মরীচিকা

মরীচিকা

-সৌম্যপ্রভ গাঙ্গুলী

ফেসবুকে রোজ কত মানুষের সাথেই কথা হয়, আলাপ গুলো কখনো প্রলাপ কখনো বিলাপ হয়ে চিরতরে হারিয়ে যাওয়া সংলাপ হয়ে থেকে যায়।
সৈকত আর সূর্যের আলাপটাও খানিক আকস্মিক ভাবেই হয়েছিল। কিন্তু কথায় আছে অমৃতযোগ না কি যেন একটা সেরকমই একটা সময় দুজনকে দুজনের কাছাকাছি এনে দেয়।

সূর্য তখন কলেজে পড়ে আর সৈকত University তে। সৈকত একটু লাজুক, introvert, পড়াশোনা পাগল ছেলে। সূর্য আবার ভরপুর রকমের romantic। অবসরে কবিতা লেখে, গুনগুন করে গান গায়। ঐ যে বলে না opposite attracts, ওরকমই কিছু একটা হয়েছিল বোধহয়। প্রথম আলাপ থেকে আস্তে আস্তে ফোনে ঘন্টার পর ঘন্টা গপ্পো করে করে বন্ধুত্বটা পেকে এল যখন দেখা করার প্ল্যান হল। যথারীতি দেখা করার দিন-ক্ষণ ঠিক হল। ওমা সৈকত আর আসে না। প্রায় একঘন্টা পর এলেন মহারাজ। সূর্য একটু চটেই গেল কিন্তু প্রথম বার তাই আর রাগটা continue করল না। যাই হোক গপ্পো শুরু হল। এতদিন অবধি যেটা বোঝেনি সূর্য আস্তে আস্তে সেটা খেয়াল করল সেটা। নাহ সৈকত একটু আপনভোলা বটে কিন্তু unromantic না। বেশ রসিয়ে কসিয়েই proposal টা ছুঁড়েছে। মনটা একটু উথাল পাথাল করছে সূর্যের। একটা দীর্ঘ একতরফা সম্পর্কের পর ঘা খাওয়া মন, সিঁদুরে মেঘের দেখা পেলে মনটা খচ করে ওঠে। প্রাক্তনের দেওয়া ঘা টা এখনো ভীষণ দগদগে। 

আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব পেরিয়ে তার বেশি কিছুতে যাওয়ার যাত্রাটা খানিকটা স্বপ্নের মতোই ছিল। দিন গড়াতে থাকে, কাছাকাছি আসতে থাকে দুটো মন। একসাথে থাকলে দুটো বাসন তো ঠোকাঠুকি লাগবেই। সৈকতের খুব একটা অভিজ্ঞতা ছিল না প্রেমের ব্যাপারে। ওদিকে সূর্যের প্রাণোচ্ছল প্রেমিকসত্ত্বাটা বারবার গলা চিরে চেঁচিয়ে উঠতো। ভালোবাসি সৈকত। খুব ভালোবাসি। দিন এগোতে থাকলে সৈকত কেমন ধীরে ধীরে শীতল হয়ে যায়। মাঝে মাঝে উষ্ণতার আঁচ আসত না বললে নেহাত মিথ্যাচার হবে। দুজনের প্রেমিকসত্তাটা দুজনের কাছে এতটাই অচেনা ছিল যে ভুল বোঝাবুঝিগুলো ঠিক নিজেদের একটা স্থান করে নিত। কিন্তু সব মিলিয়ে ওদের সম্পর্কটা বেশ যত্নেই এগোচ্ছিল।

সৈকত তো চাপা স্বভাবের কিন্তু কিছু কিছু ঘটনায় ও সব সময়ে বুঝিয়ে দিত সূর্য ওর জীবনে ঠিক কী! সূর্য আবার ভীষন অভিমানী। কথায় কথায় অভিমান করত। সৈকতের মন ভার হয়ে যেত কিন্তু অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য যে আসলে কী করা উচিত ও বুঝতে না পেরে একেবারে নাকানিচুবানি খেত আর সেটা দেখে সূর্যের সব অভিমান গলে জল হয়ে যেত। সূর্যের বাড়িতে সৈকতের আনাগোনা শুরু হয় ক্রমশ। এমন করেই একটা দুষ্টু মিষ্টি সম্পর্ক বেশ ভালো এগোচ্ছিল।

হঠাৎ ই বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটার মতো একটা পরিস্থিতির শিকার হতে হয় দুজনকে। সৈকতের বাড়িতে সূর্যের তখনো পা পড়েনি। হঠাৎ এক সন্ধ্যা থেকে শুরু হয় সৈকতের অস্বাভাবিক ব্যবহার। সকালে কথা দিয়েছিল সন্ধ্যায় ফোন করবে হঠাৎ? কী হল ওর? না একটা ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছে, ফোন করলে ধরছে না। এরকম তো করার কথা না। শত ব্যস্ততার মধ্যেও সৈকত কখনো এতটা অবহেলা করে না। সূর্য এমনিতে খুব ধৈর্য্যশীল কিন্তু কি জানি কেন আজকে ওর ধৈর্যের বাঁধটা ভেঙে গেল। সারাটা সন্ধ্যা যে ওর মনে কী পরিমাণ উথাল পাথাল হয়েছে সেটা শুধু ওই জানে। তখন প্রায় এগারোটা। সৈকতের ম্যাসেজ। বুকটা হুহু করে উঠলো সূর্যের।
-সরি রে, একটু busy ছিলাম।
-ও
-কীরে?
-হুম
কী করছিস?
-খাওয়া, অপেক্ষা, পড়াশোনা, অপেক্ষা, ডিনার, অপেক্ষা
-ও
-শুধু তো অপেক্ষাটাই রয়ে গেছে। ভালোবাসাটা বোধহয় আর নেই তাই না?
-জানি না।
এই উত্তরটার জন্য প্রস্তুত ছিল না সূর্য।

-মানে?
-কিছু না।
কী হল বল? সারাটা দিন অপেক্ষা করে আছি সন্ধ্যায় কথা হবে। সারাটা সন্ধ্যা অপেক্ষা করে আছি রাত্রে কথা হবে। কালকে যে বাড়িতে এসে চুমু খেয়ে গেল সে আজকে আমায় ভালবাসে কিনা জানে না?
-শোন সুর্য
-…
-আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই রে
-জানি
-আমাদের সম্পর্কটা আর continue করা ঠিক না। তোর জীবনটা আমার জন্য একটা অনিশ্চয়তার অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে।
-আর এত সুন্দর বর্তমানটা? রোজ সকালে তোর আমায় চুমু খাওয়া ফোনে? সেগুলো কার জন্য হারিয়ে যাবে?
-ও গুলোর জন্যই তো আরও কষ্ট হচ্ছে রে। কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি তোকে use করছি। পরে যখন ছাড়তে বাধ্য হব তখন কোন মুখে ক্ষমা চাইব বলতো?
-হঠাৎ ছাড়ার প্রশ্নই বা আসছে কেন! সব তো ঠিক ছিল। সব! কালকেও আমরা প্রেম করেছি আজ হঠাৎ কী হল?

ঐ যে বললাম আমাদের একদিন বিচ্ছেদ হবেই। কিছু হয়নি রে।
-তুই যদি সত্যি টা বলিস আমি বিচ্ছেদের জন্য ready। কী হয়েছে বল!

সত্যি কথাটা হল আমার পক্ষে সম্ভব নয় রে বাড়ির লোকের অমতে যাওয়া। তাছাড়া আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। তাকে ভুলতেই তোর উপর Concentrate করেছিলাম এতদিন। পারলাম না। কিছুতেই পারলাম না তাকে ভুলতে। তুই খুব ভালো রে। আমার মতো একটা ছেলের সাথে নিজের সারাটা জীবন কাটাস না। আমায় ক্ষমা করা তোর পক্ষে সম্ভব নয় তাই আজ ক্ষমাও চাইলাম নারে। ভালো থাকিস। কবিতা লেখা ছাড়িস না। আর আমাদের মধ্যে যোগাযোগটাতে এবার একটা ইতি টানতেই হবে। কারণ আমি আর তোকে ঠকাতে পারছি না।

সূর্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল সৈকত ব্লক করে দিয়েছে। দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে পাগলের মতো ফোন করতে লাগলো সূর্য সৈকতকে। না কখনো সৈকত এমন করতে পারে না। তখনো মনে মনে সূর্য ওকে defend করে চলেছে। নাহ! লাগছে না ফোন। সেখানেও blocked। আর ভাবতে পারল না। ক্রমশ যেন চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে কখন কোন এক অজ্ঞাত অন্ধকারের অন্তরালে সূর্য অস্ত গেল তা সে নিজেও জানে না।
যখন জ্ঞান ফিরল, সূর্য দেখে ও হাসপাতালে ভর্তি। প্রচন্ড high pressure আর mental trauma এর কারণে sense less হয়ে গেছিল সূর্য। এখন সব কিছু control এ। আস্তে আস্তে সব মনে পড়ল ওর।

“নাহ!”চেঁচিয়ে উঠলো সূর্য। আওয়াজ পেয়ে নার্স আর ওর বাবা মা ছুটে আসে। মা-বাবার মুখটা দেখে ফুঁপিয়ে ওঠে সূর্য। ওরা এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। মা বলল “কী হয়েছে বাবাই? তোর কী নিয়ে এত tension। আমরা থাকতেও তুই এত insecured কেন?”
-” না মা। আমি ভুল ছিলাম মা। তোমাদের আশ্রয়ে থেকেও আমি মরিচীকার পেছনে ছুটছিলাম কিন্তু কিন্তু….”
ঘুমে ঢুলে পড়ল সূর্য। কড়া কড়া antibiotic আর sleeping pill চলছে ওর।

এরপর ছমাস কেটে গেছে। সূর্য এখন অনেক সুস্থ। কলেজ যায় নিয়মিত। কবিতা লেখে গান গায়। সৈকতের chapter টা আস্তে আস্তে closed হয়ে যায়। এখন মা-বাবাকে নিয়েই ওর সমস্ত জগত। অন্য কোনো প্রলোভনে আর পা বাড়ানোর কথা ভুলেও ভাবে না। আর সবথেকে বড় কাজটা করে ফেলেছে সূর্য। বাড়িতে come out করেছে। প্রথমে মা একটু আমতা আমতা করলেও বাবা দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল ছেলেকে। বাবার বোঝানোর পরে মায়ের মনেও আর কোনো দ্বিধা ছিল না।  জীবনের এই critical period টায় ও একটা বড় শিক্ষাই পেল বটে। পৃথিবীতে এদিক ওদিক ছড়িয়ে থাকে প্রচুর মরিচীকা। তার মধ্যে কেবল দুজন মানুষ মরুদ্যান হয়ে ছায়া জোগায়, তৃষ্ণা মেটায়। বাবা এবং মা। আজকে social media এর এই দুর্দান্ত দিনে সবাই আপন হয় না। তুমি যাকে নিয়ে দেখছ স্বপ্ন পরিনয়ের, সে তোমায় ছলনা করবে মিথ্যা অভিনয়ের। আর এমন কিছু অজুহাত দেখিয়ে চলে যাবে যা হয়তো তুমি স্বপ্নেও ভাবোনি। কখনো এটা ভেবো না যে বাবা মা কিছু বুঝবে না, বাবা মা কিছু জানে না। তারা তোমাকে তখনো বুঝত যখন তুমি নিজেই কিছু বুঝতে না। হোক না তারা একটু conservative, তোমার ই তো দায়িত্ব তাদের আধুনিক করে তোলা ঠিক যেমনভাবে তারা তোমায় একদিন বড় করে তুলেছিল নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে। ফেসবুক আছে ফেসবুক থাকবে। তাতে বন্ধুত্ব হবে,প্রেম হবে;বিয়েও হবে। কিন্তু যে সম্পর্ক নাড়ির টানে শুরু হয়েছিল তাদেরকেও আগলে রাখো। কোনোদিন ঠকবে না। কে বলতে পারে হয়তো আজ থেকে দশ বছর পর এই সূর্যর বাবা-মা ই তার ঘটা করে বিয়ে দেবে ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া তার perfect partner এর সাথে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *