ফুরায় শুধু চোখে…

ফুরায় শুধু চোখে…

– ডঃ অভিষেক বব চক্রবর্ত্তী

পুরুষকার কি কেবলই পুরুষের? প্রশ্ন উঠতেই পারে। আভিধানিক অর্থ বলছে, দৈবনিরপেক্ষ প্রযত্ন বা উদ্যম  হল পুরুষকার। নিজের শক্তিতে, সাহসে, মনোবলে ভাগ্যকে জয় করার অধিকার যদি পুরুষকার হয়ে থাকে, তবে তা পুরুষের একচেটিয়া নয় কোনওমতেই।

পিতৃদত্ত নাম পরিবর্তন করে, নিজের নাম নিজে রাখা… অর্থনীতির ছাত্র হয়েও চলচ্চিত্র পরিচালনায় আসা… দৈহিকভাবে পুরুষ হয়ে জন্মেও, এসআরএস করে নিজের পছন্দমতো নারীতে রূপান্তরিত হওয়া… নিজের জীবনের এতোকিছু নিজে বেছে নেওয়ার ক্ষমতাকে কি পুরুষকার বলবো না?

পুরাণে আছে, সূর্যবংশীয় রাজা, অযোধ্যার নৃপতি অযুতাশ্বের পুত্র ঋতুপর্ণ। অক্ষক্রিড়া ও গণনাবিদ্যায় ইনি অসাধারণ পারদর্শী ছিলেন। কলির কোপে রাজ্য হারিয়ে কলিগ্রস্ত নলরাজ যার আশ্রয় নিয়েছিলেন,যার সারথি হয়েছিলেন, তিনিই ঋতুপর্ণ। মহাভারতের বনপর্বে আছে, কলির হাত থেকে মুক্তি এবং পুষ্করের হাত থেকে রাজ্য ফিরে পাওয়া, দুইই রাজা নলের পক্ষে সম্ভব হয়, ঋতুপর্ণের প্রদত্ত বিদ্যায়। তথ্যচিত্র পরিচালক এবং প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী সুনীল ঘোষ জ্যেষ্ঠ সন্তানের নাম রেখেছিলেন সৌরনীল। আমরা জানি না, সৌরনীল থেকে ঋতুপর্ণ হয়ে ওঠার যাত্রাপথ। কিন্তু, বাল্যকাল থেকেই তার মহাভারতের প্রতি অনুরাগ ছিল চোখে পড়বার মতো। একটি সমবাহু ত্রিভুজের ভরকেন্দ্রে যদি ঋতুপর্ণকে রাখি, তবে ওই ত্রিভুজের তিনটি শীর্ষবিন্দু হবে মহাভারত, রবীন্দ্রনাথ এবং অন্য যৌনতা। আর, ওই ত্রিভুজের পরিবৃত্ত হবে চলচ্চিত্র।

রাবীন্দ্রিকতা মানে যে কেবলই রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করা নয়,রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহার নয়,পরিচালকের নিজস্ব কল্পনার কিছু কিছু ফ্রেম,কিছু কিছু সংলাপ,দৃশ্যকল্প,এমনকি সেটের নির্মাণও যে কতোটা রাবীন্দ্রিক হতে পারে, সেটা ঋতুপর্ণ ঘোষের ছবি দেখলে অনুধাবন করা যায়।

কর্মই মানুষের পরিচয়। তার সুদীর্ঘ কর্মজীবনের দিকে তাকালে দেখবো, সাউথপয়েন্ট স্কুলে পড়বার সময়েই বাবার হাত ধরে কুম্ভমেলা এবং সুন্দরবন নিয়ে দুটি তথ্যচিত্রে কাজ করার অভিজ্ঞতা হলেও, নিজে প্রথম তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন ১৯৯০ সালে, ‘বন্দেমাতরম’।এ সময় তিনি ‘রেসপন্স’ গ্রুপে কর্মরত। এর আগে অবশ্য যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। “বঙ্গ জীবনের অঙ্গ”, “বোরোলিন চিরদিন” এর মাধ্যমে ততোদিনে পরিচিতি পেয়েছেন কিছুটা। ১৯৯২ এ প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি ‘হীরের আংটি’। ১৯৯৪ এ ‘উনিশে এপ্রিল’, যা ১৯৯৫ সালের সেরা ছবি এবং সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরষ্কার দুটি অর্জন করে,পরবর্তীতে ৫ম কলাকার পুরষ্কার পায়। ১৯৯৭ এ ‘দহন’, আবারও জাতীয় পুরষ্কার, এবার সেরা চিত্রনাট্য এবং সেরা অভিনেত্রী(যুগ্ম)।১৯৯৯ এ ‘বাড়িওয়ালি’ আবার সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা সহ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরষ্কার এনে দেয়। বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা পরিচালকের পুরষ্কার পায় ছবিটি। সে বছরেই আরও একটি ছবি মুক্তি পায়, ‘অসুখ’(FIPRESCI prize 1999)। সেরা বাংলা ছবির পুরষ্কার পায় ছবিটি। ২০০০ সালে মুক্তি পেলো ‘উৎসব’, এবার পরিচালনার জন্য জাতীয় পুরষ্কার পান ঋতুপর্ণ ঘোষ স্বয়ং। ২০০২ এ মুক্তি পেলো ‘তিতলি’(FIPRESCI prize 2002)। ২০০৩ এ পরপর তিনটি ছবি। ‘শুভ মহরৎ’ দুটি পুরষ্কার পায়, একটি সেরা সহ অভিনেত্রীর, অপরটি সেরা বাংলা ছবির। সেরা বাংলা ছবি হিসেবে ‘চোখের বালি’ও এ বছরেই পুরষ্কৃত হয়। তৃতীয় ছবিটি একটি ওড়িয়া ছবি, ‘কথা দেই থিল্লি মা কি’,এই ছবিতে অভিনয় করেন স্বয়ং ঋতুপর্ণ ঘোষ। ২০০৪ এ সেরা হিন্দী ছবির পুরষ্কার পেলেন, ‘রেইনকোট’ ছবির জন্য। ২০০৫ এ ‘অন্তরমহল’। ২০০৬ এ ‘দোসর’। সেরা অভিনয়ের স্পেশাল জুরী এওয়ার্ড ঝুলিতে আসে। ২০০৭ এ মুক্তি পায় ‘দ্য লাস্ট লীয়ার’, যা সেরা ইংরেজী চলচ্চিত্রের মুকুট ছিনিয়ে নেয়। ২০০৮ এ ‘খেলা’।২০০৯ এ ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’,যা সেরা বাংলা চলচ্চিত্রের তকমা পায়। ২০১০, সেরা বাংলা চলচ্চিত্র, সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেত্রী এবং সেরা সম্পাদক এই চারটি জাতীয় পুরষ্কার পায় ‘আবহমান’ ছবিটি।এছাড়াও  ২০১১ সালে, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’(সেরা অভিনয়ের জন্য ১৯শ কলাকার পুরষ্কার) এবং সঞ্জয় নাগ পরিচালিত ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ ছবিদুটিতে অভিনয় করেন ঋতুপর্ণ।২০১১য় ‘নৌকাডুবি’ মুক্তি পায়, যার হিন্দী ডাবিং হয় ‘কশমাকশ’। ২০১২, ‘চিত্রাঙ্গদা : আ ক্রাউনিং উইশ’ মুক্তি পেলো। নিজের ছবিতে এই প্রথম নিজেই অভিনয় করলেন ঋতুপর্ণ। অভিনয়ের জন্য বিশেষ জুরি পুরষ্কারে ভুষিত হন তিনি। ২০১২তেই রবীন্দ্রনাথের উপর তথ্যচিত্র ‘জীবনস্মৃতি – আ সিলেক্টিভ মেমোরী’র কাজ সমাপ্ত হয়। ২০১৩, তার শেষ ছবি, ‘সত্যান্বেষী’ মুক্তি পায় তার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই। এছাড়াও, ‘বাহান্ন এপিসোড’ নামের একটি টেলি-ধারাবাহিক, ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’ নামক একটি টেলি-ফিল্ম, ‘এবং ঋতুপর্ণ’ এবং ‘ঘোষ & কোম্পানি’ নামক দুটি জনপ্রিয় টিভি-শো তিনি করেছিলেন। ২০১০ এ টেলি-সিরিয়াল ‘গানের ওপারে’র জন্য কিছুদিন চিত্রনাট্য লিখেছিলেন তিনি।

এ তো গেলো ছবির কথা। এর বাইরেও, ২০০৬ সাল থেকে আমৃত্যু প্রতিদিন কাগজের ক্রোড়পত্র ‘রোববার’ সম্পাদনা করেছেন ঋতুপর্ন। ‘আনন্দলোক’ পত্রিকাও কিছুদিনের জন্য সম্পাদনা করেছিলেন তিনি।

এতোসবের সাথে নিরলস নিজের কাজে ব্যপৃত থাকা। কখনও ওড়িশি নৃত্যশিক্ষা, কখনও রবীন্দ্রগবেষণা, কখনও মহাভারতশিক্ষা অধ্যাপক ডঃ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ির কাছে। নিজের ছবির জন্য তো বটেই, অন্য ছবির জন্যও গান রচনা করেছিলেন তিনি।‘বাড়িওয়ালি’, ‘তিতলি’, ‘রেইনকোট’, ‘খেলা’, ‘আবহমান’, ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’, ‘মাছ,মিষ্টি এন্ড মোর…’, ‘সত্যান্বেষী’ প্রভৃতি ছবিতে তিনি বাংলা এবং হিন্দীতে গান রচনা করেছেন।

২০০৬র ২৪শে ডিসেম্বর থেকে ২০১৩র দোসরা জুন, প্রতিটি রবিবার, সংবাদ প্রতিদিনের ক্রোরপত্র ‘রোববার’-র সম্পাদকীয় ছিল ‘ফার্স্ট পার্সন’।কেটি মিত্তিরের  প্রতিদিনের পুকর ঘাট থেকে ঘড়ায় ভর্তি করে জল তুলে আনার প্রাত্যহিকতা, সংসারের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কাজ, খুটিনাটি, নানা তুচ্ছ জিনিসের অনুসঙ্গেও সম্পাদকীয় হয়ে উঠতো স্বাদু, পাঠকচিত্তে অনাবিল পরিতৃপ্তির ভাব জাগাতো তার সাবলীল লেখনী। নিজে যদিও কোনওদিন নিজের লেখকপ্রতিভাকে স্বীকৃতি দিতে চাননি। বলেছেন, “আমি আবার লেখক না কি!” সম্পাদকীয়র পাতায় উঠে আসতো সিনেমা, সাহিত্য, সাম্প্রতিক ঘটনা, রাজনীতি।

জীবনে এতোগুলি কাজের পাশাপাশি, তিনি LGBTQ+ মানুষদের কাছে একজন আইকন ছিলেন। তার “অ-পুরুষোচিত” আচরণ তাকে নানান সময়, নানান বিদ্রূপের মুখে ঠেলে দিয়েছে। টিভির পর্দায়, খবরের কাগজে, রক্ষণশীল বাঙালীর বৈঠকখানায় তাকে নিয়ে, তার পুরুষ থেকে নারী হয়ে ওঠা নিয়ে  কম সমালচনা হয়নি। কুৎসিত ইঙ্গিত করা হয়েছে। কিন্তু, শান্ত এবং অবিচল থেকে তিনি সেই সমালচনাকে উপেক্ষা করেছেন। নিজের কাজে এগিয়ে গিয়েছেন। প্রয়োজনে তীব্রকন্থে প্রতিবাদ করেছেন, যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, দেখিয়ে দিয়েছেন, কেন এ অনুচিত, সমাজের কোন স্তরের কোন মানুষ কিভাবে এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। তথাকথিত শিক্ষিতভদ্রমুখের আড়ালে থাকা হোমোফোবিক মানুষগুলিকে শিক্ষিত হবার পাঠ দিয়েছেন।

৩০শে মে,২০১৩,ঝড়ের মতো খবর ছড়িয়এ গেলো, সব শেষ।য়ার তাকে কোনওদিন ছবি বানাতে, অভিনয় করতে, পাঠ করতে দেখা যাবে না।আর তার নতুন লেখা পড়ার সুযোগ হবে না।দর্শক, পাঠক কতো কিছু পাওয়া থেকে বঞ্চিত হলেন। আসলে, একজন মানুষ যখন চলে যান,তার সাথে তার সবটুকুই চলে যায়, এ জীবনে অর্জিত জ্ঞান,কলা সব চলে যায়। রয়ে যায় শুধুই স্মৃতি। আর, রয়ে যায় সেই মানুষটার সারাজীবনের সব কাজ, আর সেই কাজগুলোকে পুণরাবিষ্কার করার সাধ।কবির বানী দর্শক, পাঠকের মনেও গুঞ্জরিত হয়,

“ফুরায় যা, তা ফুরায় শুধু চোখে,

অন্ধকারের পেরিয়ে দুয়ার, যায় চলে আলোকে”…


তথ্যসূত্রঃ

১. বিভিন্ন অন্তর্জাল

২. এই সময়,রবি বারোয়ারি,ঋতুপর্ণ ঘোষ স্মরণ সংখ্যা,৯ই জুন,২০১৩

৩. প্রথম পুরুষ, রোববার, সংবাদ প্রতিদিন,৯ই জুন, ২০১৩

৪. ফার্স্ট পার্সন – ঋতুপর্ণ ঘোষ

 ৫. রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইন্টারভিউ

ছবিঃ শ্রী অনুভব সেন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *