লিহাফ – ইসমত চুগতাই

~~ লিহাফ ~~

— ইসমত চুগতাই

** অনুবাদঃ অনিরুদ্ধ (অনির) সেন

যখনই শীতকালে আমি লেপ গায়ে দি, পাশের দেওয়ালে মনে হয় তার ছায়াটা যেন হাতির মতো নাচানাচি করছে আর তখুনি হঠাত আমার মন ছুটে চলে যায় সেই ফেলে আসা দিনগুলোর পর্দায়। কতকিছুই না মনে পরে যায়!

মাপ করবেন, আমি আপনাদেরকে নিজের লেপ নিয়ে কোন কাব্যিক কথা শোণাতে যাবোনা। আর লেপ নিয়ে আদৌ কোন কাব্য হতেও পারে কি? আমার মনে হয় কম্বল হয়তো আরামপ্রদ কিন্তু তার ছায়া এতোটাও ভয়ঙ্কর নয়, লেপের যে ছায়া দেওয়ালের উপরে দোল খায়, তার কাছে তুশ্চু।

এই গল্প যখকার, তখন আমি ছোট, আর আমার সারাদিন কাটতো আমার ভাইদের আর তাদের বন্ধুদের সাথে মারামারি করে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমি এতোটা ডানপিটে ছিলামই বা কেন। সেই বয়সে, যখন আমার সমস্ত বোনেরা প্রেমিক সংগ্রহ করতেই ব্যস্ত, আমি কাছের হোক বা দূরের, সব ছেলে আর মেয়েদের সাথে চুলোচুলিতেই মশগুল।

আর ঠিক এই কারণেই, আমার আম্মু যখন আগ্রা যাচ্ছিলেন, তখন হপ্তাখানেকের জন্য আমাকে নিজের পাতানো বোনের কাছে রেখে গেলেন। উনি জানতেন সে বাড়িতে একটা ইঁদুরের বাচ্চাও নেই, তাই আমার মারামারি করারও সুযোগ নেই। বাহ! বেশ কড়া শাস্তি তো! হ্যাঁ, তো আম্মু আমাকে বেগমজানের কাছে রেখে গেলেন। সেই বেগমজান, যার লেপ, আমার মনের গভীরে গরম লোহার ছাপের মতো আজো সুরক্ষিত। এই বেগমজান, যার দরিদ্র বাপ-মা নবাবসাহেবকে জামাই হিসেবে এই জন্য বেঁছে নিয়েছিলেন, কারণ তার বয়স হয়েছিলো, কিন্তু ছিলেন বেজায় ভালোমানুষ। বাজারের কোন বাজে মেয়েছেলেকে তার বাসায় দেখা যেতোনা কখনো। নিজে ছিলেন একজন হাজি, আর অনেক মানুষকে হজে যেতে সাহায্যও করেছেন। কিন্তু ওনার এক উদ্ভট শখ ছিলো। লোকে পায়রা পোষে, বা মোরগের লড়াই করায়, এইসব ভুলভাল খেলা নবাবসাহেব ঘৃণা করতেন। ওনার বাসায় তো শুধু জ্ঞানার্জনে উৎসুকরা থাকতো। যুবকেরা, ফর্শা, তন্বী তাদের কোমর, যাদের ভরণপোষণ উনিই করতেন।

কিন্তু বেগমজানকে বিয়ে করে তো উনি তাকে তার সবকিছুর সাথে ঘরে রেখে কেমন জানি ভুলেই গেলেন, আর অসহায় রোগাসোকা কোমল বেগমজান বিরহের অতলে হারিয়ে যেতে থাকলেন।

ওনার জীবনটা যে ঠিক কোথা থেকে শুরু হয়েছিলো, তা বলতে পারবোনা। যখন তিনি এই পৃথিবীতে জন্ম নেওয়ার ভুল করেছিলেন তখন থেকে? নাকি যেদিন থেকে উনি নবাবের বেগম হয়ে আসলেন আর গদীর বিছানায় জীবন অতিবাহিত করতে শুরু করলেন, তবে থেকে? নাকি যবে থেকে নবাব সাহেবের ডেড়ায় ছোকরাদের ভিড় বাড়তে শুরু করলো, তবে থেকে?ওদের জন্য সুস্বাদু খাবার আর মিষ্টি যেতো আর বেগমজান দেওয়ানখানার দরজা দিয়ে তাদের কোমড়দোলানী বাঁকা শরীর আর শিশিরের ন্যায় মসৃণ পোশাক দেখে, যেন কয়লার আগুনে পুড়তে থাকলেন।

নাকি যেদিন থেকে উনি মুরাদ করে করে ক্ষান্ত দিলেন, তুকতাক, টোটকায়ও কাজ হলোনা, আর রাতের দোয়াদুরুও নিষ্ফল, সেদিন থেকে। পাঁথরের গায়ে কি জোঁক আটকায়? নবাব সাহেব যে কে সেই রইলেন। তারপর বেগমজান হতাশ হয়ে সাহিত্যের দিকে মন দিলেন, কিন্তু তাতেও কিছু পেলেননা। রঙিন প্রেমভরা উপন্যাস আর সাহিত্যের ভাব তাকে আরো হতাশার দিকে ঠেলতে লাগলো। রাতের ঘুমও চলে গেলো আর বেগমজান ধীরে ধীরে যেন এক অপূর্ণ অসম্ভব ভালোবাসার অনুরাগে মগ্ন জড়বস্তুতে পরিণত হলেন।

সব কাপরচোপড় উনুনে দিয়ে দি, এরম মনে হতো। লোকে কাপড়চোপড় পরে কারোর উপর রোয়াব দেখানোর জন্য। কিন্তু এখন না নবাবসাহেবের ফুরসৎ ছিলো ঐ শিশিরভেজা কাজ কাম ছেড়ে একটু এদিকে বেগমজানের উপরে নজর দিতে, আর না তিনি তাকে কোথাও যাওয়ার অনুমতি দিতেন। বেগমজানের যবে থেকে বিয়ে হয়েছে, তার আত্মীয়েরা এসে মাসের পর মাস থাকতো, আবার চলেও যেতো। কিন্তু তিনি সেই বন্দীই।

ঐ আত্মীয়দের দেখে বেগমজানের যেন আরো মাথায় রক্ত উঠে যেতো। আপদের দল, টাকার ধ্বংস করতে, চর্বচোষ্য গিলতে, আর শীতের পোশাক বানানোর জন্য ঠিক উড়ে এসে জুড়ে বসে, আর উনি, নতুন তুলোর লেপের মধ্যেও যেন ঠান্ডায় জমে থাকতেন। প্রত্যেক আড়মোড়ায় সেই লেপ নতুন নতুন চেহারায় দেওয়ালে ছায়ার সৃষ্টি করতো। কিন্তু সেইসব ছায়াদের মধ্যে কোনটাই তাকে জীবনের রসদ জোগানোর জন্য যথেষ্ট ছিলোনা। তাহলে বেঁচে থেকে লাভ? কিন্তু ওনার প্রাণে প্রাণশক্তির অভাব ছিলোনা, ভাগ্যে আয়ু লেখা ছিলো অনেক, তাই উনি বাঁচলেন, আর বেশ ভালোভাবেই বাঁচলেন।

অবশেষে রব্বো এসে এই অতল সাগর থেকে ওনাকে উদ্ধার করলো। নিঃশব্দের অন্তরালে দেখতে দেখতে ওণার শরীর যেন আরো সবুজ হয়ে উঠলো। গালের রঙে সৌন্দর্য্য যেন চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। একটি অদ্ভুত তৈলমর্দনের সূত্র ধরে বেগমজানের মধ্যে যেন প্রাণ আবার প্রস্ফুটিত! তবে এই তেলের ফর্মুলা কিন্তু আপনারা কোন ম্যাগাজিনে পাবেননা, সে যতো ভালো ম্যাগাজিনই হোক না কেন।

আমি যখন বেগমজানকে দেখি তখন ওনার বয়স ৪০ কি ৪২। উফ! কি গরিমায় উনি মসনদে আধশোয়া, আর রব্বো ওনার পিঠের সাথে লেপ্টে ওনার কোমড় টিপে দিচ্ছে। একটা মেরুন রঙের শাল দিয়ে ওনার পা ঢাকা, যেন মহারানী। ওনার চেহারা আমার বেজায় ভালো লাগতো। মনে হতো ঘন্টার পর ঘন্টা ওনার পাশে বসে, একদম কাছ থেকে খালি ওনাকেই দেখতে থাকি। ওনার রং বেশ ফর্শা। ত্বকের কোনখানেই ঠিক রাঙ্গা নয়। আর ঘনকালো চুল সবসময় তেলে লেপ্টে আছে। আজ অবধি আমি কখনো ওনার সীঁথি অগোছালো দেখিনি। একটা চুল এদিকওদিক হওয়ার জো নেই। ওনার চোখ কালো, ভুরূ তীরের মতো। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। ভারী ফোলা ফোলা চোখের পাতা। ওনার মুখে সবচেয়ে বেশী আশ্চর্য আর দেখার মতো ছিলো ওনার ঠোঁট। সাধারণত লাল রঙে রাঙ্গা। উপরের ঠোঁটে হালকা গোঁফ আর, আর ঝুলপির লম্বা চুল, ওনার চেহারা দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে কেমন যেন মনে হতো। কমবয়সী ছেলেদের মতো!

সাদা আর উজ্জ্বল চামড়া, আটোসাটো। যখন উনি নিজের পা চুলকাতেন মঝে মাঝে, আমি চুপি চুপি তার ঔজ্জ্বল্য লক্ষ্য করতাম। উনি লম্বা আর স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার দরুন, বেশ বড়সড় মনে হতো। কিন্তু সমানুপাতিক আর ছাঁচে ফেলা শরীর। বড়ো বড়ো উজ্জ্বল ফর্শা হাত, সুগঠিত কোমড়। তো এই রব্বো ওনার পিঠ চুলকাতো, ঘন্টার পর ঘন্টা। যেন পিঠ চুলকানোটাই জীবনে প্রয়োজন, বা বলা ভালো জীবনের চেয়েও বেশী প্রয়োজনীয়।

রব্বো বাড়ীর আর কোন কাজ করতোনা। শুধু ঐ গদীমোড়া খাটে চড়ে বসে, কখনো বেগমজানের মাথা, আর কখনো দেহের অন্য কোন অংশ টেপাটেপি করতো। আমার তো মাঝে মাঝে মনে ভয়ের উদ্রেক হতো, যখনই দেখো তখনই রব্বো হয় এটা টিপছে নয় ওটা মালিশ করছে। অন্যকারোর সাথে এরম করলে কি জানি কি হতো, আমি তো নিজেরটুকুই বলতে পারি, কেউ এতোক্ষন ধরে আমায় স্পর্শ করলেও বোধহয় আমার দেহ পচেগলে শেষ হয়ে যেতো।

আর এই রোজ রোজ মালিশই শুধু নয়, যেদিন বেগমজান স্নান করতেন, আল্লাহ! দুই ঘন্টা আগে থেকে তেল আর সুগন্ধি অঙ্গরাগ দিয়ে মালিশ শুরু হয়ে যেতো। এতো হতো, এতো হতো, যে ভাবতেই আমার বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ করে মালিশের পর্ব শুরু হতো, আর সাধারণত খালি রব্বোই ভিতরে থাকতো, বাকি দাসীরা দরজা থেকেই প্রয়োজনের জিনিষপত্র সরবরাহ করতো।

আসলে বেগমজানের চুলকুনির রোগ ছিলো। বেচারির এতো চুলকুনি হতো আর হাজার তেল আর অঙ্গরাগ মেখেও সেই চুলকুনি যেতোনা। ডাক্তার-হাকিমেরা বলতেন, কিচ্ছু নয়, চামড়া তো একদম পরিষ্কার, হ্যাঁ, যদি চামড়ার নিচে কিছু হয়ে থাকে তা অবিশ্যি অন্য কথা। “ধুশ! এই ডাক্তারগুলা পাগল। অসুখ হোক শত্তুরের। আল্লাহ হেফাজত করুণ, এতো গরম রক্ত আপনার।” – রব্বো মুচকি হেসে বলতো আর আলতো আলতো করে বেগমজানের দিকে তাকাতো। আর এই রব্বো, যেমন বেগমজান ফর্শা, তেমনই রব্বো কালো। যেমন বেগমজান সাদা, তেমনই রব্বো রাঙ্গা। যেন আগুনে পোড়া লোহা। হালকা হালকা বসন্তের দাগ, আটোসাটো শক্ত শরীর। চটপটে ছোট ছোট হাত, শক্ত সরু পেট। বড় ফোলা ফোলা ঠোঁট, সবসময় ভেজা। ফোলা নাকের ফুটো, শরীর দিয়ে কেমন একটা গন্ধের ফুলকি যেন ভয় তৈরি করে। হাত এতোটাই চটপটে, এই ধরুন কোমড়ে, তার পরে পিছলে পাছায়, তারপর হঠাত সরে থাইয়ে, তারপর সেখান থেকে এক ছুটে গোড়ালিতে। আমি তো বেগমজানের পাশে বসলেই দেখতাম, এখন ওর হাত ঠিক কোথায় আর কি করছে।

গ্রীষ্ম হোক বা শীত, বেগমজান হায়দ্রাবাদের জালি কাপড়ের কুর্তি পরতেন। গাঢ় রঙ্গের পাজামা, সাদা ফেনার মতো কুর্তি। পাখা যদিও বা কখনো চললে তবু পাতলা একখানা শাল ঠিকই শরীরে জড়ানো থাকতো। ওনার শিতকাল বেশী প্রিয়। আমারও শীতেই ওখানে বেশী ভালো লাগতো। উনি বেশী নড়াচড়া করতেন না। কার্পেটে শুয়ে, আর পিঠ চুলকানো চলছেই, উনি শুধু শুকনো মেওয়া চিবিয়ে চলেছেন। রব্বোকে বাকি দাসীরা বেশ হিংসে করতো। ডাইনীটা বেগমজানের সাথেই খায়, তার সাথেই ওঠাবসা করে, আর আল্লাহ! একসাথে শোয়ও? রব্বো আর বেগমজান তো নিভৃতে হাসিঠাট্টার চরিত্র। ওনাদের দুজনের প্রসঙ্গ আসবে, আর হাসির রোল উঠবে না, এই যেন অসম্ভব। ঐ বেচারিকে নিয়ে তারা না জানি কি কি কথাই বলতো। কিন্তু উনি এই পৃথিবীতে কারোর সাথে দেখাও করতেননা। এখানে খালি উনি ছিলেন আর ওনার চুলকুনি।

আগেই বলেছি, আমি তখন খুব ছোট্ট আর বেগম জানের ভক্ত। উনিও আমায় খুবই ভালোবাসতেন। হঠাতই আম্মু আগ্রা গেলেন, আর উনি জানতেন, বাসায় একা থাকলেই ভাইদের সাথে মারামারি করবো। মার খেয়েই হয়তো ঘুরে বেড়াবো। তাই উনি সপ্তাহখানেকের জন্য আমায় বেগমজানের কাছে রেখে গেলেন। আমিও খুশী, বেগমজানও খুশী। বৌদি বলে কথা।

কিন্তু কথা হলো আমি শোবো কোথায়? নিয়ম মতে বেগমজানেরই ঘরে। অতএব আমার জন্য ওনার পেল্লায় পালঙ্কের গা ঘেঁষে ছোট একটি খাট বসানো হলো। দশটা কি এগারোটা অবধি তো আড্ডাই চলতে লাগলো, আমি আর বেগমজান তাস খেলছিলাম, আর তারপর আমি আমার খাটে ঘুমুতে চলে গেলাম। আমি যখন ঘুমুতে যাই, তখনো রব্বো সেভাবেই বসে ওনার পিঠ চুলকাচ্ছিলো। “আপদ একটা” – আমি মনে মনে বললাম। মাঝরাতে একটা চটকায় ঘুম ভাঙ্গলে আমার কেমন একটা অদ্ভুত ভয় লাগতে আরম্ভ করলো। ঘরে একটা আবছা অন্ধকার, আর তার মধ্যেই বেগমজানের লেপটা এমনভাবে নাচছে যেন ওটায় একটা হাতি আটকা পড়েছে। “বেগম জান!” – আমি ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠলাম। হাতীর লম্ফঝম্ফ থামলো। লেপ নিচু হয়ে গেলো।

“কি হলো? শুয়ে পড়।” বেগম জান কোনোখান থেকে বলে উঠলেন।
“ভয় করছে।” আমি প্রায় ইঁদুরের গলায় বললাম।
“শুয়ে পড়, ভয়ের কি আছে? আয়াতুল কুরসী বলে নাও।”
“বেশ!” আমি চটপট আয়াতুল কুরসী বলতে শুরু করলাম, কিন্তু “ইয়া’লামু মা-বাইনা” তে এসে হঠাত আটকে গেলাম। যদিও আমার গোটা আয়াতুল কুরসীই মুখস্থ।
“তোমার কাছে যাবো বেগমজান?”
“না বাছা! শুয়ে থাকো” একটু কড়াভাবেই বললেন।
এর পরেই দুজন মানুষের ফিসফিস আওয়াজ শোনা গেলো। এই রে! এই দ্বিতীয় জন আবার কে?
“বেগম জান, চোর নয় তো?”
“শুয়ে পড় বাছা, কিসের চোর?” রব্বোর গলা। আমি চটপট লেপে মুখ লুকিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকালে আমার আর রাতের সেই ভয়ানক ঘটনার কথা মনেই এলোনা। আমি বরাবরি এরকম। রাতে ভয় পেতাম। ঘুম থেকে উঠে পালিয়ে বেড়াতাম, বিড়বিড় করতাম, প্রায় রোজ রাতেই। সবাই বলতো আমার ঘাড়েই ভূত চেপেছে। তাই আমার কিছু সেসব মাথাতেই এলোনা। সকালে লেপটিকে কেমন সরল সাধাসিধে মনে হচ্ছিলো। দ্বিতীয় রাতে, আমার যখন ঘুম ভাঙলো, বুঝতে পারলাম পালঙ্কের উপরে বেগমকান আর রব্বো কি একটা নিয়ে ফিসফিস করে ঝগড়া করছে। কি নিয়ে যে ঝগড়া কিছুই বুঝলামনা। আর সেই ঝগড়ায় যে কি সিদ্ধান্ত হলো… রব্বো হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছিল, আর তারপর বেড়ালের সপ সপ করে থালা চাটার মতো একটা আওয়াজ হলো। আমি ভয় পেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

আজ রব্বো নিজের ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলো। সে বড়োই ঝগড়ুটে। বেগমজান তার জন্য কতোকিছুই না করলেন। দোকান করে দিলেন, গ্রামে কাজে লাগালেন, কিন্তু সে শোধরায়না। নবাবসাহেবের কাছেও কিছুদিন ছিলো। পোশাকআশাকও তৈরি হলো। কিন্তু কে জানে কেনো, এমন পালিয়ে গেলো, যে রব্বোর সাথেও দেখা করতে আসতোনা। অতএব রব্বোই নিজের কোন এক আত্মীয়ের বাসায় তার সাথে দেখা করতে গেলো। বেগমজান যেতে দিয়ে চাইতেননা, কিন্তু রব্বোই বা কি করে? গোটা দিন বেগমজান অস্বস্তিতে কাটালেন। গাঁটে গাঁটে অস্বস্তি। আবার অন্য কারোর ছোঁয়াও ওনার পছন্দ না। খাবারও খেলেননা, গোটা দিন ধরে উদাস হয়ে রইলেন।

“আমি চুলকে দেবো বেগমজান?” তাসের পাতা আলাদা করতে করতে আমি বেশ আয়েশেই বললাম। বেগমজান গভীরভাবে আমায় পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
“আমি চুলকে দেবো? সত্যি বলছি।” আমি তাস রেখে ওনার পিঠ চুলকোতে লাগলাম।

আমি বেশ কিছুক্ষণ চুলকে দিলাম, আর বেগমজান চুপটি করে শুয়ে থাকলেন। পরের দিন রব্বোর আসার কথা ছিলো কিন্তু এলোনা। বেগমজানের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো। চাএর পরে চা গিলে ওনার মাথায় শুরু হলো ব্যাথা।

আমি আবার চুলকাতে লাগলাম, মসৃণ টেবিলের মতো ওনার পিঠ। আমি বেশ রয়েসয়েই চুলকাচ্ছিলাম। কি আনন্দ লাগে ওনার কাজ করে!

“একটু জোড়ে জোড়ে চুলকাও, হুক খুলে দাও।” – বেগমজান বললেন।
“এখানে, হ্যাঁ হ্যাঁ, কাঁধের নিচের দিকে, বাহ বাহ, হা হা” উনি আমেজে সুশীতল নিঃশ্বাসের সাথে নিজের তৃপ্তি প্রকাশ করছিলেন যেন।
“আর এদিকেও…” যদিও সেখানে বেগমজানের হাত অনায়াসেই পৌঁছে যেতে পারতো, কিন্তু উনি আমাকে দিয়েই চুলকিয়ে নিচ্ছিলেন, আর আমার উল্টে বেশ গর্ব বোধ হচ্ছিলো, “এদিকে, আরে! তুমি তো কাতুকুতু দিচ্ছো, বাহ!…” উনি হেসে উঠলেন। আমি কথাও বলছিলাম আর চুলকেও যাচ্ছিলাম।
“কাল তোমায় হাটে নিয়ে যাবো, কি চাও বলো, চোখ খোলা-বন্ধ করা খুকি পুতুল?”
“না বেগমজান, পুতুল নেবোনা, আমি কি এখনও বাচ্চা নাকি?”
“বাচ্চা না? তাহলে কি বুড়ি হয়ে গেছো?” উনি হাসলেন, “মেয়ে পুতুল লাগবেন তো ছেলে পুতুল নিও, নিজের মতো করে কাপড়চোপড় পড়িয়ে নিও, আমি দেবো তোমায়, অনেক কাপড়।” উনি পাশ ফিরলেন।
“বেশ!” আমি উত্তর দিলাম।
“এখানে।” আমার হাতটা নিয়ে, উনি, যেখানে চুলকোচ্ছিলো, তার উপরে রেখে দিলেন। ওনার যেখানে যেখানে চুলকাতো, সেখানে সেখানে উনি আমার হাত ধরে রেখে দিচ্ছিলেন, আর আমি অন্যমনস্ক হয়ে, পুতুলের কথা ভাবতে ভাবতে মেশিনের মতো চুলকে যাচ্ছিলাম। আর উনি অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিলেন।
“শোনো, তোমার ফ্রক লাগবে আরো কিছু, কাল দর্জি ডেকে নতুন কিছু সেলাই করতে দিয়ে দেবো, তোমার আম্মু কাপড় রেখে গেছেন।”
“ঐ লাল কাপড়টা না, চামারের মতো লাগে।” আমি বকবক করছিলাম, আর আমার হাত কোথায় কোথায় যে গেলো, কথায় কথায় সেদিকে আমার খেয়ালও থাকলোনা। বেগমজান চিত হয়ে শুয়ে ছিলেন, আর আমি এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলাম।
“এই মেয়ে, দেখে চুলকা, আমার পাঁজর আঁচড়িয়ে বের করে নিবি যে!” বেগমজান দুষ্টু করে হাসলেন, আর আমি লজ্জায় মাটিতে মিশে গেলাম।
“এদিকে আয়, আমার পাশে শুয়ে পড়।” নিজের হাতে আমার মাথা দিয়ে, উনি আমাকে শুইয়ে দিলেন।
“আহা রে! কেমন শুকিয়ে গেছিস রে তুই। বুকের পাঁজরা দেখা যাচ্ছে।” উনি আমার পাঁজরের হাড় গোনা শুরু করলেন।
“উঃ!” আমি কঁকিয়ে উঠলাম।
“আরে! আমি কি খেয়ে ফেলবো নাকি? কেমন আঁটসাঁট যেন সোয়েটারটা, গায়ে গরম গেঞ্জিও নেই” আমি ছটফট করছিলাম। “পাঁজরে কটা হাড় থাকে?” উনি কথা ঘোরালেন।
“এদিকে নয়টা আর ওদিকে দশটা।” ইষ্কুলে হাইজিন ক্লাসে পড়িয়েছিলো, সেখান থেকেই যতোটা পারলাম মনে করে বললাম। তাও ভুলভাল।
“হাত সরাও দেখি, হ্যাঁ! এই এক, এই দুই, এই তিন… ”
আমার মন বলছিলো পালিয়ে যাই, উনি সজোরে খোঁচা দিলেন।
“উঃ!” আমি কুঁকড়ে গেলাম, বেগমজান যেন অট্টহাসি দিলেন। আজও, আমি যখনই ওনার তখনকার সেই মুখ মনে করি, আমার মনে ভয় এসে জেঁকে ধরে। ওনার চোখের পাতা ভারী হয়ে এলো। ওপরের ওষ্ঠে ঘন কালো ছায়া। প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও ছোটো ছোটো ঘামের বিন্দু ওনার ঠোঁটে আর নাকে চিকচিক করছিলো। ওনার হাত ঠাণ্ডা। কিন্তু নরম, যেন উপরের চামড়াটাই নেই। ওনার শরীরে কোন শাল নেই, আর সুক্ষ কুর্তায় প্যাঁচানো ওনার শরীর যেন আটার লেচী। ভারী পাথর-বসানো সোনার তৈরি সবুজ বোতামগুলি কুর্তার একদিকে ঝুলছে। সন্ধ্যে নেমে আসার দরুন ঘরে অন্ধকার দানা বাঁধছিলো। আমি কেমন এক অজানা আতঙ্ক অনুভব করতে শুরু করলাম। বেগমজানের গভীর গভীর চোখ। আমার মন ভয়ে কেঁদে উঠলো। উনি আমাকে মাটির পুতুলের মতো খোঁচাচ্ছিলেন। ওনার উষ্ণ শরীরের উত্তাপে আমার মন গুলিয়ে উঠলো, কিন্তু ওনার ঘাড়ে যেন ভূত চেপেছে। আর আমার মনের অবস্থা তখন, আর্তনাদও করতে পারছেনা, সহ্যও করতে পারছেনা।
খানিক বাদে উনি আলগা হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। ওনার মুখ ফীকে বিবর্ণ হয়ে গেলো, আর নিঃশ্বাস ঘন। আমি ভাবলুম, মরেছে বুঝি, আর ওখান থেকে উঠে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে এলাম।

ভাগ্যিস! রব্বো রাতেই চলে এসছিলো, আর আমি লেপমুড়ি দিয়ে চটপট শুয়ে পড়লাম। কিন্তু ঘুম এলো কৈ? নিঃশব্দে ঘন্টার পর ঘন্টা ঘাপটি মেরে পড়ে রইলাম।

আম্মু কি জানি কেন, আসছিলোই না। এদিকে, বেগমজান আমার কাছে এমনই ত্রাস হয়ে উঠেছিলেন, যে সারাদিন আমি মামাদের কাছেই রইলাম, কিন্তু ওনার ঘরে পা রাখতেই, আমার নিঃশ্বাস আটকে আসতো। কাকেই বা বলি? কিই বা বলি? এই, যে বেগমজানকে আমি ভয় পাচ্ছিলাম? সেই বেগমজান যিনি আমায় প্রাণাধিক ভালোবাসেন?

আজ রব্বো আর বেগমজানের মধ্যে ফের কেমন মনকষাকষি ছিলো। জানিনা আমার ভাগ্যই খারাপ না অন্য কিছু, ওদের মধ্যেকার এই মনকষাকষিটাকেও আমি ভয় পাচ্ছিলাম। কারণ ঠিক রাত্রিবেলাতেই বেগমজানের মনে হলো যে আমি বাইরে ঠাণ্ডায় ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আর ঠিক নিউমোনিয়ায় মারা পরবো।

“এই মেয়ে, আমার মাথা ন্যাড়া করাবি না কি? কিছু হয়ে গেলে, সে যে বিষম বিপত্তি।”
উনি আমাকে নিজের কাছে বসালেন। উনি পাত্রে হাত ধুচ্ছিলেন আর চায়ের সরঞ্জাম তেপায়ার উপরে রাখা ছিলো।
“একটু চা তো বানিয়ে খাও, এক কাপ আমাকেও দিও” তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, “আমি একটু কাপড়টা ছেড়ে নি।”
উনি কাপড় ছাড়ছিলেন আর আমি চা পান করছিলাম। আজকাল বেগমজান যখনই পিঠ ডলাইমলাই করার সময় যদি বা আমায় কখনো কোন কাজে ডাকতেন, তো আমি ঘাড় গুজে যেতাম, আবার পালিয়েও আসতাম। এখন ওনার কাপড় পালটানো শেষ, আমায় কেমন একটা অস্বস্তি এসে চেপে ধরলো, আমি মুখ অন্যদিকে করে চা খেতে থাকলাম।

“আম্মু গো”, আমার মন নিঃশব্দে নিরুপায় হয়ে ডাক দিলো যেন, “কি এমন আমি ভাইদের সাথে মারপিট করতাম, যে তুমি আমায় এই…”। আমি ছেলেদের সাথে খেলি, মা কখনোই পছন্দ করতেননা। কেন? ছেলেরা কি বাঘ-ভাল্লুক, যে খেয়ে ফেলবে ওনার পিয়ারের মেয়েকে! আর ছেলেরা বলতে তো আর কেউ না, নিজেরই ভাই, আর দু’চারজন ছুটকো-ছাটকা, পুঁচকে পুঁচকে সব বন্ধুবান্ধব। কিন্তু আম্মু তো মেয়েমানুষকে সাত তালায় বন্ধ করে রাখার পক্ষপাতী। আর এদিকে এই বেগমজানের ভয়, সে যে সারা দুনিয়ার গুণ্ডা বদমাসকে ভয় পাওয়ার চেয়েও আরো আতঙ্কের। সম্ভব হলে, তখনই ছুটে রাস্তায় পালিয়ে যাই, সেখানেও থাকতে পারতাম না হয়তো, কিন্তু আমার পক্ষে এ সবই অসম্ভব। নিরুপায় বুকে পাথর রেখে আমি সেখানেই বসে রইলাম।

উনি কাপড় পাল্টালেন, সাজুগুজু করলেন, আর উষ্ণ আতরের গন্ধে যেন আরো ঝলসে উঠলেন, তারপর আমার সাথে আদিখ্যেতা শুরু করলেন।
“বাড়ি যাবো,” ওনার সব কথার উত্তরে আমি কাঁদতে কাঁদতে এটুকুই বলছিলাম।
“আরে আমার কাছে তো এসো, তোমায় হাটে নিয়ে যাবো, শোনোই না”।
কিন্তু আমি তখন বেঁকে বসেছি। দুনিয়ার সব খেলনা, সব মিষ্টি একদিকে, আর বাড়ি যাওয়ার জেদ আরেক দিকে।
“ওখানে তোর ভাইরা তোকে মারবে রে বোকা” উনি আলতো করে আমায় একটি চাটি লাগালেন।
মারুক গে ভাইরা, আমি ভাবলাম আর সেভাবেই অভিমানে গোঁ ধরে বসে রইলাম।
“কাঁচা আম, একটু তো টক হবেই বেগমজান” রব্বো বেশ কাঠখোট্টাভাবেই বললো যেন, আর তারপরেই বেগমজানের উপরে যেন ভর হলো। সেই সোনার হারটা, যেটা একটু আগেই উনি আমার গলায় পরাতে চাইছিলেন, ছিঁড়ে খণ্ড বিখণ্ড হলো, সুক্ষ ওড়না ফালাফালা, আর ওনার সেই সিঁথি যা সবসময় নিপাট গোছানো থাকতো তাও বিদ্ধস্ত এলোমেলো।
“ওহ ওহ ওহ ওহ” উনি দমকে দমকে চিল্লাতে শুরু করলেন। আমি দৌড়ে পালিয়ে এলাম।
অনেক সাধ্যসাধনের পরে বেগমজান থিতু হলেন।

আমি যখন পা টিপে টিপে ঘরে উঁকি দিলাম, তখন রব্বো সেই ওনার কোমড়ের সাথে লেপ্টে ওনার শরীর ডলাইমলাই করছে।
“জুতা খোলো” সে ওনার পাঁজর চুলকাতে চুলকাতেই বললো, আর আমি ইঁদুরের মতো নিজের লেপের তলায় সেঁধিয়ে গেলাম।

(খানিক পরে) অদ্ভুত শব্দ করে বেগমজানের লেপটা আবার হাতির মতো নাচানাচি করছিলো।
“আল্লা গোঁ!” আমি চিঁচিঁ করে বলে উঠলাম। লেপের মধ্যে হাতিটা লাফ দিয়ে মিলিয়ে গেলো। আমিও চুপ মেরে গেলাম। সেই হাতি আবার জেগে উঠলো। আমার সর্বাঙ্গের লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। আজ আমিও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম, সাহস করে মাথার কাছের বাতিটা জ্বালিয়ে দেবো। হাত নিশপিশ করছিলো। সপ সপ করে কি একটা খাবার শব্দ আসছিলো। যেন কেউ মজাদার কোন চাটনি খাচ্ছে, চেটে চেটে। এবার বুঝলাম। বেগমজান তো আজ কিছুই খাননি, আর রব্বো বেটি বিশ্বহ্যাংলা। নিশ্চয়ই বেটি লুকিয়ে কিছু একটা খাচ্ছে। আমি নাকের ফুটো বড়ো করে শোঁ শোঁ করে বাতাসের গন্ধ নিলাম। কিন্তু বাতাসে শুধু আতর, চন্দন আর হেনারই উষ্ণ গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে!

ওদিকে লেপ আবার ফুলতে শুরু করেছে। আমি অনেক চেষ্টা করলাম, চুপচাপ শুয়ে থাকবো, কিন্তু সেই লেপ এমনই অদ্ভুত অদ্ভুত আকার ধারণ করতে শুরু করলো, কে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিলো গ্যাঙর গ্যাং করে একটা বিশাল কুনোব্যাং ফুঁসছে আর এখুনি আমার উপরে লাফ দিলো বলে।

“ও আম্মু গো!” আমি সাহস করে স্মিত আওয়াজে বলে উঠলাম। কিন্তু ওদিকে যেন এর আওয়াজই পৌঁছালোনা। এবার লেপটা যেন আমার মনমস্তিষ্কে ঢুকে গিয়ে ফোঁসা আরম্ভ করলো। আর থাকতে না পেরে, আমি ভয়ে ভয়ে খাটের উল্টোদিকে নামলাম, আর টলতে টলতে লাইটের সুইচটা জ্বালিয়ে দিলাম। হাতিটা কেমন একটা ডিগবাজি খেলো লেপের তলায় আর লেপটে গেলো। ডিগবাজির দরুন লেপের খুটটা চট করে অনেকটা উঠে গেলো।

“আল্লাহ!” আমি লাফ দিয়ে নিজের বিছানায়…

ছবি সূত্রঃ উইকিপিডিয়া (ক্রিয়েটিভ কমনস লাইসেন্স)

~~ o ~~ o ~~ o ~~ o ~~


<< কালিজা ২০২০ (৩য় বর্ষ) – সূচীপত্র


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *