঞ্জনার কথায় হেসে ওঠে সব্বাই।

‘ওরম খয়েরী ঠোঁট, শক্ত চোয়াল, ডুমো ডুমো শরীর। ছাড়া যায়?’ অবন্তিকাও সায় দেয়।

হৃদিকার হাসি থামেনা।

‘ধুত! ও আমার ছোট্টবেলার বন্ধু। ও ওরমই; ফাজিল। ছাড় তো।’ নিজের সপক্ষে যুক্তি হাজির করে হৃদিকা আরো এক চোট হেসে নেয়।

মনে মনে ভাবে আজ রাতে অ্যালেক্সকে গিয়ে বলবে ‘কি গো আলুবাবু? সোমুকে বে করবো?’। তার হাসি থামেনা।

নীলাঞ্জনা আর অবন্তিকা সূক্ষ্ম চোখে একবার দেখে নেয় হৃদিকার দিকে। ঈষৎ ঠোঁট বেঁকিয়ে একে অন্যের দিকে চায়। ভাবখানা এমন যেন…

‘বাব্বাহ! কতো দেখলুম।’

 

।। ৬ ।।

পঙ্ক!! দ্বিতীয় বিয়ারের বোতলটা খুলতে খুলতে সোমনাথ হৃএর হাতের স্পর্শ বোঝার চেষ্টা করছিলো। শিশির ছোঁয়া সবুজ পাতা। তার নিঃশ্বাসে তখন ঘুর্নি। নিজের পেশিবহুল হাতে, খাঁজকাটা উঁচু বুকে, পেটানো অ্যাবসে, মাংসল থাইয়ে ছুঁইয়ে নিচ্ছিলো এক আঙুল লাল গোলাপ। তার শরীরের চটচটে ঘসঘসে ঘামে, খোঁচা খোঁচা লোমকূপে, মিশে যাচ্ছিলো সেই পাপড়িমাখা গন্ধ। পেলবকে জাপটে ধরছিলো এক কঠোর আশ্বাসে। এই বারটায় এ.সি. নেই। সস্তার জায়গা।

‘কি বে? চুপ করে গেলি?’ রাজার কথায় সম্বিত ফেরে ওর। ‘তোর কি একটা বিয়ারেই নেস্যা হয়ে গেলো নাকি কাকা?’

‘না রে ভাবছিলাম।’

‘কি? হৃ? ছাড় তো। কত্তো ভালো ভালো মেয়ে আছে লাইনে। তা না। হৃ। কেন বে? হ্যা।  মানছি মেয়েটা মিষ্টি। কিন্তু আর কি কেউ নেই?’

বজ্রনির্ঘোষ কন্ঠে জবাব আসে…

‘না।’

 

।। ৭ ।।

হৃএর ফিরতে এখনো রাত ৯টা। কলেজ থেকে দুজায়গায় আঁকা শিখিয়ে তবে সে ফিরবে। অফিস থেকে ফিরে শর্মিষ্ঠা আজ আবার ভাবতে বসলেন সোমনাথের কথা। ফাকা সময় এই কথাগুলোই মাথায় ঘুরপাক খায়। বাজে বাংলা সিরিয়াল দেখার অভ্যেশ তার কোনোদিনই নেই। কারো দুটো বর। কারোর দুটো বৌ। গল্পের মধ্যে গল্প। শয়তানের মধ্যে শয়তান। মেয়েরা বেনারসি আর এক গা গয়না পরে ঘুমোয়। ঘরে বাইরে শত্রুর তারনায় নায়িকা অস্থির। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেনা।

কদিন পরেই হৃএর পড়া শেষ। নিজের আঁকার স্কুল খুলতে চায় মেয়ে। তারও মত আছে। সোমনাথ চাকরি হাতে নিয়ে বসে আছে। ফাইনাল রেসাল্ট বেরোলেই জয়নিং। ছেলেটাকে তার বেশ পছন্দ। পরিবারটাও ভালো। তার চোখমুখ দেখে মনে হয় সে হৃকে পছন্দই করে। হৃ যদিও জিজ্ঞেস করলে হেসে উড়িয়ে দেয় ব্যাপারটা। কিন্তু মা হিসেবে এই কর্তব্য নিয়ে তাকে তো ভাবতেই হবে। যতোবার তিনি প্রসঙ্গ এনেছেন, হৃ কোনো ছুতো খুঁজে ঠিক ততোবার এড়িয়ে গেছে। এদিকে তার নিজের  শরীরও ভালো নেই কদিন হলো। পরিশ্রমের ক্ষমতাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাপমড়া মেয়েটাকে তো জলে ভাসাতে পারেননা। আত্মীয় স্বজন, কে কতদূর করবে খুব ভালোভাবে জানেন তিনি। অলোক মারা যাওয়ার পর সম্পুর্ন একা লড়াই করতে হয়েছে তাকে। শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে। তাই যা করার, রিটায়ারমেন্টের আগেই করতে হবে। কড়া নাড়ার শব্দে সম্বিৎ ফেরে তার। ঐ তার মেয়ে এলো। দরজা খুলে খাবারগুলো চট করে গরম করতে হবে এবার।

 

।। ৮ ।।

‘আমার কিন্তু আর ঠিক এক বছর আছে চাকরির’ ভাত বাড়তে বাড়তে মেয়েকে মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন শর্মিষ্ঠা।

হৃ কথা ঘোরানোর চেষ্টা করে। সে জানে এই কথার ইঙ্গিত।

‘মা আজ আবার আলুপোস্ত বানিয়েছো? এটা কিন্তু তুমি খুব ভালো বানাও। আমার তো রান্নাবান্না ভালো লাগেনা, কিন্তু জানো ছোটোবেলায় স্কুলেও আমার অনেক বন্ধু বলেছিলো তোমার কাছ থেকে এই রেসিপিটা নিতে।’

‘কথা ঘোরাসনা। আলুপোস্ত এমন কিছু আহামরি রান্না নয়। যে কেউ পারে। হ্যা। তুইও শিখে নিলে পারবি। আর এবার… আস্তে আস্তে শিখেই নে।’

‘ধ্যুত, তুমি থাকতে এসব শিখে আমি কি করবো?’

‘শ্বশুর বাড়ি কি আমাকে নিয়ে রাখবি? জানিস না মেয়েদের বাড়ি মা কে থাকতে নেই। লোকে কি বলবে?’

‘বেশ তো একটা ঘরজামাই দেখো।’

বিচ্ছুভরা হাসি খেলে যায় হৃএর চোখেমুখে। এঁটো হাতে শর্মিষ্ঠার গলা জড়িয়ে হামি খায়।

‘তোমায় ছেড়ে আমি কোত্থাও যাবোনা মামাই।’

শর্মিষ্ঠা কপট সুরে বলেন। ‘আচ্ছা সে দেখা যাবে। এখন খেয়ে উদ্ধার করো। এই বাসন মেজে তবে আমায় ঘুমোতে যেতে হবে।’

মনে মনে ভাবেন, তিনিও কি চান? পারবেন হৃকে ছেড়ে থাকতে? কিন্তু মায়েদের তো মেয়েদের বিয়ে দিতেই হয়। জন্ম থেকে বড়ো করে তোলার, হাসিকান্না মিশিয়ে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার মুল্য হিসেবে গুনে নিতে হয় কয়েক মুঠো কনকাঞ্জলি।

‘তুমি কিন্তু আলু খেয়োনা মা’, খাওয়া শেষ করে যাওয়ার সময় হৃ বলে গেলো।

 

।। ৯ ।।

রাতে আজকাল ঘুম কম হয় শর্মিষ্ঠার। সুগারটাও বেড়েছে। খাওয়া দাওয়া খুব নিয়ন্ত্রণেই রাখেন। আলু, মিষ্টি খাননা। তবু রাতে মাঝে মাঝেই উঠে বাথরুমে যেতে  হয়।

ফেরার পথে চোখ পড়ে যায় বসার ঘরের ছোট্ট টেবিলটাতে। কি যেন একটা চকচক করছে। মেয়ে বোধহয় হ্যান্ডব্যাগটা ফেলে গেছে। মোবাইলটা কি আছে ওর মধ্যে? কে জানে? ব্যাগ খুলে কি আছে কি নেই দেখবেন, এই রুচি শর্মিষ্ঠার কোনদিনই তৈরি হয়নি। মেয়ে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে। ডাকা কি ঠিক হবে? একটু ভাবলেন। দেখেই আসা যাকনা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে কি না। যদি কোন সাড়াশব্দ না পান ফিরে আসতে ক্ষতি কি? মেয়ের ঘরের সামনে গিয়ে একটু আটকে গেলেন শর্মিষ্ঠা। ভিতর থেকে হৃএর স্পষ্ট গলার আওয়াজ। আড়ি তিনি পাতেননি। শব্দটা ফিসফিসে হলেও দরজার সামনে দাঁড়ালেই স্পষ্ট শোনা যায়।

‘তোমার ঠোঁটগুলো এতো সুন্দর রোজি? কি করে বলতো? রোজ তোমায় চুমু খাই। গাঢ় নিঃশ্বাসের বাষ্প আমার সমস্তটায় ঘনীভূত হয়। ভিজে যায় আমার লাল-নিল-কালো-বাদামী, সব। তুমি এরম থাকো কি করে? রাজার বুকটা দেখেছো? ঐ চওড়া বুকে মাথা রেখেছো কখনো? আমি রেখেছি। তুমি যদি রাখতে তাহলে তুমিও আমার মতো আর নিস্তার পেতেনা। ডুগডুগির সিম্বালস আমার নিপলকে পিষে ফেলে চাবির দমে। রাজা যদি কখনো ঐ হাতদুটো দিয়ে আমায় পিষতে পারতো তাহলে…’

একটা দুষ্টুমি ভরা হাসিকে জায়গা ছেড়ে দিয়ে কথা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। তারপর আদর অভিমান গায়ে মেখে আবার শুরু…

‘ধুস! তা হবেনা। যদি কখনো সত্যি ও পারতো তাহলে শেলিকে ও ছেড়ে দিতোনা। ওর যদি দম দেওয়া হাত থাকতো… ও স্বপ্নে আমায় বলেছে, জানো, ওর লম্বা স্ত্রেইট চুল খুব পছন্দ। শেলির চুল কিন্তু হিংসে করার মতো। তোমার শেলিকে হিংসে হয়না রোজি? আমার হয়। তবু আমি কিন্তু শেলিকে ভালোবাসি। তোমাকেও। রাজাকেও। তোমাদের সব্বাইকে। কিন্তু ভয় হয় জানো। মা আমার বিয়ে দিতে চায়। মা’কে কি করে বোঝাবো বলো আমার ভালোবাসার কথা? কেউ কি বুঝবে? কেউ বুঝবেনা। তোমরাই আমায় আটকে রাখো। তোমরাই আমায় বোঝো। তোমাদের নরম ঠোঁটে আমি আশ্রয় পাই। তোমাদের ডেন্ড্রাইড চুলে গালসুড়সুড়ি দি। তোমাদের বুকে আঙ্গুলের আগায় আগায় জমে থাকা অস্বস্তি চেপে ধরি। তোমরা আমার গোপনীয়তা, আমার অভিমান। এই শান্তি আমি আর কোথাও পাবো? ঐ দেখো, রাজা কিরম দুষ্টুর মতো চেয়ে আছে। কি হয়েছে সোনা? আদর খাবে? আসো। আ…সো। আ……সো। আ…আ…সো।’

‘আ’ আর ‘সো’ এই পারমুটেশান কম্বিনেশানে শর্মিষ্ঠা খেই হাড়িয়ে ফেলেন পুরোপুরি। ভিতর থেকে ভেসে আসা কথারা ফাজলামি পেরিয়েছে। আদর কুড়িয়েছে। এখন নিস্তব্ধতায় ঘুমিয়ে পড়ে গিয়েও মাঝে মাঝে জাগছে। কিছু বিক্ষিপ্ত গোঙ্গানি। আর ‘আ’ আর ‘সো’ এর বিভিন্ন বিসমপদী ছন্দে কখনো বেদনা, কখনো সুখ, কখনো উত্তেজনা, কখনো উচ্ছ্বাসের যে সুরগুলো ভেসে আসছে, যেকোন মেয়ের সেগুলো চিনে নিতে একটুও অসুবিধে হয়না। শর্মিষ্ঠাও সুরগুলো চিনেছেন। কিন্তু একলহমায় বাকি সবকিছু অচেনা হয়ে গেছে যেন। দেওয়াল ধরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেননা।

না। আর দেওয়াল না। মেঝেতে আসতে আসতে বসলেন তিনি। অল্প কিছুক্ষণ বসে থাকলেন।

থমকে যাওয়া এলোমেলো ভাবনাগুলো গুছিয়ে নিতে ঠিক যতটা সময় লাগে। চোখ ফেটে কান্না আসছে আজ অনেকদিন বাদে। বমির মতো। উঠে নিশ্বব্দে নিজের ঘরের দিকে একরকম ছুটে পালিয়ে যান তিনি। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে ঢুকে আগল দেন। কান্না তার কাছে বড়ো নিজস্ব। বালিশের গভীর তুলো ছাড়া আর কারও সাথে উনি কান্নাদের ভাগ করে নিতে চাননা কখনো। আর আজ রাতের কান্নাতে বালিশটাও বাধ্যতা। সবকিছুই খুব পর। একটা জিনিস, থুড়ি একটা মানুষ ছাড়া। অলোকের ছবিটা খুলে বুকে জড়িয়ে ধরলে কিছুটা ভালো লাগতো। কিন্তু সময় বিলাসিতার সুযোগ আর দেবেনা। অন্তত কিছুক্ষণ নৈশব্দের বড়ো প্রয়োজন। জিততে তাকে হবে। নিজের মেয়ের জন্য। গা গুলিয়ে ওঠে তার। চোখ ভেজে।

 

।। ১০ ।।

অনেক বেলা হোলো। পাখির ডাক হাল্কা মানে ভোরও শেষ। ঘুম ভেঙ্গে হৃ কিছুটা অবাক। মামাই আজ ডাকেনি তো! অথচ এতো বেলা…। বিছানায় চোখ যেতে লজ্জায় রাঙ্গা হোলো শ্রীরাধিকা। পুতুলগুলো নিয়ে কাল রাতে অতিরিক্ত আদিখ্যেতা হয়েছে। ইস! ঘর আর নিজেকে গুছিয়ে বাইরে এসে দেখলো, মা উঠেছেন। টেবিলে ব্রেকফাস্ট ঢাকা দেওয়া। বোধহয় অফিসে বেড়িয়ে গেছেন। একটু অবাকই হোলো হৃ।

আপাতত নিজের মতো ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে মোবাইলে নজর বোলায় হৃ। সোমনাথের ম্যাসেজ। আজ সে তাকে নিতে আসবেনা। কিন্তু কি একটা জরুরি কথা আছে। কলেজে পৌঁছেই যেন একবার কল করে। কিছুটা আঁচ করা অসম্ভব নয়। তবে সত্যিটার মুখোমুখি তো একদিন দাঁড়াতেই হবে। আজকেই? বেশ।

মনটা বিষিয়ে গেলেও খানিকটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেল্লো। মামাইয়ের সাথে সকালে দেখা না হওয়ার জন্য এমনিতেই বিস্মিত আর খারাপ। অফিসে আর ফোন না করে একেবারে রাতে কথা বলবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই কলেজের জন্য বেড়িয়ে পড়লো সে। আজ কলেজের পিছনের মাঠটাতে দীঘিকে সাক্ষী রেখে সত্যস্বীকারের দিন।

 

।। ১১ ।।

‘কিন্তু কেন হৃ? জানি তুই খুব পপুলার। কিন্তু আমি কি খুব খারাপ? পাঁচটা মেয়ে কিন্তু আমার দিকেও ঘুরে তাকায়।’

হৃদিকার নিস্তব্ধতা জবাবের জায়গা ভরাট করতে পারেনা। সোমনাথের ভুরু কুঁচকেই থাকে। সে বলে চলে। আজ ঠারেঠোরে না, সরাসরি।

‘বেশ। ভাব। আমাদের বাড়িতে কোন অসুবিধে হবেনা, আশা করি এটুকু তুইও বুঝিস।’

‘এটা হয়না সোমু। প্লিজ। আমার ভালো লাগেনা।’

“ভালো লাগেনা মানে? তুই কি লেসবো?’

“না!’

“তাহলে?’

“ছাড় না! ভাল্লাগছেনা।”

‘নাহ! প্লিজ বল। আমার কথা ভেবে। অ্যাটলিস্ট আমাদের বন্ধুত্তের খাতিরে।’

‘বেশ!’

দুজনে কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। সোমনাথ যাই ভাবুক হৃ এর সম্বন্ধে। সোমনাথ মেয়ে হলে হয়তো হৃ এর আরেকটু সুবিধে হোতো। কিন্তু এটাও ঠিক সোমনাথের মতো কাছের বন্ধু বোধহয় আর কেউ তার নেই।

একটু গুছিয়ে নিয়ে হৃ শুরু করে।

‘আচ্ছা সোমু, আমি যদি লেসবিই হতাম? তখন?’

‘হতিস মানে কি? এই তো বললি তুই লেসবি না।’

‘ধর! যদি হতাম। তখন?’

এবার সোমনাথের চুপ করে থাকার পালা। অঝোর বৃষ্টিতে রাশ টেনে একটু ভেবে সে বলে।

‘দ্যাখ। এরকম চট করে এ কথার উত্তর দিতে পারবোনা। তবে আমি তোকে যেকোনভাবেই মেনে নিতে রাজি আছি।’

‘যদি আমাদের সেক্স লাইফ আনন্দের না হয়, তাও?’

বৃষ্টি আবার জোর নেয়। ‘হ্যা! তাও।’

‘থ্যাঙ্ক্যু রে! এতোটা আমায় ভালোবাসার জন্য। কিন্তু আমি যে তোর এই ভালোবাসার যোগ্য নই।’

‘ধুর বাল! এত্তো কনফিউজ করছিস কেন? ঝেরে কাস না। তুই কি লেসবি?’

‘না।’

‘তবে? বাই?’

‘না! তাও নই।’

‘তবে? এতো ভণিতা করছিস কেন? তুই স্ট্রেইট। শারীরিক কোন প্রবলেম? মা হওয়ার সমস্যা? আমরা কিন্তু অ্যাডপ্ট করতে পারি। নো ইস্যু।’

‘আচ্ছা সোমনাথ! একটা মেয়ে লেসবিয়ান, স্ট্রেইট, বাই, এর বাইরে কিছু হতে পারেনা না?’

‘নাহ! কিকরে হবে?’

‘হয় রে।’

‘সেটা আবার কি?’

‘সে হয়! ছাড়! বাট… আসলে আমি যে ঠিক কি? আচ্ছা আমার যদি মানুষদেরই ভালো না লাগে?’

‘মানে?’

‘যদি অন্য কিছু ভালো লাগে?’

‘এরকম হয় নাকি?’

‘হয়! অ্যাগাল্মাটোফিলিয়া, পিগ্ম্যালিওনিস্ম নাম শুনেছিস?’

‘বাপের জন্মে শুনিনি। কি এগুলো?’

‘এগুলো একধরনের প্রেম যৌনতা যা বলিস। আমার… পুতুল ভালো লাগে। মানুষ না।’

‘তুই কি পাগল? এসব কি যাতা বকছিস? তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোকে এক্ষুনি মাথার ডাক্তার দেখানো দরকার।’

‘ডাক্তাররাও এ ব্যাপারটা খুব একটা বুঝবে বলে মনে হয়না।’

‘নাহ! ডাক্তার বুঝবেনা, তুই বুঝবি। ঐ অ্যাগাল আবাল কিসব বললি, ওইগুলো। তুই বুঝিস?’

‘আমি কিন্তু এখনো তোকে এটাও বলিনি যে আমি অ্যাগাল্মাটোফিলিক বা পিগ্ম্যালিওনিস্ট,বা হয়তো আমি সেটাই। কখনো ভাবিনি। ভাবতে পারিনি। পরে ভাবার ইচ্ছেটাও আর বিশেষ ছিলোনা।’

খাদের আওয়াজে সোমনাথ বলে ওঠে। আস্তে আস্তে, কেটে কেটে।

‘দ্যাখ তোর কথা আমি কিচ্ছু বুঝছিনা। আমি একটা ভালো সাইক্রিয়াটিস্টের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি। তুই আমার সাথে চ।’

‘লাভ নেই সোমু। সাইক্রিয়াট্রি অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স। কেস স্টাডিসের উপর ভিত্তি করে চলে। এরকম কেস কলকাতার কজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে এসেছে বলে মনে হয় তোর?’

‘তাহ তুই থাকনা তোর পুতুল নিয়ে। আমি কি বারন করেছি?’

‘নাহ! করিসনি। কিন্তু আমি শুধু আমার পুতুল নিয়েই থাকতে চাই সোমু। প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর।’

‘তুই তো ভুলও হতে পারিস।’

চোখ ছলছল করে হৃদিকার। নদির ছলাৎ, হাতুড়ির আঘাত, সিলিং ফ্যানের গোঙানি মিশিয়ে ধরা গলায় যেন নিজেকেই বলতে থাকে।

‘ভুল। কি জানি! একটা অভিশাপ গেছে জীবনের একটা সময়ে, যখন ভুল ভাঙ্গলে সবথেকে শান্তি বোধহয় আমিই পেতাম। ধীরে ধীরে বড়ো হলাম। ভেবেছিলাম ভুল ভাঙ্গবে। ভাঙ্গলোনা। নিজে ভেঙ্গে পড়লাম। কখনো মনে হতো মরে যাই। মামাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে পারিনি। মামাইয়ের আমি ছাড়া কেউ নেই রে। কেউ না। কিন্তু আমি যে কেন এরকম হলাম। অন্যরকম। সুখী সংসার করতে পারলে তো সবাইকে খুশি করতে পারতাম। স্বামীকে। মামাইকে। হয়তো অন্যদের মতো মেয়ে হলে, নিজেকেও। পাল্টাতে চেয়েছি। পারিনি। তারপর একসময় নিজেকে স্বীকার করা শুরু করলাম। রাতদিন ইন্টারনেট ঘাটতাম। খুঁজতাম। পৃথিবীতে কতোরকম মানুষ। কতো বিচিত্র ইচ্ছে। বিশ্বাস করতে শুরু করলাম যে অন্যের ক্ষতি না করে নিজের ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখার অধিকার আমারও আছে। আমি এভাবেই বাঁচবো। আর তারপর এভাবেই বাঁচছি। আমার আর এখন কোন অসুবিধে হয়না। তবে মাঝে মাঝে ভাবি, মামাইকে কি করে বোঝাবো। তখনই একটা বোঝা খুব ভারী হয় বুকের মধ্যে।’

‘তা ইন্টারনেটে কাউকে পেলি তোর মতো পাব্লিক?’

 

ঘোর কাটে হৃদিকার।

‘ঠিক এক্স্যাক্ট আমার মতো পাইনি। তবে ইন্টারনেটে খুঁজতে আমার আজকাল আর হয়না।’

‘মানে?’

‘মানে আমার পুতুলগুলো। আমি যেমন ওদের নিয়ে আছি। ওরাও তো… একইভাবে…’

হৃ এর দুচোখ বেয়ে অনেকদিন পর জমে থাকা যমুনোত্রীরা সচল হয়।

সোমনাথের মুখে কথা সরেনা। কিছুক্ষন সে খেই হারিয়ে ফেলে। তার বাজেরা এতো সহজে নিভে যাবে? তার বৃষ্টি শুকিয়ে যাবে এই না বুঝতে পারা আকস্মিকতায়? কোথাও তার অসহয়তা আর পৌরুষে হয়তো তীব্র আঘাত লাগে। নইলে পরক্ষনেই সে কেন করে ফেলে এমন কাজ? ধীরে ধীরে হৃকে কাছে টেনে নেয়। তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার চেষ্টা করে। হৃ ছাড়িয়ে নিতে চায় নিজেকে। পারেনা। সোমনাথ আজ নিয়ন্ত্রনের বাইরে গিয়ে কঠিন। সে শুধু বলে চলে…

‘সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস, আমি সব ঠিক করে দেবো।’

নোখ খোদাই করে শরীরের সিলমোহর। ঠোঁট শুষে নেই ইচ্ছের জলকণা। পেশীরা চেপে ধরে ব্যাতিক্রান্তের দুর্বলতা। অস্র্যুগ্রন্থিরা হতবাকে শুকিয়ে যায় নিস্তব্ধতায়। পার্কস্ট্রিট থেকে একাত্তরের বাংলায়। বিশ্বযুদ্ধ থেকে দেশভাগে। হৃ প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে যায়। সোমনাথ ওর সারা শরীরে নিজের হাতের দুরমুশ দিয়ে ঘেটে চলেছে অবিরত। নিজেকে কিছুক্ষন প্রাণহীন লাগে। পরক্ষনেই। সমস্ত স্বত্বা চেঁচিয়ে ওঠে তার।

‘সোমনাথ তুই ভুল করছিস। তুই কিচ্ছু বুঝিসনি। জানোয়ার হয়ে গেছিস তুই। তোর শরীর জানোয়ারের। তোর মন জানোয়ারের।’

বলতে পারেনা। কারন তার ঠোঁটের উপর তখন সোমনাথের ঠোঁট চেপে বসে আছে। দাঁতের উপর দাঁত। জিভের উপর জিভ। নারীর উপর পুরুষ। পুরুষের ঠোঁট এ কি সাঙ্ঘাতিক কামড় দিতে পারে! এর চেয়ে ডুগডুগির সিম্বালস অনেক অনেক বেশী আদর দিতে জানে। এ তো আদর না! এ কর্তৃত্ব! হৃ ধীরে ধীরে অচেতন হয়ে পড়ে। তার ছোটবেলার বন্ধুকে তার খুব অচেনা মনে হয়। খুব…

 

।। ১২ ।।

সারাদিন গা গুলিয়েছে হৃ এর। আর থেকে থেকে রাগ আর যন্ত্রণা তাকে কুড়ে কুড়ে খেয়েছে। ছি! এ তো সে কখনো ভাবেনি। এতো কঠিন নিজের সত্যি নিয়ে নিজের ছোটবেলার বন্ধুর কাছে দাঁড়ানো?

কিন্তু তার তো বলার দরকার ছিলো? তার ভালোর জন্য শুধু না। সোমনাথের ভালোর জন্যও। কি নিষ্ঠুর অবুঝের মতো আজ দুপুরে সোমনাথ তাকে জাপটে ধরেছিলো। অথচ অচৈতন্য হয়ে যাওয়ার পর সেই তার চোখে মুখে জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফিরিয়েছে। তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। অনেক্ষন হৃ কিছু বুঝতেই পারছিলোনা যে ঠিক কি তার করা উচিৎ।

তবে ধীরে ধীরে আত্মস্থ হয়েছে সে। সোমনাথের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব খারিজ করে নিজেই ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। মামাই ফেরার আগেই। তারপর চুপ করে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা

মামাই এখনো এলোনা। একটা মোবাইলও ক্যারি করতে চাননা শর্মিষ্ঠা। হৃ নিজে কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কতোবার। তার মামাইই রাজি হননি। অফিস থেকে প্রায় আড়াই ঘন্টা আগে বেড়িয়েছে মামাই। হৃ ফোন করেছিলো। মায়ের বস, মিস্টার সোলাঙ্কি ফোন ধরেছিলেন।

সেই মিস্টার সোলাঙ্কি, যাকে নেকরে বাঘ বললেও কম বলা হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর কয়েকদিন এসেছিলেন তাদের বাড়িতে। ফিসফিস করে মাকে কিসব বলতেন। হৃএর একদম পছন্দ হোতোনা তাকে। তারপর একদিন তাদের বাড়িতে এসে খুব কান্নাকাটি করলেন তার স্ত্রী। মাকে অনুরোধ জানালেন তিনি যেন তার এই দিদির স্বামীকে ক্ষমা করে দেন। তার কেস তুলে নেন। তিনি কথা দিচ্ছেন মিস্টার সোলাঙ্কি আর কখনো এমন করবেন না। তারপর কি হয়েছে হৃ জানেনা। ঘটনাটার আগাগোড়াই হৃয়ের কাছে ধোঁয়াশা। মামাই বরাবরই চাপা স্বভাবের। কখনো এ বিষয়ে কথা উঠলেও এড়িয়ে গেছেন।

সেই মিস্টার সোলাঙ্কি বেশ বিরক্তির স্বরেই জানালেন, আজ মামাই একটু আগে অফিস থেকে বেড়িয়েছেন, কি একটা জরুরি কাজ আছে বলে।

মাকে নিয়ে খানিক চিন্তা করে হৃএর ভাবনারা আবার ফিরে গেলো দুপুরবেলায়। সোমনাথ তার খুব কাছের একজন ছিলো। তাকে সে নিজের ভাইয়ের মতোই দেখতো হয়তো। বা হয়তো সব সম্পর্ককে ওভাবে নামও দেওয়া যায়না। তার কাছ থেকে শেষ অবধি এরকম ব্যাবহার পেলো সে? অনেকবার কল আর এস-এম-এস পাঠিয়েছে আজ দুপুরের সেই জানোয়ারটা। ধরেনি সে। উত্তর দেয়নি। এখন কিছুটা মাথা ঠান্ডা করে ভাবতে বসেছে। হয়তো এরকমই হওয়ার ছিলো। সোমনাথকে কি শেষমেশ ক্ষমাই করে দেবে সে? তারও কি আগে বলা উচিৎ ছিলো সবটা? আসলে এই জায়গাটার মুখোমুখি সে কখনো হতে চায়নি। হওয়া তার জন্য আদৌ সম্ভবও ছিলোনা। এই গতানুগতিক চারপাশ যা সবসময় ঘিরে রাখে আমাদের ছায়াটুকুকেও, তার মধ্যে দাঁড়িয়ে বলে ওঠা, আমি মানিনা, আমি জানিনা, শুধু জানি আমি সত্যি, এটা মুখের কথা নয়।

বাইরে দরজা খোলার আওয়াজ। মামাই এসেছে। মামাইকে এ ব্যাপারে কিছু জানাবেনা সে। সোমনাথের সাথে আপাতত কিছুদিন দুরত্ব রাখাই উচিৎ হবে ঠিক করে নিজেকে একটু ধাতস্থ করার চেষ্টা করলো সে। শর্মিষ্ঠা ঘরে ঢুকলেন। হৃকে দেখলেন। আস্তে আস্তে তার কাছে এলেন।

‘মামাই! তুমি নাকি আজ জলদি বেড়িয়েছো অফিস থেকে। আমি অনেক্ষন থেকে…’

‘আমি আজ সোমনাথের বাড়ি গেছিলাম। ঘরে এসো। কথা আছে।’

 

।। ১৩ ।।

দুইজন মানুষের মাঝে কখনো সখনো কথারা শুরু হতে চায়না। তারা সুর হারিয়ে ফেলে। আর তারপর হঠাত বেতালে বেসুরে বেজে ওঠে। হৃএর মনে উৎকণ্ঠা। মা কি জানে আজ দুপুরের কথা? সোমনাথের সাথে তার কি কথা হয়েছে? কি শাস্তি দিয়ে এলো মা সোমনাথকে?

‘হৃ’ ডাকটা কানে যেতেই হৃএর চমক ভাঙ্গলো। মায়ের চোখে মুখে রাগ আর হতাশা। নাহ! সোমনাথের

কোন কঠিন শাস্তি হোক হৃ চায়না।

‘তুমি জানতে চাইলেনা তো আমি আজ কেন সোমনাথের বাড়ি গেছিলাম।’

হৃ কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা অহেতুক অন্যের অন্যায়ের লজ্জা তাকে পেয়ে বসে।

‘আমি আজ তোমার বিয়ের ব্যাপারে সোমনাথের মায়ের সাথে কথা বলতে গেছিলাম।’

হঠাত ছিটকে মায়ের দিকে তাকায় হৃ। এ কি শুনছে সে?

‘মা…’

ডান হাত তুলে তাকে থামতে বললেন শর্মিষ্ঠা। এবং একই প্রাবল্যে বলে চলেন।

‘তাছাড়া ওর মাও বেশ কদিন ধরে ডাকছিলেন। যাওয়া হচ্ছিলোনা। সোমনাথ বাড়ি ছিলোনা। তবে ওনার মা আমায় জানিয়েছেন হাবেভাবে সোমনাথ অনেকদিনই এই বিয়েতে হ্যা বলে রেখেছে। তবে তোমার মতামত নিয়ে সবাই খানিকটা সন্দিহান। তো এ ব্যাপারে তোমার কি বলার আছে? এবার বলতে পারো।’

কি বলবে হৃ? কি তার বলা উচিৎ? এই আকস্মিকতায় তার কথা। তার কান্না। সব যেন একসাথে হারিয়ে গেছে।

‘দেখো। বিয়ে তোমায় খুব শীগগিরই করতে হবে। সোমনাথকে না করো অন্য কাউকে। তোমার মতামত না থাকে আমায় বলো। আমি তাহলে কাল খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে যাবো।’

‘এতো তাড়াহুড়ো কোরোনা মামাই। আমি তোমায় কিছু বলতে চাই। কিন্তু আজ না প্লিজ। আজ আমার শরীর খুব খারাপ লাগছে।’

‘কবে?’

‘কদিন সময় দাও। আমাকে একটু গুছিয়ে নিতে দাও কথাগুলো।’ কথাগুলো যেন সারঙ্গীর চেয়েও করুণ সুরে বেজে উঠলো হৃএর গলায়।

‘সেটা সম্ভব নয় হৃ। আমি তোমায় অনেক সময় দিয়েছি। আর নয়। আমি এখনই শুনতে চাই সব কথা।’

শর্মিষ্ঠার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। হৃএর চোখে বিশ্ময়। এতো কঠিন সে তার মামাইকে কখনো দেখেনি।

‘কাল আমি তোমার ঘরের থেকে অদ্ভুত আওয়াজ শুনেছি হৃ। তুমি কি ধীরে ধীরে পারভার্ট হয় যাচ্ছো?’

দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। দুপুরের ঐ জানোয়ারটা তার মায়ের চোখে সুপাত্র। আর সে? পারভার্ট? নিজের সমস্ত শক্তি একজোট করে হৃ বলে।

‘ওটাই আমি মামাই। হয়তো পার্ভার্শন। তবু ওটাই আমি।’

উঠে এসে মেয়ের গালে সপাটে এক চড় কসিয়ে দিলেন শর্মিষ্ঠা।

‘এতো সাহস তোমার? আমার সামনে দাঁড়িয়ে অসভ্যতা করতে তোমার এতোটুকু বাঁধলোনা? এই শিক্ষা তুমি পেয়েছো আমার আর তোমার বাবার কাছ থেকে? তোমায় দেওয়া স্বাধীনতার অপব্যাবহার করে আজ তুমি এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছো?’

‘তুমি এখন আমার কথা বোঝার অবস্থায় নেই মামাই। তাই আবারো বলছি, আমরা কাল কথা বলি?’

‘নাহ! যা বলার এক্ষুনি, এই মুহুর্তে বলো। নিজের রক্ত জল করে তোমায় আমি মানুষ করেছি। কখনো নিজের দিকে একফোঁটাও ফিরে তাকায়নি। একই তারই পুরষ্কার?’

হৃ একটু চুপ করে। মায়ের চোখের জল মোছানোর জন্য ওড়নার খুট তুলে ধরে। কাছে টেনে নেয় মাকে। সত্যি তো। মা আজ দুপুরের কথাও জানেনা। আর তার মেয়ের যৌনতাও বোঝেনা। শুধু তাকে অক্লান্ত অবিরাম ভালোবেসে গেছে, সারাটা জীবন ধরে। নিজেকে শেষ করে। কান্নায় ঝাঁপিয়ে পরেন শর্মিষ্ঠা। হৃদিকার চোখও ঝাপসা হয়। মা মেয়ের কান্না একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে। একে অন্যের বিরোধিতা করে। ঘরে অনুরণন খেলে যায় নিজস্ব সংশয়ে।

‘আমার নাম হৃদিকা তুমিই রেখেছিলে, তাই না মা?’

‘হ্যা। হৃদিকা রাধার নাম। খুব আনকমন আর মিষ্টি লেগেছিলো নামটা।’

‘কিন্তু আমি তো কোনোদিনও রাধা হতে চাইনি মা। তোমার মনে আছে আমার যেবার আঠেরো হোলো, তুমি আমায় খুব সুন্দর একটা ড্রয়িং বোর্ড উপহার দিলে। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম ওটা পেয়ে। আর তোমায় ঐ ঐটা কিনে দিয়েছিলাম।’

হৃদিকার আঙ্গুল গেছে শর্মিষ্ঠার ঠাকুরের আসনের দিকে। সেখানে মিরাবাঈয়ের মূর্তিটা এখনো একদম সামনে খুব যত্ন করে রাখা। বাদামী রঙের লম্বা দোতরা ধরে বসে তিনি ভজন গাইছেন। পরনে ধবধবে সাদা শাড়ি। যেন নিজের গানে নিজেকে হারিয়ে ফেলা ‘দেবী ভারতী’ নিজেকে সমর্পন করেছেন তার গিরিধরের জন্য।

‘হুম! মনে আছে। কেন রে?’

‘মীরাবাঈ কিন্তু কখনো তার গোপালকে দেখেননি। তবুও গোপালের মূরতি সামনে রেখে সারাজীবন শুধু তার সাধনা করে গেছেন। তুমিও তো পুজো করো মা। সিংহাসনে তোমার দেবতাদের রেখে যখন তাদেরকে নিজের সুখ দুঃখের কথা বলো, কখনো অনুভব করোনা যে তারা সত্যিই তোমার সামনে বসে আছেন?’

‘এসব কথা বলে লাভ নেই হৃ। আমি যেটা করি সেটা পুজা। তুমি যেটা করো সেটা নোংরামো। ছি! মীরাবাঈ সাক্ষাৎ দেবী। ওনার সাথে তুমি নিজের নোংরামোর তুলনা করো?’

‘কোনটা নোংরামো মা? কেউ যদি নিজেকে নিজের ইছেয় সমর্পন করে, শুধু সমাজের নিয়মে বিয়ে না করার জন্যই সেটুকু নোংরামো হয়ে যায়। এ দেশে কতো মেয়ে আছে জানো মা, যারা বিয়ে করেছে, কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় তার স্বামীর হাতে সমর্পিত হয়না। রাতের পর রাত নিজের স্বামীর কাছেই ধর্ষিতা হয়। সেখানে তুমি নোংরামো দেখোনা?’

‘শোন। এসব বড়ো বড়ো কথা আমায় শোনাতে আসবিনা। বিয়ে করিসনি, বিয়ের মর্ম কি বুঝবি তুই?’

‘কি জানি মা? হয়তো বিয়েই হয়ে গেছে আমার। হয়তো হয়নি। হ্যা! তোমাদের সমাজের নিয়মে হয়তো হয়নি। কিন্তু একটা সংসার আমারো আছে। কাল সেই সংসারের আওয়াজ তুমি শুনেছো মাত্র। কিন্তু ধীরে ধীরে ঐ সংসার আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি মা। আর তার বীজ আমার ভিতরেই ছিলো। অনেক… অনেকদিন ধরে।’

‘হৃ!! এসব কি আবোলতাবোল বকছিস তুই? ’

শর্মিষ্ঠার গলায় বিস্ময়। এভাবে তার মেয়ে কোনদিন তার সাথে কথা বলবেন তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। আর এই কথা? না না। এ হতে পারেনা। তার মেয়ে, যাকে নিয়ে তার গর্ব, যাকে নিয়ে তার সর্বস্ব, সে কিনা…

‘ছি!’ মেঘের মতো শর্মিষ্ঠা বলে চলেন। ‘ভাগ্যিস তোমার বাবা আজ বেঁচে নেই। উনি থাকলে হয়তো ওনার সামনে আমিও মুখ দেখাতে পারতামনা। তোমাকে আমি মানুষ করতে পারলামনা হৃ। আমার অতিরিক্ত স্নেহ তোমায় ভুল পথে নিয়ে চলে গেছে। পুতুলগুলোও তোমায় আমিই কিনে দিয়েছিলাম। তোমার বন্ধুরা অনেক বেশী আতিশয্যে বড়ো হয়েছে। ভাবতাম সেভাবে তো কিছুই কখনো দিতে পারিনি। ঐ সামান্য সামান্য আবদার যখন তুমি করতে, রাখার চেষ্টা করতাম। আজ বুঝতে পারছি। ভুল করেছি।’

‘না মামাই! কোন ভুল করোনি তুমি। আমি তোমাকে সামনে রেখে বড়ো হলাম মামাই। তুমি কক্ষনো কোন ভুল করতে পারোনা। আমার মামাই কোন ভুল করেনা।’

মাকে কাছে টেনে গলা জড়িয়ে হৃ তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। পরম যত্নে। নিজের স্থিরতা দেখে আজ হৃ নিজেই আশ্চর্য। তার মা’কে এভাবে বোঝাতে হবে, কিভাবে বোঝাবে, কোনদিন সে ভাবতেই পারেনি। ভাবতেও ভয় পেতো। অথচ আজ বলতে তার এতটুকু অসুবিধে হচ্ছেনা। আসলে বোধহয় দুপুরের ধাক্কাটার পর নিজের ইচ্ছের জন্য আজ সে  নিতান্তই মরিয়া। নিজের ইচ্ছেটাকে মায়ের সামনে অপমানিত করতে সে চায়না। তার ইছেরা একবার ধর্ষিত হয়েছে। তাদের আর ধর্ষিত হতে সে দেবেনা।

‘পুতুলগুলোর মধ্যে মাঝেসাঝে আমি তোমার স্নেহ, তোমার যত্ন, তোমার ভালোবাসাকেও খুঁজে পাই মামাই। আমার সংসারে তুমি যে কিভাবে নিজের অজান্তেই জড়িয়ে আছো এটা তুমি নিজেও জানোনা।’

‘আমি চাইনা অমন পোড়ার সংসার। হৃ। আমরা ডাক্তার দেখাবো। তুই ভাবিসনা মা। সব… সব দেখবি কিরকম ঠিক হয়ে গেছে। তোর বিয়ে হবে। ভালো জীবন হবে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে তোর কোল আলো করে থাকবে।’

‘বিয়ে হলেই ভালো জীবন হয় মামাই? তোমার যে জীবনটা তুমি কাটালে, খুব ভালো কাটিয়েছো? আমাকে ছেড়ে নিজের জন্য কতটুকু করেছো তুমি?’

‘তোর জন্য করে যে আমি সুখি হৃ। মা আমার। তোকে যে আমি ভালোবাসি। তুইই যে আমার জীবন।’

‘আর ওরা যে আমার জীবন মামাই।’

বিধবা মায়েরা আর কতক্ষন মেয়ের সাথে তর্ক করতে পারে? তার মেয়ে যদি তার কথা বুঝতে না চায় কিই করার বাকি থাকে আর? জীবনের লড়াই শর্মিষ্ঠাা কি জানেননা? অসহায় একা মেয়ের পক্ষে সমাজে বেঁচে থাকা কতোটা ঝুঁকির এ কি তাকে কেউ শেখাবে? না! নিজের মেয়েকে সেই ঝুঁকির দিকে মা হয়ে তিনি ঠেলে দিতে পারেননা। কখনোই না! অতএব তিনি ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতো হুংকার দিলেন।

‘দেখো হৃ। তোমায় অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এবার ঠান্ডা মাথায় শুনে রাখো। আমার সিদ্ধান্তের কোন নড়চড় হবেনা। বিয়ে তোমাকে করতেই হবে। এখন নিজের ঘরে যাও। একটু পড়ে আমি তোমায় তোমার রাতের খাবার তোমার ঘরেই দিয়ে আসবো। আজ আমায় একটু তাড়াতাড়ি বেড়োতে হয়েছে অফিস থেকে। কাল অনেক কাজ পড়ে আছে। তোমাকে আর আমার বলার কিছু নেই। এখন তুমি আসতে পারো।’

হৃ উঠে দাঁড়ায়। নিজের ঘরের দিকে যেতে গিয়ে আবার ফিরে আসে। বাঁদিকের দেওয়ালে তার বাবার ছবি লাগানো। শর্মিষ্ঠা রোজ পুরানো চন্দন মুছে নতুন চন্দন লাগান। ধুপ দেন। প্লাস্টিকের রজনীগন্ধার মালাতেও ধুলো জমতে দেননা। সেই ছবির সামনে কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। চোখের জলে বাবার কাছে নিজের ইচ্ছেগুলোর ভিক্ষে চায় যেন।

 

‘তোমার বাবার কাছে আশির্বাদ চেয়ে নাও হৃ। তিনি যেন তোমায় সুস্থ মানসিকতা দান করেন।’

‘আচ্ছা মা এই ভদ্রলোক তোমার স্বামী, তাই না?’ ধরা গলায় প্রশ্ন আসে।

‘এসব কি আবোলতাবোল প্রশ্ন। নিজের বাবাকে কেউ ভদ্রলোক বলে? তুমি কিন্তু সমস্ত সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো হৃ।’

‘ব্যাস মামাই! আরেকটু। আমি তো শুতেই যাচ্ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ… বলোনা। খুব সহজ প্রশ্ন।’

‘তোমার বাবার মতো এতোবরো মনের মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি হৃ।’

‘উহু! এটা আমার প্রশ্ন নয়। আমি জিগ্যেস করলাম ইনি কে হন তোমার?’

দাঁত কিড়মিড় করে শর্মিষ্ঠা উত্তর দেন। ‘হ্যা! উনিই আমার স্বামী। তোমার বাবা! শ্রী অলোকেন্দু রায়। আর কিছু?’

‘আর এই ছবিটা তোমার কে হন? শ্রী অলোকেন্দু রায় তো অনেকদিন মারা গেছেন মামাই। এই ছবিটা কি আমার বাবা? না তোমার স্বামী? এতো যত্ন কেন করো এই ছবিটাকে?’

শর্মিষ্ঠা হতভম্বের মতো মেয়ের মুখের দিকে তাকান। কি বলবেন ঠিক বুঝে উঠতে পারেননা। ইচ্ছে করে উঠে আরেকটা চড় কসিয়ে দেবেন মেয়ের গালে। অত্যন্ত কষ্টে নিজেকে সংবরণ করেন।

‘যাও হৃ। রাত হোলো। ফ্রিজে খাবার আছে। ইচ্ছে হলে গরম করে খেয়ে নিয়ো। আমি আজ কিছু খাবোনা।’

হৃ আসতে আসতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। শর্মিষ্ঠা কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে তাকিয়ে থাকেন অলোকের ছবির দিকে। তারপর হু হু করে তৃতীয়বার…

 

।। ১৪ ।।

আমার নাম পুতুল। হ্যা। আমার পুতুল শরীরটাকে কদিন আগে দোকান থেকে কিনেছেন এক বিবাহিতা। তার মেয়ের জন্য। আমার দাম অনেক। এখনো কেউ আমার কোন নাম রাখেনি। সামনের বাড়িতে যে মেয়েটা থাকে সে নিজের পুতুলগুলোর কি সুন্দর সুন্দর সব নাম রাখে। কি ভালোবাসে তাদের। আমার হিংসে হয়। কি জানি? এই যে বাচ্চা মেয়েটা এখন সবে দোলনায় দুলছে, ওর মুখ ফুটলে ও আমার নাম রাখবে কি না?

আমি পুতুল। আমার খিদে নেই। আমার ঘরের ঠিক ঠিকানা নেই। আমার লজ্জা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়না। কিন্তু আমার ঘুম আছে। কারন আমায় যখন কেউ শুইয়ে দেয়, আমার সোনালি সোনালি চোখের পাতা আপসে বন্ধ হয়ে যায়। আমি সেভাবেই তৈরি। তখন আমি ভাবতে পারি। তখন আমি অনেককিছু দেখতে পাই। একটা জগত, ঠিক এই শহরটার মতো। কিন্তু চারদিকে শুধু নীল ধোঁয়া। সেখানে আমরা পুতুলরা নিজেদের মতো থাকি। যে যার নিজের মতো, নিজের ইচ্ছে নিয়ে। আমাদের কেউ বাধা দেয়না। আমাদের জগতে আসতে গেলে, ইচ্ছের জোর লাগে। আর লাগে ঘুম। কাউকে এ জগতে আনার জন্য ইচ্ছের সাথে ইচ্ছের মিল ঘটাই আমরা। তারপর ঘুমের রাস্তায়, তাকে নিয়ে আসি আমাদের এ জগতে। পথ গুলোনো রাস্তা। নিজে থেকে কেউ চিনে আসতে পারেনা।

এখন আমার চোখ বন্ধ। এখন আমি ঘুমোচ্ছি। আজ এই জগতে, আমার এই নিজের শপ্নপুরিতে আমি অসহায় হয়ে দেখছি। কারন আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ কি যেন একটা ঘটবে। নীল ধোঁয়া আমায় বলেছে।

আজকের ঘটনাগুলো খামখেয়ালি, এ জগতটাই তো তাই। রাস্তার ওধারে ঐ বাড়ীটায়, যার কথা বললাম, ওর আজ বিয়ে। ওর নাম হৃদিকা। ওকে আমরা চিনি। ও খুব ভালো। কিন্তু ও যে মানুষ। আর বাকি মানুষরা যে ভালো না। তাই ও ভালো হলেও আজ ও খারাপ থাকবে। আজ পুতুলরাজ্যে ওর পুতুলবিয়ে।

আজ নীল ধোঁয়া গাঢ় হয়েছে আরো। খুব অস্পষ্ট চারদিকটা।

হৃদিকার মায়ের ঘরে নাকি সেই নীল ধোঁয়া ঢুঁকে চুরি করেছে। হৃদিকার মা ঘুমোচ্ছিলেন। টের পাননি।

আচ্ছা! আমি যদি গিয়ে ওর মাকে… ভোর হতে আর বেশী বাকি নেই। তাই এবার চটপট…

 

।। ১৫ ।।

বিছানা ছেড়ে উঠে বসেন শর্মিষ্ঠা। দেওয়ালে অলোকের ছবিটা নেই। ঠাকুরের সিংহাসন শূন্য। ঘরের খোলা দরজা দিয়ে নীল রঙের ধোঁয়া এসে পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। অদ্ভুত আশংকায় ঘরের বাইরে ছুটে বেড়িয়ে এলেন তিনি। হৃয়ের ঘরের দরজাও খোলা। ঢুকে দেখলেন সেই ঘরও ফাকা। একটা নীলরঙের আগুনে পুড়ে যাচ্ছে তার মেয়ের সাধের সব পুতুলেরা। অ্যালেক্স, রাজা, ধুবলি, রোজি, পিটার, জেনিফার, শেলি, রাণী, পল, ডুগডুগি … তার মেয়ের পুতুলগুলো। তার মেয়ের সংসার। আশ্চর্য নীল আগুন? নীল ধোঁয়া? এসব কি?

হঠাত খুব করুণ সানাইয়ের সুর কানে এলো তার। রাগ ভৈরবী। বাবুল মোরা নইহর টুটোরি যায়। বাইরে সানাই বাজছে? এ কি? কার বিয়ে হচ্ছে? দোরগোড়া থেকে শুরু করে রাস্তা অবধি ধানের একটা রেখা। কনকাঞ্জলি?

‘হৃ! হৃ তুই কোথায়?’ চিৎকার করে রাস্তায় ছুটে গেলেন তিনি। তার গলা দিয়ে চিঁচিঁ শব্দ ছাড়া কিছুই বার হোলোনা। ভয়ে শর্মিষ্ঠা ঘেমে নেয়ে অস্থির। রাস্তায় রাখা লাল গোলাপে মোড়ানো গাড়ি। হৃএর বিয়ে? হ্যা! ঐ তো তার মেয়ে গম্ভীর মুখে বাবার ছবি হাতে গাড়িতে উঠছে। পাশে তার বড়ো জা, অলোকের মারা যাওয়ার পর যাকে তিনি আর কখনো দেখেননি। তার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলছেন

‘কি গো? মেয়ের কি জোর করে বিয়ে দিয়েছো? কেমন জানি কাঠ হয়ে বসে আছে তোমার মেয়ে। লোকেরা বলাবলি করছে।’

শর্মিষ্ঠা অবাক। জোরগলায় বলতে চাইলেন,

‘না না! আমি এ বিয়ে দিইনি। দিইনি এ বিয়ে! এ বিয়ে কবে হোলো? আমি মানিনা এ বিয়ে। কার সাথে হোলো?’

হাওয়ায় যেন ভেসে এলেন সোমনাথের মা!

‘ও মা! বেয়ান! বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আপনিই তো গেছিলেন আমাদের বাড়ি। ভুলে গেলেন?’ আন্তরিকতার দেঁতো হাসিতে সোমনাথের মায়ের মুখটা কি কুৎসিত।

গাড়ি থেকে টোপর মাথায় দিয়ে এবার যে নামলো, একি! কে এ? মিস্টার সোলাঙ্কি? পৈশাচিক হাসি হেসে এগিয়ে এসে শর্মিষ্ঠার পায়ে হাত দিতে গেলেন। ছিটকে দূরে সরে এলেন শর্মিষ্ঠা। তার পায়ে কি যেন একটা ঠেকলো। তুলে দেখলেন তত্বসূচি। একটা থালায় ছোট্ট একটা প্যাড। উপরে বর-বৌ এর পুতুল। হাতে সেই নিয়ে এগিয়ে গেলেন গাড়ির দিকে। হৃ এর মাথায় হাত বুলাতে চাইলেন। কেমন যেন ছুঁতে পারলেননা মেয়েকে। পাথরের মতো মেয়ের হাতে বাড়িয়ে দিলেন থালাভরা তত্বের তালিকা। যেন এটুকুই এ বিয়েতে তার ভুমিকা। যেন এই তত্ত্বসুচির জন্যই গাড়ি দাঁড়িয়েছিলো। বর আর বৌয়ের পুতুলদুটোকে বুকে আঁকড়ে ঝরঝর করে কেঁদে উঠলো হৃ। মামাইয়ের দিকে আর ফিরেও তাকালোনা। গাড়ি মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়।

 

সব হঠাৎ স্থির হয়ে গেলো। নিস্তব্ধ। সব উধাও। কেউ কোত্থাও নেই। শুধু হাওয়ায় একবার হৃএর জেঠিমার গলা যেন শুনতে পেলেন শর্মিষ্ঠা। দূর থেকে নিদানের মতো। আকাশ ফুরে। ‘যাব্বাবা মেয়ে তাহলে এতোক্ষনে কাঁদলো।’

[ছবিঃ ভুটান]


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *