লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের সাথে আলাপচারিতায় উত্তর কোলকাতার সিপিআইএম প্রার্থী কনীনিকা বসু (ঘোষ)
— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন / নিজস্ব সংবাদদাতা
২১শে এপ্রিল, ২০১৯, কোলকাতাঃ বেজে গেছে নির্বাচনের ডঙ্কা। দু’দফা ভোট শেষ। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের মহোৎসব ভারতের সাধারণ নির্বাচন। এর অন্তিম পর্যায়ে পশ্চিমবঙ্গে যে আটটি সংসদীয় এলাকায় নির্বাচন হতে চলেছে তারই মধ্যে অন্যতম কোলকাতা উত্তর। সিপিআইএমের তরফে এই কেন্দ্রে প্রার্থী এবার কনীনিকা বসু। বামপন্থী নারীবাদী আন্দোলনের অন্যতম এই মুখ এবার আলাপচারিতায় বসলেন কোলকাতার লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের সাথে।
দলের তরফে অনুষ্ঠানের পরিচালিকা অধ্যাপিকা ডঃ ইশিতা মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিগুলির তীব্র নিন্দা করে জানান, এই বৈষম্য ইচ্ছাকৃতভাবে জিইয়ে রেখেছে কেন্দ্রের সরকার। এর বিরুদ্ধে সবাইকে রাজনৈতিক পথে লড়াই করার আহবান জানান তিনি। ট্রান্সজেন্ডার বিল ২০১৪-এর পাশ না হওয়া এবং ট্রান্সজেন্ডার বিল ২০১৮-এর মধ্যে সংরক্ষণের সুবিধে না থাকার বিরুদ্ধে সোচ্চারও হন তিনি।
পরবর্তী বক্তা অপ্রতিম জানান অন্যান্য দলের ইশতেহারে সমকামী বা রূপান্তরকামীদের ক্ষমতায়নের প্রসংগ আসলেও সিপিআইএমের মতো বিশদে কেউই নিজেদের প্রতিশ্রুতিগুলিলে লিপিবদ্ধ করেনি। তিনি ধিক্কার জানান ট্রান্সবিলের অন্তর্গত স্ক্রিনিং কমিটির। প্রসংগত অপ্রতিম নিজেও নিজেকে লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক গোষ্ঠীর নাগরিক হিসেবেই পরিচয় দিয়ে থাকেন।
এর পরে লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের পক্ষ থেকে পরামর্শ আহবান করা হলে প্রথম বক্তব্য রাখেন প্রান্তকথার কর্ণধার শ্রী বাপ্পাদিত্য মুখার্জি। তিনি লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের প্রতি বঞ্চনার বিরুদ্ধে আইন আনার সুপারিশ করেন। রূপান্তরকামীদের জন্য আলাদা হোম করার সাথে তাদের জন্য আদমসুমারি করার বিশেষ দাবী জানান তিনি। দক্ষিণ ভারতের আলাদা হোম এবং বিনামূল্যে লিঙ্গপরিবর্তনের বর্তমান ব্যবস্থার সাথে পশ্চিমবঙ্গের রূপান্তরকামীদের প্রাপ্ত সুবিধেগুলির তুলনা টেনে আলাপচারিতার মঞ্চ থেকে ট্রান্সজেন্ডার বোর্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন তিনি। ভারতের লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক গোষ্ঠী যে ভোটব্যাংক হিসেবে মোটেও নগণ্য নয় এই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি সিপিআইএমের সামনে দাবী রাখেন, এই একসাথে পথচলা যেন ১৯শে মে শেষ না হয়।
পরবর্তী বক্তা হিসেবে এটিএইচবি-এর রঞ্জিতা সিনহা একাধারে কেন্দ্রীয় ও রাজ্যসরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত বঞ্চনার কথা তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন৷ বিশেষ করে রূপান্তরকামী সম্প্রদায়ের উপরে বর্তমানে এবং আগের ঘটে যাওয়া দুঃখজনক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে রাজ্যে এবং দেশের মধ্যে সাংবিধানিক স্থিরতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরক্ত না হলেও যে দল সত্যিই লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষদের জন্যে কাজ করবে, এলজিবিটি নাগরিকরা তাদের পাশে অবশ্যই থাকবে এই আস্বাস শোনা যায় তার বক্তব্যে।
ওয়েস্ট বেঙ্গল ফোরাম ফর জেন্ডার এন্ড সেক্স্যুয়ালিটির পক্ষ থেকে পরবর্তী বক্তব্য রাখেন কৌস্তুভ। তিনি বামপন্থা এবং লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক আন্দোলনের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে নিজের বক্তব্য শুরু করেন এবং সিপিআইএমের কাছে জানতে চান, যৌন-কর্মীদের সম্পর্কে তাদের অবস্থান।
স্যাফো ফর ইক্যুয়ালিটির তরফে পরবর্তী বক্তা আবির ক্ষোভ প্রকাশ করেন নির্বাচনী ইশতেহারে সমগ্র লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি প্রতিশ্রুতিগুলিকে “ট্রান্সজেন্ডার” শিরোনামের আওতায় নিয়ে আসার জন্যে। সিপিআইএম-কে জনসমক্ষে নিজেদের রাজনৈতিক পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের পাশে এসে দাঁড়ানোর আহবান জানান তিনি। দলের মধ্যেও যে পুরুষতান্ত্রিকতা আছে তাকে কাটিয়ে ওঠার উপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন৷
এর পরবর্তী বক্তা দিনাজপুরের বিনন্দন সকলের সাথে ভাগ করে নেন নিজের জীবনের কর্কশ অভিজ্ঞতা। জানান তার সমকামী পরিচয় প্রকাশ্যে আসার পর কিভাবে তার বাবা/মা হাত পা বেঁধে তাকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। নবান্নের দারস্থ হয়ে সেখানেও মেলে বঞ্চনা আর অপমান। তিনি বিশেষ কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপন করেন অপ্রতিমের উদ্দেশ্যে।
এই সমস্ত কথার প্রত্যুত্তরে পরিচালিকা জানান যে সিপিআইএম প্রচেষ্টা করবেন শুধু লিঙ্গ বা যৌনতার নিরিখে নয়, সামগ্রিকভাবে প্রান্তিক শব্দটাকেই মুছে ফেলার জন্যে। উনি এসএফআই-এর সর্বভারতীয় সম্পাদক শ্রী ময়ুখবাবুকে আহবান জানান শিক্ষাক্ষেত্রে এ বিশয়ে তার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার জন্যে।
ময়ুখবাবু নিজেদেরকে লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক মানুষদের দুঃখকষ্টের শরিক হিসেবে উল্লেখ করে দাবী করেন যে এসএফআই প্রথম ছাত্রসংগঠন যারা তাদের সদস্য হওয়ার ফর্মে পুরুষ নারী এবং অন্যান্য – এই তিনটি অপশান রেখেছিলো এবং লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে তাদের ছাত্রনির্বাচনের প্রার্থী বেছে নিয়েছিলো। এই ত্রুটিবিচ্যুতিযুক্ত সমাজের থেকে উঠে আসার দরুন নিজেদের মধ্যেও যে কিছু গোঁড়ামো রয়েছে তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন ময়ুখবাবু। জানান তাকে অতিক্রম করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা এবং বিভিন্ন দৃষ্টান্তমূলক সাহসী পদক্ষেপ লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক পড়ুয়াদের পাশে থাকার জন্যে গ্রহণ করেছেন ইতিমধ্যে। উদাহরণস্বরূপ এসএফআই-এর সাম্প্রতিক দিল্লীর রামধনু শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণের উল্লেখ করেন তিনি। কোলকাতা উত্তর নির্বাচনী কেন্দ্রের প্রার্থীর লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সাথে এই আলাপচারিতকেও একটি অভিনব উদ্যোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
এর পরবর্তী পর্যায়ে মূল বক্তা কনীনিকাদেবী লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক আন্দোলনের সাথে নারীবাদী আন্দোলনের তুলনা টেনে বলেন, সমস্ত লড়াইই শুরু হলে বিভিন্নভাবে ভিতরে এবং বাইরে পরিবর্তনের মাধ্যমে এগিয়ে চলে, থেমে থাকেনা। নারী আন্দোলনের সূচনার দিনগুলোতেও কাজটা অতো সহজ ছিলোনা। এল-জি-বি-টি আন্দোলনও এর ব্যতিক্রম নয়। দলের তরফে বরাবরই এর সপক্ষে আওয়াজ উঠেছে, কিন্তু এখনকার প্রেক্ষিতে কাজটায় আরো অনেক বেশী বন্ধুদেরকে সিপিআইএম সঙ্গে পাবে বলে মনে করছেন তিনি। যেকোন নতুন কিছু শুরু করার আগে জমি তৈরির প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষকে পাশে পাওয়ার জন্য আগে যে অসুবিধেটা ছিলো, এখন এ বিশয়ে কথা বলতে গেলে অতোটা অসুবিধে হবেনা। মঞ্চ থেকে কনীনিকাদেবী বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার অস্তিত্বের পাশাপাশি প্রথাগত রাজনৈতিক আন্দোলনকে হাতিয়ার করার সপক্ষে যুক্তি পেশ করেন এবং জানান যে বর্তমান সময়ে যেখানে রাজ্যে এবং গোটা দেশে বাকস্বাধীনতা বিপন্ন, সেখানে তার পরিবর্তন না ঘটিয়ে অন্য কোন ধরনের মানবমুক্তির আন্দোলন সফল করা সম্ভবপর নয়। লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক নাগরিকদের সিপিআইএম অচ্ছুৎ মনে করেনা, আর এ বিশয়ে কারো অবিশ্বাস থাকলে ২৪ তারিখ মনোনয়ন জমা দেওয়ার দিনে, যেকোন মানুষকেই লিঙ্গচেতনা অথবা যৌনতা নির্বিশেষে সঙ্গী হওয়ার আহবান জানান তিনি। ১৯শে মেয়েতেই এই একসাথে পথ চলার শেষ নয়, এই আস্বাস ভেসে আসে তার দৃঢ় কণ্ঠস্বরে। সমাজের গোঁড়ামো নয়, চিরপরিবর্তনশীল বিজ্ঞান এবং তার দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে সবকিছুর বিশ্লেষণের উপরে গুরুত্ব আরোপ করে তিনি বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে নয়, একসাথে একে অন্যের উপরে নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকার নামই সমাজ। তাই মূলধারার সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মিলিয়ে দেওয়ার দায়বদ্ধতা সিপিআইএম অস্বীকার করতে পারেনা
সমর্থনের খোঁজে, বন্ধুতার অন্বেষণে দু’পক্ষই। একদিকে পোড়খাওয়া রাজনৈতিক দল, অন্যদিকে দেশের আপামর লিঙ্গ-যৌন-প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। সেই জনগোষ্ঠী যারা প্রতিনিয়ত লড়াই করে নিজেদের ন্যুনতম অধিকারের জন্যে। যাদের বিশ্বাস ভেঙ্গেছে বারবার কখনো সমাজ, কখনো বন্ধুরা, আবার কখনো নিজের পরিবার। তাই তাদের দৃষ্টিতে কি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্যোতনা নিতান্তই অমূলক? ঘরপোড়া গরুর দল। এদের পাশে পাওয়ার জন্যে, এদের বিশ্বাস অর্জনের দায়ও তাই হয়তো মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলিকেই নিতে হবে।
কাঁচালঙ্কার তরফে আমাদের সংবাদদাতা এই অনুষ্ঠানটিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরিক্ষন করে বন্ধুদের জন্যে এর সারাংশগুলি এই নিবন্ধের মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করলেন। প্রায় দেড় ঘন্টা ধরে চলা সমস্ত কথাকে লিপিবদ্ধ করা সম্ভবপর হয়নি, এই ত্রুটি বন্ধুরা নিজগুণে ক্ষমা করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
** বিঃ দ্রঃ কাঁচালঙ্কা কোন রাজনৈতিক দলকে সরাসরি সমর্থন করেনা। কিন্তু এলজিবিটি সম্প্রদায়ের পক্ষে ও বিরুদ্ধে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছে তার সমালোচনা মুক্তকণ্ঠে করতে কোন সংকোচও বোধ করেনা।
ছবিঃ বাপ্পাদিত্য মুখার্জি