নারীবাদ, এলজিবিটি, যৌনকর্মী আর একটি মে দিবস – একটি অশ্লীল নিবন্ধ

নারীবাদ, এলজিবিটি, যৌনকর্মী আর একটি মে দিবস – একটি অশ্লীল নিবন্ধ

— অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

“উৎসব” ছবির একটি দৃশ্য

পয়লা মে, শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবী মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষের দিন।
শ্রম, কি তার সংজ্ঞা? কারা শ্রমিক? এসো বন্ধুরা একটু কথা বলা যাক তাদের নিয়ে, যাদের সমাজ/রাষ্ট্র এখনো শ্রমিকের মর্যাদা দেয়নি। আর আমরা তথাকথিত বাবু বিবির দল, যাদের নাম বলতেও নজ্জা পাই, যদিও বা বলি, তাহলে সেটা অন্য কাউকে খিস্তি দিতে।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছিলো, যৌনকর্মীদের নিয়ে, বা ভদ্রসমাজ যাদের বেশ্যা, খানকি, রেন্ডী, মাগী, ইত্যাদি আরো কতো মিষ্টি নামে ডাকে, তাদের নিয়ে। “সেক্স ওয়ার্কার”।
যৌনকর্মী বা আরো নির্দিষ্ট শব্দ হিসেবে, যৌনবিনোদনকর্মী। এরা কারা? সোজা কথায় যারা শরীর বেচে খায়। শরীর এরা কিভাবে বেচে? ছুড়ি দিয়ে কেটে পায়ের মাংস, সিরিঞ্জ দিয়ে চুসে রক্ত বিক্রি করে কি? নাহ! এরা নিজের শরীর ভাড়া দেয়, এবং যিনি সেই শরীর ধার নিচ্ছেন, তাকে সেই শরীর সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করার জন্যে সমস্তরকম সাহায্য করেন। যারা শরীর ব্যবহার করেন তারা অবশ্যই সেটা ব্যবহার করেন নিজেদের যৌনচাহিদা মেটানোর জন্যে। বা গোদা বাংলায় “সেক্স” করার জন্যে। যদিও সেক্স করা ছাড়াও অন্য উপায়ে উপভোগকারী নিজের যৌন-ইচ্ছে মেটাতে পারে। আর শুধু আপাত-যৌনচাহিদা নয়, আপনি গিয়ে ঘন্টাখানেক গান শুনুন, তাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে ঘুরে আসুন দীঘা-পুরি-দার্জিলিং, এদের প্রাপ্য পারিশ্রমিক দিলে, সেরকম বন্দোবস্তও আপনার জন্যে পাকা।
এদের বিশয়ে আরেকটু বলার আগে, একটা অর্থবহ প্রশ্ন, যা অনেকের মনেই ঘুরপাক খাচ্ছে, তার একটু নিরসন না করলে সত্যি মুশকিল। “কাঁচালঙ্কা হঠাৎ বেশ্যাদের নিয়ে মাতলো কেন? ছি!!”
… মনে উঠছে তো প্রশ্নটা? উত্তরও দিতে আমি প্রস্তুত। তবে এ উত্তর জবাবদিহি নয়। বরং পয়সার যে দিক নিয়ে কথা হয়না, সেই দিকটা নিয়ে কথা বলা।
“তমসো মা জ্যোতির্গময়”। তুমি শোও মা, আমি একটু জ্যোতির বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ঠাট্টাচ্ছলে এই পানিং বলা হলেও আমরা এর মানে তো জানি। অন্ধকার নয়, আলোই শ্রেষ্ঠ, অতএব হে মনুষ্য, বাঁচতে চাইলে তোমরা দলেদলে পিলপিল করে আলোর দিকে দৌড় দাও, শ্যামাপোকার মতো। “শ্যামা মা কি আমার কালো রেএএএ”। এইক্কেলো, এতো গুলিয়ে গেলো। ঐটেই তো প্যাঁচ। আর এই প্যাঁচের নাম ধর্ম। যে ধর্ম, সমাজ এবং রাষ্ট্রের সাথে, তিন বোনেতে নিজের সুবিধার্থে থ্রিসাম করে জন্ম দিয়েছেন পুরুষতন্ত্রের। তাই ফুউউশতন্ত্রকে ফুউউশ করতে হলে আগে তার স্তম্ভগুলোকে চেনা প্রয়োজন। চেনা প্রয়োজন তার কোন কোন শিক্ষা আমাদের উপকারে লাগে, আর কোনটে কোনটে তাদের পকেট ভরে।
মানুষ বুদ্ধিমান জন্তু। জন্তু কি করে? খায়, ঘুমায়, লাগায়। মানুষ বুদ্ধিমান, বুদ্ধি করে খায়, বুদ্ধি চুলোয় রেখে ঘুমায়, আর বুদ্ধু হয়ে লাগায়। কারন লাগানোর কিছু নিয়মকানুন তিন দোসরে মিলে ঠিক করে দিয়েছে।
১. লাগানো পুরুষের অধিকার, মেয়েরা এখানে লাগানোর বস্তু।
২. লাগাচ্ছো লাগাও, কিন্তু খালি মেয়েদের। ছেলেদের লাগিও না। আর মেয়েরা তো লাগানোর বস্তু। তারা নিজেদের মধ্যে আর কি করে সেক্স করবে?
৩. লাগাবে যখন বাচ্চা বানাও তাগড়াই। ধর্মের সংখ্যা দরকার, সমাজের সদস্য, আর রাষ্ট্রের কর্মী, ট্যাকশো দেবে যে। সৈনিক হলে তো কথাই নেই, তবে সেক্ষেত্রে ব্যাটাচ্ছেলেই ভালো।
৪. কন্ডোম পরে লাগিওনা, আর লাগালে বিয়ে করা বৌকেই লাগাও। নইলে হাজারো হ্যাঙ্গামা। আর ধর্ম আর সমাজ তো পুরুষকে একাধিক বৌ রাখার অধিকার দিয়েইছিলো। রাষ্ট্রও সায় দিয়েছিলো। ইদানিং ক বছর হলো ফেমিনিস্টদের জ্বালায় তা আর হচ্ছেনা, এই আর কি। তো বিয়ের বাইরে লাগাবেই বা কেন ভাইটি?
৫. বাচ্চা প্যায়দা না করতে পারলে লাগিয়ে কোন লাভ নেই। তাই সবসময় লাগাবো লাগাবো করে হুলোবেড়ালের মতো চুলকিওনা।
৬. আর এসবের পরে একটাই ব্রম্ভাস্ত্র, আমরা তিন বোনে যা বললাম সেটাই করো। সেক্স নিয়ে ভেবোনা, এ এক পবিত্র সন্তান উৎপাদন পন্থা। তা ছাড়া, এসব ভাবা পাপ। তোমার যৌনখিদে অন্যায়। তোমার বাড়া বিচি গুদ দুধ, এ সব অপবিত্র।
…. আর ঠিক এখানেই শুরু হয় সেক্সকে নোংরা কদর্য বলে দাগিয়ে দেওয়ার খেলা। পুরুষতন্ত্রের তিন হোতার ব্রেনচাইল্ড এই ধারনা, আসলে পুরুষতন্ত্রেরই আরেকটা রুপ। চোড়াগোপ্তা ফুউউশতন্ত্র। তাই এর বিরুদ্ধে বলার দরকার আছে। দুর্বার সংগঠনের ডঃ এস জানার একটা কথা এখানে খুব মনে পড়ছে। সমুদ্রমন্থনের পড়ে অমৃতে ভাগ বসিয়েছিলো দুই অসুর, রাহু আর কেতু, যারা এখনো দেবতাদের পিছনে লাগতে ছাড়েনা। ঠিক সেরকমই পুরুশতন্ত্র নিজেদের আখের গুছিয়ে সবাইকে যেমন ঘোল খাওয়াচ্ছিলো সেটা টের পেয়ে অন্তত দুজন মানুষ ঠিকঠাক বেড়িয়ে এসে নিজেদেরটা নিজেরা বোঝার চেষ্টা করেছে, অন্যদের মতো ঘোল খায়নি। এক হিজড়েরা, এবং দুই যৌনকর্মীরা। তাই ফুউউশতন্ত্রের কাছে এরা চোখের বালি।
এই তো গেলো যৌক্তিক কারণ, অন্যভাবে যদি এটা ভাবি “আমার শরীর আমার মন” অধিকার প্রয়োগ করবো আমি নিজে, সেটা বিক্রি করেই যদি হয়, ভুলটা কোথায়? একজন আই-টি নিজের মন বিক্রি করবে, বুদ্ধি বিক্রি করবে, আর যৌনকর্মীরা নিজেদের শরীর বিক্রি করলেই দোষ? এখনো আটকাচ্ছে তো বন্ধু? আটকাবেই যে। পুরুষতন্ত্র ছোটবেলায় ঐ যে শিখিয়েছিলো, লাগানো মহাপাপ, সেটা থেকে আমরা এখনো যে বেরোতে পারিনি। আর সত্যি একটু ভালো করে বোঝো তো। যেকোন মানবাধিকার আসলে একটাই লড়াই। যৌনকর্মীরা কিন্তু অনেক সহজে মেনে নিয়েছে নারীবাদ, অনেক সহজে মেনে নিয়েছে লিঙ্গের তরলতা। অনেক সহজে মেনে নিয়েছে সমান্তরাল যৌনতা। উলটে আমরা, যারা নারীবাদী, যারা এলজিবিটিআইকিউএএইচ+ নিয়ে বড়ো বড়ো বক্তৃতা দিই, সমস্যা তাদেরই। তারাই ঐ, সুবিধাবাদী জায়গাটা পেতে চায়, মধ্যপন্থা। সমাজকে অস্বীকার করে নয়, সমাজের অংশ হয়ে বাঁচতে চাই। ঘোল খাই ঢুকুঢুকু, চোখ চাই চুকুচুকু, আর যৌনকর্মীদের নাম শুনলেই থুকুথুকু? যারা নাতিঝেটা মারে তাদের কাছে গিয়ে “আমায় নাও গো”। আর যারা বন্ধুত্বের হাত বাড়াতে চায় তাদেরকে “দূর লক্ষীছাড়ি বিড়ালীনি”? আমরা সবাই, এমনকি আমিও এই দুমুখো মুখোশ নিয়েই চলছি, তাই অন্তত একদিন নিজের মনের সত্যিটা না হয় বলেই ফেললাম।

“বি এ পাশ” ছবির একটি দৃশ্য

এবার না হয় আবার ফিরে আসি আমাদের বন্ধুদের কথায়। যৌনবিনোদনকর্মী। বলা হয় বিশ্বের আদিমতম রোজগারের পন্থা যৌনবিনোদন। আমরা গান শুনি মন ভালো করতে। নাটক দেখি, বই পড়ি, সিনেমা, টিভি। কতো কি। কিন্তু সেক্স যে কতো ভালো রিফ্রেশমেন্ট, সেটা ভেবে নিতে আমাদের কোথাও বাঁধোবাঁধো ঠেকে। কিন্তু সেক্সকে বিনোদন ভাবতে তো সত্যি কোন সমস্যা নেই। আর যেসব বন্ধুরা আমাদের এই বিনোদন জোগায়, তারা কেন মুচি মেথড়ের পাশে “সমাজবন্ধু ” হিসেবে স্থান পাবেনা? সমাজ বাকি “সমাজবন্ধু”দের মতো এদের খুল্লমখুল্লা শোষণ করতে পারেনা, সেইজন্য? সানি লিওন (তার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই) থেকে শুরু করে তাবড় তাবড় আইটেম সঙ্গে শরীরের কিয়দংশ দেখানো (যা করে বেশ করে) হিরোইনরা এবং হিরোরা, তাদের তো আমরা মাথায় তুলে নাচি। আর কদিন আমাকে অন্য কেউ বলে দেবে কোনটে ঠিক আর কোনটে বেঠিক। আমার নিজের যুক্তিতে এনারা তো কোন অংশে এদের চেয়ে কম জাননা। নাচ গান শিল্প ধারন করে রেখেছেন এরা যুগের পরে যুগে। আর আমাদের শিল্প-সমাজ? নেমকহারামের দল। একসময় এই যৌনকর্মীরাই নাটকে অভিনয় করতো, তখন এরা হলভর্তি করার জন্যে “ভদ্রঘরের মেয়েছেলে” খুঁজেও না পেয়ে এদেরই দোরে আসতো ঠিক। একসময় নাটক-সিনেমাকেও লোকে নোংরা ভাবতো। আজ যখন এরা সমাজের অংশভাগ, সবাই যখন এদের মাথায় তুলে নাচছে, তখন এরাই নাক শিঁটকোয় সোনাগাছির নাম শুনলে? আর তাদেরকেই বা কি বলি। ভারতের স্বাধীনতার লড়াইতে এদের ভূমিকা কম ছিলো? কোলকাতার রাস্তায় এরা হাটেনি? আন্দোলনের জন্যে টাকা তোলেনি? বন্দুক লুকিয়ে রাখেনি? কি করেছে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ, স্বাধীন হওয়ার পরে, এদের জন্যে?
প্লিজ, হোমোরা যেমন জোড় করে রাস্তা থেকে তুলে একটা ছেলেকে বিছানায় রেপ করেনা, একজন মাসীও ভিক্টোরিয়ার মাঠ থেকে তুলে খাটে তুলে এনে ফেলবেনা কাউকে। কিন্তু এদের দেখলে তো এখনো অনেকে ভয় পায়। একটা ফোবিয়া নিয়ে কথা বলবো আর আরেকটা নিয়ে বলবোনা?
অনেকে বলবে কতো মেয়েকে জোড় করে আনা হয়, হ্যাঁ হয়। যতোদিন না যৌনতাকে আর যৌনকর্মীদের খোলামনে গ্রহণ করা হবে, যতোদিন না তাদের স্বাভাবিক কর্মী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন হবে, ততোদিন এ কমার নয়। আইনে ফেললেই, সব খোলাখুলি হবে, আর এই ট্র্যাফিকিং বন্ধ করা যাবে। তা তো নইই। লুকিয়ে লুকিয়ে সেক্স করো এদের সাথে যৌনরোগ ছড়াক, তাতেই যেন রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন সমর্থন। কোন দেশে কোন কালেই যৌনকর্মীদের নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। এরা আমাদের প্রয়োজনীয় অংশ। যদি তা না হতো, নিজে থেকেই এ ব্যবসা উঠে যেতো। কৈ তা তো যায়নি। গেছে?
আমাদের আইনে এখনো এরা অপরাধী, হ্যাঁ, এখানেও ৩৭৭ ধারার মতোই কেস। যেমন গে হলে চাপ নেই, চোদালে চাপ। ঠিক তেমনি বেশ্যা হলে চাপ নেই, যদি তুমি তার বিজ্ঞাপন দাও তালে চাপ। বোঝো!! এইসব বস্তাপচা আইন কবে যাবে? ৩৭৭ নিয়ে তো তাও আমরা অন্য দেশের উদাহরণ দি, কিন্তু যৌনকর্মীরা তো সব দেশেই উহ্য, (কয়েকটি বাদে) স্বরবর্ণের “ঌ”। বিস্বের প্রথম সারীর দেশেও এদের খুব যে উঁচু চোখে দেখা হয় তা নয়। আর ভারত বা বাংলাদেশ, মানুক বা না মানুক, অনেক কাজই করে বড়োভাইদের খুশি রাখতে, সেটা কে না জানে।
কোথায় গেলো কামসুত্রের ভারতীয় উপমহাদেশ? কোথায় গেলো “আমার শরীর, আমার মন” আমার যৌনতার স্বাধীনতা? যেভাবে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড দেখলেও আজকাল রাস্তায় কেলানো হয়, তাতে আবার সেই স্বর্ণযুগে ফিরতে কদিন, কতোবছর যে লাগবে, কে জানে?
কিন্তু একটা জিনিস সত্যি বোঝার আছে, নারীবাদী আন্দোলন, এলজিবিটিআইকিউএএইচ+ আন্দোলন, আর যৌনকর্মীদের আন্দোলন কোথাও এক সুতোয় বাঁধা। একসাথে যদি আমরা না চলি ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।
আমার এই লেখায় আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ দেবো “দুর্বার মহিলা সমন্বয় সমিতি”-কে। ভালো লাগে যখন দুর্বার গোষ্ঠী এক ছাদের তলায় এনে হাজির করে পুরুষ, নারী, আর ট্রান্স যৌনকর্মীদের। সারা বিশ্বের কাছে নজির সৃষ্টি করে পিয়ার এডুকেশন পদ্ধতির সাফল্যে। উদ্বুদ্ধ করে অন্য আন্দোলনকে।
লালন বলেছিলেন বেশ্যার ঘরে ভাত খেলে জাত যায়না। আমরা তাকেও ভুলেছি। নিজেদের ইতিহাসও ভুলেছি। আর এক অদ্ভুত পলিটিক্স খেলে চলেছি, কামকে দাবিয়ে দেওয়ার। সমাজকে বলছি আমরা কামুক নই প্রেমিক। আমাদের গ্রহণ করো। বলতে পারছিনা নিজেদের কামুক সত্বার কথা চিৎকার করে।
তাই অন্তত আমার তরফ থেকে খুব ইচ্ছে থাকলো পরেরবার প্রাইডওয়াকে এক যৌনবিনোদনকর্মী ভাই/বোন/দাদা/দিদি-র হাতে হাত রেখে হাঁটার। দুজনে মিলে একসাথে বলার “তুমি শোও মা, আমি একটু জ্যোতির বাড়ি থেকে ঘুড়ে আসি”।

“মান্ডি” ছবির একটি দৃশ্য

[রচনাঃ ১লা মে, ২০১৭]

— o — o — o —

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *